সকালে আরশিকে ছেড়ে আসার সময় খুব মন খারাপ হচ্ছিল। আমার নয় পুজো-টুজো ঘিরে আবেগ বহুদিনই ফিকে হয়ে এসেছে কিন্তু ওর এটাই প্রথমবার ভালো করে বুঝেশুনে আনন্দ করার পুজো। আরশিও পুজোর বেশিরভাগ সময়টাই বাড়িতেই কাটাবে। মাঝে কখনও অল্পস্বল্প সময় বুড়ি ছোঁওয়ার মতো করে মায়ের সাথে পাড়ার পুজো দেখতে যাবে। বাবা ষষ্ঠীর কাকডাকা ভোরে উঠে হাসপাতাল চলে এসেছে। পুজোর প্রায় পুরোটাই বাবা হাসপাতালেই থাকবে। আরশি বাবার গলা জড়িয়ে বলেছে- বাবা, আমার খুব মন খারাপ
– কেন গো?
– তুমি কেন হসপিটাল চলে যাবে?
কুচোটাকে জড়িয়ে ধরে চটকে দেওয়া ছাড়া এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। হয়তো এখন থেকেই আরশি বুঝে যাবে, ডাক্তার-বাবা বেশিরভাগ আনন্দের দিনগুলোই তার কাছে থাকতে পারবে না। তার বয়সী অন্যান্য বাচ্চারা বাবার কোলে করে ঘুরতে বেরোবে। তখন হয়তো আরশির খুব অভিমান হবে। খুব ইচ্ছে করবে বাবা তার সাথে একটা গোলাপী রঙের বেলুন নিয়ে ছোঁড়াছুড়ি খেলুক। সে বাবাকে পাবে না। হয়তো বাবার বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোর মতো অর্থকষ্ট তার কোনোদিনই থাকবে না। সে আয়নায় অভাব দেখবে না। তবু তারও মন খারাপ। আসলে, কেউ খেলনা পায় না। কেউ খেলনা পেয়েও খেলতে পারে না। আর, শেষমেশ দিনের শেষে তাদের না খেলতে পারাটাই সত্যি।
আমার ছোটবেলায় বাবা খুব কষ্ট করে একটা জামা কিনে দিত। অল্প দামের জামা। পুজোর প্রায় মাসখানেক আগে। পরের একমাসে কতবার সে জামা নেড়েচেড়ে দেখা… পুজোর মজার কত প্ল্যান… পুজোয় পরার আগে অন্তত বার দশেক জামার ট্রায়াল হয়ে যেত। আমার সেই সবেধন নীলমণি! আরশির এবার ছ’টা জামা হয়েছে। এক জামা বারবার পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার সে অনুভূতি আরশির হবে না। তবু কোনও একদিন নিশ্চিতভাবেই মনে হবে, বাবা না এলে কী লাভ ওরকম নতুন জামার? বাবা তখন হাসপাতালে গম্ভীর মুখে মাস্ক এঁটে অন্য কোনও বাচ্চার বাবাকে বোঝাবে- “বাচ্চার বুকের অবস্থা খুব অবস্থা খুব খারাপ। ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাইরে থেকে মেশিন দিয়ে শ্বাস দিতে হচ্ছে।” তারপর পাতা ভরিয়ে ক্লিনিক্যাল নোটস দেবে। হাসপাতালের জানলা দিয়ে পুজোমণ্ডপের গান ভেসে আসবে। এক ছাপোষা ডাক্তারের শারদীয়া হেমন্তের সুরে ভরে উঠবে- “আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি”
পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাচ্চাদের জ্বর-শ্বাসকষ্ট মারাত্মকভাবে বেড়েছে। অনেক বাচ্চারই শ্বাসনালীর রসে পুরোনো শত্রু আরএসভি (এক ধরনের ভাইরাস) পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাইরাসও করোনার মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। প্রতিরোধের উপায়ও প্রায় একইরকম। যদিও এই ভাইরাসঘটিত শ্বাসকষ্ট শীত আসার ঠিক আগে আগে বেশি হয়। এ বছর এত আগে থেকে এত সংখ্যক শিশুর অসুস্থতা চিন্তার কারণ বৈকি! করোনার ভয়ও আছে পুরোমাত্রায়। যদিও ‘ভয়ের কারবারি’ ডাক্তাররাই এসব নিয়ে অকারণে চেঁচামেচি করে মরে। ওদের কথায় সাধারণের থোড়াই কেয়ার! টিভিতে, স্যোশাল মিডিয়ায় দেখছি- মানুষ কীভাবে আনন্দ-উৎসবের মজাটুকু লুটেপুটে নিচ্ছেন। টিভিতে দেখাচ্ছে জনসমুদ্র, আমি দেখছি টাইম বোম! আগে হ’লে বিরক্তিতে চিৎকার করতাম। এখন বলার উৎসাহ ফুরিয়েছে। আমার আশঙ্কার পুরোটাই নিজের কাছে। আশঙ্কা যদি সত্যি নাও হয়, তবু ভবিষ্যতের জন্য লেখা থাকবে- একটি আত্মঘাতী জাতি সব জেনেশুনে, সব সতর্কতা ফুৎকারে উড়িয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল।
শারদীয়ার রাতে অসুস্থ শিশুদের মায়েরা জেগে। নির্ঘুম। বেডের পাশে একটা চেয়ার। তাতেই কোনোরকমে ঘাড় গুঁজে বসে থাকা। কখনও তাও নেই। অগত্যা মেঝেয় একটু চোখ বুজে ফেলা। ঘুম আসে না। রাত-বিরেতে ডাক আসে- ‘রতন মন্ডলের মা…’ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মা। অন্য মায়েদেরও ঘুম ভেঙে যায়। ক’টা বাজে গো? তিনটে দশ। আবার একটু ব্যর্থ চোখ বোজা। এভাবেই আরেকটা সকাল। ভোরের দিকে একটু শীত শীত। শাড়ির আঁচলটা আরেকটু জড়িয়ে নেয় রতন মন্ডলের মা। রতন মন্ডলদের মায়েদের কোনও নাম হয় না। কেউ আলাদাভাবে তাদের নাম মনে রাখবে না। ‘তিনশো পঁয়ষট্টি বেডের মা’ হিসেবেই তাদের ছুটি হয়ে যাবে। কোলের বাচ্চাটা কখনও কোলে ফেরে, কখনও সাদা চাদরে মুখ ঢেকে…
এমনিতেই ডাক্তারির মতো অন্যান্য আপৎকালীন পরিষেবার সাথে যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁদের কাজগুলো বরাবরের থ্যাঙ্কলেস জব। ক্রিকেটের উইকেটকিপারের মতো। একটা ক্যাচ মিস করলে কেউ মনে রাখে না, এই মানুষটা বাকি পঞ্চাশ ওভার নিশ্ছিদ্র ছিল! সকালেই দেখেছি ট্রাফিক পুলিশ কী নিপুণ দক্ষতায় ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদেরও বাড়ি আছে, সন্তান আছে, পুজো আছে। অভিমান হয় না কি? হয় তো। তারপর ভাবি- আমাদের তবু অল্প সংখ্যক কেউ কেউ বলে যান, “অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। আপনারা আমার বাচ্চাটাকে বাঁচালেন।” তখন কেউ রতন মন্ডলের মা’কে মনে রাখে না। তার রাতের পর রাত জেগে বসে থাকাগুলো আলোর বৃত্তে আসে না কোনোদিন। অথচ, তাকে ছাড়া রতনকে সুস্থ করা যেত না কিছুতেই। বাড়ি ফিরে গিয়ে রতনের মা এককামরা ঘরের কোণে আধময়লা ছাপাশাড়ি কোমরে জড়িয়ে ফ্যানমারা ভাত ফোটাবে। আবার একবার করে ছুটে ঘুমন্ত রতনের গায়ে চাদরটা টেনে দেবে। এই তো আমার দুর্গা, এই আমার শারদীয়া…
(আপাতত এটাই পুজোর পোষাক। প্রিয় সবুজ গাউন। নাইট ডিউটি চলছে। সবাইকে শুভ ষষ্ঠী কিংবা সপ্তমী’র শুভেচ্ছা)
১১ই অক্টোবর, ২০২১ রাতে লেখা।