বাচ্চার জ্বর হ’লে বাবা-মা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় থাকেন। তার ওপর যদি কয়েক মিনিটের জন্য বাচ্চার চোখ উল্টে, হাত-পা শক্ত হয়ে যায়? বারবার হাত-পায়ে ঝাঁকুনি হয়? মুখ দিয়ে লালা গড়াতে শুরু করে? অজান্তেই মলমূত্র বেরিয়ে যায়?
এরকম একটা অবস্থা অভিভাবকদের জন্য নিঃসন্দেহে ভীতিপ্রদ। জ্বরের সাথে এ ধরনের খিঁচুনিকে আমরা জ্বর-তড়কা বলে জানি। বিজ্ঞানসম্মত ধারণার অভাবে জ্বর-তড়কায় অসংখ্য অযৌক্তিক চিকিৎসা করা হয়। হরেক রকমের কুসংস্কারও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জঙ্গলমহলে চিকিৎসক থাকাকালীন একে মুরগীঝাঁকি বলে চিনতাম। কোনও এক অপয়া শক্তি নাক দিয়ে ঢুকে নাকি সব বিপত্তি ঘটায়। সমাজের তথাকথিত মূলস্রোতে বসবাসকারীদের মধ্যেও ভুল ধারণার বহর নেহাত কম নয়।
আগেই বলে নিই, সমস্যাটা দেখে যতটা ভয় লাগে আসলে সেটা ততখানি খারাপ নয়। জ্বর তড়কা আর মৃগী (যে রোগে সাধারণত জ্বর ছাড়াই খিঁচুনি হয়) সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। প্রধানত ৬-৬০ মাস বয়সী বাচ্চারা জ্বর-তড়কার সমস্যায় ভোগে। ২-৫ শতাংশ সুস্থ বাচ্চারও জ্বর-তড়কা হ’তে পারে। অনেক সময় কিছু জিনঘটিত কারণে একই পরিবারে অনেকের জ্বর-তড়কা দেখা যায়। যে কারণে অনেক সময় জ্বর-তড়কা হয়েছে এমন বাচ্চার বাবা-মায়েরও ছোটোবেলায় জ্বর-তড়কার ইতিহাস পাওয়া যায়।
সব জ্বর-তড়কাই কি একইরকম?
বোঝার সুবিধের জন্য জ্বর-তড়কাকে ‘সাধারণ’ এবং ‘জটিল’ এই দু’ভাগে ভাগ করবো। ‘সাধারণ জ্বর-তড়কা’ ২৪ ঘন্টায় একবারই হয়। পুরো শরীরে একসাথে ঝাঁকুনি হয় এবং ১৫ মিনিটের কম সময় স্থায়ী হয়। অপরদিকে ‘জটিল জ্বর-তড়কা’ ২৪ ঘন্টার মধ্যে বারবার হ’তে থাকে, ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে হয়, পুরো শরীরে না হয়ে শরীরের বিশেষ কিছু অংশে ঝাঁকুনি হয়। অধিকাংশ জ্বর-তড়কা ‘সাধারণ’ গোত্রীয় এবং এতে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে স্নায়ুর ক্ষতি বা মৃগীরোগের সম্ভাবনা নেই।
কাদের বারবার জ্বর-তড়কা হয়?
এক বছরের কম বয়সী শিশুদের বারবার জ্বর-তড়কার সম্ভাবনা থাকে। জ্বরের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তড়কা হ’লে এবং অল্প মাত্রার জ্বরেই (১০০.৪-১০২.২ ফা) খিঁচুনি শুরু হ’লে ভবিষ্যতে বারবার জ্বর-তড়কা হওয়ার প্রবণতা থাকে।
কোন কোন খারাপ রোগ থেকে জ্বর-তড়কাকে আলাদা করা জরুরি?
একই ধরনের লক্ষণের খারাপ রোগ মেনিনজাইটিস বা মস্তিষ্কের অন্যান্য ইনফেকশন। ছ’মাসের কম বয়সের শিশু বা টিকা পায়নি এমন শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। অনেক সময় রক্তের সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদির গন্ডগোল কিংবা রক্তশর্করার মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি হ’তে পারে।
মাথার রোগ যখন, অনেকরকম পরীক্ষা লাগবে নিশ্চয়ই?
রোগের ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্বর-তড়কা বোঝা যায় এবং মৃগীরোগের থেকে আলাদা করা যায়। সাধারণত মাথার ছবি (সিটি স্ক্যান বা এমআরআই) কিংবা ইইজি (মস্তিষ্কের স্নায়ু-সংযোগ বোঝার পরীক্ষা) করার দরকার হয় না। জ্বর না কমলে জ্বরের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার।
চিকিৎসা কী?
জ্বরের জন্য প্রয়োজনমতো প্যারাসিটামল দিতে হবে। সাধারণভাবে ১০০ ডিগ্রির ওপরে জ্বর উঠলে ওষুধ খাওয়াতে বলা হয়। একবার জ্বর-তড়কা হ’লে অনেক বাবা-মা পরের বার থেকে ৯৮-৯৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠলেই জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দেন। সেটা ঠিক নয়। অল্প তাপমাত্রায় ওষুধ খাইয়ে জ্বর-তড়কা রোধ করা গেছে, এমন প্রমাণ নেই। কত বেশি তাপমাত্রা উঠলো তার ওপর তড়কা হওয়া নির্ভর করে না। বরং, কত দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই, অযথা জ্বর নিয়ে আতঙ্কে ভোগার দরকার নেই। শুধু জ্বর কমানোর জন্য মেফেনামিক অ্যাসিড, অ্যাসপিরিন ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
জ্বর-তড়কার খিঁচুনি বন্ধ করার জন্য মিডাজোলাম, ডায়াজিপাম, লোরাজিপাম ইত্যাদি গোত্রের ওষুধ ব্যবহার করা যায়। পেশীর মধ্যে বা শিরায় ইঞ্জেকশন, নাকের স্প্রে বা পায়ুপথে ওষুধ দেওয়া যায়। বাড়িতে তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য নাকের স্প্রে বেশ উপযুক্ত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যায়। খিঁচুনির সময় অযথা উৎকন্ঠিত হবেন না। বাচ্চাকে শুইয়ে রাখবেন না। বসিয়ে দিন বা মাথার দিক উঁচু করে পাশ ফিরিয়ে দিন। মুখের বাইরে লালা বা গাঁজলা যা বেরিয়ে আসবে সেগুলো মুছে দিন। দাঁতে দাঁত লেগে গেলে আঙুল ঢুকিয়ে জোর করে খোলার চেষ্টা করবেন না। মাথায় জল ঢালার কোনও দরকার নেই। বাচ্চাকে দ্রুত হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। প্রাথমিক ওষুধে খিঁচুনি না থামলে অন্য কিছু খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ শিরায় দিতে হয়। সেই চিকিৎসা অবশ্যই হাসপাতালে হবে।
জ্বর-তড়কা রোধ করা যায়?
সাধারণ জ্বর-তড়কায় প্রায় কখনোই কোনও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয় না। তাই আগে থেকে ক্লোবাজাম বা ওই জাতীয় খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ ব্যবহার না করাই ভালো। এক বছরের মধ্যে বারবার জ্বরের সাথে তড়কা হ’তে থাকলে জ্বর থাকাকালীন কিছু সতর্কতামূলক খিঁচুনি বন্ধের ওষুধ ব্যবহার করা যায়। তবে সাধারণত জ্বর কেটে গেলে সেগুলো আর নিয়মিত খেয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ভুল ধারণাগুলো সম্পর্কে যদি বলেন…
জ্বর-তড়কার সাথে কোনও অশুভ শক্তি ইত্যাদির সম্পর্ক নেই। মাদুলি-তাবিজ বেঁধে তড়কা আটকানো যাবে না। অনেক সময় ‘গ্যাস মাথায় উঠে গেছে’ বলে খিঁচুনির সময় জোর করে অ্যান্টাসিড সিরাপ খাওয়ানো হয়। তাতে লাভ তো কিছু হয়ই না বরং তড়কার সময় শ্বাসনালীতে সিরাপ আটকে মারাত্মক অবস্থা হ’তে পারে।
বেশ বিস্তারিত আলোচনা। একটু ছোট্ট করে মূল বিষয়গুলো বলা যায়?
জ্বর-তড়কা বা জ্বরের সাথে খিঁচুনি ৬-৬০ মাস বয়সের একটি অত্যন্ত সাধারণ সমস্যা। বাচ্চার আগে থেকে মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের কোনও রোগ না থাকলে বেশিরভাগ সময় কোনও অসুবিধে হয় না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। জ্বর কমানো নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন হবেন না। মস্তিষ্কের সংক্রমণ, মৃগীরোগ, রক্তের সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম বা অন্যান্য কিছু সমস্যার জন্য খিঁচুনি হচ্ছে কিনা সেটা বুঝে নেওয়া জরুরি। ৫-৬ বছর বয়সের পরে বেশিরভাগ বাচ্চার আর কোনও সমস্যা হয় না। কাজেই, অযথা ভয় পাওয়ার দরকার নেই।
(এই লেখার পরিমার্জিত রূপ সংবাদ প্রতিদিনে প্রকাশিত।)