ছোটবেলায় খুব দাঁতের সমস্যায় ভুগতাম। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসতাম তো। বাবা অফিস থেকে ফিরলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম বাবার ওপর। এ পকেট সে পকেট ঘেঁটে ঠিক খুঁজে নিতাম আমার জন্য আনা নীল র্যাপারে মোড়া ক্যাডবেরি। সব বাচ্চাই জানে চকোলেটের থেকে সুস্বাদু খাদ্য পৃথিবীতে আর দুটো নেই। ফলে হরেক কিসিমের দাঁতের ব্যামোর ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল আমার মুখের ভেতরটা। আর দুঃখের বিষয় দাঁতের ডাক্তারের সাথে আমার প্রথম এনকাউন্টারটা মোটেই ভালো হয়নি।
তাঁরও কোনো দোষ দেখি না। আমারও কোনো দোষ ছিলনা। বেমক্কা একটা লোক কথা নেই বার্তা নেই সাঁড়াশি নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ চালাবে সেটাই বা আমি মেনে নেবো কিভাবে? তাই দাঁতে দাঁত চেপে একটা শেষ লড়াই চালিয়ে ছিলাম। ডাক্তারবাবু দাঁত তুলেছিলেন ঠিক কথা, কিন্তু খারাপ দাঁতের পাশের দাঁতটা। তুমুল রক্তপাতের পরেও জমি ছাড়িনি, কিছুতেই আর জায়গাটায় সেলাই করতে দিইনি। আমার এই জয়ে আমার ব্যতিব্যস্ত বাবা চটজলদি চেম্বারের পাশের এক দোকান থেকে এক খেলনা রেলগাড়ি কিনে এনেছিল। জয়ের ট্রফি পেয়ে হাঁ করেছিলাম একটাই শর্তে – মুখের ভেতর শুধু ওষুধ দিতে পারো, কিন্তু সেলাই নৈব নৈব চ।
তারপর থেকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে মোটেই যেতে চাইতাম না। দাঁতের যন্ত্রণা হলে কাঁদতাম। খুব স্নেহশীল এক ডাক্তারজেঠু ছিলো আমার। বাবা তাঁর কাছ থেকে ওষুধ এনে দিতো। দাঁতের ক্যাভিটি আর আমার এক অশান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছোটবেলাটা কেটেছে। সেজোমামা ছিলো দাঁতের ডাক্তার। মামাবাড়ি গেলে ছোটখাটো মেরামতির কাজ চলতো। কিন্তু মামার “তোর শুধু বিষদাঁতটা উপড়ে নেবো” আশ্বাসেও সাঁড়াশি যন্ত্র মুখে ঢোকাতে দিইনি।
আর সবাই জানে যন্ত্রণা বাড়ে রাতে। ওষুধে যখন যন্ত্রণা কমতো না, তখন বাবা সেই গভীর রাতে আমাকে কাঁধে নিয়ে ছাদে ঘুরতো। আকাশ ভর্তি তারার মাঝখানে শুকতারা, সাঁঝতারা চেনাতো, কালপুরুষ চেনাতো, লুব্ধক চেনাতো। ভোররাতের দিকে আকাশগঙ্গা চিনলাম। আর জানলাম আমার সমস্ত কষ্ট নেবার জন্য একটা কাঁধ আছে, বেশ চওড়া একটা কাঁধ।
মায়ের মৃত্যু যেনো আরও বাবার মূল্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো। দেশের বাড়ি থেকে আমার কর্মস্থলে নিয়ে এলাম বাবাকে। বাবার বেশকিছু বাহানা তৈরি হলো – ইলেকট্রিকের মিটার দেখতে এসে লোক ফিরে যাবে, বাড়িতে দুজন কাজের লোকের মাইনে দিতে হবে, মঠের কিছু কাজ আছে। বাবা দেশের বাড়ির এক গৌড়ীয় মঠের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ঠিক হলো মাঝেমধ্যে দেশের বাড়ি যাবে। এরমধ্যে একজন বাবাকে ফোন করে জানালো বাগানে নাকি মরা বেড়াল পড়ে আছে। বাবা একেবারে অস্থির। লকডাউনে পুলিশি উৎপাতের ভয় দেখিয়েও বাবাকে আটকানো গেলোনা।
করোনা মহামারী, লকডাউন, পিপিই কিট, জনতা কারফিউ, সোশ্যালডিস্ট্যান্সিং, পরিযায়ী শ্রমিক ইত্যাদি শব্দগুলো আমাদের অভিধানে গত কয়েক মাস ধরে জায়গা করে নিচ্ছে। বয়স্কদের জন্য করোনা যে কতোটা মারাত্মক সেটাও বাবা বুঝেছিল। বুকে পেসমেকার বসানো – অধুনা বহুল প্রচারিত কোমরবিডিটি অঙ্কটার হিসাব বোঝার মতো শিক্ষা বাবার ছিল। ফলে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে দেশের বাড়ি গিয়েছিল বাবা।
লোক লাগানো হয়েছিল বাগানে। তাদের তদারকি করতে এবং তাদের সাথে হাতে-হাত লাগাতে নিজেও নেমে পড়েছিল সেখানে। পিছলে পড়ে হাতে লাগে। হিউমারাসের হেডে ক্র্যাক ধরা পড়ে। দুদিন বাদে জ্বর, নড়তেচড়তে কষ্ট। ব্যথার ওষুধ চললো – একটু উপশম হলো। কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় কাশি। অ্যান্টিবায়োটিক, গরম জলে গার্গল, ভিটামিন। জ্বর, কাশি গেলো – কিন্তু ভয়ংকর দুর্বলতা। কৃষ্ণনগরে ফিরে যাওয়াই ভালো। নাতিনাতনির সাথে ক্যারামবোর্ডে বসলে শরীরমন চাঙা হয়ে যাবে। বিচক্ষণ পিতামহের মতো একটা প্রয়োজনীয় কথা বললো বাবা – “পড়ে যাওয়ার পর অনেকে মিলে তুলেছিল। আর এক্সরে করতে গিয়েও তো কারোর সংস্পর্শে করোনা হতে পারে। জ্বর আর কাশির অঙ্কটা মিলছে না। ওখানে যাওয়ার আগে কোভিড টেস্টটা করিয়ে নিই।”
বাবার কষা অঙ্কটাই মিললো। পজিটিভ আসার খবর পেতে আমার সিএমও স্যার ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের সহায়তায় বাবাকে এখানকার কোভিড হাসপাতালে নিয়ে এলাম।
দুর্বলতা, দুর্বলতা আর দুর্বলতা। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ঠিক আছে। জ্বর নেই, কাশি নেই। কিছু খেতেও চাইছেনা। দুদিন পর,রবিবার। পিপিই কিট পরে ঢুকে বাবাকে জোর করে বাড়ি থেকে তৈরি করা মাছেরঝোল আর ভাত খাওয়ালাম। তিন-চার চামচ। কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ে নিজের মুখে অক্সিজেনের মাস্ক টেনে নেয় বাবা।
সন্ধ্যাবেলায় ফোন -“দাদা, মেসোমশাইয়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত ফল করছে। তুমি একটু এসো।”
আটমাস নদিন, দ্বিতীয়বার আমার স্রষ্টার মৃত্যু দেখলাম। আকাশটা বড়ো নগ্ন হয়ে গেলো আমার কাছে। আজন্ম সস্নেহে আগলে রাখা ছায়া সরে গেলো মাথার ওপর থেকে।
গভীররাতে আকাশের দিকে তাকাই। কালপুরুষ, লুব্ধকের ভিড়ে বাবাকে খুঁজি। ছোটবেলার বিশ্বাস উপড়ে তুলে এনে ভাবি – ওখান থেকে বাবা আমায় দেখছে, মিটমিট একটা আলো জ্বালিয়ে।
————————- সমাপ্ত —————————–
শ্রদ্ধা জানাই। সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই। আপনারা সকলে সুস্থ থাকুন। ?
ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি । আপনাদের জন্য রইলো গভীর সমবেদনা । ভগবান আপনাদের এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিক । সুস্থ থাকুন,ভালো থাকুন ।
কিছু বলার ভাষা নেই, চোখে জল চলে আসলো। কালের অমোঘ নিয়ম কে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের সত্যিই কিছু করার নেই।
ভালো থাকবেন ডাক্তার বাবু।
ওনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি, আপনারা সাবধানে থাকুন, এর বেশি আর কি বা বলি !! এ অভাব কোনোদিন ই পুরন হবার নয়, স্মৃতি বয়ে বেড়ানো সারাজীবন।
আপনারা সকলে ভালো থাকুন।
So sad, excellent bengali language this is a mind blowing article
কিছু বলার কোন ভাষা জানানেই। মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেলে মানুষ ভীষণ ভাবে অসহায় হয়ে যায়। এই দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। ভগবানের কাছে পার্থনা ওনার আত্মর শান্তি দেন।
অসাধারণ sir । মন ভরে গেল