ছুটির দুপুরে খাবার টেবিলে পার্বতীদির যত্ন করে রেঁধে রাখা ঠান্ডা ভাত আর মুরগির মাংস, এক গরাস নৈঃশব্দ্য দিয়ে মেখে মুখে তুলছিলাম।
ডাইনিং টেবিলটা বুড়োদাদুর আমলের। আগে সাদামাটা কাঠের টপ ছিল, বাবা পরে সানমাইকা করিয়ে নেয়। জন্ম ইস্তক বাড়িতে থাকলে এখানে বসেই খেয়ে এসেছি আমি। প্রথম প্রথম তিনজনে, তারপর দুজনে, আর ইদানিং একাই।
খেতে খেতে ভাবছিলাম, কতদিন মা আর আমি এক টেবিলে বসে ভাত খাইনি? ঠিক কতদিন?
অনেকদিন। আমাদের খাবার ঘর একতলায়। আমার আর মায়ের শোবার ঘর দোতলায়। চলে যাবার বছর দুই আগে থেকেই মা আর সিঁড়ি ভেঙে ভাত খেতে নামতে পারত না, হাঁপ ধরত খুব।
আমি শোবার ঘরে এককোণে একফালি টেবিলে মায়ের খাবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলাম।
তখন থেকেই একা লাঞ্চ করার অভ্যেস — হাসপাতাল ডিউটির দিনে তো বটেই, ছুটির দিনেও।
রাতের খাবার অবশ্য একসঙ্গে খেতাম — খাটে বসে, টিভি দেখতে দেখতে।
আজ দুপুরে খেতে বসে মনে হচ্ছিল যেন কতযুগ আগের কথা সব।
আমার মামাতো, মাসতুতো দিদি, বৌদি, বোনঝি যারা ফেসবুকে আমার বন্ধুবৃত্তে আছে, তারা এই অবধি পড়ে দুঃখ পাবে খুব। ভাববে —“আহা, মেয়েটা/ মাসিটা ভাল করে খেতে পায় না মোটে।”
তারপর উৎকন্ঠিত ফোন আসবে কিছু —“পরের ছুটির দিনে চলে আয় না দুপুরবেলা — একসঙ্গে খাবো। কি মাছ খাবি বল? চিকেন খাবি? তোর পছন্দমতো হালকা করে রান্না করব —“
উৎকন্ঠাটুকু স্বার্থপরের মতো উপভোগ করব আমি — কিন্তু তাদের বোঝাতে যাব না যে খাবারের উষ্ণতা বা স্বাদ নয়, খাওয়ার ইচ্ছের দরজাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমার। কোনো মরসুমি ফল, কেক, পিঠে পায়েসের অশনেই এ রসনাবিলাস আর ফিরবে না।
তবু খেতে হয়। মনের সঙ্গে ষড় করে স্বাদকুঁড়িরা ধর্মঘটে গেলেও খেতে তো হয়। হ্যাঁ, একাই।
সাম্প্রতিককালে মা নিজের হাতে আর খেতে চাইত না। দুপুরে পার্বতীদি আর রাত্রে আমি খাইয়ে দিতাম। কোনো জ্বালা ছিল না খাওয়ার। শুধু চিবোতে পারত না বলে একটু নরম, গলা খাবার দিতে হতো মা-কে।
সকলেই বলে, মনে এনো না পুরোনো কথা, চেষ্টা করো ভুলতে, মনে পড়লেই কষ্ট। বলে, সময় সব ভুলিয়ে দেবে।
কি করে বোঝাই সকলকে, ঠিক সেটাই তো আমি চাই না। ভুলতেও চাই না, মন থেকে সরাতেও চাই না। একেবারেই নিরাবলম্ব হয়ে যাব যে তাহলে।
হয়ত এই pining, যা গেছে তাকে ফিরে পাওয়ার এই শাশ্বত হাহাকার খুব অস্বাস্থ্যকর। তবু, একে আঁকড়েই বাঁচতে চাই। কারণ, আমার দিনের বাকি সময়টা যে সদর্থক সক্রিয়তার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে ফিরি, তার বোধনের সুর রয়েছে এই অপ্রাপ্তির মনকেমনের বাঁশিতে। একে আমি হারাতে দিই কেমন করে?
তাই দিনান্তের ডায়েরি লিখছি ভেবে মনের মুঠো আলগা করে ফেসবুকের পাতায় ছড়িয়ে দিই এককুচি বিষাদের পাপড়ি। বিষক্ষয় হয় যেন, আখর-ইথারের স্পর্শে শাপমুক্তি ঘটে বেদনাময়ী অহল্যার।
কেউ না পড়ুক, আমি তো ফিরে ফিরে পড়তে পারি, জুটিয়ে নিতে পারি আগামী দিনটা সকর্মক ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার একটুকরো তাগিদ।
হ্লাদিনী মুখপুস্তিকার উল্লাসময় অঙ্গনের এককোণে এই গুরুভার শোকের একটুকরো যাপনও না হয় থাকুক। কালো বিনে আলো-কে অত উজ্জ্বল লাগে কি?
সঙ্গের ছবি বছর ছয়েক আগে এক অঘ্রাণের দুপুরবেলার। মামাতো দিদির ছেলের বিয়ে উপলক্ষে মায়ের খাওয়ার ছবি। সঙ্গে মামাতো বৌদি, ভাইপো আর আমি।
ছবি তুলেছিল আরেক মামাতো দিদির মেয়ে, মায়ের অতি আদরের নাতনি পুটুর।