আচ্ছা, কি ব্যাপার বল তো?
আজ চলে যাব।
দাদুকে কিরকম জানি লাগলো। জানি বয়স আরো বেড়েছে, কিন্তু যে মানুষটা এত কথা বলত সে একদম চুপ, খালি মিষ্টি মিষ্টি হাসে আমাকে দেখে। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হল সন্ধ্যে হলেই লাইট নিভিয়ে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকে, যতবার লাইট জ্বালিয়ে কথা বলতে গেছি এই ৩ দিন, শুধু একটাই উত্তর: লাইটটা নিভিয়ে দাও, দাদুভাই। একটু বিশ্রাম করি।
আমি সেটা শুনে ডিস্টার্ব করিনি, কিন্তু আমার কিরকম খটকা লাগছে।আজ বিকালের ফ্লাইট আমার।আবার সেই পুজোতে আসবো। ব্যাপারটা কি?
কি হল তোমরা দুজন এরকম মুখ করে আছ কেন? আরে মা বা বাবা, কেউ তো কিছু বল?
মা, বাবাকে ইশারা করতেই বাবা বলে ওঠেন তাহলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। তুই আর থাকিস না এখানে, কবে কখন Bangalore থেকে আসবি, তাই এসব বলিনি।
তোর দাদুভাই বা আমার বাবা একটা ভয়ংকর রোগে ভুগছে। কেউ বলছে dissociative identity disorder, কেউ বলছে সিজোফ্রেনিয়া, কেউ depression আর কেউ বলছে it’s nothing but self talking।
কিছুই বুঝলাম না। একটু ডিটেইলে বলো।
নরেন্দ্রপুরে বাড়িটা আর রাখা যাচ্ছে না, ওটা একটা ভালো প্রোমোটারকে দিয়ে দেবো, ভালো রিটার্ন দেবে। তাই বাবা মাকে এখানে নিয়ে এসেছি। উনি রাজি ছিলেন না। আমরাই জোর করে…..
কিসে রাজি ছিলেন না? বাড়ি প্রোমোটারকে দেওয়া নিয়ে নিশ্চই?
তুই কি করে বুঝলি?
অনেকদিন মিশেছি মানুষটার সাথে…. তুমি বলতে থাকো শুনি…
তা এখানে আসার পর কারণে অকারণে আমার বা তোর মায়ের বন্ধু বান্ধবদের মাঝে হুটহাট কমেন্টস করে বসতেন। সবাই বিব্রত বোধ করতো। একদিন বলেই ফেললাম: তুমি এইভাবে অযাচিত জ্ঞান দিও না সবার মাঝে, লোকজন হাসাহাসি করে। আমাদের সম্মানহানি হয়।
মেনে নিল চুপচাপ জানিস: কিন্তু তারপর থেকে দেখতাম রাতে একা একটা ঘরে শুতে যেত। তোর ঠাম্মাকেও ঢুকতে দিত না। কিন্তু ঠিক ৯.৩০-তে রাতের খাবার খেয়ে ১০ টায় দরজা বন্ধ করে দিত। ১০.৩০ অবধি ঘরে ওনার আওয়াজ পাওয়া যেত, কারোর সাথে কিছু বলছেন, তারপর ঠিক ১০.৩০*এ লাইট নিভিয়ে দিতেন। আর কোনো শব্দ পাওয়া যেত না। পরের দিন জিজ্ঞাসা করলে সম্পূর্ণ অস্বীকার করত। আমার কিরকম একটা সন্দেহ হল। ডাক্তার দেখালাম। নিউরো, সাইকিয়াট্রিস্ট সব। অনেক টেস্ট হলো, কাউন্সেলিং হলো, কিন্তু বিশেষ কিছু উপকার হলো না। আমার কিরকম একটা জেদ চেপে যায়। এর শেষ দেখে ছাড়বো।কি কথা বলেন উনি…..
একদিন ওনার বিছানার নিচে একটা মোবাইল রেকর্ড টাইম দিয়ে রাখলাম। ১০ টা থেকে ১০.৩০ অবধি। সেই দিনই বাড়িতে একটা অফিস কলিগদের নিয়ে get together ছিল। হৈ চৈ খাওয়া দাওয়া সব হয়েছে: অফিসের গল্প, ইউনিয়নের কথা, ভোটের বাজার, তাই রাজনীতির কথা সবই হয়েছে। উনি নিজের ঘরেই ছিলেন। কিন্তু কথাবার্তা ওনার কানে যেতেই পারে। নিজেরা একটু ড্রিংকও করেছিলাম। যা হয় আর কি।
তা সেই দিন রাতের ওনার কথা পরদিন রেকর্ডে শুনে চমকে উঠি!
কি বলেছিল দাদু?
তোর শুনে কাজ নেই।
বাবা, প্লিজ সবটা শুনতে দাও। আমি আজ চলে যাবো। যে অবস্থায় ওনাকে দেখলাম জানি না এরপর আর দেখতে….pl carry on।
নিজের দিকে তাকাতে জানিস? নিজের কাজের জায়গা? সব গর্ধবের দল। তোর অফিসেই তো স্থায়ী আর অস্থায়ী দুরকম কর্মী আছে। অস্থায়ীরা আবার তিন রকমের। স্কিলড, সেমিস্কিলড, unskilled। এদের মোট সংখ্যা স্থায়ী কর্মীদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। এরা হাতে কলমে কাজ করে। কখনো বা একজন skilled অস্থায়ী কর্মী অনেক বেশি যোগ্য একজন স্থায়ী কর্মীর থেকে।
তা বাপু, তোদের যাবতীয় অভাব, অভিযোগ, দেনা পাওনা সব তো ঐ স্থায়ী কর্মীদের জন্য। তোরাই লাইম লাইটে থাকিস। তোরাই কোম্পানির মুখ। তোদের অনেক সুযোগ সুবিধা আছে, অনেক দাবিও আছে। কিন্তু একদিন সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের কাজ বন্ধ থাকলে তোর কোম্পানির কোনো প্রোডাকশনই হবে না, অথচ ওদের লাইম লাইটে তো দূরের কথা, দূরবীন দিয়েও দেখা যায় না।
ভারতবর্ষের রাজনীতিতেও তাই। যারা অনেক জ্ঞানী, বিদ্বান, ভোকাল, তারা সংখ্যায় কত জন?
খোদ মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সারা ভারতের মুখে অনেক পথ দেখায়, দিশা দেখায়, ভোট কতজন দেয় মুম্বাইতে জানিস?
অথচ গ্রাম গঞ্জে ৮০ শতাংশ ভোট পরে। ভোটের আগের দিনে একটা রাতের খাবারের যোগান দিলেই পরদিন ওই পার্টি ভোট পায় ওদের কাছে। এটাই আমাদের দেশ, এটাই দেশের রাজনীতি।
বাহ্ দারুন প্র্যাক্টিকাল কথা তো?
হ্যাঁ, তা তো বলবি। নিয়ে রাখ,বুঝবি:
স্কোপ থাকলে সত্যি দাদু আমার কাছে থাকতো। যাক গে, …তো, তার সাথে ঘর অন্ধকার আর চুপচাপ থাকার কারণ কি?
না, এইভাবে উনি এক একদিন একজনের মুখ দিয়ে অনেক কথা বলতে থাকেন। আমি আর বিশেষ নজর দিতাম না…
তা যেদিন প্রোমোটার আসলো কাগজ পত্র নিয়ে সইসাবুদের ব্যাপারে, সেদিন উনি বিনা বাক্যব্যয়ে সই করে দিলেন বটে, কিন্তু কি তীব্র এক ঘৃণার দৃষ্টি ছিল ওনার মুখে:
সই করে আমাকে বলে উঠলেন শুধু: মাধবীলতাও কাটা পড়বে তাই না?
আমি কিছু বলিনি। সেই দিন ইচ্ছা হলো ওনার কথাগুলো শোনার। রাতে যথারীতি রেকর্ডের বন্দোবস্ত করে রাখি। পরদিন ওটা শুনে আর মাথা ঠিক রাখতে পারি নি প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি করি। ওনার সব কথাবার্তা আমি শুনি তাও বলে দেই। রেকর্ডের কথাও।
সেই থেকে উনি আর লাইট জ্বালিয়ে রাখেন না। সন্ধে হলেই অন্ধকার ওনাকে চুপ রাখে…..
কি বলেছিল সেদিন?
শোন:
আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারও,
আরো কঠিন সুরে জীবন তারে ঝঙ্কারও।
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে
বাজেনি তা চরম তানে
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারও…..
বাবার দিকে অপলক চেয়ে টুকাই বলে ওঠে ….আর কদিন পর বাড়িটা দেওয়া যেত না প্রোমোটারকে? দাদুভাই-এর অবর্তমানে?
বেশি জ্ঞান দিস না তো। মার্কেট ভ্যালু জানিস এখন?
দাদুভাই-এর ভ্যালু?
চোপ! বড্ড বেশি বলছিস ..
চুপ করে যায় টুকাই রাগ, অভিমান, ক্ষোভ, দুঃখ…..কার উপর নিজেই জানে না…
এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে বাড়ি থেকে দমদমের দিকে বেরোনোর সময় দ্যাখে ড্রইং রুমে ঠাম্মা টিভি দেখছে, বাংলা সিনেমা..”এপার ওপার”
বুঝতে পারে …দাদুভাই বলেছিল একবার দেখতে, আর কিছুক্ষণ পরেই সেই গানটা আছে, ঠাম্মাকে আদর করে বেরোবার আগে রিমোটের ভলিউমটা খুব বাড়িয়ে দেয়।
জুতো পরে বেরোবার আগে শোনে সারা ডুপ্লেক্স জুড়ে আশা ভোঁসলের গলায় ….
আমি অন্ধকারের যাত্রী..
প্রভু আলোর দৃষ্টি দাও…
আমার দু চোখে রাত্রি
তুমি আলোর পথ দেখাও….
এটা অন্তত বাবার কানে যাক….
আর নিজের কানে হেডফোন গুঁজে ….
Watch out now, take care। Beware of falling swingers
Dropping all around you
The pain that often mingles
In your fingertips
Beware of darkness
(জর্জ হ্যারিসন)
Bye Kolkata….
না পুজোতে কলকাতায় আর আসে নি টুকাই…..
কাজের খুব চাপ….
মার্কেট ডাউন….