১৮৫৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। লন্ডন শহরের এক সন্ধ্যা। সেন্ট জেমস প্যারিস এর বোর্ড অফ গার্ডিয়ানদের এক সভা চলছে। সভার আলোচ্য বিষয় পুর পরিষেবা, আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে চারদিকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ কলেরা মহামারী নিয়ন্ত্রণে কি করা যায়। সেই সভায় রবাহুত এক চিকিৎসক মৃদু সুরে একটি আবেদন জানায়। কলেরা নিয়ে তাকে বলতে কিছুটা সময় দেয়া হোক। এই চিকিৎসক কে, কেন ই বা তিনি কলেরা নিয়ে প্রশাসকদের মিটিং এ বলতে চান সে সব জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হয় বেশ কয়েকটা বছর।
১৮১৩ সালে ইয়র্কের এক কয়লা খনি শ্রমিকের ঘরে জন্ম নেন জন স্নো। ছোট বেলা থেকেই তার অনুসন্ধিৎসা দেখে তাকে ডাক্তার বানানোর জন্য তার বাবা মা বহুকষ্টে টাকা পয়সা জমিয়ে ১৪ বছর বয়েসে এক ডাক্তারের কাছে শিক্ষানবিশি করার জন্য পাঠান। সেই সময়ে স্নোর কপালে নিউ ক্যাসলের কলেরা রুগী দেখার সুযোগ ঘটে।
কলেরা কেন হয় সে নিয়ে দুটি হাইপোথিসিস চালু ছিল সে সময়ে। তার একটি ছিল মিয়াসমা বা “খারাপ বাতাস” থিওরি। আরেকটি জার্ম থিওরি। নিজের লিখে রাখা কেস হিস্ট্রি ঘেঁটে স্নো দেখেছিলেন যে আক্রান্ত শ্রমিকদের বাড়িগুলো গোরস্থান, নর্দমা কিংবা নোংরা ডোবা থেকে অনেক দূরে, অর্থাৎ যে জায়গাগুলো থেকে মিয়াসমা তৈরি হয় বলে লোকের বিশ্বাস সেসব জায়গা থেকে অনেক দূরে।
এর পরে স্নো লন্ডনে ডাক্তারি পড়তে আসেন ও ডিগ্রি লাভ করেন। নিজের প্র্যাকটিসে উনি এনস্থেটিস্ট হিসেবে খুবই খ্যাতি লাভ করেন এমনকি রানী ভিক্টোরিয়ার ওপর দুবার নিজের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পান। এর পাশাপাশি এপিডেমিওলজি বা মহামারী বিজ্ঞান নিয়ে স্নোর উৎসাহ কিন্তু কমেনি। ১৮৪৮ সালে লন্ডনের কলেরা মহামারীর সময় নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্নো বুঝতে পারেন যে মিয়াজমা নয়, সম্ভবত জল থেকেই কলেরা ছড়াচ্ছে। ১৮৫০ সালে স্নো ও কয়েকজন গবেষক চিকিৎসক মিলে তৈরি করেন এপিডেমিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন। রোগ কেন হয়, কি ভাবে ছড়ায় কিভাবে সেটা প্রতিরোধ করা যায় এসব নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে গবেষণা করার জন্য এই সোসাইটি।
এর পরেই আসে লন্ডনের কুখ্যাত ১৮৫৪ সালের কলেরা মহামারী। বহু পরিশ্রমে তথ্য সংগ্রহ করে স্নো দেখেছিলেন যে বাড়িতে জল সরবরাহকে ঘিরে বাড়িগুলোকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায় মূলত। কিছু বাড়িতে পানীয় জল দেয় সাউথওয়ার্ক অ্যান্ড ভক্সহল (এসঅ্যান্ডভি) ওয়াটার কোম্পানি, আর কিছু বাড়িতে ল্যাম্বেথ বলে কোম্পানি। উনি আরো দেখলেন যে ল্যাম্বেথের তুলনায় এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির জলে নুন প্রায় চারগুণ গুণ বেশি আছে আর ল্যাম্বেথের তুলনায় এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির জল খায় এমন বাড়িতে মৃত্যু প্রায় ছয় গুণ। এর কারণ ছিল দুটি কোম্পানির জল সংগ্রহের জায়গা। দুটি কোম্পানিই টেমস নদী থেকে জল নিলেও ল্যাম্বেথ কোম্পানি যেখান থেকে জল নিত সেখানে যেখানে বর্জ্যের পরিমাণ কম ছিল, জল কম দূষিত ছিল এসঅ্যান্ডভি কোম্পানির জল সংগ্রহের জায়গা থেকে। এই তথ্য বিশ্লেষণের পরে জল থেকে কলেরা ছড়ায় এই বিশ্বাস জন স্নোর মনে আরো পোক্ত হয়। এই দুইভাগে বিভক্ত করে তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেই স্নো নিজের অজান্তে মহামারী বিজ্ঞানের সুপরিচিত কেস কন্ট্রোল স্টাডি বা গবেষণা পদ্ধতির জন্ম দেন।
এসব করতে করতেই মহামারীর আরেকটা ঢেউ আছড়ে পরে লন্ডন শহরে। সোহো অঞ্চলের ব্রড স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে কলেরায় মৃত রোগীদের সংখ্যা অনুযায়ী ফুটকি দিয়ে স্নো একটি বিশেষ ধরনের মানচিত্র তৈরি করেন যা ভবিষ্যতে মহামারী বিজ্ঞানে স্পট ম্যাপ নামে পরিচিত হবে। স্নো দেখেন যে ব্রড স্ট্রিটের একটি জলের পাম্পের কাছাকাছি মৃতের সংখ্যা বেশি, যতদূরে যাওয়া যাবে মৃতের সংখ্যা তত কম। ব্রড স্ট্রিটের ওই জলের কল থেকেই কলেরা ছড়াচ্ছে এ নিয়ে স্নোর মনে আর কোনো সন্দেহ ছিল না।
শুধু তিনটে খটকা ছিল। এক মহিলা ও তার ভাইঝি যাঁদের বাড়ি ব্রড স্ট্রিট থেকে অনেক দূরে তাঁরাও কলেরায় মারা যান। স্নো খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে ওই মহিলা আগে ওই পাম্পের কাছেই বসবাস করতো এবং মা ওই পাম্পের জল খুব সুস্বাদু বলে পছন্দ করতো, এতটাই করতো যে দূরে চলে যাওয়ার পরেও লোক পাঠিয়ে ওই পাম্পের জল নিয়ে যেত আর খাবার খাওয়ার সময় এক গেলাস করে পান করতো।
খটকা নম্বর দুই, পাম্পের কাছাকাছি পোর্টল্যান্ড স্ট্রিটের মোড়ে একটি কারখানায় গাদাগাদি করে প্রায় পাঁচশ শ্রমিক থাকতেন তাঁদের কেউ কলেরায় মারা যান নি। স্নো খোঁজ নিয়ে দেখলেন যে কারখানার ভেতরে গ্র্যান্ড জাংশন ওয়াটার ওয়ার্কস কোম্পানির নিজস্ব পাম্প আছে আর শ্রমিকরা সেই জলই খাচ্ছেন।
তিন নম্বর খটকাটি আরো মজার। আরেকটি কারখানার শ্রমিকদেরও কলেরা হয় নি যদিও তাঁদের নিজস্ব কোনো পাম্প ছিল না। অনুসন্ধানে এটা জানা গেছিল যে কারখানাটি বিয়ার তৈরির কারখানা। ওখানকার শ্রমিকরা মূলত ওই বিয়ারই খায়, জল টল বিশেষ খায় না।
এই সব তথ্য প্রমাণ হাতে নিয়েই সেদিন ওই মিটিং এ উপস্থিত হয়েছিলেন স্নো। তাঁর যুক্তি তথ্য তর্ক শোনার পরেও প্রশাসকরা প্রথম চোটে একমত হন নি। কিন্তু স্নো ধীরে ধীরে সবাইকে মতে নিয়ে আসেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী পরের দিন সকালে ব্রড স্ট্রিটের সেই পাম্পের কাছে হাজির সবাই। কল মিস্ত্রি খুলে ফেললো সেই পাম্পের হাতল যাতে ওই দূষিত পাম্প থেকে আর কেউ জল নিতে না পারে।
এর পরের গল্পটা প্রায় ম্যাজিক। হ্যাঁ, ম্যাজিকের মতই দিনকে দিন কমতে থাকে কলেরায় মৃত মানুষের সংখ্যা। এর পরেও অবশ্য স্নোকে তাঁর মতবাদ অর্থাৎ জল দিয়ে কলেরা ছড়ায় ও পরিশোধিত জল পান করা উচিত এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনেক লড়াই লড়তে হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে হ্যান্ডেল না খুললেও কলেরা কমে যেত ইত্যাদি ইত্যাদি। সে আরেক গল্প।
জন স্নো মারা গেছেন বহুদিন হল। কিন্তু তাঁর নাম আজও অমর হয়ে আছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাতায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা নতুন শাখার জন্ম দিয়েছিলেন বলে, যার নাম মহামারী বিজ্ঞান। ফাদার অফ এপিডেমিওলজি। জনক দিবসে একটু অন্য রকম একজন জনকের গল্প শোনালাম, কয়লাখনি শ্রমিকের ঘরে জন্ম নেয়া এক কৌতুহলী অনুসন্ধিৎসু বালকের বাবা হয়ে ওঠার কাহিনী। হ্যাপি ফাদার্স ডে।