ইনি জোশ ব্লু, আমেরিকান স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘লাস্ট কমিক স্ট্যান্ডিং’ ২০০৬ এর শো তে। পাশের জন গেরি জুয়েল… একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী, লেখিকা ও সুবক্তা। ইনি হলেন ড্যান কেপ্লিঙ্গার, একজন প্রখ্যাত শিল্পী ও বক্তা…যাঁর জীবনী নিয়ে অস্কার জয়ী তথ্যচিত্র ‘কিং গিম্প’ বানানো হয়। এই ছবিটি ক্রিস্টি ব্রাউনের… একজন নামকরা আইরিশ চিত্রশিল্পী, কবি ও লেখক। আর ইনি হচ্ছেন ‘ব্রেকিং ব্যাড’ এর ওয়ালটার হোয়াইট জুনিয়র। এনাদের সবার মধ্যে কি মিল জানেন? সবাই সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত হয়ে ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন শারীরিক অক্ষমতার শিকার। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে বড় হয়ে এনারাই নিজের নিজের জায়গায় বিখ্যাত হয়েছেন।”
ছবিগুলোর দিকে মা-মেয়ে দুজনকেই অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে দিদিমণি আবার শুরু করলেন, “কি ভাবছেন? এ শুধু পশ্চিমের দেশেই সম্ভব…আমাদের দেশে সম্ভব না! তাহলে আপনাকে বলব প্রথম ভারতীয় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ডিরেক্টর ও অভিনেত্রী দিব্যা অরোরার কথা, যাঁর কাছ থেকে হৃত্বিক রোশন ‘গুজারিশ’ সিনেমাতে অভিনয় করার সময় ট্রেনিং নিয়েছিলেন। কিংবা তেলেঙ্গানার বোরা রাজেশ্বরী র কথা বলব। এক গরীব তাঁতি পরিবারে জন্ম নেন তিনি। তাঁর দুটো হাতই জন্ম থেকে ছিল না, কথাও বলতে পারতেন না ঠিক মত, হাঁটতেও সমস্যা হত। পঞ্চম সন্তান সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত হলেও বাবা মা পড়াশোনা ও চিকিৎসায় কোন খামতি রাখেন নি। ১৯৯৯ সালে তীব্র অভাবের জেরে আত্মহত্যা করেন তেলেঙ্গানার অনেক তাঁতি। সেই ঘটনাই প্রভাব ফেলে ১৮ বছরের রাজেশ্বরীর মনে। পায়ের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা কলমে ফুটে ওঠে একের পর এক কবিতা। গত কুড়ি বছরে প্রায় ছশোর ওপর কবিতা লিখে নজরে পড়েন বিখ্যাত তেলুগু লিরিসিস্ট সুদ্দলা অশোক তেজার। প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সিরসিলা রাজেশ্বরী কবিতালু’। একাধিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর সাথে কবিতার মাধ্যমেই তিনি যোগসূত্র স্থাপন করে চলেছেন।”
দিদিমণির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন খাদিজার মা। তাঁর মেয়েও এরকম বড় হবে?
স্কুলের নতুন দিদিমণি ক্লাস নিতে এসে কয়েকটা প্রশ্ন করেন। ছোট্ট খাদিজা সবগুলোর উত্তর দিয়ে দেওয়ায় খুব অবাকই হন তিনি।কারণ কিছু প্রশ্ন উচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও কঠিন ছিল। কিন্তু খাদিজাকে কাছে ডাকতেই তিনি চমকে ওঠেন তাঁর হাঁটার ভঙ্গিমা দেখে। সে কেমন যেন পা বেঁকিয়ে ঘোড়ার মত হাঁটছে, গোড়ালি টা মাটি ছুঁতে পারছে না। জানতে পারলেন আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে সে হেঁটে বেড়ায় প্রথম থেকেই। আরও বিশদে জানতে ওর মা কে দিদিমণি সেদিন ডেকে পাঠান।
দিদিমণি তাঁর পরিচিত এক ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলে জানতে পারেন খাদিজা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হতে পারে। এখন থেকেই চিকিৎসা শুরু করা দরকার, নাহলে পরবর্তী কালে হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু সুন্দরবনের এই প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের যেখানে এক মুঠো ভাতের জন্য প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।
খাদিজার মা অনেকক্ষন পর কাপড়ের খুঁট টা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “আমি একা মানুষ কি করবো? ওর বাবা তো বনে মধু আনতে গিয়ে আর ফেরেনি! বাড়িতে দুটো ছোট বাচ্চা, আমি দিনমজুরী করে কোনরকমে সংসারটা টানি। কি করে ওর চিকিৎসা করাবো?”
–“আগে কোথাও ডাক্তার দেখান নি?”
–“পাড়ার এক হাতুড়ে আছেন, তাঁকে দেখিয়েছি। তিনি তো বললেন অপারেশন করতে হবে…অনেক খরচ!”
–“শুনুন, আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমার পরিচিত এক ডাক্তার বাবুর সাথে কথা হয়েছে। সেখানেই চিকিৎসা হবে।”
ডাক্তার বাবু খাদিজার মায়ের কাছ থেকে পুঙ্খানপুঙ্খভাবে সব জানলেন। হতদরিদ্র পরিবারের প্রসূতি মায়েদের কপালে পুষ্টিকর খাবার তো জোটেই না উপরন্তু বিশ্রাম টুকুও মেলে না। খাদিজা স্বাভাবিক সময়ের প্রায় একমাস আগেই জন্ম নিয়েছিল। দুটো নদী পেরিয়ে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার মত সময় পাওয়া যায়নি, তাই বাড়িতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল খাদিজা। জন্মের অনেকক্ষন পর কেঁদেছিল সে। জন্মের সময় ওজনও খুব কম ছিল।
ডাক্তার বাবু পরীক্ষা করে দেখলেন এটা স্পাস্টিক ডাইপ্লেজিক সেরিব্রাল পালসি। অর্থাৎ সমস্যাটা দুই হাতের থেকে দুটো পায়েই সবথেকে বেশি। গ্যাস্ট্রোকনেমিয়াস ও সোলিয়াস পেশিতে স্পাস্টিসিটি খুব বেশি রকম থাকার জন্যে গোড়ালি উঠে থাকছে। এই ধরনের হাঁটা বা গেইট কে ইকুইনাস গেইট বলে। এর একমাত্র চিকিৎসা স্পাস্টিসিটি কমানোর ওষুধ। কিন্তু যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে বটিউলিনাম টক্সিন ইনজেকশন দিতে হয় ওই পেশিতে। চিকিৎসা ঠিক মত না করলে বয়স এবং ওজন বাড়ার সাথে সাথে হাঁটার সময় হাঁটু দুটো আরও ভাঁজ হয়ে যেতে থাকবে। তখন হাঁটাচলার ধরন পাল্টে যাবে, যাকে ক্রাউচ গেইট বলা হয়। এই ধরনের রোগীদের সুস্থ করা আরও জটিল।
আবার হাতুড়ে যদি ভুল করে অপারেশন করে ফেলত, মানে গোড়ালির পিছনের টেণ্ডো-অ্যাকিলিস কে আলগা করে দিত …তাহলেও সেই ক্রাউচ গেইট-ই দেখা যেত।
ডাক্তার বাবু মাথার ছবি, আই.কিউ টেস্ট সহ আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দিলেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও অর্থোসিসের প্রেসক্রিপশনও করে দিলেন।
রিপোর্ট দেখে তো ডাক্তার বাবু একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন। ফোন করে দিদিমণি কে জানালেন, “আরে ম্যাডাম, আপনি তো জুহুরি! খাদিজা তো জিনিয়াস, ওর আই.কিউ লেভেল স্বাভাবিকের থেকে বেশি।”
–“হ্যাঁ ও তো পড়াশোনাতে খুবই ভালো। এরকম পরিবেশেও ট্যালেন্ট জন্ম নেয়, শুধু ওদের আগলে রাখতে হয়!”
* * * * *
প্রতি বছর ৬ অক্টোবর বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস পালিত হয়। এই দিনের লক্ষ্য হল সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত মানুষদের সমান অধিকার ও সুযোগ প্রদান করা থেকে শুরু করে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।
আসুন দেখে নিই কি এই সেরিব্রাল পালসি? এটি মূলত একধরনের স্নায়বিক বিশৃঙ্খলাকে বোঝায় যা বাল্যকালে বা শৈশবের প্রথম পর্যায়ে দেখা দেয় এবং স্থায়ীভাবে শরীরের গতিবিধি, চলাফেরা এবং পেশি সমন্বয়কে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের কোনও অংশে (যা আমাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে) ক্ষতির কারণে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বিকাশ ঘটে, যার ফলে সেরিব্রাল পালসি হয়। এই ক্ষতি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়, শিশুর জন্মের সময় বা জন্মের কিছু পরে হতে পারে। প্রাথমিকভাবে পেশির দুর্বলতা ও মাংসপেশির অস্বাভাবিক টোন-এর জন্য স্বাভাবিক চলাফেরা প্রভাবিত হয়। তবে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্তদের দেখা, শেখা, শ্রবণশক্তি, কথা বলা এবং বুদ্ধির বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত চার জনের মধ্যে একটি শিশু কথা বলতে পারে না, তিন জনের মধ্যে একজন হাঁটতে পারে না (৬০% স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে, ১০% কোনও অবলম্বনের সাহায্যে হাঁটতে পারে, ৩০% হুইলচেয়ার ব্যবহার করে), দুইজনের মধ্যে একজনের বৌদ্ধিক অক্ষমতা রয়েছে এবং চারজনের মধ্যে একজনের খিঁচুনি হয়।
এর প্রতিরোধের জন্য অন্তঃসত্বা ও প্রসবের সময় সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি জটিলতা গুলোর যথাযথ চিকিৎসা দরকার।
এই রোগে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত। বাচ্চার বৃদ্ধির মাইলফলকে কোনো অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত বাচ্চাদের আরোগ্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে… যদি দুই বছর বয়সের মধ্যে সে স্বাধীনভাবে বসতে পারে এবং তিনটের কম প্রিমিটিভ রিফ্লেক্স বর্তমান থাকে। অন্যদিকে চার বছর বয়সেও সে যদি স্বাধীনভাবে বসতে না পারে, তাহলে তার উন্নতির সম্ভাবনা খুবই কম।
পেডিয়াট্রিসিয়ান ও নিউরোলজিস্টের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার এই শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর প্রধান দায়িত্ব পড়ে একজন ফিজিয়াট্রিস্ট বা রিহ্যাব ফিজিশিয়ানের ওপর। তিনি ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, অর্থোটিস্ট-প্রোস্থেটিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, ভোকেশনাল কাউন্সিলর, সোশ্যাল ওয়ার্কার, এন.জি.ও…সবাইকে নিয়ে রিহ্যাব টিম গঠন করেন এবং অভিভাবকের সাথে আলোচনা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করেন।
সেরিব্রাল পালসিতে একদিকের হাত-পা (হেমিপ্লেজিক), এক হাত দুই পা (ট্রাইপ্লেজিক) বা চার হাত-পা (টেট্রা বা ডাইপ্লেজিক) -তে সমস্যা থাকতে পারে। হাঁটাচলাতে যাদের অসঙ্গতি আছে, তাদের ক্ষেত্রে ইকুইনাস ও ক্রাউচ গেইট ছাড়াও সিজারিং, জাম্প বা স্টিফ-নী গেইট দেখা যায় এই রোগীদের ক্ষেত্রে। হ্যামস্ট্রিং-এ স্পাস্টিসিটির জন্য যেমন ক্রাউচ গেইট হয়, সেরকম হিপ অ্যাডাকটরের জন্য সিজারিং গেইট অর্থাৎ হাঁটতে গেলে এক পা অন্য পা কে কাঁচির মত ক্রস করে যায়। আসল কারণ নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ, ইনজেকশন, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, অর্থোসিস এবং প্রয়োজনমতো অ্যাসিস্টিভ ও কমিউনিকেটিভ ডিভাইস, স্পিচ থেরাপি, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং, স্পেশাল এডুকেটর-এর মাধ্যমে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রিহ্যাব টিমের সদস্যরা। দীর্ঘদিন রিহ্যাব থেকে দূরে থাকলে স্পাষ্টিক মাংস পেশি গুলো ছোট হয়ে যায় ও অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যায়। তখন সার্জারী ছাড়া কোনো উপায় থাকে না বা অনেক সময় সার্জারী করেও কোনো লাভ হয় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব সঠিক রোগ নির্ণয় ও তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করুন…সকল শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে পৃথিবীর বুকে একটা সদ্য ফোঁটা কুঁড়িকে নিজের রূপ, রস, গন্ধ দিয়ে মেলে ধরতে বাড়িয়ে দিন আপনার হাত!
ভালো লেখা।
Excellent article , every should read and know the facts ,