২৮ শে মে,২০১০ সাল। ভোর রাত্রে মেদিনীপুর মেডিক্যাল হস্টেলে শুরু হলো ছোটাছুটি। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনা। প্রিন্সিপাল স্যার সমস্ত জুনিয়র চিকিৎসকেদের তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়েছেন হাসপাতালের বি.সি.রায় ব্লকে। আমি আর দেবদীপ চোখ মুছে ছুট দিলাম।
হাসপাতাল চত্ত্বর লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে রক্ত মাখা স্ট্রেচারে দিগবিদিক শূন্য ভাবে ছুটে চলেছে ফালা ফালা দেহাংশ। কান্না আর আর্তনাদে আমাদের অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত কচি মননের দফারফা। ভয়াবহ বাস্তবতায় চটক ভাঙ্গল রক্তের নুনচে ছিটে অবাক হওয়া মুখে পড়ার পর।
বছর সতেরোর এক তরুণীর এক হাতের তর্জনী আর মধ্যমা সমেত বেশ কিছুটা অংশ ঝুলে পড়ে আছে। তখনও ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে একটু চাপ মুক্ত হলেই। “ডাক্তারবাবু,তাড়াতাড়ি কিছু করুন”। তরুণীর মায়ের চিৎকারে সম্বিত ফিরলো আমাদের। তখনও পেশাদার চিকিৎসক নই আমরা। চিকিৎসক ছাত্র মাত্র। সিনিয়র সবাই রীতিমতো ছুটছেন তখন। কাউকে পাবো না বুঝে অনভিজ্ঞ হাতেই শুরু করলাম চিকিৎসা। শুরু হলো আমাদের সত্যিকারের “চিকিৎসক” হবার হাতেখড়ি।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। ধমনী কেটেছে। রাত দেড়টায় দুর্ঘটনার পর থেকে দমকে দমকে বেরোচ্ছে রক্ত। তরুণী তখন প্রায় বেহুঁশ।
তরুণীর কেটে যাওয়া জায়গাটা হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিমায় চেপে ধরলাম বেশ জোরের সাথে। রক্তপাত রোধে এ পদ্ধতি অতি প্রাথমিক ও আবশ্যিক পদ্ধতি। প্রায় না থাকা হাতের ছিন্নাংশে আমার অনভ্যস্ত অত্যুৎসাহি চাপের ঠেলায় রক্ত আর বেরোনোর পথ পেলো না ঠিকই। কিন্তু অতিযন্ত্রনার ক্লেশে অতিপ্রাকৃত এ চাপ তরূনীর মুখে আলাদা কোনো যন্ত্রণা তৈরী করলো না।
বার কয়েকের চেষ্টায় কনুইয়ের এক শিরায় স্যালাইন চালানো গেলো।
ততক্ষণে কেটে যাওয়া হাতের ওপরের অংশে চাপ দিয়ে গজ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে দেবদীপ। রক্ত আর বেরোচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু এতক্ষণের রক্তপাতে ফ্যাকাশে তরুণী প্রায় মৃত্যুমুখী। হাতে নিডল আর সেলাইয়ের সুতো নিয়ে অপারদর্শী হাতে সেলাইয়ে মন দিয়েছি আমি। রক্ত বন্ধ করতেই হবে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থিকথিক করছে ভিড় আর রক্তমাখা দেহাংশের আর্তনাদ। ইত্যবসরে আমাদের মুক্তি দিয়ে এগিয়ে এলো সিনিয়র চিকিৎসক সুমন্ত্রদা। অপারেশান থিয়েটারে ঢুকলো তরুণী।রক্তমাখা গ্লাভস খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্সিপালের নির্দেশে আহত রোগীদের লিষ্ট বানাতে চললাম আমরা।
শিরার কেটে যাওয়া ধমনীর কেটে যাওয়ার মত মারাত্মক না হলেও দুই ক্ষেত্রেই প্রাথমিক চিকিৎসা হলো কেটে যাওয়া জায়গাটা অন্তত মিনিট দশেক চেপে ধরে রাখা। উপায় থাকলে বাড়িতে থাকা চিনি, বরফ দিয়ে জায়গাটি চেপে ধরে হৃৎযন্ত্রের থেকে ওপরে জায়গাটা তুলে ধরে রাখুন যাতে রক্ত চলাচল ঐ জায়গায় কম হয়। রক্ত বন্ধ হয়েছে কি হয়নি পরীক্ষা করে দেখার জন্য বারেবারে চাপ ছেড়ে দেখতে থাকলে রক্তপাত বন্ধ হবে না।
কোনো দেহাংশ কেটে অঙ্গচ্যুত হলে দেহাংশটি বরফশীতল পরিষ্কার জলে ডুবিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। মনে রাখবেন, কেটে যাওয়া অংশে চাপ দিয়ে রক্ত বন্ধ না করতে পারলে অতিরিক্ত রক্তপাতে রক্তের আয়তন কমে গিয়ে হাইপোভলিমিক শক হেতু প্রাণহানিও ঘটতে পারে। তাই ক্ষতস্থানে চাপ দেওয়া প্রাথমিক ও আবশ্যিক পদ্ধতি। এরপর চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়াই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সাহায্য করবে।
জ্ঞানেশ্বরীর ভয়াবহতা কচিমনে দীর্ঘমেয়াদি রক্তাক্ত প্রভাব ফেললেও চিকিৎসক হবার পথে চোয়াল শক্ত করেছিল আমাদের। পরের দিনে ঐ তরুণের ফ্যাকাসে হাসিমুখের এককোণে আমাদের ছোট্ট প্রচেষ্টা কোথাও যেন তৃপ্তির জায়গা করে নিয়েছিলো। সেই পথে পাড়ি দিয়েই দেবদীপ আজ এয়ারফোর্সের দৃঢ় চিকিৎসক। আর আমি আরও তৃপ্তির খোঁজে।