মহিলার নাম মেহজাবিন বেওয়া। মেহজাবিন অর্থ চাঁদকপালি। ‘মেহ’ মানে চাঁদ, ‘জাবিন’ মানে কপাল। মহিলাকে দেখে অবিশ্যি চাঁদকপালি বলে মনে হচ্ছে না ! বয়স মোটামুটি ষাটের আশেপাশে হবে, ক্ষয়াটে চেহারা, পরনে ন্যাতার চেয়েও নোংরা একটা শাড়ি। সাথে কোনও পুরুষমানুষ নেই, স্রেফ একটা পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে। মেয়েটা সম্ভবত বুড়ির নাতনি।
বুড়ি গলা টেনে টেনে বিলাপের সুরে বললো – “ও ডাক্তার গো, আমায় শিগগির বাঁচান গো, আমি যন্তন্নায় মরি গিলাম গো !”
আমি তখন ইমারজেন্সিতে অন্য একটা রুগী নিয়ে ব্যস্ত। বুড়ির দিকে একঝলক তাকিয়ে বললাম – “কি কষ্ট হচ্ছে বলো।”
বুড়ি চেঁচিয়ে বলল – “আগে কল লাগিয়ে ভালো করে দ্যাখেন। আমার কষ্ট আমিই বলবো তো আপনে ডাক্তার হইছেন কি কত্তি ?”
রীতিমতো ব্রহ্মতালু জ্বলিয়ে দেওয়ার মত কথাবার্তা ! আমি তিরিক্ষি ভাবে বললাম – “তোমরা আমাদের কি ভাবো টা কি, অ্যাঁ ? আমাদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, শুধু সবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কল লাগিয়ে বেড়াবো ? তোমার কষ্ট তুমি বলবে, তারপর কোথায় কল ঠেকাতে হবে আমি বুঝবো। এতে যদি না পোষায় তো বলো, সোজা রেফার করে দিচ্ছি।”
বুড়ির নাতনি এবার বলে উঠলো – “দাদির আজ আট দিন হলো পায়খানা হয় নি, পেটের বিষে ছটফট করছে।”
বুড়ি তার নাতনিকে মুখ ঝামটে বলল – “শুধু হাগার কথা বললি, পাদনের কথা বললি না ? ডাক্তার গো, আমার আট দিন হাগা-পাদা সব বন্ধ। দুইডা পাদ বেরোলেও জানডা আরাম পাইতাম।”
নাতনি এক ধমক দিল। “ছিঃ, দাদি ! ওরকম অসভ্য কথা বলতে নাই।”
“চুপ কর হারামজাদী ! এমন ভাব করছস য্যান তুই পাদস না। দুনিয়ায় সবাই পাদে। এই ডাক্তারও পাদে। রুগীর সামনে পাদে না, আড়ালে গিয়া ভটাম ভটাম করে। কি গো ডাক্তার, ঠিক কি না ?”
আমি হেসে ফেলে বললাম, “ঘটনা সত্য।”
মেহজাবিন বেওয়া একঘন্টার মধ্যেই মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেল। পরদিন সকালে ডিসচার্জ দেওয়ার সময়ে বুড়ি আমার হাত ধরে বলল – “ডাক্তার, তুমি নিজের হাতে আমার গু ঘাঁটছো, এইডা আমি কখনোই ভুলবো না।”
‘গু ঘাঁটা’ বিষয়টি সত্যি। বুড়ির মলদ্বারে impacted stool, অর্থাৎ পাথরের মত শক্ত মল জমে ছিল। এনিমা (enema) দিয়েও সেটা বার করা যায় নি, ফলে আমাকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেসব বার করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে আমাদের মত গ্রামীণ হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের কাছে রুগীর ‘গু ঘাঁটা’ কোনও বিরল ঘটনা নয়, বরং নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ! এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে নর্মাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে। যোনিপথ দিয়ে বাচ্চার মাথা বেরোচ্ছে, ওদিকে প্রচন্ড চাপের ফলে পায়ুপথে মল বেরিয়ে আসছে…..এটা আমাদের কাছে খুবই কমন একটা দৃশ্য। গ্লাভস ছাপিয়ে সেই বস্তু প্রায়ই আমাদের হাতে মাখামাখি হয়ে যায়।
তা যাইহোক, কিছুদিনের মধ্যেই বুড়ির কথা ভুলে গেলাম। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। এত রুগীর ভিড়ে আলাদা করে কারো কথা মনে রাখা সম্ভব নয়, যদি না সেই রুগী, তার রোগ অথবা তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার ঘটে থাকে। মেহজাবিন বেওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনটাই ঘটে নি, অতএব মনে রাখার প্রশ্নও ওঠে না।
কয়েক মাস পর অন্য একটা হাসপাতালে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম। একই জেলা, তবে এই হাসপাতালটা আরেকটু বড়। নতুন ব্লক, নতুন হাসপাতাল, সেখানকার প্রশাসনিক দায়িত্ব…..এসব নিয়ে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেল। তার সাথে আবার ডাক্তারদের সংগঠনেও একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছি, কথায় কথায় এখানে সেখানে ছুটতে হচ্ছে ……. মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা, সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততা চলছে।
এরকমই একটা ব্যস্ত দিনে মেহজাবিনের নাতনি এসে হাজির। আমি প্রথমে চিনতে পারি নি, পরিচয় দেওয়ার পর চিনলাম। বেচারা আমার খোঁজে আগের হাসপাতালে গিয়েছিল, তারপর সেখান থেকে আমার ট্রান্সফারের খবর পেয়ে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। মেয়েটার কাছে শুনলাম যে তার দাদি নাকি কয়েকদিন আগে মারা গেছে। শুনে আন্তরিক ভাবেই দুঃখ পেলাম। মেয়েটার জন্যও বেশ খারাপ লাগলো। আহা রে, বেচারার বোধহয় তিনকূলে ওই দাদি ছাড়া কেউ নেই। কে জানে এখন কার কাছে থাকে ? একবার ভাবলাম মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করি, পরক্ষণেই মনে হল বেশি কৌতূহল দেখানো ঠিক হবে না। হয়তো কান্নাকাটি করে সাহায্য-টাহায্য চেয়ে বসবে, তখন আবার আরেক বিপদ ! তাছাড়া শুধু দাদির মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার জন্য এত ঝামেলা করে আমার কাছে এসেছে এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিশ্চয়ই বৃহত্তর কোনো পরিকল্পনা আছে !
আমি যতটা সম্ভব দুঃখিত গলায় বললাম – “তোর দাদির খবর শুনে মনটা খুব খারাপ লাগছে রে ! যাক, কি আর করা যাবে, মৃত্যুর উপর তো কারো হাত নেই !” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
মেয়েটা কিছু বলল না। একমনে পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুঁটতে লাগল। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম – “আমাকে এবার একটু বেরোতে হবে, বুঝলি ? তোর কাছে বাড়ি ফেরার টাকা আছে তো ? না থাকলে বল, আমি দিচ্ছি। লজ্জা করিস না।” বলে মানিব্যাগটা বার করলাম।
মেয়েটা আঁতকে উঠে বলল – “না না, আমার কাছে ফেরার পয়সা আছে। আমি শুধু আপনাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম – “কি জিনিস ?”
“দাদি আপনার কথা খুব বলতো। বলতো সুস্থ হয়ে গেলে আপনাকে খুঁজে বার করে কিছু একটা দেবে। ছোটখাটো যাই হোক কিছু। দাদি তো আর সুস্থ হল না, তাই আমি ভাবলাম দাদির ইচ্ছা পূরণ করি। আমরা খুবই গরীব মানুষ ডাক্তারবাবু, কি আর দেব বলেন ? ইচ্ছা থাকলেও দামী কিছু দেওয়ার ক্ষ্যামতা নেই। আপনার জন্য সামান্য একটা কলম এনেছি। নেবেন তো ডাক্তারবাবু ?” মেয়েটা তার ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগ থেকে একটা পার্কার কলম বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
কলমটা এখনও আমার কাছে আছে। ব্যবহার করা হয় নি। আমার ভয় লাগে ওটায় হাত দিতে। মনে হয় কলমটা বোধহয় পৃথিবীর মতো ভারি, আমি তুলতে গেলেই মাজা ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। তবে আমি হাল ছাড়ি নি ! আশায় আশায় বসে থাকি, একদিন না একদিন তুলতে নিশ্চয়ই পারবো ! আমি অপেক্ষা করি সেই অলৌকিক দিনটার জন্য। অপেক্ষা করতে আমার ভালো লাগে।
অসাধারণ। ??
আপনাদের মতো ডাক্তার দের জন্য ই আজও ডাক্তারী টা নোবেল প্রফেশন। অন্য কোনো প্রফেশন কিন্তু নোবেল হতে পারে নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি তে অনেকেই ডাক্তার দের ওপর আস্থা হারায়। কিন্তু এই ধরণের ঘটনা যত বেশী করে সাধারণ মানুষের নজরে আসবে ততই মঙ্গল সারা সমাজের পক্ষে, কারণ এতে করে ডাক্তার, রোগীর মধ্যে যে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা র সম্পর্ক আজও অনেক অনেক আছে সেই টা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে। আপনি সেই রকম একজন ডাক্তার যাঁর জন্য কিন্তু এই উপহার ভারী নয়। আপনার আরও এই ধরণের লেখা গুলো পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকব।
এখনও ডাক্তারদের দেশের আদর্শ নাগরিক মানতে দ্বিধা নেই, যে মহৎ কাজ এখনও তোমরা করে চলেছো তার উদাহরণ তোমার এই লেখাটি। এই লেখাটি অনেক মানুষকে উজ্জীবিত করবে, কিভাবে গ্রামে, গন্জে অশিক্ষিত মানুষকে বুঝিয়ে চিকিৎসা কর তা প্রশংসনীয়। শহরের মানুষ থেকে অনেক ভালো। তোমাদের মানুষের সেবা এই মহৎ কার্য কে কুর্নিশ জানাই।
Jato bari pori tatobari mehojabin kadiea chare…ami ata age porechi…kintu mehojabin k vule gieachilam…kintu tar namtai kafi chilo take abr saron karar jonno……akbar sahos kore penta diea tar namta likhea e felun…atai tar proti srodha jananor akmatro upai bole amr mone hai…parkar pen j dr baburi upojukto seta hoito tar natni kono vabe bujheachilo…..tai amr mone hai sanman ta 2joneri prappo….ata kei bole haito unconditional love….
অসাধারণ ।
মর্মস্পর্শী লেখা। গ্রামে কাজ না করলে এই অভিজ্ঞতা পাওয়া কঠিন।