ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের সুস্থ থাকার মূল মন্ত্র। আমাদের ইমিউনিটি নির্ভর করে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ, কলার সুস্থতা এবং পুষ্টিকর প্রোটিন যুক্ত খাদ্য খাবারের উপরে। শরীরের বিভিন্ন ধরনের কোষ-কলা আক্রমনকারী নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য রোগ জীবাণুকে ধংস করে শরীর সুস্থ রাখে।
যখন কোনও রোগের জীবাণু শরীরের সংস্পর্শে আসে, তখন শরীর তার বিরুদ্ধে ‘এন্টিবডি’ তৈরি করে, এই এন্টিবডি জীবাণু ধংস করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখে। এন্টিবডি এক ধরনের প্রোটিন।
বিশেষ কিছু কিছু খাবার আমাদের শরীরের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। তারা শরীরের কোষ-কলাকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করে এবং কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে। তাই সুস্থ ভাবে বাঁচতে গেলে ইমিউনিটি ঠিক রাখতে হবে এবং এই সব খাবার কিছু না কিছু আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। তবে তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে, সব ধরনের খাবার খেতে হবে। ‘ব্যালেন্স ডায়েট’ আমাদের শারীরিক সুস্থতার জন্য জরুরি।
১। ব্লু বেরি
বেরি বা জাম জাতীয় খাদ্য ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। বেরিতে থাকে এনথ্রোসায়ানিন নামক এক ধরনের ফ্লাভোনয়েড, যা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের ইমিউনিটি বাড়ায়। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফ্লাভনয়েড বিশেষ করে আমাদের শ্বসন তন্ত্রের ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়। দেখা গেছে, যারা ফ্লাভনয়েড যুক্ত খাবার তথা বেরি নিয়মিত খায়, তাদের ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি তুলনামূলকভাবে কম হয়।
২। ডার্ক চকলেট
ডার্ক চকলেটে থিওব্রোমিন নামক এক ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এই থিওব্রোমিন আমাদের শরীরের কোষকে ফ্রি-রেডিক্যাল বা আয়নের হাত থেকে রক্ষা করে। শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়ার ফলে প্রতিনিয়ত এই ফ্রি-রেডিক্যাল বা আয়ন তৈরি হয়। এই আয়ন আমাদের শরীরের কোষকেই ধংস করে এবং নানা রকম রোগ তৈরি করে।
তবে, ডার্ক চকলেটে অনেক ক্যালোরি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। চকলেট খাওয়ার আগে এ কথা মনে রাখতে হবে। যাদের ক্যলোরি বর্জন করা দরকার, তারা চকলেট খাবেন না।
৩। ব্রোকলি
ব্রোকলিতে প্রচুর ভিটামিন-সি থাকে। এ ছাড়া থাকে সালফোরাফেন নামক এক ধরনের শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট। এই দুই যৌগই আমাদের ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়। তাই নিয়মিত খাদ্য তালিকায় ব্রোকলি রাখা দরকার।
৪। মিষ্টি আলু
মিষ্টি আলুতে বিটা-ক্যারোটিন নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, তার জন্য আলুর রঙ লাল হয়। এই বিটা ক্যারোটিন একটি শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং আমাদের শরীরের ভিটামিন এ’র অন্যতম উৎস। ভিটামিন-এ আমাদের চোখের জন্য দরকার তো বটেই, তার সাথে ত্বকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ত্বকের স্বাস্থ্য শুধু ভালো রাখা নয়, ত্বককে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়।
৫। পালং শাক
পালংশাকে অনেক দরকারি পুষ্টিকর যৌগ এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্লাভনয়েড, ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই।
ফ্লাভনয়েড সর্দি কাশির হাত থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন সি ও ই ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়।
৬। তেল যুক্ত মাছ
মাছের তেল, বিশেষত সমুদ্রের তৈলাক্ত মাছ বা সমুদ্রের মাছের তেলে অনেক ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড থাকে। এই ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড বাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দেয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এক ধরনের অটোইমিউন রোগ, যা ইমিউনিটির গোলমালের জন্য হয়। কাজেই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ইমিউনিটি ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
ইমিউনিটি ঠিক রাখা ছাড়াও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আমাদের ত্বকের কোলাজেন ঠিক রাখে, কোষকে ঠিক রাখে, মস্তিস্কের কার্জক্ষমতা ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের নানাবিধ উপকার করে।
৭। হলুদ
হলুদ গুড়া শুধু রান্নায় রঙ ধরায় না, হলুদের নানা রকম ঔষধি গুণ আছে। আয়ূর্বেদে ঔষধ হিসাবে হলুদের ব্যাবহার প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে।
হলুদে কারকিউমিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ থাকে, যা এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং এন্টি-ইনফ্লামেটরি হিসাবে কাজ করে ও আমাদের ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়।
৮। আদা
আদা বিভিন্ন রান্নায় এবং চায়ের সঙ্গে ব্যাবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আদা এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং এন্টি ইনফ্লামেটরি হিসাবে কাজ করে। তাই আদা আমাদের ইমিউনিটি বাড়িয়ে নানা রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করে।
৯। রসুন
রসুন আমাদের ঠান্ডার বা সর্দির হাত থেকে রক্ষা করে এ কথা প্রায় সকলের জানা। ঠান্ডা লাগলে রসুনকে ঘরোয়া টোটকা হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই।
রসুনের মধ্যে থাকে এলিসিন নামক যৌগ, যার প্রভাবে সহজে ঠান্ডা লাগে না। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রসুন খেলে সর্দি লাগার প্রবণতা অর্ধেক কমে যায়।
১০। গ্রিন টি
গ্রিন-টি তে অল্প পরিমাণ কফি থাকে, তাই গ্রিন-টি কফি বা ব্লাক-টির বিকল্প হিসেবে খেতে পারেন।
এছাড়া গ্রিন-টি তে ফ্লাভনয়েড থাকে, যা সর্দি কাশির হাত থেকে রক্ষা করে এবং ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়।
১১। কেফির
কেফির তৈরি করা হয় দুধকে ফারমেন্ট করে। এর মধ্যে অনেক ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা আমাদের হজমে সাহায্য করে, পেটের রোগ কমায়, অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল রাখে। টক দইয়ের থেকেও এর উপকার অনেক বেশি।
দেখা গেছে, কেফির নানা ভাবে ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত কেফির খেলে ইনফ্লামেশন কমে, রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধংস করার ক্ষমতা বাড়ে, এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবেও কাজ করে। সব মিলিয়ে কেফির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
১২। সূর্যমুখী ফুলের বীজ
সূর্যমুখী বীজে ভিটামিন-ই থাকে যা এন্টি অ্যাক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। ভিটামিন-ই আমাদের ইমিউনিটি বাড়ায় এবং শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি-রেডিক্যাল ধ্বংস করে কোষ কে রক্ষা করে, যার ফলে ভিটামিন-ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ইমিউনবুস্টার হিসেবে কাজ করে।
সূর্যমুখী বীজ নানাভাবে খাওয়া যায়। বিভিন্ন পদের সঙ্গে রান্না করে, প্রাতরাশের সঙ্গে এবং স্যালাডের সঙ্গেও খাওয়া যায়।
১৩। আমন্ড বাদাম
আমন্ড বাদামেও অনেক ভিটামিন-ই থাকে । এ ছাড়া থাকে ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম ও ফাইবার। এই সব কিছুই ইমিউনিটি বাড়িয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন আমন্ড খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়।
১৪। আরেঞ্জ বা কিউই ফল
এই ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি আছে। ভিটামিন-সি একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে এবং ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করে।
১৫। লাল ক্যাপসিকাম
লাল ক্যপসিকামে অনেক ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-এ থাকে। হাফ কাপ লাল ক্যাপসিকামে আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার ১৫৯ শতাংশ ভিটামিন সি ও ৪৭ শতাংশ ভিটামিন এ থাকে। এরা আমাদের শরীরের কোষকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করে, জীবানুর আক্রমণ হলে ইমিউনিটি বাড়িয়ে দেয় এবং এন্টি ইনফ্লামেটরি হিসাবেও কাজ করে।
যাদের ডায়াবেটিস আছে, যারা সুগার বাড়ার ভয়ে ফল খেতে পারে না, তারা ভিটামিন সি পেতে বিকল্প হিসেবে লাল ক্যাপসিকাম খেতে পারে। মনে রাখতে হবে, লাল ক্যাপসিকাম হালকা ভেজে বা রোষ্ট করে রান্না করা উচিত। বেশি ফুটিয়ে রান্না করলে তার খাদ্য গুন কমে যায়।
খাবার ছাড়াও অন্য যে ভাবে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বা পরোক্ষভাবে ইমিউনিটি বাড়ানো যায়, সেগুলো হলো:
- বার বার হাত ধুতে হবে
- স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে
- ধূমপান বন্ধ করতে হবে
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে
- দুশ্চিন্তা কমাতে হবে
- যথেষ্ট সময় ঘুমাতে হবে
- ওজন ঠিক রাখতে হবে
- মদ্যপান বা অন্য নেশা ত্যাগ করতে হবে বা মাত্রা রেখে খেতে হবে।
এ ছাড়াও টিকাকরণের মাধ্যমে বিশেষ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।