আপাতত ভোটযুদ্ধ শেষ। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া বড়সড় কিছু মারামারি, হানাহানি হয়নি; এটাই বাঁচোয়া। তবে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার- রাজনৈতিক দল নয়, এবারের ভোটে আসলে বাংলার মানুষ জিতে গেলেন। বাংলা ভাষাটা বেঁচে গেল। হাস্যকররকম বিকৃত উচ্চারণে ‘রভিন্দরনাথজী কা পোয়েম’ বলে, ধর্মীয় গোঁড়ামির জিগির তুলে, মানুষকে ঘরছাড়া করার ভয় দেখিয়ে যে বাংলার কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে ছোঁওয়া যায় না সেটুকু বুঝিয়ে দিলেন এ রাজ্যের মানুষ। যেখানে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে শ্রীচৈতন্যের ডাকে প্রেমের গানের প্লাবন, দু’শো বছর আগে তৎকালীন সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে সতীদাহ বন্ধের আন্দোলন, একশো পঁয়ষট্টি বছর আগে বিধবাবিবাহের প্রচলন, দেড়শো বছর আগে যে বাংলার মাঠ-নদী ভরে যায় লালনের সম্প্রীতির সুরে সেখানে মানুষকে শুধু উগ্র সাম্প্রদায়িকতার সমীকরণে বেঁধে ফেলা আকাশকুসুম কল্পনা। একশো বছর আগেই বাংলার ঈশ্বর শিখিয়েছেন, “ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো। এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।” দেশকে দাঁড়িপাল্লায় তুলে আসা কিছু বহিরাগতর সাধ্য কী এ বাংলায় ঘৃণার বীজ পোঁতে!
বাঙালী হারিয়েছে অনেক। অর্থবল কিংবা রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র উত্তর-পশ্চিমে সরে গেছে। বাঙালী-মেধায় ভাটার টান। তবু সব মোছে না। আজও বৃহত্তর অংশের বাঙালী মন্দির-মসজিদের বদলে হাসপাতাল-স্কুল চাইবে। এবারের ভোটের ফল তারই প্রতিফলন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বোতাম টেপার সময় বাঙালী আসলে ভোটটা নিজেকে দিয়েছে। প্রত্যেকটা ভোট মাতৃভাষার ওপর জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে সজোরে থাপ্পড়। প্রত্যেকটা ভোট টাকার জোরে বাঙালী পরম্পরাকে কিনে ফেলতে চাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রত্যেকটা ভোট শুধু প্রচারের ঢক্কানিনাদে দেশের কঙ্কালসার দশাকে ঢাকতে চাওয়াকে প্রত্যাখ্যান।
আপাতত বাইরের শত্রু বিদেয় হ’ল। এবার ঘরের আবর্জনা পরিষ্কারের পালা। অসংখ্য সমস্যা আছে। চাকরি হোক, ব্যবসা হোক; সব জায়গায় ঘুষের আবাদভূমি। সৎভাবে কাজ করতে গেলে হেনস্থা হওয়ার ভয়। সবাইকে দলদাস বানিয়ে রাখার চেষ্টা। মুখ খুললেই খাঁড়া তৈরি। সত্যিই রাজ্যের উন্নতি চাইলে এবার থেকে সবাইকে মোসাহেব বানিয়ে ফেলার চেষ্টাটা বন্ধ হওয়া দরকার।
খেলা শেষ হয়নি। অতিমারীর থাবা ক্রমাগত চেপে বসছে। সবচেয়ে বড় শত্রু সেটাই। অনেক হয়েছে ভোটখেলা, এবার দলমত নির্বিশেষে মারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পালা। কাল যখন হাসপাতালের গেটের কাছে চা খেতে যাচ্ছি তখন বাইরে উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজছে, পটকা ফাটছে, সংখ্যায় কম হলেও বাইকবাহিনীর উৎকট আনন্দ-উল্লাস চলছে। হাসপাতালের বেডে তখন কোনও বাচ্চা ছটফট করছে পেটের ব্যথায়, কারও জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, কেউ সম্ভাব্য রক্ত-ক্যান্সার নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে, কারও করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার চিন্তায় বাড়ির লোকের ঘুম উড়ে গেছে। তাদের সামনে এ আনন্দ অশ্লীল, এ উদযাপন কদর্য। গোটা দেশ যেখানে মারীর আক্রমণে ধুঁকছে সেখানে কীসের উল্লাস? কীসের উৎসব?
মারীও হেরে যাবে একদিন। হারতেই হবে। আমরাই হারাবো। তারপরেও লড়াই থাকবে- স্বাস্থ্যের জন্য, শিক্ষার জন্য, পেটে ভরে খাওয়ার জন্য, ছাদের জন্য, ভাষার জন্য। আমাদের গান থাকবে। বাঁচার গান, ভালোবাসার গান। আজ শুধু মুঠো শক্ত করার দিন-
“প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।”