সিস্টারদের টেবিলের একপাশে বসে প্রদীপ্ত আমাকে বোঝাচ্ছিল, ডাক্তারি পড়ার ফলে কিভাবে আমার ব্রেনটা আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী অতিরক্ত তথ্য হিপ্পোক্যাম্পাসের মেমরি কার্ডে জমা হওয়ার ফলে বাকি ব্রেন ক্রমশ স্লো হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সে যথারীতি রাজনীতিতে ঢুকে গেল। একগাল হেসে বলল, ‘ভাই ঐন্দ্রিল, আমাদের বাঁ দিকের মস্তিষ্কই কিন্তু বিজ্ঞান বা অঙ্কের যে যুক্তি তা পরিচালনা করে। তাই ভেবে দেখলে সব বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী মানুষই বামপন্থী।’
আমি বললাম, ‘আর ডান দিকের মস্তিষ্ক সংগীত, শিল্পকলা, সাহিত্য এই সব সূক্ষবোধের জন্য দায়ী। তাহলে তোর লজিক অনুযায়ী এই সব গুণ থাকলে তাকে বামপন্থী বলা যাবে না।’
আমাদের উল্টোদিকে কমবয়সী তিনজন ট্রেনি সিস্টার হাঁ করে মেডিসিনের দুই হাউসস্টাফের আঁতলামো শুনছিলেন। হঠাৎ সকলেরই ইন্টার্ন ছেলেটির ডাকে হুঁশ ফিরল।
নতুন ব্যাচের এই ইনটার্ন ভাইটি ভয়ংকর সিনসিয়ার। গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে ছোটাছুটি করে কাজ করে চলেছে। সে বলল, ‘দাদা, তেরো নম্বরকে দুবার ফুটিয়েছি। রক্ত আসছে না।’
প্রদীপ্ত বলল, ‘দুবারে আসেনিতো কি হয়েছে। আরেকবার ফোটা।’
আমি ইন্টার্ন ছেলেটিকে বললাম, ‘তুই অন্য কাজ কর। আমি রক্ত টেনে দিচ্ছি। তেরো নম্বর রোগী আবার পেনশন কেস। বাড়ির লোক হেব্বি খিটখিটে।’
প্রদীপ্ত বলল, ‘তুই এতো মনে রাখিস কি করে! আমি তো একটা গ্যাসপিং পেশেণ্টকে পেনশান বাবা ভেবে হেব্বি চাপ নিয়ে নিয়েছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সি পি আর দিলাম। রোগী মারা যাওয়ার বুঝলাম তিনি আসলে এলআইসি বাবা। ডেথ সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে বাড়ির লোকের আনন্দ আর ধরেনা।’
আমি সিরিঞ্জ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে তেরো নম্বর বেডের দিকে এগোচ্ছি, গাইনি ডিপার্টমেন্ট থেকে রেফার এসে হাজির। এর আগে আমি গাইনির হাউসস্টাফ ছিলাম। ইডেন হাসপাতালের বেড়ালগুলো পর্যন্ত আমাকে চেনে। আমাদের ইউনিট সিক্সের একটা অলিখিত নীতি হ’ল গাইনির রেফার এলে আমি চ্যটার্জী স্যারকে নিয়ে রেফার দেখতে যাব।
চ্যাটার্জী স্যারের কাছে আমি উঠতে বসতে গালি খাই। সেদিন সকালেও খেয়েছি। রোগী সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না দিতে পারায় স্যার সবার সামনে আমাকে ইউনিট সিক্সের ‘ঠিকে ঝি’ বলেছেন। অর্থাৎ আমি ঠিকে ঝির মত রোজ এসে মেডিসিনের ইউনিট সিক্সের কাজকর্ম করে যাই। কিন্তু ইউনিট সিক্স পরিবারের একজন হয়ে উঠতে পারিনি।
অপমানে চোখে জল আসব আসব করছিল, সে সময় আমাদের ইউনিটের আরেকজন প্রফেসর, ডাঃ মুখার্জী স্যার পিঠে হাত রেখে বলেছেন, ‘চ্যাটার্জীর কথায় কিছু মনে করিস না। ও যাকে বেশী ভালোবাসে তাকে বেশী গালি দেয়।’
যাই হোক, ঠিকে ঝি চ্যাটার্জী স্যারকে নিয়ে লেবার রুমে ঢুকল। লেবার রুমে অদ্ভুত গন্ধ। মায়েদের অ্যামনিওটিক ফ্লুয়িড, মল, মূত্র, রক্ত সব মিলে মিশে একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। সাধারণ মানুষের পক্ষে মিনিট খানেকের বেশী সহ্য করা মুশকিল। ছ’মাস গাইনিতে হাউসস্টাফশিপ করতে করতে গন্ধটাতে কেমন নেশা হয়ে গেছিল। বুক ভরে শ্বাস নিলাম।
একজন পিজিটি দিদি এগিয়ে এল। গাইনির বিখ্যাত চার্লিস এঞ্জেলদের একজন। চ্যটার্জী স্যার সংগে থাকায় ঘাবড়ালাম না।
একলামশিয়া রুমের শেষ বেডের রোগিণীকে দেখলাম। সম্পূর্ণ অজ্ঞান। হেপাটাইটিস ই তে আক্রান্ত।
হেপাটাইটিস ই একটি জল বাহিত ভাইরাস। এমনিতে এই ভাইরাস খুব বেশী ভয়ংকর নয়। আমার আপনার হলে সাধারণ জণ্ডিস করবে। দিন দশবারো বিশ্রাম নিলে আর হাল্কা খাওয়াদাওয়া করলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু গর্ভে সন্তান থাকা অবস্থায় এক অজানা কারণে এই ভাইরাস প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
এই মেয়েটিকেও ভাইরাস ভালোরকম বাগে পেয়েছে। মেয়েটির হেপাটিক এনকেফালোপ্যাথি হয়ে গেছে। রোগীদের গ্যাস হামেশাই মাথায় ওঠে। এই মেয়েটির প্রকৃত প্রস্তাবেই অ্যামোনিয়া গ্যাস মাথায় ওঠেছে।
চ্যাটার্জী স্যার সেই চার্লিস অ্যাঞ্জেলকে জিজ্ঞসা করলেন, ‘কদ্দিন অজ্ঞান?’
‘স্যার, ডেলিভারি তিন দিন পহেলে হো গিয়া। উসকে বাদ সে বেহুঁশ হ্যায়। কনভালশানও হো রহা হ্যায়।’
‘তোমরা কি চিকিৎসা করেছ?’
‘স্যার, সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট। এন্টিবায়োটিক, পি পি আই আর ল্যাকটুলোজ।’
‘রাইলস টিউব কোথায়। খাচ্ছে কি করে?’
‘স্যার, রাইলস টিউব তো ছিল। লাগছে খুল গেছে। এ সঞ্জীব, পাঁচ এম্পুল ম্যাগসালফ রেডি কর দে ভাই। তিন নাম্বার কো টাইম হো গিয়া।’
চার্লিস অ্যাঞ্জেল লেবার রুমের বাতাসে সুগন্ধের হিল্লোল তুলে চলে গেল। চ্যাটার্জীস্যার বললেন, ‘ঐন্দ্রিল, এই পেশেন্টকে মেডিসিনে ট্র্যান্সফার কর।’
‘স্যার, সেটা কি উচিৎ হবে। ম্যাটার্নাল মর্টালিটি নিয়ে খুব হই চই চলছে। কোনো মা মারা গেলেই স্বাস্থ্য ভবন থেকে টিম এসে ডাক্তারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দিচ্ছে।’
চ্যাটার্জী স্যার শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর কি এঁকে দেখে মৃত বলে মনে হচ্ছে। এই নেগেটিভ চিন্তাধারা নিয়ে চিকিৎসা করবি কি করে? তুই সত্যিই ঠিকে ঝি।’
সে রোগিণী তো মেডিসিনে শিফট হয়ে গেল। সমস্যা শুরু হ’ল তারপর। মেয়েটির সাতকুলে কেউ নেই এক অন্ধ স্বামী ছাড়া। তাঁদের ঘর দোর নেই। থাকে মেডিক্যাল কলেজের পাঁচিলের গায়ে। মেয়েটিও অন্ধ। দুজনে ভিক্ষা করে খায়।
মেয়েটির বরের আবার নামের বাহার আছে। সফিউদ্দিন আহমেদ। কিছু বললেই মিটি মিটি করে হাসে। জামা কাপড় আনতে বলায় একটা বোরখা এনে দিল। আর কিচ্ছু না।
অজ্ঞান রোগী। নার্সিং কেয়ার ভালো হওয়া দরকার। তাছাড়া রাইলস টিউব দিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাওয়াতে হবে। ওষুধ গুঁড়ো করে খাওয়াতে হবে। ওদিকে মেয়েটির অন্ধ বর হাত তুলে দিয়েছে। আয়া রাখতে পারবে না। সব সময় থাকার মতো কোনো মহিলা আত্মীয়ও নেই।
বস্তুত এই অন্ধ ভিখারি দম্পতির কোনো আত্মীয় স্বজনই নেই। এতোদিন তাঁরা দুজন ছিল। এখন তিন জন হয়েছে। নব জাতক মেয়েটি আছে নার্সারিতে।
পরেরদিন চ্যাটার্জী স্যার আসার আগে নিজেই একবার রাউন্ড দিচ্ছি; সিস্টার দিদি বললেন, ‘আপনাদের ঐ নতুন পেশেন্টটার ভাগ্য দেখুন। নিজের বাচ্চাটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে পেল না। যা অবস্থা, বাঁচবে কিনা সন্দেহ।’
আমি চ্যটার্জী স্যারের মত ঘ্যাম নিয়ে বললাম, ‘এতো নেগেটিভ চিন্তাধারা নিয়ে আপনি সিস্টার হলেন কি করে?’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললাম, ‘অবশ্য মেয়েটি ভালো হয়ে গেলেও কোনও দিনও নিজের সন্তানকে দেখতে পাবে না, কারণ মেয়েটি অন্ধ।’
আমার সাথে সাথে সেই ভয়ংকর সিনসিয়ার ইনটার্ন ভাইটিও রোগী দেখছিল। আমার কথা শুনে ওর মুখ করুণ হয়ে উঠল। চিকিৎসক যদি এতো বেশী সিনসিয়ার আর ইমোশানাল হয়, তাহলে পরবর্তী কালে তাঁর কপালে যথেষ্ট দুঃখ আছে।
ভাইটি বলল, ‘দাদা, পেশেন্টটির কি হবে? এর সাথে কেউ থাকছে না। আবার মাসিও রাখেনি। তাহলে রাইলস টিউব দিয়ে এঁকে কে খাওয়াবে?’
বললাম, ‘মাসিদেরই কাউকে ধরতে হবে। যাতে চারবেলা খাবার আর ওষুধপত্র গুলো খাইয়ে দেয় আর রোগীকে দিনে একবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দেয়। দরকার হলে চাঁদা তুলে মাসিকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দেওয়া যাবে।’
সেদিন ইভিনিং রাউণ্ডে এসে দেখি ইনটার্ন ভাইটি রাইলস টিউব দিয়ে রোগীটিকে খাওয়াচ্ছে। আমায় দেখে বলল, ‘দাদা, কেউ সারাদিনে এক ফোঁটা জলও খাওয়ায় নি। ওষুধ পত্রও কিছু পরেনি।’
সে মেয়েটির দায়িত্ব নিয়ে নিল। দু ঘণ্টা বাদে বাদে মেয়েটিকে লিকুইড খাবার খাইয়ে যাচ্ছে। ছিপি মেপে মেপে ল্যাকটুলোজ খাওয়াচ্ছে। এ ধরণের রোগী ঘন ঘন পাতলা পায়খানা করে। ছেলেটি দুই হাতে গ্লাভস পরে গজ দিয়ে অম্লান বদনে সেই পায়খানা পরিষ্কার করছে। বলতে নেই এবার ইনটার্ন ভাইটিকে দেখে হিংসাই হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমি কেন এমন হতে পারলাম না।
প্রথম প্রথম সবাই ছেলেটির কাজকর্ম দেখে ভুরু কুঁচকাচ্ছিল। বাড়াবাড়ি বলছিল। আড়ালে হাসাহাসি করছিল। কিন্তু কেউ যদি আন্তরিক ভাবে কোনো কাজ করে, আস্তে আস্তে সবাই তা বুঝতে পারে।
দু তিনদিন বাদেই আয়ারা, ট্রেনি সিস্টাররা, অন্য ইনটার্নরা এগিয়ে এলেন। ফলে ছেলেটির চাপ অনেক কমল। কিন্তু এ ছেলে অন্য ধাতুর। সে পাশের বেডের আরেক ভবঘুরের পোকা ভর্তি পায়ের ঘা থেকে পোকা বেছে রোজ দুবেলা ড্রেসিং করতে শুরু করল। গন্ধে ওয়ার্ডে সবাই ওয়াক ওয়াক করছে। একমাত্র তারই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
মেয়েটির লিভারের অবস্থা খুবই খারাপ। পেটে জল জমে গেছে। ছেলেটি রোজ সন্ধ্যায় ব্লাড ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করে চার ইউনিট প্লাজমা জোগাড় করে আনে। মেডিকেল রিপ্রজেণ্টিভদের কাছে ভিখারির মতো ল্যাকটুলোজের স্যাম্পেল চায়। সে একার চেষ্টায় অন্ধ মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখে।
অবশেষে যেন তাঁর চেষ্টাকেই সম্মান দিতে মেয়েটির জ্ঞান ফিরে আসে। সে খাওয়াদাওয়া শুরু করে এবং দিন পাঁচেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়।
ইনটার্ন ভাইটি প্রথম বার হাতে মাইনে পায়, চার হাজার তিনশ টাকা। সেই সামান্য টাকা থেকে মেয়েটির জন্য দুটো নাইটি কিনে আনে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদা, মুসলমানদের বোরখা কোন দোকানে পাওয়া যায়। ছুটির সময় তাহলে একটা দিতাম।’
আমি বললাম, ‘প্রথমবার মাইনে পেয়ে সবাই বাবা মাকে কিছু দেয়। আর তুই…’
ছেলেটি বলল, ‘বাবা মাকে এখন কোথায় পাব। কুচবিহারের গ্রামে ফেরা কমিনিটি মেডিসিনে রোটেশান শুরু না হওয়া পর্যন্ত সম্ভব নয়। আর এই কাজে বাবা মা নিশ্চিত গর্বিতই হবেন।’
গর্বিত তো হবেনই। এক বছরের সিনিয়ার দাদা হিসাবে আমারই গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে।
অবশেষে মেয়েটির ডিসচার্জ হ’ল। নার্সারি থেকে তার মেয়েরও ছুটি হ’ল। মেয়েটির স্বামী লাঠি নিয়ে ঠুক ঠুক করে সিস্টারদের টেবিলে গিয়ে টিপছাপ দিয়ে ছুটি নিল।
যাওয়ার সময় মেয়েটি ইনটার্নটির হাত ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি সব দিদির যেনো তোমার মত ভাই থাকে। আমাদের আস্তানা একবার দেখে এসো ভাই।’
ছোটো মেয়েটিকে কোলে নিয়ে তাঁরা দুজনে হাতড়ে হাতড়ে ফিরে চলল রাস্তার সংসারে।
তারপর কেটে গেছে তেরো বছর। সেই ইনটার্ন ছেলেটি পরে মেডিসিনেই এম ডি করে। তারপর কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তারি করার চেষ্টা করে অবশেষে দিল্লী চলে যায়। ফোনে কথা হয়। বলে দাদা, ‘এখানেও পরিস্থিতি ভালো নয়। কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গলের থেকে ভালো। অন্তত পরিশ্রমের মূল্য পাই। আমি আর ফিরব না। বাবা মাকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।’
আমি আর প্রদীপ্ত দুজনেই দীর্ঘ এগারো বছর সরকারি চাকরী করে বর্তমানে বেকার। জীবন সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি অনেক পাল্টেছে। অনেক হিসেব করে কাজ করি। সমাজকে সন্দেহের চোখে দেখি।
কিন্তু কিছু জিনিস একই রয়ে গেছে। আমরা এখনো রোগীর পদবি দেখে চিকিৎসা করিনা। শুধু পদবী কেন, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা চিকিৎসা শুরুর পরে এসব কিছুই মনে থাকে না।
আর মৃতপ্রায় রোগী সুস্থ হতে দেখার আনন্দও তেরো বছর আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে।
২০১৯-এ জুনিয়ার ডাক্তারদের এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের সময় লেখা।