গলায় একখান মস্ত ফুটো করে রাখা। তাইতে সেঁধিয়ে আছে একখানি প্লাস্টিক পাইপ। কথা বলতে গেলেই সেখান দিয়ে হাওয়া বেরিয়ে যায় ফসফস আর শুনতে লাগে অনেকটা–” খচ, খচখচির খচিছা খচছি…।”
ট্রাকিওস্টমি। শ্বাসনালীতে কৃত্রিম ফুটো ক’রে তৈয়ার করে রাখা প্রাণবায়ু আহরণের বিকল্প ব্যবস্থা। টেম্পুররি হতে পারে… অথবা ভাগ্যের ফেরে দীর্ঘস্থায়ী। বস্তুত, এ জিনিস যার হয়েছে সেই জানে কেবলমাত্র। যিনি করেছেন এমনকি তিনিও জানেন না কিস্যু। কেতাবি বুলিটুকুই কপচাতে পারেন স্রেফ। এই যেমন আমি নিজেই কপচাচ্ছি এই লেখাটিতে; এবং বুঝে উঠবার চেষ্টা করছি– ঠিক কী বলছেন এই সম্মুখস্থিত ভদ্রলোকটি। মাথায় যাঁর সস্তার ক্যাপ টুপি। পড়ে যাওয়া চুলকে লুকিয়ে রেখে, সুন্দর হয়ে থাকার তামাদি প্রচেষ্টা। সঙ্গে, ঢোলা শার্ট। লিভার পচতে শুরু করেছে। শুরু হতে করেছে বৃহদাকায়। সেইটা লুকিয়ে রাখার জোগাড় যন্তর। আর, রোদচশমা। ধুঁয়াশা ভরপুর ফেব্রুয়ারি আউটডোর উত্তরবঙ্গীয়তে। অথচ চোখের নিচে মৃত্যুর সুস্পষ্ট চিহ্ন থাবা বসিয়েছে না? এবং এই সমস্ত ছদ্মবেশ সমেত একজন মানুষ…সে যেন অদৃশ্য মানব অথবা এইচ জি ওয়েলস-এর দ্য ইনভিজিবল ম্যান… সহসা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে –অকিঞ্চিৎকর এই হাত -পা-নখ-দাঁত ওয়ালা বেঁচে থাকাটাও কতটা অসামান্য। কতখানি প্রত্যাশার। আর তাই সমস্ত গুপিচুপি দিয়ে ঢেকে ঢুকে প্রশ্ন করছে উদগ্র স্বরে -“খচ, খচখচির খচিছা খচছি…।”
ক্ষণিকের ভুল। যেটিকে পরমুহূর্তেই শুধরে নিয়ে গলার পাইপে এক আঙুল দিয়ে চেপে ধরলেন পরাজিত লোকটি। ট্রাকিওস্টমি পেশেন্টের স্পিচ থেরাপি সেশন লব্ধ জ্ঞান। কথা বলবার সময় বন্ধ করে দিতে হবে কৃত্রিম শ্বাসের পথটিকে। এবং এ পদ্ধতিতেই আজ, এ মুহূর্তে উচ্চারিত হবে এ বিশ্বসংসারের সর্বোৎকৃষ্ট প্রেমের বাণীটি। আমার চারিপাশে থেমে যাবে সময়। স্তব্ধ হবে বেনেবউয়ের ডাক। অস্পষ্ট হবে বিনোদের হাত নেড়ে নেড়ে বলা-– “মৌচাক ভাঙার লোক পাইছি সার। ওই যে মোচাক হইছে না ফিমেল ঘরে।” এবং জেগে থাকবে শুধু অসহায় এবং শুদ্ধতম প্রেম নিবেদন। এই পাঁচপেঁচির সরকারি আউটডোরে।
“স্যার রণবীরেরর পরীক্ষা অব্দি…?”
প্রশ্নকর্তা–পিতা। রণবীর পুত্র তাঁরই। প্রশ্নকর্তা ক্যানসার রোগাক্রান্ত। নিজেই বুঝেছেন সময় ঘনিয়ে এসেছে এইবারে। অথচ সন্তানের পরীক্ষা।
প্রকৃতি সর্বদাই বড় নিরাসক্ত ভাবে নিত্য নতুন ক্রীড়া করে চলেন ক্রীড়নকদের নিয়ে। এই ঘটনাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এই যে এই রণবীর নামক পুত্রটি এখন যে পাঠে রত, সেটি ডাক্তারি। পাঠ্যক্রমের এইটিই শেষ পরীক্ষা। পাস পাইলেই চিকিৎসকের তকমা জুটবে সরকারি সীলমোহর সমেত। এবং তারই পিতা মরে যাবেন খুব শিগগিরই। আর মরে যাওয়ার আগে নিশ্চিত করতে চাইছেন শুধু এটুকুই– যেন তাঁর মৃত্য কোনোভাবেই ঘটিত না হয় পুত্রের পরীক্ষা কালীন।
অথচ পুত্র?
সে পুত্র এখন লড়াই শেষে পড়তে বসেছে বারমুডা গুটিয়ে। কোন সে লড়াই? লড়াই সামান্যই। রক্তচক্ষু সরকার যেন ভয়ের বাতাবরণ তৈয়ার করে বছরের পর বছর ধরে স্থগিত রেখে দিতে না পারে কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশন। এবং বকলমে সকল প্রকার রাশ ধরে রেখে দিতে না পারে নিজের নির্লজ্জ মুষ্ঠিতে।
সে লড়াইতে জিতেছে সেই পুত্র। জিতে গেছে দিন সাতেকের অনশনের শেষে। এশিয়ায় প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজ আবার পেয়ে গেছে এই নগ্ন সময়েও অবাধ -ইলেকশন। যে ইলেকশনের সুফল ভোগ করছে অজস্র বালিতে মুখ গুঁজে থাকা কৃমিকীট। ইউনিয়ান লড়াই করছে যাদের হয়ে পর্যাপ্ত ক্যাডাভারের। যাতে সক্কলে সমান ভাবে শিখে নিতে পারে শব ব্যবচ্ছেদ। লড়াই করেছে পর্যাপ্ত হোস্টেলের। যাতে ক্ষমতায় থাকা পার্টিটির দলভৃত্য না হলেও যোগ্য ছাত্র পায় আবাসনের অধিকার। অথবা অর্থকরী ভাবে পিছিয়ে পড়া স্টুডেন্ট নাম মাত্র মূল্যে পেয়ে যায় পুরোনো স্কলারদের নোটস। এদের কিছু এসে যায়নি। এদের…অর্থাৎ এই যে এই সুফল ভোগকরা ছাত্রছাত্রীদের। এরা, ফিরেও তাকায়নি রণবীরের মতো লড়াই করা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে। বরং এদের জীবন নির্লজ্জ আহ্লাদের। এদের বাবা মা বড় আনন্দে বলেছে – দশ টাকাতেই নোটস পেয়ে গেলি বাবু?
এদের প্রেমিক/প্রেমিকারা আদরে উৎফুল্ল হতে হতে বলেছে– ভাগ্যিস তুই হোস্টেলে ঘর পেলি বল? এদের আত্মীয়রা পিঠ চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে মুগ্ধ স্বরে বলেছে– ডিসেক্সন শিখে গেলি? ফাইন্যালি? বাঃ।
কেউ দেখতে যায়নি খতিয়ে যে, যেকোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে কোনকিছু যদি ছিনিয়ে আনতে হয়…যদি চোখে আঙুল দিয়ে সরকার-পক্ষকে প্রশ্ন করতে হয়–ব্যবস্থা কেন এত বেসামাল, তাহলে…তবে বুকে আশ্চর্য ধক রাখতে হয় দামাল এবং দপদপে। এতটাই দপদপে, এতখানিই দামাল যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়তে হয় আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ। ভুলে যেতে হয় যে বাড়িতে অসুস্থ বাপ আছে, ফোনের ওপারে ডিপি পাল্টানো প্রেমিকা আছে আর আছে ধামাধারী শিক্ষকের দল; যারা প্রস্তুত হচ্ছেন এই সরকার -বিরোধী ছেলে/মেয়েটিকে পরীক্ষায় ফেল করাবেন ব’লে। স্রেফ সরকারের নেক নজরে থেকে যেতে পারবেন ব’লে।
চমৎকার কিছুমাত্র নয়। এ ঘটনা বারে বার ঘটে এসেছে। দশকের পর দশকে। বছরের পর বছরে। বারেবারে। আঠারো বছরের আশ্চর্য বয়সীরা তাবৎ-সমস্ত ভুলে গিয়ে শানিয়ে নিয়েছে গান্ডিব। হয়ত পরবর্তীতে তারা হয়েছে নির্লজ্জ চটি চাটা। অথবা গেরস্ত ছাপোষা। কিন্তু সেইটাই শেষ কথা নয়। সেটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। জরুরি এইটাই…মনে রেখে দেওয়া দরকার এইটাই যে… তারা একদা লড়েছিল। লড়াই করেছিল অকুতোভয়। প্রাপ্য বুঝে নিয়েছিল বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে। যে বাহ্যে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আকুল মাতা, অসহায় পিতা এবং প্রিয় রমণী। চটি চাটা হলেও তাই তারা মরবার আগে আগে পেরে যাবে তৃপ্ত হতে। পারবে ভাবতে যে পেরেছিলাম। একদা। এ বাদে বাকি সমস্ত মানুষ, সকল পুরুষ এবং নারী স্রেফ জন্তু। আহার নিদ্রা এবং তুমুল মৈথুনে ব্যস্ত কৃমিকীট। এরা জন্মায় এবং মরে। এরা নির্লজ্জ প্রস্ফুটিত হয় এবং বেমালুম ঝরে পড়ে। কিন্তু এতটুকুও দাগ রেখে যায় না জগতে। সে দাগ যতই ক্ষীণ হোক না কেন! দাগ তো আচ্ছে হ্যায়! তাই না?
এবং আজ আমার সামনে ভেঙে পড়েন ট্র্যাকিওস্টমি পিতা। – ওর পরীক্ষা অব্দি বাঁচব? পরীক্ষা নষ্ট হয়ে যাবে না তো? ওর? আচ্ছা, ও… জিজ্ঞেস করে? আমি কেমন আছি? স্যার? করে? ওকে বলবেন না যেন… বলবেন না কিন্তু! যে আমি…।
এ প্রকারেই ঝরে ঝরে পড়ে বাক্য। ঝরে ঝরে পড়ে লুকিয়ে রাখা শিউরে ওঠা অনুচ্চারিত দুরাশা।– ও পরীক্ষা বাদ দিয়ে আসবে না বলুন? পলিটিক্স ছেড়ে? আমার কাছে? …না না…ও বড় হোক। অনেক অনেক বড়।
এরও মুহূর্ত খানিক পরে ধীরপদে চলে যান সস্তা টুপি, ঢোলা প্যান্ট, রোদচশমা ভদ্রলোক। যার আরেক নাম পিতা। চলে যান পরাজিত অথবা নিশ্চিন্ত হয়ে। ছেলে ভালো আছে। ছেলে… ভুলে গেছে আমাকে। পেরেছে এগিয়ে যেতে।
( ◆ রণবীরের ফাইন্যাল এম বি বি এস পরীক্ষা দুয়ারে কড়া নাড়ছে এখন।
রণবীর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের বৈধ ইলেকশনকে বছর সাতেক পরে আবার বাস্তবে পরিণত করেছে বন্ধুদের সাথে হাত মিলিয়ে।
◆ আমার বাবার হার্ট এটাক হয়েছিল আমার সেকেন্ড এম বি বি এস পরীক্ষার সতেরো দিন আগে। তখন আমি বন্ধুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বামপন্থী সরকার পক্ষের হুলিগ্যানদের হারিয়ে দিয়ে বিজয় উৎসব পালন শেষ করেছি সদ্য। পড়তে বসেছি বারমুডা গুটিয়ে। বাবা হাসপাতালে ভর্তি ছিল একথা জানতে পেয়েছিলাম বাবার ছুটি হওয়ার এক মাস পর। যেদিন লাস্ট পরীক্ষা শেষে, আকণ্ঠ মদ খেয়ে ফোন করেছিলাম বাড়িতে।
◆ লেখাটা কয়েকদিন আগেকার। পোস্ট করতে ভয় পাচ্ছিলাম। রণবীর আহত হবে ভেবে। আজ সেসবের বালাই নেই। ভদ্রলোক মারা গেছেন।
◆এই শোন রণবীর, পড়বি। পড়তে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে। ব্যাস। এর বাইরে আর কিচ্ছু ভাববি না। নয়ত… আমি ত্যাজ্যভ্রাতা করব। মাক্কালী।
I swear…করবই )
ছবিটা, বছর পাঁচেক আগেকার। রণবীর, মেডিক্যালে চান্স পেল যখন।