আশির দশক। আমরা বেশ কয়েকজন সদ্য হাউস স্টাফ শেষ করে বাইরের জগতে। সবাই হয় চাকরি নয়তো পি জি-র স্বপ্ন দেখছি। কারণ ততদিনে জেনে গেছি, অল্প কাশি হলে লোকে চেস্ট স্পেশ্যালিস্ট আর বুক ধড়ফড় করলে কার্ডিওলজিস্ট খোঁজে ।
আমাদের মধ্যে দীপঙ্করই শুধু বলে উঠল, না ভাই আমি ডাক্তারি করব। বাবা বলে দিয়েছে, ডাক্তার হয়েছ এবার পাড়ায় ডাক্তারি কর।
— শেষ পর্যন্ত তুই পাতি ডাক্তার হবি?
আমাদের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বলল– তোরা বড় ডাক্তার হ’না।
এরপর আমরা ছিটকে গেলাম। কারণ তখন শুরু হয়ে গেছে জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিস) মানে পাতি ডাক্তারের কাজ।
আমার এক বি এ পাশ আত্মীয়ার এক ডাক্তারের সাথে সম্বন্ধ হওয়ায় বলেছিলাম, বাঃ ভালো পাত্র তো। তৎক্ষণাৎ একজন উত্তর দিয়েছিলেন, আরে না না শুধু এম বি বি এস।
এরপর আর সাহস হয় নি পাতি ডাক্তারি করার ।
অথচ এমন তো ছিল না।
আজ এই বয়সে এসেও ডাক্তার বলতে যে নাম ও চেহারা ভেসে ওঠে তা ‘ঠাকুর ডাক্তার’ নামে এক ভদ্রলোকের। হাওড়ায় হালদারপাড়ায় ক্লিনিক। সর্দি-কাশি, জ্বর, নাক কান দিয়ে রক্ত পড়া–সবকিছুতেই বাবা অফিস যাবার পথে বসিয়ে দিয়ে বলে যেতেন, ডাক্তারদা, একটু দেখে দেবেন। ব্যস, বাবা নিশ্চিন্তে অফিসের বাস ধরতেন।
সেই ঠাকুর ডাক্তার বাড়িতে ভিজিটে এলে দেখতাম বাবা কাকা ওনার ব্যাগ বয়ে আনতেন। বিরক্তিতে নয়,সম্মানে আর ভালোবাসায়।
সবরকম সামাজিক অনুষ্ঠানেও শেষ ব্যাচে বাবা কাকা জেঠা অপেক্ষায় আছে, ডাক্তারদা (তখনও স্যার বলা চালু হয় নি) আসেন নি। কারো ডেথ সার্টিফিকেট লিখে তার পারলৌকিক কাজেও তিনি নিমন্ত্রিত (আজকের দিনে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি)।
স্কুলের ল্যাবরেটরিতে আমার অসাবধানে অ্যাসিডে হাত পুড়ে গেছে। হাসপাতালের বড় সার্জেনকে দেখানো হলো। হেড স্যার বাবাকে ডেকে বললেন,
–তুমি বাপু একবার ভূপেনের মতামত নাও। ঐ তো দেখবে। ভূপেন অর্থাৎ ভূপেন্দ্রনাথ ঠাকুর– ঠাকুর-ডাক্তার।
তা যে কথা বলছিলাম। একই এলাকা থেকে চারজন ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছিলাম। প্রথম বাসে উঠতাম আমি, তারপর বেতড় থেকে দীপঙ্কর, দালালপুকুরে দেবু আর সবশেষে ঘোষপাড়ায় সুমিতা।
ডাক্তার হয়ে আমরা তিনজনেই পাড়া ছাড়লাম। একা দীপঙ্কর থেকে গেল ডাক্তারি করবে বলে।
তথাকথিত বিশেষজ্ঞের মুখোশ ও চাকরির নিশ্চিন্ত জীবনে আসলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলাম।
মাঝে মাঝে দীপঙ্করের চেম্বারে দেখা করতে আসতাম।
কিন্তু আমার বাবা-মা বা শুনেছি দেবুর বাবা-মার দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। আর কি আশ্চর্য আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন মনে করতেন আমাদের মধ্যে দীপঙ্করই একমাত্র ডাক্তার।
বাবা এখনও একটু অসুস্থ হলে আমার আগে দীপঙ্কর হাজির হয়ে যায়। বুঝতে পারি, সেই পাতি ডাক্তারই আজ খাঁটি ডাক্তার হয়ে গেছে।
কিন্তু আজকাল খুব ভয় হয়, এই পাতি ডাক্তাররা হারিয়ে যাচ্ছে। সেদিন ঝাঁ চকচকে নিউ টাউনে নাতনির সঙ্গে বসে খেলতে খেলতে মনে হচ্ছিল, আমার ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে কপাল কেটে যেতে ছোট পিসি কোলে করে ছুটেছিল ঠাকুর ডাক্তারের কাছে। কিন্তু এখানে কি কোনো ঠাকুর ডাক্তার বা দীপঙ্কর ডাক্তার আছে? ঝকঝকে শহরে বসে বুকটা কেঁপে উঠল। সমাজ যত দ্রুত এদের ফিরিয়ে আনবে ততই মঙ্গল।
আর হ্যাঁ, এটাও বোঝার সময় এসেছে এদের ফিজ বা দক্ষিণা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের থেকে একটুও কম নয়, তবেই মর্যাদা সহকারে এঁরা ফিরবেন।
সমাজের এঁদের আজ বড় প্রয়োজন।
Truth
দরকারি । খুব দরকারি ।