পূর্বপ্রকাশিতের পর
মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আবার বলা হলো যে পূর্বতন নীতিতে নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। কী সমস্যা তার কোনো উল্লেখ নেই কিন্তু তার সমাধান দেওয়া আছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণকে আরও ‘নমনীয়’ করা। আরাও বেশি বেশি বুনিয়াদি ওষুধ ও তৈরি ওষুধকে ওই তালিকা থেকে বার করে আনা। নানা ধানাইপানাই করে, নানা জনমুখী ভালো ভালো কথা বলে মোদ্দা যে সিদ্ধান্ত করা হলো তা আমারা ১৯৮৭-এর পর থেকেই বারে বারে শুনে আসছি- “it has emerged that the domestic drug and pharmaceutical industry needs reorientation in order to meet the challenge and harness opportunities arising out of liberalization of the economy and impending era of the product patent regime.
It has been decided that the span of rice control over drugs and pharmaceuticals would be reduced substantially. However, keeping in view of the interest of the weaker section of the society, it is proposed that the government will retain the power to in the case where price behave abnormally.
সারণিঃ ১
সাল | ১৯৭৯ | ১৯৮৭ | ১৯৯৫ | ২০০৩ |
মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত ঔষধ | ৩৪৭ | ১৪২ | ৭৬ | ৭৪ |
দেশে মোট ঔষধের কত শতাংশ | ৯০ | ৭০ | ৫০ | ৩৬ |
লাইসেন্স রদ করা, বিদেশী পুঁজির অনুমোদন, মূল্য নিয়ন্ত্রণের অবলুপ্তি ঘটানো এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলো, উপেক্ষিত রয়ে গেল ১৯৮৬ বা ১৯৯৪ সালের ঘোষিত নীতির অন্যান্য নানা গুরুত্বপূর্ণ ধারা। যেমন
১) অবৈজ্ঞানিক ও ক্ষতিকারক ঔষধ বাতিল করা।
২) ‘ব্রান্ড’ নাম এর পরিবর্তে ‘বর্গ’ (জেনেরিক) নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ও বাণিজ্যিক নাম নিষিদ্ধ করা। যদিও ২০০২ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়েছিল,
The policy of use of generic drugs and vaccines in both public and private domain…is a prerequisites for cost effective public health care. In the public health system, this will be enforced by prohibiting the use of propriety drugs, except in special circumstances.
স্পষ্টতই বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিদের চাপ ও মুনাফার শিকার, এই নীতী প্রয়োগ না করতে সরকারকে বাধ্য করেছিল।
৩) নিম্নমানের ওষুধ ও ভেষজ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করা।
8) বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত (ADR) নজরদারি সারা দেশে চালু করা।
এই সব বিষয়ে মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া প্রায় কোনো উদ্যোগই নেওয়া হলো না। যার ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, অন্য বহু দেশে নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকারক ওষুধ, ওষুধ পদবাচ্যই নয় এমন বহু জিনিস অবাধে বাজারে চলছে। মানুষ কিনছেন, খাচ্ছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিপুল ভাবে।
প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব
‘সুলভে সব ধরণের ওষুধ সমস্ত মানুষের কাছে লভ্য করা’ হচ্ছে বারে বারে ঘোষিত নীতি—অথচ কার্যক্ষেত্রে এমন ভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হচ্ছে যে তা হয়ে উঠেছে আরও মহার্ঘ এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। লাইসেন্স প্রথা বাতিল করা হচ্ছে এই যুক্তিতে যে বাজারি প্রতিযোগিতা ওষুধের দাম কমাবে। অথচ কার্যত বাণিজ্যিক নামে ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ না করার ফলে এবং ইচ্ছামতো অবৈজ্ঞানিক মিশ্রণ (Fixed Dose Combination) বিক্রিকে ঢালাও অনুমতি দেওয়ায় ওষুধের দাম হু হু করে বেড়েই যাচ্ছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণের উর্দ্ধসীমাও (Price Ceiling) উৎপাদকরা মানছেন না। সরকারও উদাসীন।
১৯৭০ সালে ১৭টি বুনিয়াদি ওষুধের ক্ষেত্রে সর্ব্বোচ্চ মুনাফা ৭৫ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। অন্যান্য ওষুধের ক্ষেত্রে ১৫০ শতাংশ।
১৯৭৯ সালে পরিবর্তিত হার দাঁড়াল নিম্নরূপ।
সারণিঃ ২
ওষুধের শ্রেণি | সর্ব্বোচ্চ অনুমোদিত মুনাফা |
১. জীবনদায়ী (Life Saving) | ৪০ শতাংশ |
২.অত্যাবশ্যক (Essential) | ৫৫ শতাংশ |
৩. প্রান্তিক (Non Essential) | ১০০ শতাংশ |
৪. অন্যান্য (Other) | লাগামহীন |
এর ফল দাঁড়াল কোম্পানিগুলির জীবনদায়ী ও অত্যাবশ্যক ওষুধের উৎপাদনে ঘাটতি এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বেশি উৎপাদন করে বিপুল লাভ।
ফলে ১৯৮৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে ৭৫ শতাংশ ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১০০ শতাংশ মুনাফা অনুমোদন করা হলো। অন্য সব ওষুধের ক্ষেত্রে মুনাফা লাগামহীন। এর সঙ্গে বহু ওষুধকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসা হলো। তাতেও কোম্পানিগুলির মুনাফা বাড়া ছাড়া কাজের কাজ কিছু হলো না।
২০০২ সালে নীতির ফলে ওষুধের দাম বেড়েছে রকেটের গতিতে। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কথা বলে কার্যত কেবল বাণিজ্য, প্রতিযোগিতা, আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং মুনাফার নীতিতে বিষবৃক্ষে কি করে অমৃত ফল ফলবে।
লক্ষনীয় বিষয় যে, বারে বারে ভেষজ শিল্পের ‘সাফল্য’ তুলে ধরতে গিয়ে পরিসংখ্যান দেওয়া হয় কত কোটি টাকার উৎপাদন বা বাণিজ্য বাড়ল, তার। দেশের কত শতাংশ মানুষ এই নীতির ফলে উপকৃত হয়ে ওষুধ পেলেন, মাথাপিছু ওষুধের ব্যবহার কেমন বাড়ল সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
২০০২ সালের নথিতে পরিষ্কার স্বীকার করা হয়েছে যে কত বুনিয়াদি বা তৈরি ওষুধ দেশে বিক্রি হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিন্তু বেসরকারি তথ্যের উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেমন ORG-MARG,CIMS,MIMS ইত্যাদি। কিন্তু এসবই যে অতি অপরিমিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ভাণ্ডার তাও স্বীকার করা হয়েছে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (২০০৫-২০১২) নথিতেই বলা হয়েছে যে ৪০ শতাংশ ভারতবাসী হাসপাতালের খরচের জন্য ঋণগ্রস্ত এবং মাথাপিছু বার্ষিক আয়ের ৫৮ শতাংশ (গড়ে) চিকিৎসার খরচে ব্যয়। শুধু হাসপাতালের খরচ মেটাতে গিয়ে ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে তলিয়ে যায়। সেখানে কিভাবে সরকার জনস্বার্থের কথা বলে, কেবল বাণিজ্যের স্বার্থে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণকে লাগাতার লঘু করে বিপুল মূল্য বৃদ্ধি এবং কোম্পানিগুলির মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তা বোঝা সত্যিই কঠিন।
১জানুয়ারি ২০০৫ সালে লাগু হওয়া নতুন মেধাস্বত্ব ও পেটেন্ট আইন, গত চার-পাঁচ দশক ধরে বিকশিত দেশীয় ওষুধ শিল্পের (বিশেষত ছোট উৎপাদকদের) মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ পেটেন্ট আজ বহুজাতিকদের হস্তগত। ছোটো কোম্পানিগুলির নাভিশ্বাস উঠেছে। বহু ক্ষুদ্র উৎপাদক ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিদেশী অধিজাতিকদের কাছে র্যানব্যাক্সি বা পিরামলের মতো কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের আমদানি বাড়ছে। বাড়ছে পেটেন্ট দখল করে দেশে উৎপাদন না করে, উচ্চমূল্যে বুনিয়াদি ওষুধ আমদানি করার প্রবণতাও। দেশীয় বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশই দখল করেছে দানবাকৃতি বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন কমে যাচ্ছে, নতুন নতুন বাণিজ্যিক ফর্মুলেশনে ভরে যাচ্ছে বাজারে।
বিদেশী পুঁজির প্রত্যক্ষ অভিঘাত
বাজারে আসা নতুন ওষুধকে বলা হয় green field sector। এতে ১০০ শতাংশ বিদেশী পুঁজি অনুমোদিত। পুরানো ওষুধের ক্ষেত্রে হলো Brown field sector। তাতে ১০০ শতাংশ বিদেশী পুঁজি, কিন্তু তথাকথিত নজরদারির কথা বলা হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি খুচরো ব্যবসার মতো জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রেও ভারতকে Sourcing Hub হিসেবে ব্যবহার করতে উঠে পরে লেগেছে। কারণ গত প্রায় দুই দশক ধরেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলিই নতুন কোনো ঔষধ বা Molecule বাণিজ্য আবিষ্কার করতে পারেনি—যাকে বলে Block Buster ওষুধ। যার থেকে কোম্পানির মুনাফার বিপুল অংশ আসে। ২০১৩-১৪ সালে বহু ওষুধের মেধাস্বত্ব বা পেটেন্টর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে যার মোট মূল্য প্রায় তিনশো বিলিয়ন ডলার। ফলে এই সব বহুজাতিক, অধিজাতিক হাঙ্গর-কুমিরেরা ঝুঁকছে ভারতের জেনেরিক ঔষধ তৈরির ব্যবসার দিকে। আগেই বলেছি, গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই, কম দামের জেনেরিক ওষুধ তৈরিতে ভারত পৃথিবীতে অগ্রগণ্য। এখানকার ওষুধই আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হতো। এইসব ওষুধ অনেক সস্তাও বটে। এই ওষুধের ওপর আফ্রিকার বহু দেশে এইডস আক্রান্তরা বেঁচে আছেন। যেমন দিশি কোম্পানির এইডস-এর ওষুধ (Anti Retroviral Drugs) যেখানে মাসে সাত হাজার টাকা পাওয়া যায় সেখানে বহুজাতিক কোম্পানির ওষুধের মাসিক খরচ দেড় লক্ষ টাকা। একই কথা সত্য ম্যালেরিয়া, যক্ষা, ক্যান্সারের নানা ওষুধের ক্ষেত্রে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা ডা. মার্গারেট চ্যাং নিজে বলেছেন যে, ভারতে এই সব ওষুধ বহুজাতিকদের হাতে চলে গেলে তৃতীয় বিশ্বের ঘরে ঘরে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে যাবে।
জেনেরিক ওষুধের ব্যবসায় ঢোকার জন্য বিদেশী কোম্পানি টপাটপ দেশী কোম্পানিদের কিনতে আরম্ভ করেছে কারণ তারা এখানকার পরিকাঠামো ব্যবহার করতে চায়—ভারতকে Sourcing Hub হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। (সারণী ৩ দেখুন)।
ভারতবর্ষের ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়াবহ। প্রায় এক হাজার ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান (Small Scale Industry) যাদের Good Manufacture Practice শাংসাপত্রও ছিল তারা লালবাতি জ্বেলেছে। বহু মানুষ বেকার হয়েছে। চালু করা হয়েছে নানা আইনি-বেআইনি ওষুধ পরীক্ষা (Clinical Trials)। আর ওষুধের এমনকি জেনেরিক ওষুধের দামও বেড়েছে এবং বাড়ছে হু হু করে। বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিগুলোর আগ্রাসনের পরিসংখ্যান (সারণী ৪ দেখুন)।
সারণীঃ ৩
বহুজাতিক দ্বারা অধিগৃহীত | ভারতীয় কোম্পানি |
Matrix Lab | Mylan Inc. |
Dabur Pharma | Fresenius Kabi |
Ranbaxy | Daiichi Sankyo |
Santha Biotec & Universal Medicare | Sanofi-Aventis |
Orchid Chemicals (injection) | Hosira |
Piramal H. Care/Solvey | Reckill Benckiser |
Cosme Pharma | Adecock Ingram |
Wockhardt | Danone |
সারণীঃ ৪
আগে | এখন | |
Pfizer | ৪০.০০% | ৭০.২৫% |
Novarties | ৫০.৯৩% | ৭৬.৮২% |
Abbott | ৬১.৭০% | ৬৮.৯৪% |
Sanofi-Aventis | ৫০.১০% | ৬০.৪০% |
Astra Zeneca | ৫১.৫০% | ৯০.০০% |
বোঝাই যাচ্ছে শেষের সে দিন ভয়ংকর।