এই হাসিমুখের পরতে পরতে ইতিহাস। ছোট বেলায় বিয়ে, স্বামীর চার ভাইয়ের সংসারের বড় বৌ, সকলের প্রিয় বড় বৌদি। এক ননদ। সংসার নেহাত ছোট নয়, সত্তর বিঘে জমি, পানের বরজের বড় বড় পান -অবশ্য বরজের মধ্যে মেয়েদের ঢোকা বারণ। কেন জানা নেই। ছিল পুকুর ভর্তি মাছ, বরিশালের নদী, জল, মাঠের ধান। তার মধ্যে সুরেলা কন্ঠের কীর্ত্তন গান। নিয়মিত অনুষ্ঠানে গান গাওয়া। স্বামী যদ্দিন বেঁচে ছিল, চলেছে গান গাওয়া।
পান খাওয়া সেই ছোটবেলা থেকেই। দিদি শাশুড়িকে নিয়মিত পান সেজে দিতে হত, সেখান থেকেই একটু খাওয়া। দিদি শ্বাশুড়ি পান খাওয়া লাল ঠোঁট দেখে একদিন বলল, ‘তোকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে নাতবৌ’। সেই থেকেই চলছে, তবে শুধু পান, চুন আর একটু খয়ের- দোক্তা নয়।
স্বচক্ষে জয় বাংলার যুদ্ধ দেখা। তখন নতুন বৌএর বয়স ১৬/১৭। তার পরেও দ্যাশ একইরকম থাকল। শয়তানরা মেয়ে বৌদের ইচ্ছে মতো নিয়ে যায় বলেইতো সব ছেড়ে চলে আসতে হলো। শেষে আশ্রয় নেওয়া স্টেশন লাগোয়া রেল লাইনের পাশের বস্তিতে। পঁচিশ বছর আগে সেখানেই স্বামী মারা গেল হার্টের অসুখে।
তারপর শুরু বাড়ি বাড়ি এবং অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ। দেড় দুশো লোকের রান্না চলেছে যে হাতে, সেই হাত আজ স্ট্রোকে অবশ। ডান হাতের সাহায্য নিয়ে বাঁ হাত উপরে ওঠে। এখনও রান্নার সব কড়াই, খুন্তি , হাতা বস্তির ঘরে রয়েছে।
স্ট্রোকের পরে সব বন্ধ। ছেলে নেই, ছেলে থাকলেই ভাত দেবে এমন কথা আছে? একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। চার ছেলে, ৭০-৮০ বিঘে জমি নিয়ে তার সংসার। তবুও অসুখের সময় এক মাস এসে ছিল, তারপর নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। এক বছর পরে চলে আসা। ওখানকার ডাক্তাররা ভালো নয়, শুধু সকালে দুখানা আর রাত্রে দুখানা রুটি খেতে বলে, এই খেয়ে থাকা যায়?
এখন সকালে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে এসে স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে থাকা। লোকেরা নিজেরাই দেয়। এবার পুজোর প্রাপ্তি আটখানা কাপড়। কেউ পান এনে দেয়, কেউ বলে স্টেশনের জল খেয়ো না, জলের বোতল কিনে দেয়। একজনে কাপড় কেচে দেয় মাঝে মধ্যে। তাকে অবশ্য পয়সা দিতে হয়। আর দুপুরে হোটেল থেকে দুইবেলার খাবার কিনে নিয়ে গিয়ে দুপুরে খেয়ে বাকি ভাতে জল দিয়ে রাখলে আর নষ্ট হয় না। শীতের সময় অবশ্য এমনিতেই ঠিক থাকে। ঘরে হাঁড়ি চড়ে না। সে ক্ষমতা আর নেই। ঠাকুরের কৃপায় সারাদিন এখানে বসে যা পাওয়া যায়, তাতেই চলে যায়, কোনও অসুবিধা হয় না। জমানো আর কার জন্যে?
একটা মোবাইল ছিল, কে নিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। এই মোবাইলই যত নষ্টের গোড়া। আগে এতসব ভাইরাস, স্ট্রোক ছিল? পকেটে মোবাইল দেখে সতর্ক বার্তা শোনান- ‘শোনো, পকেটে মোবাইল রাখবা না, হার্টের ক্ষতি করে’।
ট্রেনের ঘোষণা হয়। ওঠার আগে বলি, ‘একটা ছবি তুলব?’
-‘কি করবা? তোলো’ ।
আমি মোবাইলে ছবি তুলি। বলে, ‘দেখি, কেমন হল!’
আমি মোবাইল দেখিয়ে বলি ‘চোখ ঠিক আছে তো?’
‘আমার চোখ ঠিক আছে’ বলে ছবি দেখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
আজ লক্ষ্মী পূজা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আজ মাটির লক্ষ্মীর আরাধনা সপ্তউপাচারে- সমৃদ্ধির আশায়, গোলাভরা ধানের আশায়। তাই ফলন্ত ধানের শীষ, পান-সুপারি পূজার অপরিহার্য উপকরণ।
কিন্তু দেশভাগের ফলে এমন সব লক্ষ্মীরা ফলন্ত ধানের মাঠভর্তি জমি ফেলে, পানের বরজ ফেলে ভিটে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে শূন্য হাতে। এখন ভিক্ষাবৃত্তি তাদের জীবনধারণের উপায়। কত লক্ষ্মী এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে, কতজন হারিয়ে গিয়েছে অন্ধকারে! কে আর খোঁজ রাখে!
—
মর্মভেদী বাস্তব জীবনের নিখুঁত চিত্রায়ণ,
বাস্তু , জমিহারা ওপার বাঙালির উপাখ্যান।