(এক)
ভোর বেলা বেরিয়ে রাতে ফিরে টিভি চালিয়ে একটু খবর শোনার চেষ্টা করি। গত কয়েকদিন ধরে দেখছি প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম কেবলি রাম ও মোদি ময় (রাম নাম কেবলম এবং নমো ময় প্রচারম)। সামান্য জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার আগে থেকেই কেন জানিনা ধর্মের প্রতি কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু প্রসাদের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ। ফলে এগুলিতে কোন উৎসাহ নেই, উৎসাহ আছে আর এস এস – বিজেপি – সমগ্র সঙ্ঘ পরিবারের সুপরিকল্পিত রাম উন্মাদনার মানব ও সমাজ জীবনে প্রভাব নিয়ে। তাই রাস্তায় ট্রেনে প্রতিটি দৃশ্য মন দিয়ে দেখার ও জনতা জনার্দন এর প্রতিটি মতামত মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছি।
অত্রাম ঘাট, হাওড়া, শিয়ালদহ গঙ্গাসাগর ফেরৎ সাধুদের দেখছি খুব খুশি খুশি ভাব। প্রায় বিনামূল্যে tour circuit এ আরেকটা জায়গা যুক্ত হল। গরুরাও খুব খুশি। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটুক, যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করুক কেউ কিছু বলে না। কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে। স্বয়ং আর এস এস সর সঙ্ঘ চালক মোহন ভাগবত গো মূত্র নিয়ে ডক্টরেট।
ছোটবেলায় রাম নাম নিয়ে প্রথম অভিজ্ঞতা অবাঙালিদের শব যাত্রায় ‘রাম নাম সৎ হায়’ ধ্বনি। ঠাকুরদার সঙ্গে ছিল এক ছেড়াখোঁড়া দড়িবাঁধা বিশাল মহাভারত। এক বিধবা পিসিমা বরং রামায়ণের মজার মজার গল্প বলতেন – জটায়ু, মারিচ, হনুমানের লাফ দিয়ে বিশল্যকরণী নিয়ে আসা ইত্যাদি। তারপর রামায়ণের কমিকস পড়া। কিছু সিনেমা দেখা। তারপর ছাত্র অবস্থায় রাজশেখর বসুর রচনা। কৃত্তিবাস ওঝা অবধি পৌঁছনোর সাধ্য হয়নি। তবে কখনই রামকে নায়ক মনে হয়নি। সীতার অগ্নি পরীক্ষায় তো খল নায়ক মনে হয়েছিল। রামায়ণ মহাকাব্যে আমার হিরো তিনজন – বালী, কুম্ভকর্ণ আর মেঘনাদ। রাবণ, হনুমান, রাম , লক্ষণ, লব, কুশ রা অবশ্য বড় বীর।
সাহিত্যের পাঠক হিসেবে আমরা হিন্দি হৃদয়ভূমির শক্তিশালী লেখক প্রেমচাঁদ, সতীনাথ ভাদুড়ি, ফনিশ্বর রেণু প্রমুখের রচনায় দেখি সাধারণ দেহাতি গরীব মানুষের ‘রাম ভরোসা’।
ইতিহাসের কাজ করতে গিয়ে দেখলাম সংযুক্ত প্রদেশের (বৃহত্তর উত্তর প্রদেশ) সবচাইতে বড় ব্রিটিশ ও জমিদার বিরোধী কৃষক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা সাধারণের মধ্যে প্রবেশ করতে বাবা রামচন্দ্র নাম নিয়ে একটি সাধারণ কুটিরে সাধুর বেশে থাকতেন। কৃষকদের মধ্যে প্রথমে রাম কথা বলে তারপর বিদ্রোহের মন্ত্র ছড়াতেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব চাইতে বড় জননেতা মোহনদাস গান্ধীর স্বপ্ন ও লক্ষ্য ছিল রাম রাজত্ব। তার আশ্রম ও আবাসনে অষ্ট প্রহর রামধুনি ও ভজন চলত। আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার মুখেও বলে গেছেন ‘হে রাম’।
দর্শনের কাজ করতে গিয়ে আরও ভালো করে বুঝতে পারলাম মধ্য যুগে ভক্তি আন্দোলনের প্লাবনে সন্ত কবি তুলসীদাস (রাম বোলা দুবে) প্রমুখেররা কি গভীর ভাবে লোক মানসে রাম চরিত গেঁথে দিয়েছেন। সহজিয়া রামানন্দীরা সাধারণের মধ্যে কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
(দুই)
গতকাল এক বিপ্লবী বন্ধুকে একটা লেখা চেয়ে ফোন করেছিলাম। সে দেখলাম খুব বিমর্ষ রাম মন্দির নিয়ে। কেন ভাই, আর পাঁচটা মেগা ইভেন্ট এর মত এটা দেখবে না? কলকাতার রাস্তায় যখন ক্রুশ্চেভ – বুলগানিনের আগমনে তোমরা লাখ লাখ লোক নামিয়েছিলে (পিতৃদেব জনসমাগমে উপস্থিত ছিলেন)? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কংগ্রেসী রা যখন ময়দানে ইন্দিরা – মুজিবের সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে সমাবেশিত করেছিল (সপরিবারে আমরা উপস্থিত ছিলাম)? জয়প্রকাশ নারায়ণ যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রের বিরূদ্ধে নামিয়েছিল (আমরাও ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে নেমেছিলাম)? ভাই, হয় আটকাও, বিকল্প কিছু করো, নয় মেনে নাও। উদ্যোগী হও, বিমর্ষ হয়ো না।
আর এস এস – বিজেপি করেছে বলে? ওরা পাঁচ জনে মিলে শুরু করে গত ১০০ বছর ধরে ধারাবাহিক অনুশীলন ও চেষ্টা করে গেছে বলে ফল পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, অর্থনীতি, মানবিক মূল্যবোধ, জীবনযাত্রার মান এইসবে উন্নতি করা খুব কঠিন কাজ, আর গড়পড়তা পশ্চাদপর ভারতীয়রা সচেতন নন। তাই ওদের সুবিধামত ধর্মের আফিং, সামন্ত সংস্কৃতি, ব্রাহ্মণ্যবাদের পরম্পরা, সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনকে বেছে নিয়েছে।
হিন্দু ধর্ম সবচাইতে বিভাজিত ধর্ম ছিল। জাতপাত, বর্ণবাদ, সামন্ত, পিতৃতন্ত্র ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অটুট রেখেই ওরা কৌশলগত সামাজিক engineering ঘটিয়ে বৃহত্তর পশ্চাদপর, দলিত ও জনজাতিদের ওদের কর্মসূচিতে সামিল করেছে ও সমর্থক করে ফেলেছে। আপাত নমনীয়তা দেখিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করেছে ওবিসি কে, রাষ্ট্রপতি করেছে দলিত আর আদিবাসী কে। ২০২৪ এর লোক সভা জেতার মেগা শো রাম মন্দির উদ্বোধন করাচ্ছে গুজরাতি ওবিসি কে দিয়ে।
একে একে প্রায় সমস্ত হিন্দু ও হিন্দুত্ব বাদী সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, আখড়া ইত্যাদিকে নিয়ে এসেছে সঙ্ঘ পরিবারের একটি ছাতার তলায়, সমস্ত দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করেছে ভারতীয় জনতা পার্টির ছত্রছায়ায়। পাশাপাশি প্রবল প্রতাপশালী আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি এবং দেশীয় একচেটিয়া পারিবারিক পুঁজিকে নিয়ে এসেছে নিজেদের সমর্থনে। গড়ে তুলেছে এক সামরিকভাবে শক্তিশালী হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। উনিশ শতকের আর্য সমাজীদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশময়, আই আই টি থেকে বনবাসী বিদ্যালয় অবধি।
আর তোমরা ওদের অনেক আগে, এমনকি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের আগে, ১৯২১ এ দল গড়ে প্রথম দিন থেকেই মানবেন্দ্র রায় আর অবনী মুখার্জী দুই নেতা ঝগড়া করেছো। ১৯২৫-এ কানপুরে দেশের মাটিতে প্রথম সম্মেলনে আহ্বায়ক রায়পন্থী সত্যভক্তকে বহিষ্কার করে বম্বে লবি ক্ষমতা দখল করেছো। গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টি ও স্টালিন নিয়ন্ত্রিত কমিন্তর্নের নির্দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছো। স্বাধীনতার পরেও চলেছ রুশ পার্টির কথায় অথবা চিনা পার্টির প্রভাবে। হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতার চাইতে বেশি সংখ্যক ফ্রাকশন এর জন্ম দিয়েছ। সুতরাং যা হবার হয়েছে। সত্যকে লও সহজে।
(তিন)
বিজেপির আজ যে বোলবোলা তা আদবানির নেতৃত্বে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আদবানির কাছে থেকে অংশ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই নোটবন্দি, কোভিড, কর্পোরেট ও পুঁজির শোষণ, মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রভৃতিতে ফোফরা হওয়া ভারতের সমাজ অর্থনীতিকে ঢেকে ২০২৪ এর নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে রাম মন্দিরের আশ্রয় নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে পরিকল্পিত উন্মাদনা সৃষ্টি করে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব ভারতে অনেকটাই সফল হয়েছেন। উত্তরপূর্ব ভারতে অসম ও ত্রিপুরা দখল হয়েছে। মনিপুরে সামরিক বাহিনী দিয়ে খ্রিস্টিয়ান কুকিদের ঘিরে হিন্দু মেইতিদের সশস্ত্র বাহিনী কে লেলিয়ে হিন্দুত্ববাদের নতুন এক্সপেরিমেন্ট চলছে। অমিত শাহ খ্রিস্টিয়ান নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের ক্ষেত্রে এই নীতির ভবিষ্যত ইঙ্গিত দিয়েছেন।
কিন্তু কিছুতেই দক্ষিণ ভারতের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। দক্ষিণ ভারতে ধর্ম উন্মাদনা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের নিগড় উত্তর ভারতের চাইতে কম নয়। হিন্দু পুনরুত্থানের তিন দিকপতি শঙ্কর, মাধব ও রামানুজ দক্ষিণী। মধ্য যুগের হিন্দু ভক্তিবাদের প্লাবনের সূচনা তামিল অন্ত্যজ বৈষ্ণব এবং মিশ্র শৈব সন্ত কবিদের মাধ্যমে। দক্ষিণে আসলে আটকাচ্ছে হিন্দি ভাষা, হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি ও আর্যবর্তের আধিপত্য বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে।
তাই এই রাম লালার রং কালো, পাথর দক্ষিণের, শিল্পী দক্ষিণী। রামমন্দিরের গাত্র শিল্পে দক্ষিণী শৈলী। রাম মন্দির ঘিরে অন্যান্য মন্দির বলয়ে দক্ষিণী মন্দির। তোরণে গোপুরমের ছাপ। কৃষ্ণের দক্ষিণী অবতার বিত্তল, বালাজি দের রামের সাথে হাইব্রিড করার মরীয়া চেষ্টা। মোদিজির দক্ষিণের মন্দিরগুলি লাগাতার চষে বেড়ানো এবং এক্স হান্ডলে ও সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া, সঙ্গে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ঘোষণা। শেষ লগ্নে রামেশ্বরমের সমুদ্রে ডুব দেওয়া।
কলকাতার মল্লিক ঘাটে আজ ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি। হাওড়া – বড় বাজারের বাইক আরোহী বানর সেনাদের জয়োধজ হাতে মুহুর্মুহু ‘ জয় শ্রীরাম ‘ ধ্বনি। ….
২২.০১.২০২৪
চমৎকার