কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে এত তাড়াতাড়ি কি ভাবে কোভিভ রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হল। এই সন্দেহ করাটা অমূলক নয়, এর আগে বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে কেমন সময় লেগেছে সেটা দেখে নেওয়া যাক।
অসুখের নাম – সময় কাল (জীবাণু আবিষ্কারের দশক – টিকা আবিষ্কারের দশক) এভাবে দেওয়া হল:
মেনিনজাইটিস (১৮৯০- ১৯৮০);
হুপিং কাশি (১৯১০-১৯৫০);
পোলিও (১৯১০- ১৯৫০);
মাম্পস (১৯৫০- ১৯৫৫/১৯৭০),
মিজলস (১৯৫০- ১৯৭০);
হেপাটাইটিস বি (১৯৬০-১৯৮০), ইত্যাদি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সাধারণত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে যেখানে পাঁচ থেকে দশ বছর লেগে গেছে সেখানে এক্ষেত্রে পাঁচ থেকে দশ মাসের মধ্যে উপযুক্ত টিকা আবিষ্কার হয়ে গেল। কিভাবে হল সেটা দেখা যাক।
(১) বিপুল বিনিয়োগ— টিকা আবিষ্কারের ইতিহাসে এত বড় কর্মযজ্ঞ আগে কখনো হয় নি। আশিটির বেশি গবেষণাগারে একই সাথে গবেষণা শুরু হয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের মধ্যে সমন্বয় ও তথ্যের আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করে। বিপুল পরিমাণ মানবসম্পদ ও অর্থসম্পদ এতে ব্যবহার করা হয় যা অভূতপূর্ব।
এর সঙ্গে এটাও যোগ করা দরকার যে রোগটি অতিমারীর চেহারা নেয়াতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় রোগী ও স্বেচ্ছাসেবক পাওয়ার ক্ষেত্রেও কোনও ঘাটতি ছিল না।
(২) পূর্বলব্ধ জ্ঞানের ব্যবহার--এই কোভিভ প্যান্ডামিকের জন্য দায়ী ভাইরাসটির নাম “সার্স কোভ দুই”। এরই সগোত্র ভাইরাস যার নাম “সার্স কোভ এক” সেটা ২০০৩ সালের মার্চ মাসে এপিডেমিক তৈরি করেছিল ও আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০০৩ সাল থেকে ওই সার্স কোভ ভাইরাস ও তার ভ্যাকসিন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টা এমন নয় যে মার্চ ২০২০-এর পরে গবেষণা শুরু হল। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ধরে এগোতে হয়। সেই পথে ২০০৩ সাল থেকে শুরু হওয়া গবেষণা লব্ধ জ্ঞান আমাদের কাজে লেগেছে কোভিভ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য।
(৩) পরিচিত প্রযুক্তির ব্যবহার— দুটি বহুল প্রচলিত ও পরিচিত কোভিভ ভ্যাকসিন যথা কোভিশিল্ড ও স্পুটনিক তৈরির জন্য “ভ্যাকসিন ভেক্টর” প্লাটফর্ম বা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে হয়ে যাওয়া ইবোলা আউটব্রেকের সময় থেকে ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা শুরু হয়েছিল ওই ভ্যাকসিন ভেক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সেটা সাফল্য পায় ২০১৯ সালে। ওই একই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শিম্পাঞ্জির এডেনো ভাইরাসকে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করে অক্সফোর্ড-এর গবেষকরা কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন তৈরিতে সফল হন।
(৪) রাজনৈতিক সদিচ্ছা – বিভিন্ন দেশের সরকার এই ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ ও যত্ন দেখান। এর ফলে প্রি-ক্লিনিক্যাল একটি ও ক্লিনিক্যাল যে তিনটি দশা ধরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলে তার আমলাতান্ত্রিক খবরদারির স্বভাবগত দীর্ঘসূত্রিতা অনেকটাই কাটিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
সবটা মিলিয়ে এত তাড়াতাড়ি উপযুক্ত টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। ভবিষ্যতের কোনো প্যান্ডেমিক অতিমারী রোগ মোকাবিলায় আমাদের কাজে লাগবে।
পাদটিকা:
আগ্রহী পাঠকদের জন্য ভেক্টর ভাইরাস প্ল্যাটফর্ম নিয়ে দু’লাইন:
সাধারণত যে যে পদ্ধতিতে টিকাকরণ হয় (শরীরে এন্টিজেন বা এন্টিবডি ঢুকিয়ে) তার থেকে এই ভাইরাস ভেক্টর প্রযুক্তি একেবারেই আলাদা। রোগ সৃষ্টিকারী মূল জীবাণু (এক্ষেত্রে সার্স কোভ দুই) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান (এ ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন তৈরির জেনেটিক কোড) অন্য একটি নিরীহ ভেক্টর ভাইরাস (এক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জির এডেনো ভাইরাস)-এর মাধ্যমে সুস্থ মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া। এর ফলে শরীরের কোষগুলি প্রচুর এন্টিজেন তৈরি করবে। শরীর আবার তার প্রতিক্রিয়ায় প্রচুর এন্টিবডি তৈরি করবে যেমনটা প্রাকৃতিক উপায়ে আসল ভাইরাস ঢুকলে হত। এই এন্টিবডিগুলি ভবিষ্যতে সংক্রমণ হলে তার সাথে লড়াই করে মানুষটিকে বাঁচবে।