গ্র্যাজুয়েসনের পর গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টিং। হরেক রকমের রোগী। আজব আজব রোগের প্রকাশ। সত্যি বলতে কি, চিকিৎসা বিদ্যার কোনও বইয়েই এসব অদ্ভুত রোগ বর্ণনা নেই। এই যেমন বাঁকুড়ার “আটু-বাটু” বা মেদিনীপুরের “আই- ঢাই”। এ যে কি বস্তু, এখনও বুঝলাম না। স্বয়ং হ্যারিসন সাহেব এসব শুনে নির্ঘাৎ পিঠটান দিতেন। তবে দিনের শেষে এই আই-ঢাই বা আটু-বাটু সিন্ড্রোমের মধ্য থেকে পরমহংসের মত আসল রোগনির্ণয় ও তার সফল চিকিৎসা দিতে পারলে দিনান্তে রোগীর মুখের হাসিতে জীবন জুড়িয়ে নিতাম। এ গ্রাম বাংলায় ডাক্তারি করে অভিজ্ঞতা অর্জন, কামারশালায় নিজেকে পিটিয়ে স্বরূপ প্রকাশের সামিল।
চিরকালই আমার প্রলাপের নির্বাক শ্রোতা সিস্টার দিদিমনি ও চিকিৎসাকর্মীরা। প্রাকসন্ধ্যের কাজের ফাঁকে এসব লঘু আলোচনার মাঝেই ডেবরা হাসপাতালের দালানে উপস্থিত হলো জনা পনেরোর উদবিগ্ন ছোট স্রোত। বছর দেড়েকের শিশু। খিঁচুনির দমকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ছোট্ট শরীরটা। ঠোঁটের কোন থেকে ফেনা গড়িয়ে ভিজেছে মায়ের কোল। তিন চার জন মিলে জোর করে হাত-পাগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে। একজন মুখের ভেতর কাপড় ঢুকিয়ে দাঁতের পাটি খুলে রাখার কসরতে ব্যস্ত। আমি যেতেই ভিড় খানিক ফাঁকা হলো। গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলাম। জ্বরে গা যেন আক্ষরিক অর্থেই পুড়ে যাচ্ছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আগে কখনও এরকম হয়েছে?
আমার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে অশ্রুসিক্ত গালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠলো যেন। বার দুয়েক ঋণাত্মক মাথা নাড়িয়ে পূনরায় পাথর হলো মায়ের মুখ। চোখ থেকে আরও দুখান জলের ফোঁটা আগের পথেই বেয়ে চললো গাল বেয়ে।
আগে কখনোই এরকম খিঁচুনি হয়নি। কয়েক ঘন্টা থেকে প্রবল জ্বর। প্যারাসিটামল খাওয়ালে কিছুক্ষণের স্বস্তি। তারপর আবার যেই কে সেই। দুপুর থেকেই ঝিমিয়ে পড়েছিলো বাচ্চাটা। মিনিট পাঁচেক আগে এরকম খিঁচুনি শুরু হয়েছে। সাতপাঁচ আর না ভেবে দৌড়ে হাসপাতালে আপনার কাছে নিয়ে এলাম, ডাক্তারবাবু। মাথা নিচু করে ভারী গলায় কথাগুলো বললেন শিশুটির বাবা।
সদ্য এম.বি.বি.এস পাশ করেছি তখন। অভিজ্ঞতার ঝুলি খুব বেশি ভরা না থাকলেও এ রোগ যে “ফেব্রাইল কনভালশান” তা বুঝতে খুব দেরি হয়নি। ঘাড় শক্ত নেই দেখে মেনিনজাইটিস নয় বলেই মনে হয়েছিলো। এ রোগের চিকিৎসাও ঠোঁটস্থ। কিন্তু খিঁচুনি অবস্থায় চ্যানেল করে ফেনোবারবিটোন প্রয়োগ! সে তো প্রায় অসাধ্য কাজ। তার উপর এত্ত ভিড়ের মাঝে ঐ কচি হাতে ঠিকমতো চ্যানেল করাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।
সিষ্টার দিদিমনিকে জিজ্ঞেস করলাম লোরাজেপাম আছে? দিদি করুণ মুখে মাথা নাড়লেন। তাহলে ডায়াজেপাম?
তা আছে বৈকি। কিন্তু এত্ত ছোট্ট বাচ্চাকে ডায়াজেপাম দেবেন স্যার? আর চ্যানেল ছাড়া ডায়াজেপাম মাংসপেশিতে দিতে গেলে খিঁচুনির চোটে যদি নিডল ভেঙ্গে যায়? সে তো কেলেঙ্কারি হবে স্যার।
মুচকি হেসে দিদিকে ডায়াজেপাম ইঞ্জেকশন রেডি করে আনতে বললাম।
মুহূর্তের মধ্যে ডায়াজেপাম এলো। দিদির মুখে সংশয়ের দৃষ্টি। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা আমার হাতে তুলে দিয়ে দু পা পিছিয়ে গেলেন সিস্টার দিদিমনি।
আমি সিরিঞ্জ থেকে নিডল খুলে দিদির হাতে দিয়ে দিলাম। দিদিমনির কপালের সংশয়ের ভাঁজ আরও গভীর হলো।
শিশুটিকে ধরে রাখার কসরৎ করতে থাকা লোকজনকে শিশুটির মলদ্বার ওপেন করতে বললাম।
এ আদেশে সংশয়ের মেঘ জমলো সকলের কপালেই।
কিন্তু আমার আর দেরি করলে চলে না। মনে মনে শিশুটির ওজনের সাথে ডায়াজেপামের ডোজ আন্দাজ করে চালিয়ে দিলাম মলদ্বারের ভেতর।
মিনিট চারেকের সুদীর্ঘ অপেক্ষা। ক্রমেই শান্ত হলো ছোট্ট শরীরটা। এতক্ষণের খিঁচুনি ধিরে ধিরে মিলিয়ে গেল।
পরিজনেদের চোখে মুখে সম্ভ্রম মেশা অবাক চাহনি ফুটে উঠলো। সিস্টার দিদিমনির চোখের বিস্ময়ের রেখাও চোখ এড়ালো না আমার। আমিও নিভৃতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
শিশুটির মা হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। কোল থেকে শিশুর মাথাটি নামিয়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার পায়ে। এ হেন অনভিপ্রেত আচরণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। সভয়ে দু পা পিছিয়ে যেতেই হাত জড়ো করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। শিশুর বাবার চোখেও ততক্ষণে নেমে এসেছে জলের ধারা।
আবেগের এহেন পরিবেশে আমার যৎসামান্য প্রচেষ্টা বড্ড বেশি মহিমান্বিত হচ্ছে দেখে বেশ আতান্তরে পড়লাম আমি।
“ফেব্রাইল কনভালসান”। অর্থাৎ কিনা জ্বরের প্রকোপে খিঁচুনি। দুই তার প্রকারভেদ। “সাধারণ” আর “অপ্রাকৃত”। সাধারণের ক্ষেত্রে এই খিঁচুনি জ্বরের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বা হঠাৎ জ্বর বাড়লে হতে পারে। প্রতিবার জ্বরের এপিসোডে একবার। মিনিট দশেক অবধি এর সর্বাধিক মেয়াদ। খিঁচুনির পর আবার সব আগের মতই গতানুগতিক। দিন দুয়েক পর ই.ই.জি ও এক্কেবারে নিষ্কলুষ।
“অপ্রাকৃত” ফেব্রাইল কনভালসন নির্ণয় করতে গেলে আগে কখনও এই ধরনের ঘটনা হয়েছিল কিনা তা জানা জরুরী। রক্তের সম্পর্কের অন্য কেউ এ ঘটনার শিকার হয়েছিল কিনা তাও বিশদ জানা দরকার। সেক্ষেত্রে মৃগীরোগের কথাও মাথায় রাখা জরুরী।
কিন্তু “হঠাৎ বিপদ”-এ এ রোগের চিকিৎসা একই। মূল লক্ষ্য খিঁচুনির সময় মুখের গ্যাঁজলা বা পিছনের দিকে চলে যাওয়া জিভ যাতে শ্বাসপথ আটকে শ্বাসরুদ্ধ না করে। আর খিঁচুনির সময় দাঁতের মাঝে পড়ে জিভ যাতে না আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এ সময় শিশুকে বামদিকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রেখে মুখ খোলা রাখা উচিত। জলে ভেজা কাপড় সারা শরীরে বুলিয়ে বাষ্পায়ন পদ্ধতিতে গায়ের তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে ফেলার দিকে জোর দিতে হবে।
চিকিৎসকের করণীয় এক্ষেত্রে শুধু একটাই। হয়ে চলা খিঁচুনি যাতে দীর্ঘমেয়াদি না হয়। জ্বরের মূল চিকিৎসার সাথে সাথে খিঁচুনির জন্য প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী চ্যানেল করে বাচ্চার ওজন অনুযায়ী ফেনোবারবিটোন প্রয়োগ। আপতকালীন পরিস্থিতিতে পায়ুপথে ডায়াজেপাম বা লোরাজেপাম অথবা নাসাপথে মিডাজোলাম সঠিক মাত্রায় সাবধানতার সাথে প্রয়োগ করা যায়।
প্রতিরোধের উপায় হিসেবে সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট বা ফেনোবারবিটোন মুখে খাওয়ানো যেতে পারে। ক্লোবাজামও কিছুক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে প্রয়োগ করা যায়।
এ রোগে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সর্বাধিক পাঁচ বছর বয়স অবধি শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। একবার আক্রান্ত হলে এই পাঁচ বছর বয়স অবধি পূনরায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। আপাত নিরীহ এ রোগের ক্ষেত্রে যদিও সাবধানী বাঙালির পরবর্তী কালে ইলেক্টোএনসেফালোগ্রাম করে মৃগী রোগের সম্ভাবনা যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি বারংবার।
এ অবধি আলোচনা জলবৎ তরলং হলেও আংশিক খিঁচুনির বিভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশকে পরমহংসের মতো যাচাই করা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নির্ভর। চোখ উপরে তুলে রাখা থেকে শুরু করে একভাবে দীর্ঘমেয়াদি কান্নাকেও অভিজ্ঞ চোখ খিঁচুনি রূপে ডায়াগনোসিস করেন।
চোখ বুঁজে এতক্ষণ জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পর সিস্টারদিদির বিস্মিত মুখের দিকে তাকালাম। পাশে থাকা ভিড়ের উদ্দেশ্যে বললাম- এ শিশুর খিঁচুনি নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু নেই। জ্বর এলে সারা শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে বারংবার মুছতে থাকুন। আবারও খিঁচুনি আসতে পারে। সেজন্য কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে রাখছি। চিন্তার বিশেষ কিছু নেই। হাসপাতালের পাশেই তো বাড়ি। সমস্যা হলে নিয়ে আসুন। নানাবিধ রোগীর ভিড়ে বাচ্চাটিকে আর ভরতি করে অন্যান্য সমস্যা বাড়াতে চাই না।
ভিড়ের মধ্য থেকে কোনও প্রতিরোধ এলো না। আমার কথা শুনে বাধ্য ভাবেই শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন তাঁরা। স্বভাবসন্দিহান রোগী পরিজনের এ হেন বাধ্য আচরণ গতানুগতিক চিকিৎসক জীবনে একটু বেমানান ঠেকেছিল বৈকি।