সংখ্যাতত্ত্বে কোনোদিনই বিশ্বাস ছিল না। তবু যুক্তিগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখলে মনে হয় ‘কুড়ি’র গায়ে অভিশাপ আছে।
আজ এই দু’কুড়ি সালের অক্টোবর অব্দি মারীর কবলে পড়ে হারিয়ে গেছেন এগারো লক্ষ মানুষ। কাজ হারানো, অনাহার, ঝড়ের তান্ডব.. সব মিলিয়ে ধুঁকছেন তার চেয়ে আরও বহু বহুগুণ।
ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণ মেনে পুজো এসেছে। এরকম পুজোও তো কেউ কোনোদিন দেখি নি। মহালয়ার একমাস বাদে পুজো। মারীর আবহে সেই চেনা থিকথিকে ভিড় নেই, অগুণতি কালো মাথা আর বিচিত্র চিৎকার ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে নিউজ চ্যানেলে গলদঘর্ম সাংবাদিকের বাক্যপ্রতি সাড়ে তেরোবার ‘কিন্তু’ নেই, উৎসবের সেই চেনা উষ্ণতা নেই। ব্যক্তিগত ভাবে ভিড়ে আমার অস্বস্তি হয়। একা থাকতেই ভালো লাগে। তবু, পুজোর জমাটি আড্ডা, কনুই অব্দি গড়িয়ে আসা জিলিপির রস, নতুন শাড়ি-পাঞ্জাবীর খস, পাড়ার জলসা, কারও দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বুক ধক আর স্বর্ণযুগের গান… মন ‘হাফপ্যান্ট’ হয়ে যায়। মানে, যেত এতদিন। এবার কুড়ির গেরোয় উৎসব ফিকে।
আরও আছে। কুড়ি ওভারের খেলা আসার পর বুঝতে শিখলাম কুস্তির আখড়া আর ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। কব্জির মোচড়, ব্যাটের আলতো ছোঁয়ায় কাব্যিক স্ট্রেট-ড্রাইভ কিংবা চার ফিল্ডারের মাঝের ফাঁক খুঁজে কভার ড্রাইভের জায়গা নিয়েছে মুগুরভাঁজা শট। ‘বিশ’-এর বিষ।
আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অমল-কে (নাম পরিবর্তিত) মনে পড়ে গেল। কতদিনের কথা.. গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে অমল আমাদের ওপরের ক্লাসে পড়তো। খেলাধুলোয় তুখোড় ছিল। ব্লক বা জেলাস্তরে প্রাইজটাইজ পেত। বাংলা মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুলে সেসময় পড়াশোনা নিয়ে অত মাথাব্যথা ছিল না কারও। বরং, খেলায় সেরারাই আমাদের কাছে ‘হিরো’ ছিল। অমল যেদিন উমুক স্কুলের ছেলেদের হারিয়ে প্রাইজ পেত, তার পরের দিন সেসব খেলার মাঠের বীরত্বের গল্প শুনতে আমরা এলেবেলেরা ভিড় জমাতাম। অমল দূর থেকে প্রাইজ তুলে দেখাতো। জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে ভাবতাম ‘আমিও যদি..’
সেই অমল একদিন বেমক্কা মরে গেল। ‘মরে গেল’ কথাটায় ধাক্কা লাগছে কি? সেসময় আমাদের ‘মরে যাওয়া’কে ললিত সাহিত্যে বলার ক্ষমতা আসে নি। তিন-চারদিন জ্বরের জন্য অমল স্কুলে আসছিল না। সে এরকম তো কতই হয়ে থাকে। তার বেশি আমরা জানতাম না। একদিন টিফিন পিরিয়ডে জানতে পারলাম আমাদের ‘হিরো’ আর নেই! ‘কী, কেন, কীভাবে’ সেসব বোঝার বয়স হয়নি তখন। সেদিন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায়। অমলের জন্য দু’মিনিটের নীরবতা। তারপর সবাই মিলে অমলের বাড়ি..
আমরা আর বহুদিন খেলার মাঠে যাই নি। খেলার মাঠের পাশেই গ্রামের শ্মশান। শ্মশানে শোলা-কলাগাছের কান্ড দিয়ে তৈরি রথ, কালো কাঠকয়লা আর তুলসীগাছ দেখলে মনে পড়তো, ‘ওর তলাতেই..’। তারপর, কত কত রাত ঘুম ভেঙে গেছে দুঃস্বপ্নে..
হিসেব করে দেখলাম কুড়ি বছরের কিছু বেশি..
অথচ, তারপর অমলকে দিব্যি ভুলে গেছি। সময় আর জীবন বয়ে গেছে নিজস্ব খাতে। অমলের মুখটাও আর সেভাবে মনে পড়ে না। অসময়ে ‘নেই’ হয়ে যাওয়া মানুষের ফটোফ্রেমে বয়স বাড়ে না। অমলের চুল পড়বে না, চামড়া ঝুলবে না, কোমরে-হাঁটুতে ব্যথা হবে না, ছোট লেখা পড়তে ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগবে না। তার চিরশৈশবের আশেপাশে ক্রমশ বুড়িয়ে, জীর্ণ হবে সমকালীন পৃথিবী।
**
তবু, আশার আলো কি নেই? এত আবেগের উৎসবের (তুলনায়) সংযত উদযাপন, ভ্যাক্সিন পরীক্ষায় প্রাথমিক সাফল্য, (এদেশে) অপ্রমাণিত বিকল্প চিকিৎসার সাময়িক বুজরুকি দূরে সরিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসায় আস্থা, চিকিৎসক সংগঠনগুলির তরফে ঝড় আর মারীর ভ্রূকুটি দূরে সরিয়ে অসংখ্য মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন, বিভিন্ন জায়গায় কমিউনিটি কিচেন.. এগুলোও তো কম কথা নয়..
বহু বহু বছর বাদে এবার পুজোয় মোটের ওপর ভালো আবহাওয়া। পুজোর চেনা প্যাচপেচে বৃষ্টি নেই। তবু, মারীর বছরের উৎসব ভিড় থেকে দূরে কাটুক। মাস্ক, স্যানিটাইজারে কাটুক। সতর্কতায় কাটুক।
উৎসবের দিনগুলোতেও যাঁরা ডিউটিতে থাকবেন তাঁদের জীবন ‘সস্তা’ নয়। এদেশে শুধু চিকিৎসক-মৃত্যু পাঁচশোর বেশি। (অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত সবাইকে ধরলে সংখ্যাটা অনেক বাড়বে) অনেকেই সবে চিকিৎসক-জীবন শুরু করেছিলেন। মারীর দেশে স্টেথোস্কোপের ‘মূল্য’ বড্ড বেশি। আপনার হুল্লোড় আর উদ্দাম মাতামাতি একটা বছর পিছিয়ে দিয়ে সে ‘মূল্যে’র খানিকটা শোধ দেবেন, প্লিজ?