কয়েক বছর আগে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত এক টিভি সিরিজে আমরা দেখেছিলাম, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধরত কয়েকটি গোত্রের অজ্ঞাতেই উত্তরের তুষারাবৃত জনহীন প্রান্তরে ক্রমশ বেড়ে উঠছিল মৃতদের এক বিশাল সৈন্য। তাদের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, প্রত্যেক যুদ্ধে পরাহত, নিহতদের দলভুক্ত করে তারা আরো বলবান হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের মাঝেও এরকম এক বিশাল সৈন্যবাহিনী বেড়ে উঠছে, প্রতিনিয়ত অপরাজেয় হয়ে উঠছে- আমরা জেনেও হয়তো জানতে চাইছি না। সেই বাহিনী আণুবীক্ষণিক জীবেদের বাহিনী- মানবসভ্যতার বহু আগে থেকেই তারা এই পৃথিবীতে বিরাজমান, অভিব্যক্তির ধারা বেয়ে এখনো প্রাসঙ্গিক এবং রক্তবীজের মতোই অবধ্য।
সত্যি বলতে এদের সকলের সঙ্গে মানবসমাজের যুদ্ধ নেই, বরং মানবদেহে ‘মানব’কোষের থেকে বহুগুণ বেশি এই জীবাণুদের অস্তিত্ব। শুধু তাই নয়, মানবদেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় এদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তাদেরই মধ্যে কিছু জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে থাকে এবং সেই জীবাণুদের সঙ্গে মানবসভ্যতার যে অবিরাম যুদ্ধ, তা কোনো বিশ্বযুদ্ধের থেকে কম নয়, যদিও তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সদিচ্ছা আমাদের বিশেষ নেই।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন যেকোনো রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর সংক্রমণই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতো। ১৯২৮ সালে এক আকস্মিক আবিষ্কার আমাদের হাতে প্রথম অস্ত্র তুলে দেয়- পেনিসিলিন। পেনিসিলিন না থাকলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জীবনহানির সংখ্যা কোথায় দাঁড়াতো, ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু পেনিসিলিন ব্যবহারে মুন্সিয়ানার অভাবে তা কালক্রমে কার্যকারিতা হারাবে- এই ভবিষ্যৎবাণী স্বয়ং আবিষ্কর্তা আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-ই করে গেছিলেন। এককালে মহার্ঘ্য এসব অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ রোগীর মূত্র থেকে সংগ্রহ করে রাখতে হতো ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য, এখন পাড়ার ওষুধের দোকানে চাইলেই পাওয়া যায়। এর সমান্তরালেই আমরা দেখতে পাই, আজকালকার সাধারণ কোনো সংক্রমণই পেনিসিলিন দিয়ে সারানো যায় না।
এর কারণ সন্ধান করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যে কোনো জীবেরই বৈশিষ্ট্য। এই জীবাণুরাও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব কাটিয়ে অভিযোজিত হচ্ছে এবং ডারউইনের তত্ত্ব মেনে এই অভিযোজিত জীবাণুরাই সংখ্যায় বাড়ছে। কালেদিনে যে জীবাণুরা ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ মেনে প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হবে, তাদের কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই প্রতিহত করা যাবে না- তারা হবে ‘সুপারবাগ’।
পেনিসিলিনের পথ ধরে বহু অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতাই আজ কমে এসেছে। বহুমূল্য কার্বাপেনেম গোত্রীয় অ্যান্টিবায়োটিক, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন জীবাণু প্রথম পাওয়া যায় ২০০১ সালে আমেরিকায়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ২০১৩-র মধ্যেই আমেরিকার সর্বত্র এধরণের প্রতিরোধী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বায়নের যুগে এই জীবাণুরাও সহজেই দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দিচ্ছে। আগে মূলত ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটেই এই ধরণের জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যেত। কিন্তু চিন্তার বিষয় এখন মাঝেমধ্যে সাধারণ কমিউনিটির মধ্যেও এরকম সুপারবাগের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যারা সমস্ত পরিচিত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।
১৯৮০-র দশক অব্দি এই নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ বিশেষ ছিল না। কারণ প্রতি বছর নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের জন্য বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি অর্থবিনিয়োগ করতো। নতুন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক প্রায়শই বাজারজাতকরণ হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই ধারায় ইতি পড়েছে, যার মুখ্য কারণ হয়তো বিনিয়োগের অভাব। অ্যান্টিবায়োটিক সুগার-প্রেসার বা মানসিক রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ওষুধ নয়, তার প্রয়োগক্ষেত্রও সীমিত, সর্বোপরি আজকের আবিষ্কৃত ওষুধ পাঁচ-দশ বছর পর কার্যকারিতা বজায় রাখবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে আজকের দিনে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারে বিনিয়োগ একদমই লাভজনক ব্যবসা নয়- তাই বড় বিনিয়োগকারীও কেউ নেই। কিছু কিছু কোম্পানি এই গবেষনাকার্যে বিনিয়োগ করে দেউলিয়া হয়েছে, সেই নজিরও বর্তমান।
বলা বাহুল্য পথের শেষে আলোর দিশা এই মুহূর্তে নেই। আমাদের সামনে হয়তো এমন দিন আসতে চলেছে যে সামান্য একটা ক্ষত প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। প্রভাবশালী অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া চিকিৎসাক্ষেত্রের অনেক কিছুই হয়তো প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। শল্যচিকিৎসা, কেমোথেরাপি ইত্যাদি জীবনদায়ী প্রক্রিয়াগুলো আজকের মত সহজ হবেনা। সহজ ভাবে বলতে গেলে আমরা পুনরায় ১৯২৮-র পূর্ববর্তী পর্যায়েই ফিরে যাবো।
আজ এই সংকটের অধ্যায় মানবসভ্যতার ইতিহাসে এলো কেন? এর উত্তরে একটা প্রবাদ মনে পড়ে- “যে জন দিবসে মনের হরষে/ জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/ নিশীথে প্রদীপ ভাতি”। অ্যান্টিবায়োটিক বস্তুটাকে তার যোগ্য মর্যাদা আমরা দিই নি। খামারে পশুদের বৃদ্ধির জন্য নির্বিচারে ব্যবহৃত হয় এই অমূল্য সম্পদ। তদুপরি মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অদ্ভুত চাহিদা এবং সেই চাহিদা পরিপূর্ণ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে এই মহার্ঘ্য ওষুধ over the counter উপলব্ধ হয়ে যাচ্ছে, ওষুধের দোকানদারের কাছে চাইলেই মিলছে, প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজনও হচ্ছে না। কোভিডের মতো ভাইরাল জ্বরে “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো” নীতিতে প্রদত্ত অ্যান্টিবায়োটিক আদপে কোনো কাজ না করলেও, বেশ কিছু ভালো জীবাণু ধ্বংস করে- ভবিষ্যতে অন্য সংক্রমণের প্রবণতা বাড়ায়। এই কুপ্রভাব শুধু ব্যক্তিস্তরে নয়, সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্রের সকল স্তরেই পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ক্ষেত্রেও অপ্রাসঙ্গিক অ্যান্টিবায়োটিক, অপর্যাপ্ত পরিমাণ বা সময়কাল- এসব কিছুই আমাদের এই সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
আমাদের বোঝা দরকার, জীবাণুদের সঙ্গে এই ফার্মাকোলজিক যুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। যতই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসুক, কালক্রমে এরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেই। তাই যুদ্ধনীতির পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। ভ্যাক্সিন গ্রহণে মানুষকে সচেতন করা জরুরি- সংক্রমণ কমলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন এমনি কমবে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভ্যাক্সিন সম্পর্কে আমাদের জনগণ একেবারেই সচেতন নন, ভাগ্যক্রমে শিশুদের টিকাকরণ বহু চেষ্টায় সাফল্যের মুখ দেখেছে। এই ক্ষেত্রে জনশিক্ষার প্রসার এবং অর্থ বিনিয়োগ উভয়ই প্রয়োজন।
কোভিডের দয়ায় যে অভ্যাসগুলো আমরা করেছি, সেগুলো টিঁকিয়ে রাখা প্রয়োজন- মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সঠিকভাবে হাঁচি-কাশি দেওয়া- এই শিক্ষাগুলো বজায় থাকলে শ্বসনতন্ত্রের বা পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ কমানো অনেক সহজ হয়ে যায়।
এবং পরিশেষে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রীতি থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। অ্যান্টিবায়োটিক সব প্রশ্নের জবাব নয়।
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার আগে বা খাওয়ানোর আগে প্রশ্ন করা অভ্যাস করুন- আদৌ কি এটা প্রয়োজন? এটাই কি সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক? সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়কাল ধরে খাওয়া হচ্ছে তো? এই প্রশ্নগুলো এখন থেকে না করলে ভবিষ্যতে আর হয়তো করার প্রয়োজন বা সুযোগ কোনোটাই থাকবে না।