গতকাল হাসপাতাল থেকে ডিউটি ফেরত গিয়েছিলাম বাজার করতে। সবজি ফুরিয়েছে। একার পেট হলেও অল্পস্বল্প কিছু লাগে তো, তাই কিনতেই গিয়েছিলাম। জিঞ্জিরা বাজারে। অতি উত্তম শাকসবজির খুচরো এবং পাইকারি কারবারের জায়গা, আমার বাড়ি ফেরার পথেই পড়ে।
চেনা দোকানটিতে ঢুকলাম। আনোয়ার একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানালো। ‘কি দেব মা আজকে? খুব ভাল ফুলকপি আছে, ব্রকোলিও ভাল আছে, বেগুন তো এক নম্বরি একেবারে — ভাজা, পোড়া, ঝোল যেমন ইচ্ছে খাবেন, একটা দানা পাবেন না’— তারপর মাথা চুলকে বলে, ‘শুধু পটলটা এবারে ভাল পাইনি মা, দিতে পারব না’। আমার পটলপ্রীতি তার অজানা নয়।
আমি তাকিয়ে দেখছিলাম আনোয়ারের পসরার দিকে। চট পাতা চৌখুপির ওপর ঢালা হরেক রকম শীতের সবজি, তাতে এসে পড়েছে ওপর থেকে ঝোলানো ঝকঝকে এল ই ডি বালবের ফটফটে সাদা আলো — কমলা রঙের স্বাস্থ্যবান গাজর, চকচকে গা ক্যাপসিকাম, জলের ফোঁটা মাখা উজ্জ্বল বেগুন আর লাল টুকটুকে টমেটোগুলো যেন হেসে উঠেছে সেই আলোয়।
আমার মনে পড়ে গেল নৈহাটির হাজিনগরে পেপার মিলের কোয়ার্টারে মায়ের করা একটুকরো কিচেন গার্ডেনের কথা।
আমার ডাক্তারির পড়া তখন শেষের পথে। পার্ক সার্কাসে কলেজ হোস্টেলে থাকি, আর গায়ে নব্বই দশকের গোড়ার দিকের কলকাত্তাই খুশবু মেখে শনি রোব্বার করে মফস্বলী মা-বাবার কোয়ার্টারে সাপ্তাহিক হাজিরা দিতে আসি।
গাছপালা, ফুল, বাগান ইত্যাদির প্রতি অনুরাগ আমার কোনোকালেই ছিল না। তাই কোনো এক শীতকালের সপ্তাহান্তে বাড়ি ঢোকা মাত্র মা যখন প্রবল উৎসাহে কোয়ার্টারের পিছনদিকে টেনে নিয়ে গেল আমাকে, ভীষণই বিরক্ত হয়েছিলাম, মনে পড়ে।
‘আলো থাকতে থাকতে দেখবি চল, টমেটো গাছগুলোতে কেমন কুটি কুটি সবুজ টমেটো ধরেছে — সন্ধে হয়ে গেলে আর দেখতে পাবি না তো!’
পরের দিন সকালে দেখলে যেন চলবে না, এতই তাড়া দিচ্ছিল মা।
গিয়ে দেখি, একফালি বাঁশের বেড়া ঘেরা জমিতে সার দিয়ে বসানো ফুলকপি, বেঁটে বেঁটে বেগুন আর টমেটোর চারা — সত্যি সত্যিই গাছে ফলে রয়েছে কাঁচা কাঁচা নবীন টমেটোর দল, আর সেই সবজি বাগানের এককোণে খুরপি হাতে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পেপার মিলের ওড়িয়া মালী ভাগীরথী, যাকে প্রতিবেশিনী ভটচাজ কাকিমা কেন যে ভগীরথ বলেই ডাকতেন, তা নিয়ে মা-মেয়েতে জনান্তিকে হাসাহাসি করেছি অনেকবার।
অস্বীকার করব না, রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম বটে।
আমার হোস্টেলাইট বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র রীণার বাড়ি ছিল শহর থেকে অনেক দূরে — দক্ষিণ বারাসত তখন পুরোদস্তুর গ্রাম। সেখানে বেড়াতে গিয়ে খেয়েছিলাম ওদের ‘নিজেদের’ পুকুরের মাছ, গাছের ডাব, মায় ‘ঘরের’ মৌচাকের মধুও। নৈহাটি মফস্বল হলেও তত গ্রামীণ পরিবেশ তো নেই, তার উপর আমাদের নিজেদের বাড়ি নয়, থাকতাম মিলের কোয়ার্টারে — বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার ক্ষয়িষ্ণু রাজকীয়তা কালা সাহেবরা ধরে রেখেছিল সেই বিশাল ঘরওয়ালা, উঁচু সিলিং আর ফ্রেঞ্চ উইন্ডোসমৃদ্ধ কোয়ার্টারে, ঢালা লন, গঙ্গার ধার বরাবর প্রশস্ত সিমেন্টবাঁধানো রাস্তা আর প্রাইভেট জেটিতে, গম্ভীর অভিজাত টিকউডের কালচে, ভারিক্কি আসবাব শোভিত ‘অফিসার্স ক্লাব’ আর তার সংলগ্ন সুইমিং পুলে, (যেটাকে কদাচিৎ জল ভর্তি থাকতে দেখেছি আমি) আর গেস্ট হাউসের ‘কুক’ মাধবের হাতে তৈরি অপূর্ব ‘চিকেন ইস্টু’-র নির্ভুল রেস্তোরাঁমার্কা স্বাদে।
পিছনে দৃশ্যমান গঙ্গা
ভাগীরথী ছাড়া আরো একজন মালী ছিল পেপার মিলে, কার্তিক। ওরা দু’জন মিলে আমাদের কোয়ার্টারের সামনের বিরাট লন ঘিরে তৈরি করতো নানা মরসুমি ফুলের বেড — শীতকালে চাষ হতো ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকার, তাদের রঙের সমারোহে ঝলমল করে উঠত আমার ছুটির রবিবারগুলো। বছরের বাকি সময়টা শুধু গোলাপি সাদা মুসান্ডা, লোহার গেটের ওপর বোগেনভিলিয়ার ঝাড় আর লাল গোলাপ রাঙিয়ে রাখত চারদিক। আমি রেলিং দেওয়া বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকতাম সামনের নদীর দিকে, পশ্চিমের রোদ্দুরে ঝিকিয়ে উঠতো গঙ্গার জল। আলো পড়ে এলে, একটু একটু করে পোঁচের পর পোঁচ কালি পড়ত পশ্চিমের আকাশের ক্যানভাসে আর আমি দেখতে পেতাম ওপারে ব্যান্ডেল চার্চের চুড়োর পিছন থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসছে স্নিগ্ধ সন্ধ্যাতারাটা।
‘কি? কি হয়েছে, শুনি? চেঁচিয়ে উঠলি কেন?’-র উত্তরে কাঁপা আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়েছিলাম, দরজার বাইরেই বাগানে যাবার সিঁড়ির গোড়ায়, হিলহিলে চেরা জিভ বার করে মুখ বাড়িয়েছে ছানা ডায়নোসর তুল্য অচেনা সরীসৃপ।
আমার আদ্যন্ত শহুরে মা হেসে উঠে বলেছিল — ‘ওমা, ওটা তো গোসাপ — চিনিস না? এখানে অনেক আছে। ঐ গঙ্গার ধার থেকে উঠে কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে চলে আসে। খাবারের লোভে। আমি খেতে দিই তো!’ বলেই আমার আতঙ্কিত চোখের সামনেই গ্যাস ওভেনের পাশে রাখা ডিমের ক্রেট থেকে একখানা ডিম তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরেছিল সরীসৃপটার মুখে, আর সেও ভীরু কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সেটি গ্রহণ করে পিছন ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল আশেপাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে।
আলোর চেয়েও দ্রুতগামী হলো মানুষের মন। কাল জিঞ্জিরাবাজারে সবজি বাজার করার সময় হঠাৎই তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের স্মৃতি কেমন হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল খ্যাপা মেলট্রেনের মতো, আর লহমার মধ্যে একফালি অতীতকে ওলোটপালোট করে ঝড়ের গতিতে পেরিয়ে গেল হৃদয়পুরের স্টেশন।
আমি ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কেনাকাটায় — অন্তত এক সপ্তাহের রসদ জোগাড় করে রাখতে হবে, ঘনঘন বাজারহাট আমার পোষায় না মোটে।
বর্তমানের দুনিয়াদারির তাড়ায় মনের চালচিত্তিরে একবার উঁকি দিয়েই হারিয়ে গেল হাজিনগর, ভাগীরথী, কার্তিক, ভটচাজ কাকিমা, ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকা-গোলাপের কেয়ারি, ব্যান্ডেল চার্চ, শান্ত গোসাপ আর আমার লক্ষ্মীস্বরূপা মায়ের এককুচি কিচেন গার্ডেন।