মানুষ বলতে হোমো সেপিয়েন্স কী খায় সেটা আমরা মূলত দুটি লাইন অফ এভিডেন্স থেকে পেতে পারি।
প্রথম এভিডেন্স এখনকার মানুষ কী খাচ্ছে সেটা দেখা। এর দুটো ভাগ আছে। আমরা যাকে সভ্যতা বলে অভিহিত করি সেই সভ্যতার মানুষেরা কী কী খাচ্ছে। আর আমরা যাকে সভ্যতার আগের স্তর বলে অভিহিত করি সেই শিকারী সংগ্রাহক মানুষেরা কী কী খাচ্ছেন। দ্বিতীয় দলের মানুষেরা শিকারি সংগ্রাহক। তার মধ্যে ভারতবর্ষের অনেকগুলি জনজাতি আছে, সব থেকে পরিচিত নাম বোধ হয় আন্দামানের জারোয়া।
দ্বিতীয় এভিডেন্স হল আগের যুগের মানুষ কী খেত। আগের যুগের মানুষকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি, ইতিহাসে লেখা হয়েছে যে মানুষের কথা এবং তার আগেকর বা প্রাগিতিহাসের মানুষের কথা। এদের মধ্যে ইতিহাসে লেখা মানুষের খাবার নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। তারা মাছ মাংস ডিম কাঁকড়া কচ্ছপ ইত্যাদি নানারকম ইত্যাদি নানা রকমের আমিষ খেয়েছে। আবার মাঝেমধ্যে মূলত সংস্কৃতিক কারণে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী আমিষ খাওয়া কমবেশি বন্ধ করেছে।
ইতিহাস লেখা শুরু হওয়ার আগের যে মানুষ তাদের মধ্যে শেষদিকে এসেছে কৃষিকাজ করা মানুষ, তারা মোটামুটিভাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ কৃষিসভ্যতার মানুষের মতন খাবার দাবার খেয়েছে। কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সের উদ্ভবের পর থেকে এই প্রজাতির জীবনের বড় অংশটাই কেটেছে অরণ্যচারী শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে। এই শিকারি সংগ্রাহক জীবন হল সেপিয়েনসের environment of evolutionary adaptedness, বাংলায় একে আমরা বিবর্তনগত অভিযোজনের পরিবেশ বলতে পারি। অর্থাৎ মানুষ মোটামুটি তিন লক্ষ বছর আগে প্রথম উদ্ভূত হয়ে তারপরে দু লক্ষ নব্বই হাজারেরও বেশি বছর সময় ধরে মানুষ হয়ে উঠেছে, আর এই সময়টাতেই তার দেহ মন বিপাক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে। তারপর কৃষির উদ্ভবের পরেও কিছু কিছু অভিযোজন হয়েছে, কিন্তু তার গুরুত্ব ও পরিমান কম।
এ কথাটা এত বড় করে বলার কারণ এই যে, প্রশ্ন হল, মানুষ “মূলত” কী রকম। যখন মানুষ শিকারি সংগ্রহক হিসেবে জীবন কাটাচ্ছিল, তখন সেই মূল গড়ে উঠেছিল।
তারা যে সে সময়ে শিকার করত, সেটা তাদের হাতিয়ারের সাক্ষ্য থেকে পাওয়া গেছে, এছাড়াও তাদের দাঁতের উপরে খাদ্যের আঁচড় থেকে বিশ্লেষণ করে জানা গেছে। তারা যে বিভিন্ন ফল কন্দ মূল কুড়িয়ে বা জোগাড় করে খেত সেটাও একই ভাবে জানা গেছে, তবে উদ্ভিজ্জ খাদ্যের জোগাড় করার জন্য যে হাতিয়ার সেগুলো খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার কারণ হলো সেগুলো ছিল মূলত গাছের ডাল জাতীয় জিনিস, সেগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যায় না।
এ হল প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এছাড়া আমাদের শিকারি সংগ্রাহক প্রাচীন পূর্বসূরীরা কেমন খাবার খেত, তা ঠিক করার জন্য বিজ্ঞানীরা এক রকম অনুমান করেছেন। তারা ভেবেছেন, আজকের শিকারি সংগ্রাহক যে সমস্ত জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মত খাবারই আমাদের প্রাচীন পূর্বসূরীরা খেত।
আজকের এই আধুনিক শিকারি সংগ্রাহক জনগোষ্ঠীগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বিগত ২ শতক ধরে এদের সম্পর্কে নানা রকম তথ্য অনেক বিজ্ঞানী এবং অভিযাত্রী লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তার মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত হল জর্জ মার্ডক এর এথনোগ্রাফিক অ্যাটলাস। তাতে অনেক ভুল আছে এবং অসম্পূর্ণতাও আছে, তা সত্ত্বেও এটা এক বিরাট তথ্যের সূত্র। মারডকের তথ্য যারা জোগাড় করে এনেছিলেন তাদের প্রশিক্ষণ ছিল না, ফলে একটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রকার খাদ্যকে সঠিকভাবে ক্লাসিফাই করা হয়নি। তাতে নানা রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্যের ফ্যাড ডায়েট প্যালিওডায়েট, তা মারডকের এটলাসের ভুল বোঝার উপরে অনেকটা দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাতে মাংস এবং চর্বি খুব বেশি করে খাবার কথা বলা হয়েছে।
পরে অবশ্য মারডকের আটলাস আরেকটু ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, এবং তাতে দেখা যায়, নিরক্ষরেখা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানের, বা বিগত দু একশ বছরের , শিকারি সংগ্রাহকরা তাদের মোট খাদ্যের ষাট শতাংশ উদ্ভিজ্জ খাদ্য খেয়েছে, বাকিটা প্রাণিজ। মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি এই হিসেব উল্টে গেছে। সেখানে শিকারি সংগ্রাহকেরা প্রাণিজ ফ্যাট এবং মাংস অনেক বেশি খেয়েছে, তার কারণ সেখানে উদ্ভিজ্জ খাদ্য বিশেষ পাওয়া যায় না।
এই তথ্যগুলো বিজ্ঞানী হারম্যান পঞ্জার মার্ডকের অ্যাটলাস বিশ্লেষণ করে প্রায় অকাট্যভাবে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। তারপরে তার মন্তব্য হল, মানবজাতি সুযোগসন্ধানী সর্বভুক প্রাণী হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। তারা যেখানে যেরকম খাবার পেয়েছে সেরকম খেয়েছে, কিন্তু তাদের শরীরে উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণিজ উভয় রকম খাদ্যকে বিপাক করার ব্যবস্থা রয়েছে এবং উভয়রকম খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
অনেক লম্বা হয়ে গেল। এখানেই শেষ করছি।
খুব ভালো লেখা। আরো কিছু জানার ইচ্ছে ছিল।