মাস দুয়েক আগে এক মধ্যবয়স্কা রোগীকে নিয়ে অপারেশন করাতে এসেছিলেন তার বৌমা।
তরুণী বধূটি বললেন, ‘অনেকদিন আগে আপনি আমার বাবারও মেরুদন্ডে অপারেশন করেছিলেন। বাবার প্যারালাইসিস হয়ে গেছিল।’
‘বাবা এখন কেমন আছেন?’
‘ভালো আছে। বাবা তো আবার ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছে।’
‘বাঃ। কতদিন আগে অপারেশন হয়েছিল?’
মেডিক্যাল প্র্যাকটিসে এই ‘অনেকদিন’ কথাটা খুব বিভ্রান্তিকর। কারও কাছে ছ’মাসটা ‘অনেকদিন’, তো কারও কাছে ছ’বছরটা।
তরুণী বলল, ‘পনের বছর।’
এবার বোঝা গেল। হঠাৎ কি মনে হতে বললাম, ‘তোমার বাবার নাম কি?’
‘দীপক সর্দার’
…….দীপক সর্দার! নামটা শুনেই মনটা এক লহমায় পিছিয়ে গেল পনেরটা বছর। ২০০৭ সাল। আর জি করে আবার নতুন করে স্পাইন অপারেশন শুরু করেছিলাম কয়েক বছর যাবৎ। প্রচুর রোগী। মেরুদন্ডের সমস্যা, বিশেষতঃ চোট ও প্যারালাইসিসের রোগীর কোনো অভাব নেই। কিন্তু অচিরেই সরকার বাহাদুর এবং কয়েকজন স্বাস্থ্য প্রশাসকের কৃপাদৃষ্টিতে বদলি হলাম মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে।
সপ্তাহান্তে বাড়ি এসেছি। বাড়ির কাছের নার্সিংহোম থেকে ফোন পেলাম, একজন এমার্জেন্সী রোগী দেখতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেখতে পেলাম, রোগী বছর তিরিশের হতদরিদ্র এক যুবক। গাছ থেকে পড়ে কোমর থেকে দুটো পা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। মূত্রনালীতে ক্যাথেটার পরানো। আরজিকরে নিয়ে গেছিল। কিন্তু ওখানে বলেছে, এখন আর মেরুদন্ডের অপারেশন ওখানে হয় না। তবে একটা এক্স-রে আর এম আর আই স্ক্যান করে দিয়েছে ওখানে- সম্পূর্ণ বিনা খরচে।এক্সরে-তে দেখা গেল মেরুদন্ডের হাড় ভাঙা। এমআরআই-তে দেখা গেল- মেরুদন্ডের ভাঙা হাড়ের টুকরো সুষুম্নাকান্ড বা স্পাইনাল কর্ডের নীচের অংশটাকে একেবারে চেপে ধরেছে।
রোগীর সঙ্গের দু-চার জন আমাকে ঘিরে ধরল, ‘ডাক্তারবাবু, লোকটা খুব গরীব, কিন্তু ভালো মানুষ। ভ্যানরিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। যদি কোনোভাবে সাহায্য করা যায় দেখুন না।
‘বুঝলাম। কিন্তু এত বড় অপারেশন! অনেক যন্ত্রপাতি লাগবে। তাও প্রাইভেট হাসপাতালে। কিভাবে হবে?’
‘আমরা ক্লাব থেকে কিছু চাঁদা তুলব। বাকি যদি আপনারা কিছু সাহায্য করেন।’
রোগীর স্ত্রী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে করুণ চোখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে।
হাসপাতালের এক অংশের মালিক ও পরিচালক স্বপনবাবু বললেন, ‘অপারেশন করে তো দিন, তারপর দেখা যাবে।’
‘অপারেশন করে দেব। কিন্তু প্রায় সম্পূর্ণ প্যারালাইসিস। তাও চারদিন হয়ে গেছে। আদৌ ঠিক হবে কি না জানি না। সে ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না।’
‘প্রতিশ্রুতি চাই না। যা কপালে আছে হবে। আপনি করুন।’ রোগীর সঙ্গীরা বলল।
এইসব ভরসায় মফঃস্বলে একটা নতুন জায়গায় বেশ ঝুঁকি নিয়ে অতবড় অপারেশন করে দিয়েছিলাম। অজ্ঞান করেছিলেন বাইপাসের বড় হাসপাতালে অভিজ্ঞ অ্যানাস্থেটিষ্ট শিবানীদি। রোগীর পরিবার শুধু যন্ত্রপাতির খরচ আর শিবানীদির যাতায়াতের গাড়ি ভাড়াটুকু দিতে পেরেছিল।
যতদূর খবর পেয়েছিলাম, রোগীর নাম করে তার পাড়ার ক্লাব ও আশেপাশের অঞ্চলে চাঁদা তোলা হলেও রোগীর পরিবার অথবা হাসপাতাল একটা টাকাও পায় নি।
যাই হোক, অপারেশনের পাঁচদিন বাদে রোগী পা নাড়তে পেরেছিল। একমাস বাদে মূত্রনালী থেকে ক্যাথেটার খোলা হল। তিনমাস বাদে রোগী হাঁটল।
…..আবার ফেরত এলাম বর্তমানে।
দীপক সর্দারের মেয়ে বলল, ‘আমি তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি। ছ’ মাস বাদে বাবা আবার কাজে যেতে পেরেছিল।’
‘সে তো জানি। তোমার বাবা পরেও দু’বার এসেছিল। বাড়ির আর সবাই ভালো আছে?’
‘হ্যাঁ। তবে মা বাতের ব্যথায় ভোগে। আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ভাই কলেজে পড়ে।’
‘তোমার বাবাকে একবার আসতে বোলো তো।’
পরদিন সকালেই হাসি-হাসি মুখে ভ্যানরিক্সা চালিয়ে দীপক সর্দার হাজির। আমাকে পিঠটা দেখালো। তারপর জোর করে তার ভ্যানরিক্সায় চাপিয়ে ঘোরালো।
এইসব রোগীদের জন্যই অসহ্য তিক্ততা ও অপমানজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এখনও ডাক্তারিটা ছাড়িনি।
বি.দ্র. :
১. পুরনো ছবিগুলো আমার কম্পিউটারে ছিল। নতুন-পুরোনো প্রতিটি ছবিই রোগী ও তার পরিবারের অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত।
২. মেরুদন্ডের এবং অন্যান্য অপারেশনে সব সময় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না-ও আসতে পারে।