‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’ —-
ফেসবুক মূলত আমার অবরুদ্ধ চিন্তাভাবনাকে মেলে ধরার একটা মুক্ত পরিসর ছিল আমার নিজেরই কাছে, নিশ্চয় আর সকলের কাছেও তাই। মুখোমুখি চেনাজানা হয়নি যাঁদের সঙ্গে, তাঁদের অন্তরমহলের খবরাখবরের দেওয়া নেওয়া চলত সময়রেখায়। আমি যদি লেখায় স্বচ্ছন্দ হই, কেউ হয়ত গানে, কেউ আঁকায়, কেউ হাস্যরসিকতায়, তো কেউ বা রন্ধনশিল্পে। আরো অন্যতর বিষয়ও ছিল, নানাবিধ সামাজিক কর্মকান্ড, জটিল মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা, ইতিহাসচর্চা, ক্রীড়াসাংবাদিকতা, আরো কতশত মননশীল আলোচনা — সে সব বিষয়ের ব্যাপ্তি দেখলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নত হয়ে আসে।
কিন্তু হালে দেখছি, রয়েছে সবই, কিন্তু সবরকম আলাপচারিতার মধ্যেই কেমন একটা আক্রমণাত্মক সুর বাজছে। সব বিষয়ে সকলেই একমত হবেন না, হওয়াটা স্বাভাবিক নয়, স্বাস্থ্যকরও নয় — এটুকু বুঝতে তো অসীম বৈদগ্ধ্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একমত না হলেই ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে, যা শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে কুরুচিকর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে, আর অধিকাংশ সময়েই মূল বিষয়ের সঙ্গে এই রুচিহীন চাপানউতোরের কোনো সঙ্গতি থাকছে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল্য সম্পর্কে চূড়ান্ত সংশয় জাগছে, যখন দেখছি বিবদমান দুই পক্ষই হয়ত অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত কিংবা স্বনামধন্য গবেষক।
কখনো প্রখ্যাত ব্লগ লেখক চাঁচাছোলা ‘স্মার্ট’ ভাষায় প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের ‘অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট’ না হওয়ার জন্য নির্মম ভাবে তুলোধোনা করছেন, যেন কবি-সাহিত্যিক মানেই সরকারপক্ষের বিরুদ্ধে গিয়ে বৈপ্লবিক কাজকর্ম না করলে ‘কালজয়ী’ হওয়া যাবে না কোনোমতেই। বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের বর্তমান লেখার মান অতলে তলিয়ে গিয়েছে বলে তাঁকে আধুনিক প্রাকৃত ভাষায় bullying করা হচ্ছে — কারণ সেটাই সাহিত্যপ্রেমের পরাকাষ্ঠা।
প্রথাগত শিক্ষায় একটু পিছনের সারির মানুষ তাই বিনোদন জগতের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের নতুন-পুরোনো দাম্পত্যজীবনকে হাটের মাঝে এনে ফেলে ধোপার পাটে আছড়াচ্ছে, তাতে অপার আনন্দলাভ করছে এবং ‘এর থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখচে?’ জাতীয় হাহাকারবাক্য আউড়ে সমাজসংস্কারকের মহান ভূমিকা পালন করতে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছে।
কি ভাবছেন? এই সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীর খুঁত বার করে, কষে নিন্দেমন্দ করে আমিও প্রগাঢ় আত্মপ্রসাদ লাভ করছি? দেখেছ, আমি কেমন শাড়ির কুঁচিটি তুলে ভার্চুয়াল ভ্যাটের ময়লা বাঁচিয়ে চলি, আমি কেমন স্বতন্ত্র?— এমনটাই ভাবছি?
না, ঠিক সেটা ভাবছি না। আমি ভাবছি, মানুষ সবসময়ে এত ফোঁস করে উঠছে কেন? ‘আমার দেওয়াল, আমি যা খুশি তাই লিখব, না পোষালে কেটে পড়ো’ — এই জাতীয় কথা কোন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে আসছে?
কিংবা এর বিপরীতে, ‘পাবলিক পোস্ট করেছেন, যে যা খুশি কমেন্ট করবে, মেনে নিতে হবে, সবাইকে আপনার হ্যাঁ-য়ে হ্যাঁ মেলাতে হবে, আপনি কোথাকার কে হনু?’ — এই রকম ঔদ্ধত্যই বা কোন হতাশাপ্রসূত?
কেউ একাধিক বিষাদপূর্ণ পোস্ট করলে তার দুঃখবিলাসী তকমা জুটছে, তো কারো টাইমলাইনে রঙিন ছবির ছড়াছড়ি দেখলে অসূয়াসূচক তির্যক মন্তব্য চোখে পড়ছে —-
বই অথবা বেড়ানোর তথাকথিত নির্দোষ গ্রুপে যে সমস্ত পোস্ট দেখতে পাচ্ছি আর তার উত্তরে যা সব মন্তব্য করা হচ্ছে, তা পুস্তকগুচ্ছ এবং ভ্রমণসমূহের কল্পনারও বাইরে। সেইসব গ্রুপের ‘অ্যাডমিন’ নামক পরিচালকবর্গের গ্রুপসংক্রান্ত নিয়মকানুনের ব্যাখ্যাকে প্রায় হুমকির মতো শোনাচ্ছে, মনে হচ্ছে এইরকম ‘রেজিমেন্টেড’ বিনোদন থেকে পালিয়ে পৈতৃক প্রাণটা বাঁচাই।
কিন্তু সব্বাই, সকলে, এমন নির্বিচারে এত জাজমেন্টাল হয়ে উঠলাম কি করে বলুন তো?
দ্বিমত দেখলেই তুলে আছাড় মারার সদিচ্ছা কেন? অন্যের জুতোয় পা না গলিয়ে, তার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবহিত না হয়ে তাকে সমালোচনা করার স্পর্ধা কেন?
বয়োজ্যেষ্ঠ যশস্বীদের বর্তমান অবস্থান (রাজনৈতিক/সামাজিক) অপছন্দ হলেই ন্যূনতম সৌজন্যের ধার না ধেরে তাঁদের প্রতি এত অশ্রদ্ধা প্রকাশ কেন?
বহমান রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে সমাজে, যুগে যুগে তাই ঘটে এসেছে, সেটা জানি। ফেসবুক সেই বৃহত্তর সমাজের বনসাই সংস্করণ, সেটাও আংশিকভাবে মানি। আংশিক বলছি, কারণ বহু ফেসবুকি বিপ্লব মুঠোফোনের স্ক্রিনে জন্মে, সেখানেই দেহরক্ষা করেছে, পারিপার্শ্বিক সমাজে তার বিন্দুসমান প্রতিক্রিয়াও হয়নি, এও দেখেছি।
কিন্তু শুধুই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন এই অসৌজন্যের আবহ তৈরি করছে এটা মানতে পারছি না।
আমরা বড় স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি সবাই। কি জানি, সুস্থভাবে বাঁচার দিন ফুরিয়ে আসছে বোধহয়, সকলেই টের পাচ্ছি, তাই এত অনিশ্চয়তা জমছে মনে। তাই বাড়ছে অন্ধকার — সহমর্মিতা, সহানুভূতি এগুলো সব লুপ্তপ্রায় লব্জ হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই জীবনদৌড়ে ছুটতে ছুটতে আমরা হারিয়ে দিচ্ছি নিজেকেই, হারিয়ে ফেলছি মানবিক বোধ, নিজস্বতা। অন্যকে ছোট না করে, নিজেকে বড় করা যায় না, এই অন্যায় ভাবনা চারিয়ে যাচ্ছে মনে। অপরকে ঝাঁঝালো অপমান করে দিন শুরু না করলে জীবন পানসে মনে হচ্ছে। প্রতি পদে তুলনা করে চলেছি, রাম শ্যাম যদু মধু ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তো বটেই, নিজের সঙ্গেও নিজের। ছুটন্ত জীবন শেখাচ্ছে, সন্তুষ্টি উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করে, অতএব সন্তুষ্ট হয়ো না। মনে বয়ে নিয়ে চলো নিরন্তর অসন্তোষের ক্ষুধা। আবেগী হয়ো না, উদাত্ত আবেগ নির্বুদ্ধিতার স্বাক্ষর, সাফল্যের পায়ে তা বেড়ি পরিয়ে রাখে।
এসব কথা লেখা আমার উচিৎ নয়, কারণ ফেসবুক-নাগরিক আমাকে বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুপারি দেয়নি, সে ধকও আমার নেই।
তবে কেন অযাচিত জ্ঞান বিতরণ? সদ্যসমাপ্ত ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের পরাজয়ে পড়শি দেশের সাধারণ মানুষের আচরণ অনেককে অবাক করেছে। কেবল একটা খেলায় হারজিৎ ঘিরে এত দ্বেষ, এত ঘৃণা?
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বলিউডি ফিল্মে বল্গাহীন হিংসার প্রকাশও বহু মানুষের বিবমিষার কারণ হয়েছে। Mindless violence এর প্রতি এত আকর্ষণ?
বলুন তো, সত্যিই কি অবাক হওয়ার মতো তেমন কিছু আছে আর? কোথায় চলেছি আমরা?
বিঃদ্রঃ পোস্ট অসহ্য মনে হলে এড়িয়ে যাবেন না, যথেচ্ছ গালাগাল দিয়ে যাবেন। আমি ক্ষুধার্ত।