Skip to content
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

প্রাপ্তি – ২য় কিস্তি

Screenshot_2023-09-16-21-51-04-97_680d03679600f7af0b4c700c6b270fe7
Dr. Aniruddha Deb

Dr. Aniruddha Deb

Psychiatrist, Writer
My Other Posts
  • September 17, 2023
  • 9:15 am
  • No Comments

~পাঁচ~

শহর থেকে বহুদূরে ছোটো গঞ্জ আমোদপুর। বড়ো রাস্তা, মানে স্টেট হাইওয়ে গিয়েছে গ্রামটার গা দিয়ে। রাস্তার দু-ধারে উৎসাহীরা দোকান দিয়েছে এই আশায়, যে বাস, গাড়ি থামলে চার-পয়সার বিজনেস হবে। সব মিলিয়ে গোটা বিশ-বাইশ দোকান। আমোদপুরে সব মিলিয়ে শ-দুয়েক ফ্যামিলি। তার মধ্যে প্রায় দেড়শো ঘর মুসলমান। বাকি হিন্দু, কিন্তু তাদের মধ্যে উচ্চবর্ণ প্রায় নেই। সেখানে কিছুদিন হল বাসা বেঁধেছে একটা নতুন মানুষ। সে হিন্দু। শুধু হিন্দু না, বামুন। চক্কোত্তি। মোড়ল শেখ নসিবুল্লার ছেলে শামীমের দোকানটা ভাড়া নিয়েছিল ‘নকডাউনের’ ঠিক আগে। বলেছিল, জেরক্সের দোকান দেবে। গ্রামের লোক, হিন্দু-মুসলমান একযোগে নসিবুল্লার কাছে নালিশ জানিয়েছিল। কাজটা ভালো হচ্ছে? দিনকাল ভালো নয়। এর মধ্যে একটা উটকো লোক, দেখতে শুনতে পুরোদস্তুর শহুরে, সে কেন এখানে এসে ঠাঁই গাড়বে? নসিবুল্লা ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন গাঁয়ের লোকের আপত্তির কথা। শামীম গা করেনি। আব্বাকে বলেছে, লোকটা শামীমেরই বয়সী, চিন্তার কিছু নেই। গ্রামে ইশকুল আছে, মাদ্রাসা আছে, আশপাশের চার পাঁচটা গ্রাম থেকে ফি বছর শ-খানেক বাচ্চা পরীক্ষা দেয় শুনে বলেছে জেরক্সের দোকান দেবে। গাঁয়ের লোকের মুরোদ নেই, অন্য কেউ ভালো কিছু করতে চাইলে ব্যাগড়া দেবে।

নসিবুল্লা তা-ও মানেননি। ওই মুরোদটা তো শামীমই দেখাতে পারত। বাপের খেয়ে ঘুরে বেড়ানোটাই ধান্দা। সহজে রোজগারের পথ হাসিল হয়েছে, এখন শামীম আর কোনও দিকে তাকাবে না। বাধ্য হয়ে নসিবুল্লা গাঁয়ের লোককেই বলে রেখেছিলেন, গোলমালের আভাসটুকু দেখলেই ভালো রকম ধোলাই দিয়ে গাঁ-ছাড়া করতে। আরও বেশি করে বলেছিলেন, যখন শামীম নিজেই লোকটা আসার পরে তাকে চিনতে পারেনি। দেখা গেছিল শামীম যাকে শহুরে পোশাকে, এক মাথা চুলদাড়ি সমেত কেবল দেখেছে, সে ধুতি ফতুয়া পরে, ন্যাড়ামাথা, চাঁছা-দাড়িগোঁফ হয়ে এসেছে। মুখে বলেছিল ‘করোলা’য় সব আত্মীয়-স্বজন খুইয়ে বিবাগী-মতন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সহজে তাতে গাঁয়ের লোকের ভবি ভোলেনি।

তবে বছরখানেক প্রায় পেরিয়ে গেল, কোনও গোলমাল কারও নজরে পড়েনি এখনও। চালচলন, হাবভাবে গোলমাল নেই, এমনকী পয়সাকড়ির ব্যাপারেও একদম পাকা কথার লোক নাড়ুগোপাল চক্কোত্তি। এসে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব, হিন্দু, মুসলমান দুই সমাজের সঙ্গেই বন্ধুত্ব, পালপার্বনে প্রতিবেশীর সঙ্গে যোগাযোগ — সবই বজায় রেখেছে। নিজের মতো থাকে। কাউকে জ্বালায় না, কারও পাকা ধানে মই দেয় না।

দোকানের বাইরে নাড়ুগোপাল দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে পিঁড়িতে বসে ছিল। রাস্তার ওপারে মদিনা ক্লথ স্টোর্সের মালিক তারিক, আর পাশের চায়ের দোকানদার, তার ভায়রা হাবিব, দু-জনে তারিকের দোকানে বসে গ্যাঁজাচ্ছে। একবার ভাবল, গিয়ে যোগ দেয়, তারপর ভাবল, নাঃ। যত কম লোক ওর সম্বন্ধে জানতে পারে, ততই ভালো। তাছাড়া কিছুদিন পর থেকেই আকন্দপুরে নিজের জমি-ভিটের দখলদারির কাজ শুরু করতে হবে। তখন হয়ত স্থানীয় লোক কারও কারও সঙ্গে বিরোধ লাগবে। সুতরাং বেশি দহরম মহরম করে কাজ নেই।

মদিনা ক্লথ স্টোর্স-এর ভেতরে হাবিব বলছিল, “মনে তো হয় ইদিকেই চেয়ে আছে। দোকানের মদ্ধি আমাদের দ্যাখতে পায়?”

তারিক বলল, “আরে দ্যাখলেই বা কী? নিজের দোকানে বসে কথা কইছি… তাছাড়া ওর দিষ্টি ইদিকপানে লয়। রাস্তা দ্যাখে। কে আসে কে যায়, দ্যাখে।”

“তুই জানিস?”

“জানি নে? দেকি নে? গাঁয়ের মানুষ গেলে গেরাজ্‌ঝি নাই। বায়রের গাড়ি আসতি দ্যাখলে শরীল টান হই যায়। বিশেষ, সে এইদিক থেকি আসলে আরও। ঘাড় ঘুরায়ে দ্যাখে, যতক্ষণ না ও-ও-ওই দূরের বাঁক পার করতেছে। তারপরও বার বার ঘাড় ফিরায়ে দ্যাখে।”

“কী দ্যাখে? যাওয়া গাড়ি ফিরে কি না?”

“আল্লায় জানে… দ্যাখে, এইটুকু দেখি। ক্যাবল এ-ই না। বাস আসলিও দ্যাখে, কিন্তুক তখন ভিতরে যায়। আন্ধার থেকি দ্যাখে, কে আসে, কে যায়… কে লামে বাস থিকি।”

হাবিবের ভুরু কোঁচকায়। “ক্যানে? লুকায়ে ক্যানে? অমনে দ্যাখলে কী হয়? আমরাও তো দেখি। রোজই তো কেউ না কেউ যায়, আবার ফিরে…”

তারিক মাথা নেড়ে বলে, “তা আমি জানিনে। তবে গাঁয়ের লোকেরে দ্যাখে না। দ্যাখে বাইরে থিকা কেউ আসছে কি না।”

হাবিব বলল, “তা তুই জানলি ক্যামনে?”

তারিক বলল, “গাঁয়ের চিনা লোক লাইমলে লগে লগে বাইর হয়। একদিন দীনু ময়রা আসছিল, তারে তো চিনে না। সে লামার পরে আর বেরয় না। দীনু আসল, আমারে আদাব কইল, তোর দোকানে চা খাইল… মনে নাই?”

হাবিব বলল, “হাঁ, এই তো সেদিন।”

“তারপর গাঁয়ের লোকে আসল, কথা কইল, তারপর সে বাইর হইলো।”

“আশ্চজ্জি! কিন্তু কেন?”

“কেন কে জানে।”

ওদের আলোচনা চলাকালীন রাস্তার ওপারের দোকানে নাড়ুগোপাল ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। অন্ধকার হয়ে আসছে, এবার রান্নার বন্দোবস্ত করতে হবে। চিরকাল রাঁধুনির রান্না খাওয়া লোকটা, এখানে আসার কিছুদিন আগেও জোম্যাটো আর সুইগি করে খাবার আনাত যে, সে আজ হাত পুড়িয়ে রাঁধতে বসেছে। হাসি পায়।

~ছয়~

রাত হয়েছে। এখনও বাস পাওয়া যাবে, আর লক্ষ্মণ যদি গাড়ি করে পৌঁছে দেয়, তাহলে আরও ঘণ্টাখানেক পরে যাওয়া যাবে। বাইরের ঘরে লক্ষ্মণ বসে টিভি দেখছে। ওকে জিজ্ঞেস করবেন, না…

দরজায় লক্ষ্মণ এসে দাঁড়াল। “হো গিয়া, ওকিলসাব?”

মাথা নাড়লেন তারাশঙ্কর। “অনেক কাগজ হে, একদিনে হবে না। সারাদিন কাজ করলেও অন্তত তিন চার দিন।”

আগের বারও জমিজমার দলিল খোঁজার সময় মনে হয়েছিল, এখন আরও মনে হচ্ছে — কাগজপত্রগুলো ইচ্ছে করেই গোলমাল করে মিলিয়ে মিশিয়ে রাখা হয়েছে। এ কেবল অগোছালো করে রাখা নয়। আগের বার হাতে সময় ছিল না। মনে হয়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলেটাকে পেতে হবে। কিন্তু এখন ভালো করে দেখতে হবে। তাই তারাশঙ্কর কাগজ পরীক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে গোছাচ্ছিলেনও। যদি ভবিষ্যতেও কাজে লাগে?

মুখ তুলে বললেন, “তুমি এখন যাবে, লক্ষ্মণ?”

লক্ষ্মণ উত্তর দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “বেহেতর আপ ঘর যাও উকিলসাব। কাল ফির আনা।”

এক লহমায় সমস্তটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আর এক মুহূর্ত লাগল তারাশঙ্করের নিজেকে সামলে নিয়ে কলম বন্ধ করে নিজের কাগজগুলো গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে। তারপর বললেন, “এই ঘরে কেউ না আসে। বন্ধ করে দিও। তালা দিলে ভালো হয়।”

লক্ষ্মণ বলল, “কোই নেহি আয়েগা। তালাকা জরুরত হ্যায় নেহি।”

দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল লক্ষ্মণ। উকিলবাবু বেরোলেন। নিচের ঘরে আর কেউ নেই। বাইরেও কেউ নেই। অর্থাৎ ঠিকই বুঝেছেন। পাহারা আর থাকবে না। মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেটা কোথায়, তা-ও এতদিনের অভিজ্ঞতায় তারাশঙ্কর জানেন। অল্প শিউরে উঠলেন। আর না ভেবে পা চালালেন বাস স্টপের দিকে।

বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে লক্ষ্মণ আস্তে আস্তে সিঁড়ি চড়তে আরম্ভ করল, মিনির ঘরের দিকে।

সামান্য কিছু ব্যায়াম সেরে মিনি আবার শুয়েছিল বিছানায়। আজকাল করার কিছু থাকে না। এ ঘরে টিভিও নেই, বইপত্রও কিছু নেই। অবশ্য মিনির বই পড়ার অভ্যেস নেই মোটেই। ঘরের আদত মালিক, দীপব্রত বা তার ভাই পরাগব্রতরও ছিল না। কাগজও পড়ত না, কেবল টিভি দেখত। টিভি নিচের তলায়। সেখানে এখন শুধু ওর পাহারাদারেরা বসে থাকে। এ ছাড়া আর কোথাও যেতে পারে না মিনি। বাগানে যাওয়া বারণ, ছাদে উঠে পায়চারি বারণ। ওর সামনেই সিংজীর পেয়ারের গুণ্ডা লক্ষ্মণ তালা লাগিয়ে গেছে। লক্ষ্মণকে মিনি সহ্য করতে পারে না। যদিও কোনও দিন কিছু বলেওনি, কিছু করেওনি — মিনির ধারণা ওর নজর থাকে মিনির দিকে। কখনও আগে মনে হয়েছে যেন আড়চোখে ওকে মাপছে। তখনও হয়েছিল, এখনও মনে পড়তেই যেন অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল মিনির।

মিনি জানত লক্ষ্মণ এখন নিচে রয়েছে। গাড়ি এসেছে। ইঞ্জিনের শব্দ পেয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়েছিল। এই গাড়িটা কেবল লক্ষ্মণই চালায়।

বেড়েছে। গাড়িটা এখনও রয়েছে। মানে লক্ষ্মণ আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা নিচের তলায় রয়েছে। কী করছে এখনও? সাধারণত আটটা নাগাদ রাতের পাহারাদাররা আসে। সাড়ে আটটা, পৌনে নটা নাগাদ একজন ওপরে উঠে এসে জানতে চায় দিদি, বা মেডাম, কী খাবেন? মিনি বলে দিলে ওরা জোম্যাটো বা সুইগি করে আনিয়ে নেয়।

সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এখনও কেউ আসেনি কেন? মিনির খিদে পাচ্ছিল। একবার দরজাটা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে নিচের তলায় দেখেছিল। লক্ষ্মণ নিচে একলা বসে টিভি-র সামনে। বাকি দুজন কোথায়? খাবার আনতে গেছে? মিনিকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি — কেন?

আরও আধঘণ্টা পর মিনি বাধ্য হয়ে ঘরে রাখা কিছু পুরোনো বিস্কুট খেয়েছিল। তারপর জল। কিন্তু সে-ও তলিয়ে গেছে।

নিচতলায় টিভি বন্ধ হল? কথাবার্তা? খাবার নিয়ে ফিরল লোকগুলো? কিন্তু না, ওরকম কথাবার্তা নয়। মিনি আস্তে আস্তে দরজা ফাঁক করল। নিচের তলায় লক্ষ্মণ অফিস ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ভেতরে কে? দেখতে দেখতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল — তারাশঙ্কর উকিল! সে-ও এসেছে? আবার এসেছে কেন? উকিলবাবু বেরিয়ে গেল। এবার মিনি বুঝতে পারছে নিচে লক্ষ্মণ একাই। পাহারাদার দুজন হয় নেই, নয়ত বাইরে। লক্ষ্মণ বাইরের দরজা বন্ধ করল। ছিটকিনি, আগল দুই-ই লাগাল। মিনির ভয় করছে। লক্ষ্মণ দরজা থেকে ঘুরে সোজা তাকাল মিনির ঘরের দিকে। চট করে দরজা থেকে সরে গেল মিনি। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। দেখতে পেল? মিনি বিছানায় গিয়ে বসল। দরজা রইল ওমনিই। মিনির একা থাকা শুরু হবার পরে একদিন লক্ষ্মণই এসে ভেতর থেকে বন্ধ করার সব ছিটকিনি খুলে দিয়েছিল। এমনকি বাথরুমেও ছিটকিনি খুলে দিয়ে একটা পাতলা এক ইঞ্চির হুক লাগিয়ে গেছিল। এর কারণ মিনি জানে না। এতটুকু জানে, যে তার পর থেকে ও আর নিশ্চিন্তে এক মুহূর্ত কাটায়নি।

লক্ষ্মণের পায়ের শব্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ঘরগুলোর সামনের ঝুলবারান্দা দিয়ে এগিয়ে এসে থামল মিনির দরজার সামনে। কাঠ হয়ে বসে মিনি। লক্ষ্মণের হাতের ছোঁয়ায় দরজা খুলল। আড়চোখে সেদিকে চেয়ে দেখে মিনির বুকটা আবার শুকিয়ে গেল। মাত্র বাইশ বছর বয়সে বহু পুরুষের সঙ্গে সহবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। পুরুষের চোখের দৃষ্টি ও চেনে। লক্ষ্মণের চোখেও আজ সেই চাহিদা ফুটে উঠছে।

পায়ে পায়ে লক্ষ্মণ এসে সামনে দাঁড়াল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “তৈয়ার হো যাও। যানা হ্যায়। কপড়া বদল লেনা। ইস কাপড়া মে বাহার নেহি যানা।”

অবাক হয়ে লক্ষ্মণের দিকে তাকাল মিনি। এ কথার অর্থ? কোনটা বেশি জরুরি ঠিক ধরতে পারল না — তুমি বলা, তৈরি হয়ে বেরোনোর কথাটা, না পোশাক বদলের নির্দেশ! পরনের স্কার্ট ব্লাউজের সেট-টা সিংজী স্বয়ং দিয়েছিলেন জন্মদিনে। সেটা নিয়ে সিংজীর অধস্তন কেউ, সে যে-ই হোক, মন্তব্য করছে, ভাবা-ই যায় না। এবং এক্ষেত্রে, লক্ষ্মণ, যে আর যা-ই হোক, সামান্য ভৃত্যই তো — ওর কাজ যা-ই হোক, দারোয়ান বা বডিগার্ডের চেয়ে বেশি কিছুই নয় — সে মিনিকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে পোশাক পরা নিয়ে হুকুম দেয় কোন সাহসে?

আগুপিছু না ভেবেই মিনি উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখিয়ে বলল, “গেট আউট।”

কথাটা বললে কী হতে পারে মিনি ভাবেনি। তবে মনে হয়েছিল, কম করেও লক্ষ্মণ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। যেটা হল, তা মিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। ঠাস করে চড়টা এসে পড়ল বাঁ গালে। কান মাথা ঝঁ ঝাঁ করে উঠল।

চোখে অন্ধকার দেখল। হেলে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু হাত বাড়িয়ে জামাটা ধরে ফেলল লক্ষ্মণ। হ্যাঁচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দিল। টানের ফলে ফড়ফড় করে ব্লাউজটা ছেঁড়ার শব্দ পেল মিনি। মুখের কাছে মুখ এনে লক্ষ্মণ হিসহিস করে উঠল, “শালী কুত্তী…”

লক্ষ্মণের নিঃশ্বাসে পান-মশলার চড়া গন্ধে মিনির মাথায় চড় খাওয়ার ঝিম-টা কেটে গেল। আবার চড় আসবে, আরও গালাগালি শুনবে, এই আশঙ্কায় চোখ বন্ধ করে মাথাটা ঘুরিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু দুটোর কোনওটাই হল না, তাই আড়চোখে লক্ষ্মণের দিকে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিচের তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখে আঁতকে উঠল। লক্ষ্মণের টানে ওর ব্লাউজের বোতামগুলো ছিঁড়ে, সামনেটা পুরো ঝুলে গিয়েছে। বাঁদিকের স্তনটা পুরোটা উন্মুক্ত। বাঁ হাতে জামার ঝুলে পড়া অংশটা তুলে লজ্জা নিবারণ করার আগেই আবার, হঠাৎ-ই লক্ষ্মণের মধ্যে আবার একটা পরিবর্তন হল। পুরুষের মধ্যে এই পরিবর্তনগুলো মিনি চেনে। মনে হল, এটা হতে পারে না। ওর প্রতি লক্ষ্মণের আকর্ষণ ও আগে অনুভব করেছে, কিন্তু কখনও ভাবেনি মালিকের শয্যাসঙ্গিনীর প্রতি ওর কামনা এভাবে উথলে উঠবে।

লক্ষ্মণের ধাক্কায় মিনি বিছানায় গিয়ে পড়ল। এক টানে হলদে র‍্যাপ-অ্যারাউন্ড স্কার্টটা ছিঁড়ে চলে গেল লক্ষণের হাতে। এক হাতে ওকে বিছানায় চেপে রেখে, আর এক হাতে ওর প্যান্টি খুলে নিল মিনি যেন একটা পুতুল। তারপর, অনায়াসে দু-হাতের টানে মিনির দুই উরু ফাঁক করে ফেলল লক্ষ্মণ…

মিনির কপাল একদিক থেকে ভালো, লক্ষ্মণের দম রইল না বেশিক্ষণ। যতক্ষণ ও মিনির ওপর ছিল, প্রতি মুহূর্তেই মিনির মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গলা দিয়ে প্রাণ বেরিয়ে গেল। তাই, একটু পরেই যখন লক্ষ্মণ ওর ওপর নেতিয়ে পড়ল, আধখোলা মুখের পান-মশলা মিশ্রিত গাঢ় শ্বাসে ওর নাড়িভুঁড়ি গুলিয়ে যেতে লাগল, মিনি অতি কষ্টে শরীরটা ওর নিচ থেকে টেনে বের করে এনে টলতে টলতে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। প্রথমে বমি করতে চেষ্টা করল, কিন্তু পেট খালি, কিছু বেরোল না। হাঁপাতে হাঁপাতে, ওক্‌ তুলতে তুলতে মিনি শাওয়ার খুলে তার নিচে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল।

বেশিক্ষণ এই একাকীত্বও সইল না। হঠাৎ বন্ধ দরজায় দুম দুম করে ধাক্কার শব্দে চমকে জল বন্ধ করল। বাইরে থেকে তর্জন শুনতে পেল, “দরোয়াজা খোল্… নেহি তো তোড় দুঙ্গা।” সামান্য হুক ভাঙতে লক্ষ্মণের এক সেকেন্ডও লাগবে না। তোয়ালে দিয়ে শরীরটা আড়াল করে দরজা ফাঁক করল।

লক্ষ্মণের চোখ ওর অর্ধাবৃত শরীরে। বলল, “পাঁচ মিনিট মে তৈয়ার হোনা। নিকলনা হ্যায়। এক সাড়ি পহননা, তিন-চার সাড়ি সাথ লেনা। বাস।”

মিনিকে বাথরুমে রেখে লক্ষ্মণ আবার নেমে গেল নিচে। টিভিটা চলছে এখনও। একটা পুরোনো, আগে দেখা হিন্দি ছবি। লক্ষ্মণের মন সে দিকে নেই। মিনির শরীরটা ওকে যতটা শান্তি দেবে মনে হয়েছিল, ততটা দেয়নি। বরং আরও বেড়েছে চাহিদা। এই চাহিদা লক্ষ্মণের আজকের নয়। মিনিকে যেদিন প্রথম দেখেছিল, সেদিনই ওর শরীরে-মনে আগুন লেগেছিল। ভাবত, একবার… শুধু একবার কি মিনিকে ভোগ করতে পারবে না? আজও সারা সন্ধে বসে ভেবেছিল ভগবান জুটিয়ে দিয়েছেন। ভোগ করে নিয়ে সাবাড় করে দিলেই হবে। হবে না। সাবাড় এত তাড়াতাড়ি করা যাবে না।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে মিনি ত্রস্ত হাতে শাড়ি পরল। মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা একত্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। লক্ষ্মণের সঙ্গে মিনির সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। এর অর্থ কি এই, যে এখন থেকে সিংজীর আশ্রয়ে থেকেই লক্ষ্মণের সখও মেটাতে হবে? এটা কি নতুন মাত্রা যোগ হল, না সিংজীর ছত্রছায়া থেকে ওর নির্বাসন? এখন সিংজী কি শরীরের সুখ পেতে অন্য কারও বিছানায় যাবে? হোটেলের ওই স্যুইটটা আর কেউ পেয়ে গেছে এর মধ্যেই?

কোন শাড়িগুলো নেওয়া যায়? শাড়ি মিনির খুব পছন্দের পরিচ্ছদ নয়। পশ্চিমী পোশাক ওর প্রিয়। আগে সিংজীর কিছু খদ্দের বা বিজনেস পার্টনারকে খুশি করতে শাড়ি পরত, আর শেষ কিছুদিন পরত দীপব্রতর ইচ্ছায়। এই আলমারির বেশির ভাগ শাড়িই দীপব্রতর দেওয়া। হঠাৎ শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে এল। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মিনি বিছানায় বসে পড়ল দু-হাতে মাথাটা ধরে। কী হতে চলেছে ওর জীবনে?
ঠিক তখনই দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এল লক্ষ্মণ। “হো গিয়া?” কাছে এল। “হো গিয়া?” বাক্সের ভেতর হাত দিয়ে দেখল। শাড়িগুলোর গায়ে হাত বোলাল। ওই মোটা মোটা আঙুলগুলো একটু আগেই ওর শরীরের খাঁজে খাঁজে ঘুরছিল। শরীরটা আবার গুলিয়ে উঠল মিনির।
লক্ষ্মণ ওর বাক্সের পাশে খাটের ওপরেই বসে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে, এক এক করে সমস্ত কথাই বলে ফেলল। সিংজী বলেছেন মিনিকে সরিয়ে ফেলতে। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়, মিনির মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায় না যেন। কিন্তু লক্ষ্মণ ঠিক করেছে তা করবে না। মিনিকে নিয়ে যাবে নিজের কাছে। নিজের মতো রাখবে কাছে। মিনি রাজি হলে ভালো, নইলে ওকে নিকেশ করে লাশ গায়েব করতে এক মিনিটও লাগবে না।

শুনতে শুনতে মিনির মাথাটা গুলিয়ে উঠেছিল আবার। আচ্ছন্নের মতো লাগছিল। মাথাটা টলে গেছিল। পড়ে যেত, কিন্তু লক্ষ্মণ ছিল পাশেই। লক্ষ্মণের ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরল।

“আবে, উঠ্, ছিনাল কাঁহিকি, নৌটঙ্কি বন্ধ্ আজসে। একদম বন্ধ্! বরনা এক এক থাপ্পড় লাগেগা।”

মিনির পড়ে যাওয়ার ভুল অর্থ করেছে লক্ষ্মণ।

উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণ ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে তুলল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল মিনি। লক্ষ্মণ এক হাতে বাক্সটা বন্ধ করে হাতে ঝুলিয়ে নিল। অন্য হাতে মিনির কনুইয়ের ওপরটা টানল। মিনি চুপচাপ সঙ্গে চলল। বাইরে এসে লক্ষ্মণ দরজা বন্ধ করল। বাইরের বারান্দায় ইলেকট্রিক মিটার বক্স। তার পাশেই দুটো মেইন সুইচ। কোনটা কিসের, জানে না লক্ষ্মণ। দুটোই নিভিয়ে দিল। অবশ্য নেভানো বা জ্বালানোতে আর তফাত হবে কি? এতদিন মিনি রয়েছে বলেই সিংজী ইলেকট্রিক বিল দিতেন। এখনও কি আর দেবেন?

মিনিকে টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলল। মিনি কি একবারও ভেবেছিল বাধা দেবে? দিলে কী হত? ঘড়িতে রাত প্রায় একটা। গোটা পাড়াই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ছড়ানো ছেটানো দু-একটা জানলায় আলো জ্বলছে। আজকাল অনেকেই নানা কারণে সারা রাতই জেগে থাকে।

তারা কেউই শুনলও না একটা গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে মুখার্জিবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

~সাত~

দিন বারো পরে উকিল তারাশঙ্করবাবু ভাগনে সত্যজিৎ প্রথম দামী কাগজটা পেল। ভুবনব্রত মুখার্জির অফিসঘরের অজস্র কাগজ যে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উথালপাতাল করে মিশিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই আর। ছাপাখানার কাগজের সঙ্গে ইনশিওরেন্সের আদ্যিকালের রসিদ, ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে পাম্পের মিস্তিরির ঠিকানা, প্রায় পাতায় পাতায় এহেন নানাবিধ অজস্র গোলমাল কোনও একজন মানুষের পক্ষে ঠিক করা সম্ভব না। তাই চার দিন হল সত্যজিৎকেও আনছেন সঙ্গে।

দুপুরেই দু-জনে আলোচনা করেছিলেন। নিজের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে এমন কোনও দলিল রেখে যায়নি পরাগব্রত। শুধু তা-ই নয়, ভুবনব্রতর সম্পত্তিরও কোনও দলিল নেই। এমনকি এ-বাড়ির দলিলটাও নেই।

মাথা নেড়েছিল সত্যজিৎ। ওর মতে সব কাগজ হয়ত সরাতে পারেনি। সরালে কেন আবার সব মিলিয়ে মিশিয়ে রাখবে? ও জানত না সব সরিয়েছে কি না। তাই কাগজপত্র হিজিবিজি করেছে।

“মামা? ভুবনব্রত মুখার্জির ওয়াইফের নাম প্রতিভা মুখার্জি ছিল?”

কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তারাশঙ্কর বললেন, “উঁ? কী ছিল?” তারপরেই খেয়াল হল, বললেন, “হ্যাঁ। প্রতিভা মুখার্জি। কেন?”

“আর ওদের তো একটাই ছেলে?”

আবার হ্যাঁ বললেন তারাশঙ্কর। পরাগব্রত তো দত্তক নেওয়া।

হাতে ধরা কাগজটা মামার দিকে বাড়িয়ে সত্যজিৎ বলল, “এটা জন্মের সময়ের কাগজ।”

“কার?” কাগজটা হাতে নিলেন তারাশঙ্কর। প্রতিভা মুখার্জি চার দিন ভর্তি ছিলেন শহরের উত্তর দিকের একটা নামী নার্সিং হোমে। সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে। ওজন তিন কেজি সাতশো।

“এটা দীপব্রত,” বললেন তারাশঙ্কর। “পরাগব্রত নয়।”

“হ্যাঁ। কিন্তু দুজন তো একই বয়সী ছিল। স্কুলের রেজিস্টারে তো তাই লেখা ছিল।” মুখার্জিদের অতীত খুঁজতে সত্যজিৎ সেখানেও গেছিল। “যদি একই ডাক্তার দু-জনের জন্ম দিয়ে থাকে?”

দু-ভাইয়ের কারওর বার্থ সাটিফিকেট পাওয়া যায়নি। শুধু ডেট অফ বার্থ লেখা ছিল স্কুলের রেজিস্টারে।

“গাইনেকোলজিস্টের নাম রয়েছে। নার্সিং হোমে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে।”

তারাশঙ্করের কপালে ভ্রূকুটি। “বলছিস? সে কবেকার কথা… কে জানে বেঁচে আছে কি না?”

ডিটেকটিভ মানসিকতা সত্যজিতের। বলল, “সার্টিফিকেটে ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে। অনলাইন এক্ষুনি পেয়ে যাব।”

এসব বোঝেন না তারাশঙ্কর উকিল। সত্যজিৎ দেখিয়ে দিল কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মেডিক্যাল কাউনসিলের ওয়েবসাইটে গিয়ে একলহমায় রেজিষ্ট্রেশন নম্বর লিখে ডাক্তারের নাম-ধাম বের করে আনা যায়।

“নার্সিং হোম, বাড়ির ঠিকানা দুইই শ্যামবাজার অঞ্চলে,” বলল সত্যজিৎ। “কাল গিয়ে খোঁজ নেব।”

তারাশঙ্কর বললেন, “মনে থাকলেও ডাক্তার কি তার রোগীর কথা বলবে?”

সত্যজিৎ বলল, “কায়দা করে বের করতে হবে। দেখি, কাল গিয়ে। তবে নার্সিং হোম-টা বোধহয় নেই।”

“কী করে বুঝলি?”

“এখানে ফোন নম্বরটা আদ্যিকালের। সাত ডিজিটের ল্যান্ডলাইন। সামনে দুই বসিয়ে ডায়াল করলাম, বলল, এই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। ইন্টারনেটেও এই নার্সিং হোমের হদিস পাচ্ছি না।”

তারাশঙ্কর বললেন, “এক সময়ে বেশ নামকরা নার্সিং হোম ছিল।”

সত্যজিৎ বলল, “তাই? তাহলে নির্ঘাত উঠে গেছে, নইলে আমিও তো নাম শুনতাম।”

তারাশঙ্করের মনে হচ্ছিল না নার্সিং হোম বা ডাক্তারকে দিয়ে কিছু হবে, তাই কথা না বাড়িয়ে কাগজ গোছানোর দিকে মন দিলেন।

~আট~

প্রায় দু-সপ্তাহ হল মিনির নতুন জীবন শুরু হয়েছে। অতীতের তুলনায় অতীব কষ্টদায়ক এই দিনচর্যা। মাঝরাতে লক্ষ্মণ গাড়ি করে কোথায় নিয়ে গেছিল, ও চেনে না, তবে আন্দাজ করেছিল, শহরের মাঝখানে কোনও বস্তি। এখানে গরিব মানুষের বাস। চারপাশে দোকান-বাজার। বড়ো রাস্তায় আলো-ঝলমল, ঝকঝকে দোকান, রেস্টুরেন্ট, অফিস। এখন অবশ্য মাঝরাত, অন্ধকার, সব দরজা বন্ধ। চেনা রাস্তাটা অচেনা। কিছু দূরে দূরে, দুটো বাড়ির ফাঁকে ফাঁকে এক একটা গলি। বড়ো রাস্তার ফুটপাথ ঘেঁষে গাড়ি পার্ক করে, তালা দিয়ে সেরকমই একটা গলিপথে ওকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছিল লক্ষ্মণ। দু-চার পা যেতে না যেতেই ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে মিনি দিকভ্রান্ত হয়ে গেছিল। তবে পেছনেই ছিল লক্ষ্মণ। চাপা-স্বরে পেছন থেকে ‘আগে ডাইনে,’ ‘আব বাঁয়ে,’ বলে বলে নির্দেশ দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত, প্রায় পাক্কা মিনিট পাঁচেক হেঁটে শেষে লক্ষ্মণ একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভাগ্যিস! গত প্রায় তিন বছর বাড়ির বাইরে পা-রাখেনি মিনি, তার মধ্যে প্রায় দু-বছর দীপব্রতর ঘরটাতেই বন্দিদশা কেটেছে। অনভ্যস্ত, মেদবহুল শরীর নিয়ে হাঁপিয়ে গেছে এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে। তবু ভালো স্যুটকেসটা লক্ষ্মণই নিয়েছে। যত অল্পই ওজন হোক, ওটা নিয়ে চলতে মিনি পারতই না। দরজার পাশের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে নিতে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করল মিনি। সরু গলি। সাইকেলের চেয়ে চওড়া কোনও বাহন চলবে কি না সন্দেহ। দু-পাশের বাড়িগুলো দোতলা।

হুড়কো খোলার খটখট শব্দ। ঝনাৎ শব্দে একটা শিকল পড়েছিল। তারপর খুলে গেছিল দরজা।

ভেতরে একটা… বাচ্চা? না, অন্ধকারে ভুল হয়েছিল মিনির… এক অশীতিপর বৃদ্ধা, শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে ভাঁজ হয়ে গেছে, দরজা খুলে সরে দাঁড়িয়েছিল। মাথা নুইয়ে ভেতরে ঢুকেছিল লক্ষ্মণ। পেছনে মিনি।

একচিলতে বাঁধানো উঠোন। ডাইনে বাঁয়ে কী আছে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না। সামনে একটা ঘর। ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে ম্লান আলো। মিনির কনুইয়ের ওপরটা ধরে বাড়ির পাশের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছিল লক্ষ্মণ। কিছুটা এগিয়ে, ততক্ষণে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে বলেও, আবার কাছে আসার জন্যেও, একটা দরজা দেখতে পেয়েছিল। লক্ষ্মণ পাল্লাটা টান মেরে খুলে, কনুই ধরা অবস্থাতেই ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতে স্যুটকেসটা দিয়ে বলেছিল, “যা, উপর কমরা মে যাকে কপড়া উতার লেনা। ম্যায় আভি আয়া।”

ভেতরে কী আছে দেখতে পাবার আগেই লক্ষ্মণ বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনিতেই ভেতরে আলো পৌঁছচ্ছিল না, তার ওপর দরজা বন্ধ করায় অন্ধকার একেবারে আলকাতরার মতো। মিনি কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুঝেছিল, এত অন্ধকারে চোখ আর সইবে না। সেই সঙ্গে ভয়ও পাচ্ছিল, যদি লক্ষ্মণ ফিরে এসে দেখে ও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে, আবার হয়ত মারবে।

শেষে হাত বাড়িয়ে, পা ঘষে ঘষে এগিয়ে সিঁড়িটা পেয়েছিল। খাড়া সিঁড়ি উঠেছে বাড়ির পাশ দিয়ে দোতলা অবধি। বেশ উঁচু উঁচু ধাপ, আগেকার দিনের বাড়ি বলেই বোধহয়।

এগারোটা ধাপের পর সিঁড়ি শেষ। আবার আন্দাজে দরজাটা হাতে পেয়েছিল। বন্ধ। লক্ষ্মণ ঘরে যেতে বলেছিল, তাহলে দরজায় নিশ্চয়ই তালা নেই? হাত বুলিয়ে হুড়কোটা খুলে ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে আবার মুশকিলে পড়েছিল মিনি। সুইচবোর্ড? এখানে অবশ্য অন্ধকার অত ঘন ছিল না। নিচের দরজা-খোলা ঘরটার ওপরেই, বাইরের দিকে দুটো বড়ো, মাটি থেকে ছাদ ছোঁয়া পাল্লা খোলা জানলা, তার পর্দা-বিহীন গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচের আলোটার মৃদু আভা ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হয়েছিল এই আলোতে পোশাক বদলানোর মতো সহজ কাজটা করতে পারবে, কিন্তু তার পরমুহূর্তেই দুটো কথা মনে পড়ে আবার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল মিনির।

লক্ষ্মণ ওকে পোশাক ছাড়তে বলেছিল। বদলাতে নয়! আর দ্বিতীয়টা আপাতদৃষ্টিতে অত ভয়ঙ্কর না হলেও অতীব অস্বস্তিকর তো বটেই — মিনির বাক্স গোছানো শেষ হবার আগেই লক্ষ্মণ এসে পড়েছিল। ফলে শাড়ি-ব্লাউজ-অন্তর্বাস নিলেও মিনির বাক্সে রাত-পোশাক নেই।

শাড়ি পরে কোনও দিন ঘুমোয়নি মিনি। আশ্চর্য, এত বিপদেও এর আগে যে মিনির কান্না পায়নি, তার তখন চোখ ফেটে যেন জল বেরিয়ে আসছিল। খিদেয় পেট জ্বলছিল। তেষ্টাও পেয়েছিল খুব। লক্ষ্মণ কি খাবারদাবার কিছু আনবে? বলা উচিত ছিল? কিন্তু সারা সন্ধে লক্ষ্মণের মেজাজ, কথাবার্তা, মার আর জামা ছিঁড়ে নিয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতায় মিনি বিহ্বল হয়ে গেছিল।

চিন্তার সুতো ছিঁড়েছিল সিঁড়িতে লক্ষ্মণের ভারি পায়ের শব্দে। কিছু করার আগেই দরজা ঠেলে ঢুকে লক্ষ্মণ খেঁকিয়ে উঠে জানতে চেয়েছিল অন্ধকারে কেন দাঁড়িয়ে আছে মিনি।

শুকনো টাকরায় শুকনো জিভ আটকে গেছিল, ঠোঁটে ঠোঁট সেঁটে গেছিল। কোনও রকমে, “লাইট সুইচ…,” বলেছিল মিনি।

নাক-মুখ থেকে ঘোঁত শব্দ করে লক্ষ্মণ দেওয়ালের এক কোনায় সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়েছিল। অল্প আলোয় দেখা গেছিল একটা কাঠের খাটিয়া, তাতে পাতলা তোশকের ওপর একটা বালিশ, আর একটা কাঠের চেয়ার। এইটুকু সময়েই লক্ষ্মণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল। বলেছিল, “কেয়া হুয়া? উতারো কাপড়া।”

মিনি বলেছিল, “নাইটি আনিনি। শাড়িই পরতে হবে।”

“কেয়া বোলা?” লক্ষ্মণ সবে বসতে যাচ্ছিল বিছানায়, ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছিল। “কেয়া বোলা তু?”

এক ঝটকায় সুটকেসটা খুলে ভেতরের সবকিছু ছড়িয়ে ফেলেছিল মেঝেতে। তারপর, হতভম্ব মিনির বিস্ফারিত চোখের সামনে এক এক করে সমস্ত দামী দামী লেসের অন্তর্বাসগুলো টেনে টেনে ছিঁড়েছিল। সেই সঙ্গে গর্জন, “ইয়ে সব নেহি চলেগা। সাড়ি পহননা, ঔর ইয়ে সব বেকার কি কুছ নেহি। উতার কাপড়া, লেট যা বিস্তর পে…”

কী ঘটতে চলেছে আন্দাজ করতে পেরেছিল মিনি। তবু সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল, “খিদে পেয়েছে খুব…”

কিছু আশা করে বলেনি, কিন্তু কাজ হয়েছিল। লক্ষ্মণ এবারে গলা থেকে হুঁ… জাতীয় একটা শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছিল। কাঠের মতো দাঁড়িয়ে ছিল মিনি।

দু-সপ্তাহ পরেও সেই মুহূর্তটার কথা মনে পড়লে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় শরীরে।

ক্রমশঃ

PrevPreviousশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে…
NextDr. Sthabir Dasgupta – Who Lived among People and for the PeopleNext
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

মন খারাপ করা মানেই খারাপ মনের নয়

September 23, 2023 No Comments

কেউ হয়তো দিনের পর দিন সন্তানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কারো হয়তো আইভিএফ-এর চিকিৎসা চলছে কিংবা কারও হয়তো সদ্য মাস দুয়েকের প্রেগন্যান্সি নষ্ট হয়ে গেছে,

নীট পিজি-তে এবার থেকে ‘শূন্য’ পার্সেন্টাইল পেলেও সুযোগ মিলবে…

September 23, 2023 No Comments

ডাক্তারির উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকায় (নীট পিজি) এবার থেকে ‘শূন্য’ পার্সেন্টাইল পেলেও সুযোগ মিলবে। আহা! চমকাবেন না। ঠিকই পড়ছেন। ‘শূন্য’ পার্সেন্টাইল! কয়েক বছর আগে হলেও এ নিয়ে

“না বলতে পারিনা ” — না বলতে শিখুন!

September 23, 2023 No Comments

ডা অরুনিমা ঘোষের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া।

“মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।”

September 22, 2023 3 Comments

(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এই প্রবন্ধটি ভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল অনলাইন আবহমান ওয়েবজিনে আগস্ট ২০১৯, সংখ্যায়।) চার দশক পার হয়ে গেছে। সেদিন কলকাতার বাতাসে “মুক্ত হবে

ভুল গল্প। সত্যি গল্প

September 22, 2023 No Comments

মেয়ে টা দাড়িয়ে ছিল নির্বাক। বেডে শুয়ে সদ্য খিঁচুনী হওয়া বর। নিস্তেজ। টেবিলের উপর পেপার ওয়েটের নীচে দুজনার রিপোর্ট। দুজনারই এইচ আই ভি পজিটিভ। স্বামীর

সাম্প্রতিক পোস্ট

মন খারাপ করা মানেই খারাপ মনের নয়

Dr. Indranil Saha September 23, 2023

নীট পিজি-তে এবার থেকে ‘শূন্য’ পার্সেন্টাইল পেলেও সুযোগ মিলবে…

Dr. Soumyakanti Panda September 23, 2023

“না বলতে পারিনা ” — না বলতে শিখুন!

Dr. Arunima Ghosh September 23, 2023

“মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।”

Dr. Jayanta Bhattacharya September 22, 2023

ভুল গল্প। সত্যি গল্প

Dr. Soumendu Nag September 22, 2023

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

451609
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

[wppb-register]