খুচরো ব্যবসায়ে ৫১ শতাংশ বিদেশী পুঁজির অনুমতি দান নিয়ে দেশ উত্তাল। ওয়ালমার্ট, টেসকো বা ক্যারিকোর মতো রিটেল চেনে ভারতে সরাসরি ব্যবসা করার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক চলছে। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে, ভারতের ওষুধ শিল্পে আজ থেকে প্রায় এক দশক আগেই একশো শতাংশ বিদেশী পুঁজির লগ্নির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার ফলাফল হয়েছে এককথায় ভয়ঙ্কর। সেই বিষয়ে দু’চার কথা বলা দরকার।
প্রেক্ষিত
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ভারতে মোট ওষুধ ব্যবসার পরিমাণ ছিল দশ কোটি টাকার মতো। ১৯৯০ সালে ওষুধশিল্পে বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার কোটি টাকায়। আর ২০০৪-২০০৫ সালে তার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে এই বাণিজ্যের মোট পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার মতো, যার মধ্যে মূল বুনিয়াদি ওষুধ (Bulk Drug) তৈরি হয় প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকার। ২০০৪-২০০৫ –এ মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৬,৭০০ কোটি টাকা। ভারত ওষুধ উৎপাদনে এবং রপ্তানিতে পৃথিবীতে এক প্রধান দেশ—ওষুধ উৎপাদনের পরিমাণে চতুর্থ এবং মোট উৎপাদনের অর্থমূল্য ত্রয়োদশ। বিশেষত, সবচেয়ে কম খরচে ‘জেনেরিক’ বা বর্গনামে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে চিনের পরেই আমাদের স্থান। এর প্রধান কারণ হলো অতি সুলভ শ্রমশক্তি এবং প্রায় ৪০ লক্ষ ইংরেজি জানা বিজ্ঞান প্রশিক্ষিত মানুষ। ভারতের দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলির বিকাশের পিছনে যে সব কারণ ছিল, তার মধ্যে প্রধান হলোঃ
ক) ১৯৭০ সালে লাগু হওয়া পেটেন্ট নীতি, যাতে উৎপাদন পদ্ধতির ওপর (Process Patent) পেটেন্ট দেওয়া হতো, উৎপাদিত বস্তুর ওপর (Product Patent) নয়। পেটেন্টের মেয়াদ ছিল ৫ বছরের। তাছাড়া কম্পালসারি লাইসেন্সিং বলে একটি ধারা ছিল, যাতে কোনো সংস্থা, মেধাস্বত্ব বা পেটেন্ট নিয়ে, সেই ওষুধ দেশে উৎপন্ন না করে ফেলে রাখলে, তার মেধাস্বত্ব বা Patent খারিজ হয়ে যেত।
খ) দেশীয় কোম্পানিগুলির জন্য সরকারি রক্ষাকবচ, যাতে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন, মাঝারি ও ছোট স্তরে দেশীয় ওষুধ কোম্পানির জন্য সংরক্ষিত রাখা হতো।
গ) যে কোন ওষুধ কোম্পানিতে বিদেশী পুঁজি বা FDI এর পরিমাণ ৫০ শতাংশর কম রাখতে হবে এবং বিদেশি পুঁজির পরিমাণ যদি ৪০ শতাংশর কম থাকে তাহলে তা দেশীয় কোম্পানিগুলির জন্য সংরক্ষিত সুলভ সুবিধাগুলি পাবে। ১৯৭৮ সালের জনতা পার্টির সময় গৃহিত প্রথম জাতীয় ওষুধ নীতিতে (Drug Policy) এই পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ওষুধ যুক্তিসঙ্গত দামে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য। এছাড়াও ১৯৭৯ সালের ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশ’ আর একটি জরুরি পদক্ষেপ, যার আওতায় ৩৪৭ টি ওষুধকে আনা হয়। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালে ওষুধ নীতিতে বলা হয়েছিল যে, এই ওষুধ নীতির উদ্দেশ্য হলো, সুলভে নিয়মিত ভাবে প্রয়োজনীয়, জীবনদায়ী এবং রোগ প্রতিরোধক (Essential, Life Saving and Prophylatic) ওষুধ যাতে যথেষ্ট পরিমাণে মানুষের কাছে পৌছায়। কিন্তু পরবর্তী কালে জাতীয় ওষুধ নীতির যে সব পরিবর্তন করা হয়, তাতে ক্রমশ দেশী কোম্পানিগুলির রক্ষাকবচ তুলে নেওয়া এবং বিদেশী লগ্নির উর্ধ্বসীমা বাড়ানো—এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
১৯৯৪ সালঃ পালাবদলের পালা
১৯৯৪ সালে ১৯৮৬-র গৃহীত নীতির নানা সংশোধন করা হয়। এই প্রস্তাবে প্রথমেই বলা হয়েছে
১) দেশে ২৫০টি বৃহৎ ও ৮০০০ ক্ষুদ্র উৎপাদন সংস্থা ৩৫০ ধরণের বুনিয়াদী ওষুধ ও প্রায় সমস্ত তৈরি ওষুধ উৎপাদন করে দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা মেটায়।
২) ১৯৮০-৮১ সালে বুনিয়াদি ওষুধশিল্পের পরিমাণ ছিল ২৪০ কোটি টাকার। ১৯৯৩-৯৪ সালে তা ১৩২০ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। ওই একই সময়ে তৈরি ওষুধ (Formulation)-এর উৎপাদন ১২০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯০০কোটিতে। বুনিয়াদি ওষুধের ক্ষেত্রে শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্পের অবদান।
৩) রপ্তানি প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইতিবাচক বাণিজ্য ভারসাম্যের (Positiv Trade Balance) সৃষ্টি হয়েছে।
এই সব সাফল্যের প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালের সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হলোঃ
ক) শিল্পের আরো বিকাশের স্বার্থে ভেষজ শিল্পে লাইসেন্স প্রথার অবসান ঘটাতে হবে।
খ) সরকারি ওষুধ কোম্পানিই কেবল উৎপাদন করে, এমন সংরক্ষিত ওষুধের তালিকা তুলে দেওয়া হলো।
গ) সমাগত গ্যাট চুক্তি ও পরিবর্তিত পেটেন্ট আইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বিদেশী বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো।
ঘ) ৪০ শতাংশের স্থানে ৫১ শতাংশ বিদেশী পুঁজি লগ্নি হয়েছে, এমন কোম্পানিগুলিও দেশি কোম্পানির প্রাপ্ত সুযোগসুবিধা পাবে।
ঙ) মূল্য নিয়ন্ত্রণকে আরো কমিয়ে আনা। সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ MAPE (Maximum Allowable Post Manufacturing Expenses) এর সুযোগ দেওয়া, যাতে উৎপাদকরা আরও উৎসাহ পায়।
চ) মূল্যে সমতার জন্য বিভিন্ন ফর্মুলেশনের সর্বোচ্চ ক্রিয়ামূল্য স্থির করা।
পশ্চাৎপানে বিরাট উল্লম্ফনঃ ওষুধনীতি ২০০২
২০০২ সালে কেন্দ্রে NDA সরকারের সময় ওষুধ নীতির আবার পরিমার্জনা করা হলো। প্রকৃতপক্ষে সংশোধন না বলে একটি নতুন প্রস্তাব বলাই সমীচীন, কেননা এর দ্বারা পূর্বতন ঘোষিত লক্ষ ও প্রয়োগকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলা হলো।
২০০২ সালে নতুন প্রস্তাবের মুখবন্ধে অবশ্য বলা হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ভেষজনীতির মূল ধারণা এখনো বজায় আছে। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের জন্য ভেষজ শিল্প নানা নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশ্বায়িত অর্থনীতি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) র চুক্তির বাধ্যবাধকতায় পরিবর্তন জরুরি। ভেষজ শিল্পের মতো এক প্রধান জ্ঞান-নির্ভর শিল্পে তাই নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি করা হচ্ছে, যাতে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগী (Competitor) হয়ে থাকতে পারে।
স্পষ্টতই দেশের দরিদ্র জনসাধারণকে স্বল্প মূল্যের জীবনদায়ী ওষুধ সরবরাহের প্রতিশ্রুতির স্থানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে জাতীয় অগ্রাধিকার (National Priority)।
জাতীয় ওষুধ নীতি ২০০২ এর নথিতে আরও বলা হলো যে ১৯৯১ সালে চালু হওয়া উদারনীতি ওষুধ সশিল্পের ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রথাকে এওং আমদানির ক্ষেত্রে নানা বাধাকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। তাই নতুন সুপারিশগুলি হলো
ক) যেসব বুনিয়াদি ওষুধ উৎপাদনে বংশাণু (DNA), নিউক্লিক অ্যাসিড বা কোনো কোশ ও কলা ব্যবহৃত হয় সেগুলি বাদে আর সমস্ত ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স নেবার প্রথা বাতিল করা হলো।
খ) ১৯৯৯ সালের মার্চের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের উর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৫১ থেকে ৭৪ শতাংশ করা হয়। এখন তা ১০০ শতাংশ করা হলো।
গ) উৎপাদনে বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহারের বিধিনিষেধ সম্পুর্ণ অবলুপ্ত হলো (বংশাণু পরিবর্তিত প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া)।
ঘ) সরকারি ভেষজ সংস্থাগুলির সব রক্ষাকবচ সরিয়ে নিয়ে তাদের নির্দেশ দেওয়া হলো বাজারের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে। যেখানে সম্ভব সেখানে এই ধরণের সংস্থার বেসরকারিকরণ ত্বরাম্বিত করতে বলা হলো।
ঙ) রপ্তানির উদ্দেশ্য উৎপাদিত ওষুধের সমস্ত কাঁচামাল বিনাশুল্কে আমদানি করা হবে।
চ) নতুন পেটেন্ট বিল সংসদে আইনে পরিণত হবার অপেক্ষায়। এই আইনের ফলে পেটেন্ট-এর সময়সীমা ৫ বছর থেকে বেড়ে ২০ বছর দাঁড়াবে। (এখানে উল্লেখ করা উচিত যে গ্যাট চুক্তি এবং মেধাস্বত্ব আইনের (TRIP) হাত ধরে যে নতুন পেটেন্ট আইন ভারতে ২০০৫ সালে লাগু হয় তার অভিঘাত এবং বিরুপ প্রতিক্রিয়া যে সমস্ত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পড়েছে, তার মধ্যে অগ্রগণ্য ভেষজশিল্প। উৎপাদন পদ্ধতির স্থানে উৎপাদিত বস্তুর পেটেন্ট, ২০ বছরের জন্য পেটেন্ট—এইসব কারণ ১৯৭০ এর দশক থেকে দেশীয় ওষুধশিল্পে যে বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল তা অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে। বহুজাতিক ও আধিজাতিক দেশীয় বাজার দখল করেছে বিরাট সাফল্য পাওয়া ক্ষুদ্র ওষুধশিল্পের অন্তর্জলী যাত্রা ঘটতে চলেছে। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে আকাশছোঁয়া।
নতুন পেটেন্ট আইনের বাধ্যবাধকতার কথা ২০০২ সালের ভেষজনীতিতে স্পষ্টতই স্বীকার করা হয়েছে এবং সেই অনুসারেই এই ভেষজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আমাদের মতে, ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থে সম্পুর্ণ পরিপন্থী।
১৯৯৯ সালে ভেষজ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ‘ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কমিটি (PRDC) তৈরি করা হয়েছিল সিএসআইআর (Council for Scientific and Industrial Research) এর অধীনে। ওই কমিটিকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলা হলো। পরিকাঠামোর উন্নতি করার কথাও বলা হলো।
ক্রমশঃ