ইন্টার্নশিপের প্রথম দিনটা ডাক্তারী জীবনের অন্যতম রঙীন একটা দিন…. আসলে ব্যক্তিগত ভাবে না চিনলেও আপনি মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন ব্যাচ এর ছেলেমেয়েদের এই দিন সহজেই চিনতে পারবেন…. যে ছেলেটা সারাবছর উস্কোখুস্কো চুল, লাল চোখ নিয়ে কোনোমতে একটা টি-শার্ট চাপিয়ে ন’টার ক্লাস-এ ঢুকতো, সেই ছেলেটাও সেদিন ফর্মাল শার্ট ইন করে পরে, সাথে চকচকে জুতো… মেয়েটার নতুন কুর্তি, হালকা কাজল, গলায় স্টেথো… সেদিন সত্যিকারের ডাক্তারবাবু হওয়ার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে ফুটতে ওরা ওয়ার্ড-এ পৌঁছয়…. !
তবে এই উত্তেজনার বেলুনগুলো চুপসে যেতে বেশি সময় লাগেনা যখন প্রথম channel করতে গিয়ে একটা DP হয় আর দু-ফোঁটা রক্ত মাটিতে পরতেই রুগীর বাড়ির লোক এমন কটমট করে তাকায় যেনো ওনার রুগীর কিডনি বের করে নেয়া হয়েছে! আর এর পরই যে মেয়েটা সুন্দর করে সেজেগুঁজে মেডিসিন-এর এডমিশন ডে দিতে গেছিলো তাকেই যদি আপনি দু-ঘন্টা পরে দেখেন তো দেখবেন মেয়েটা সারা ওয়ার্ডে জুড়ে ছোটাছুটি করছে, মাটিতে বসে BP মাপছে, ওর চুল অবিন্যস্ত, মেয়েটা ঘেমে লাল হয়ে গেছে, কাজলের দফারফা হয়ে গেছে আর বাচ্চা ছোট্ট মাথাটা ততক্ষণে খারাপ হয়ে গেছে !!
আমার নিজের ইন্টার্নশিপের দ্বিতীয় দিন আমার ইমার্জেন্সি নাইট ছিল… তখন আমরা একা ইমার্জেন্সি তে ঢুকতে ভয় পেতাম, আমার co-intern হোস্টেলের বাইরে এসে দাঁড়াতো, তারপর আমরা একসাথে ইমার্জেন্সিতে ঢুকতাম ??… তো আমার co-intern আর আমি একসাথে ইমার্জেন্সি ঢুকেছি, hand-over নেবো আর আগের shift-এর লোকজন আমাদের দায়িত্ব দিয়ে, হাঁফ ছেড়ে বাড়ি যাবে…. কিন্তু ঠিক সেই সময় কাঁচ দিয়ে হাত কেটে এক রুগী এসে ঢুকলো…. স্টিচ দিতে হবে…. আমরা তখন দিনের চার জন, রাতের তিন জন ইন্টার্ন উপস্থিত, আর আমরা সাত জন, কেউ আগে স্টিচ দেই নি!! শুরু হলো ছোটাছুটি… একটা চরম উত্তেজনা… দুজন ট্রে সাজাচ্ছে, দুজন ছুটেছে পাশেই ইমার্জেন্সি OT থেকে PGT দাদাকে ডাকতে আর তিন জন রুগীকে বোঝাচ্ছে যে সব ঠিক হয়ে যাবে…!!!!! অথচ নিজেরাই তখন মনে মনে বলছি “all is well, all is well!” … সে যাই হোক ঠিক পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে PGT দাদা ছুটে এসে সব সামলে নিয়েছিলো কিন্তু আমি আমার জীবনের ওই পাঁচটা মিনিট কোনোদিন ভুলবো না!!
বিশ্বাস করুন এই ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থাটা কাটিয়ে উঠতে এই বাচ্চা ডাক্তারদের এক মাস থেকে দুমাস সময় লাগে… তারপর এরা হাসপাতালের boss হয়ে যায়…. হ্যা, এরাই হাসপাতালটা চালায়… ইন্টার্নশিপের সময় হাসপাতালটা হোস্টেল হয়ে যায় almost!! এই একটা বছর ওদের সবচেয়ে বেশি সময় হাসপাতালে কাটে… কারোর অষ্টমীর দিন ইমার্জেন্সি, কারোর পয়লা বৈশাখ মেডিসিনের 24 ঘন্টা, কারোর বড়দিন-এ লেবার রুম… !! ওদের ছাড়া এই হাসপাতাল গুলো অচল হয়ে যাবে… যদিও এই “জুনিয়র ডাক্তার” দের তাচ্ছিল্য করার লোকের অভাব নেই!!
এই বছরের ইন্টার্নরা কাজে যোগ দিয়েছে মার্চ মাসে… ওরা ওই একমাস সময়টা পায়নি… ওদের ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতেই, ওদের ডাক্তার হয়ে ওঠার উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতেই ওদের একটা মহামারীর প্রথম সারির যোদ্ধা হয়ে সামনে দাঁড়াতে হয়েছে… ওদের বয়েস বাইশ থেকে চব্বিশ… ওদের বাড়ির লোকের উৎকণ্ঠা….. আমি যখন আমার ইন্টার্নশিপ-এর প্রথম দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, আর ওদের হাসিমুখে কাজ করার ছবিগুলো দেখি… একই সঙ্গে গর্ব, মনখারাপ আর উৎকণ্ঠায় বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে… আমরা কতটুকু করতে পারছি ওদের জন্য?? কতোটা সুরক্ষা দিতে পারছি ওদের… কিছুই পারছিনা…!!
এই সমাজের, আমাদের সব্বার ওদের মাথায় করে রাখা উচিৎ…. ওদের জন্য গর্ব করা উচিৎ… ওরা 2020-2021 ব্যাচের ইন্টার্ন… সব মনে রাখা হবে… তোদের মনে রাখা হবে… ❤️
আমাদের মনে হয় ইন্টার্ন ও ডাক্তারবাবুদের বুঝতে আরো অনেকগুলো মহামারী লাগবে। তাও গালপাড়া বন্ধ হবে না।
লেখক তোমার লেখার জন্য আর 20-21ব্যাচের সব ইন্টান দের ইয়াদ মে রাখা জায়গা।