বাবার হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল অনু। পুলিশের প্যারেড দেখতে ভিড় হয়েছে খুব।
কে একজন এসেছে বিরাট মাপের মানুষ। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা জায়গায়। আর ইউনিফর্ম পরা পুলিশের লোকেরা তাকে সেলাম করতে করতে লেফট রাইট করে চলে যাচ্ছে। বাবা বলল, “বুঝলি, এটাকে বলে গার্ড অফ অনার। তুই যদি হতে পারিস বিরাট কেউ, তবে তোকেও এমনি করে…”
“বাবা, তোমাকে কেউ গার্ড অফ অনার দেয় না কেন?”
“আমাকে? গার্ড অফ অনার?” হা হা করে হাসে বাবা।
“আমার সাহেবকেই দেয় না, তো আমাকে!” হাসে বটে। কিন্তু হাসির মধ্যে একটা কান্নাও লুকিয়ে থাকে। সাহেব মানে বিডিও সাহেব। বাবাদের অফিসের বস। অনুর বাবা বিরাট ভক্তি করে তাঁকে। বাবার খুব সখ, অনুও যেন বড় হয়ে একদিন সাহেব হয়।
অফিস নিয়ে হরিসাধনের কিছু বাতিক ছিল। মা বলত, “তোর বাবা সকাল সকাল যায়। চাবি খুলে ঝাঁট দিতে হয় যে!” মা আরও বলত, “আর ঝাঁট দেওয়াবেই না কেন। কাজ তো তেমন জানে না। কাজ যদি জানত তবে কি পাঁজা করে কাগজ বাড়িতে নিয়ে আসত? অফিসের কাজ অফিসেই সেরে আসত।”
বাবা ও’রকম করত বরাবরই। যখন বয়স কম, মাকে বোঝাতো, “আরে বোঝো না কেন? কাজ শিখছি যে!”
আর হেড ক্লার্ক হবার পর মাকে বোঝাতো, “সব ছোটো এইটুকুটুকু নতুনেরা কাজ করে। কিছু ভুলভাল করছে কি না, একটু নজর রাখতে হয়!”
তা অফিসে বলতে নেই একটু সুনামই ছিল হরিসাধনের। এক পয়সা ঘুষ নিত না। একবার একজন, অনুকে স্কুলে যাবার পথে ডেকে পকেটে একটা পাইলট পেন গুঁজে দিয়েছিল। বলেছিল, “বাবাকে বোলো, রবিকাকু এই পেনটা দিয়েছে।” সেই তখন অনুর কলম বলতে মাতৃ রাইটার। পাইলট পেন তো স্বপ্নের উপাদান।
অফিস ফেরত বাবাকে বলতে, বাবা খুব নরম করে চেয়ে নিয়েছিল পেনটা। বলেছিল, “এ রকম কেউ কিছু দিলে নিস না। রবির একটা টিএ বিল আটকে আছে। ফলস নয়। দেরি হচ্ছে। রবি ছেলেটা এমনিতে ভাল। আমি ওকে বুঝিয়ে পেনটা ফেরত দিয়ে দেব কাল।”
সহকর্মী বাদলবাবু বাবাকে বলত, “আরে, বিডিও সাহেবের অফিসে কাজ করেন। সেই আপনার ছেলেকে যদি দোকান থেকে কেনা কাগজে অঙ্ক কষতে হয়, আপনার সাহেবের অপমান না? আপনি কী মশাই! দেখুন, আমাকে দেখে শিখুন। ছেলের খাতা, পেনসিল মায় রবারটিও অফিস থেকেই… হে হে হে…”
ওই রবি না কে যেন, তার জন্যই পরে অশান্তিও হয়েছিল কম না। বাবা নাকি দু তিন বছর তার মাসমাইনের আদ্ধেক রবিকে দিয়ে দিত। রবিবাবুর চাকরি নেই তখন।
অফিসের সেই বাদলবাবু ফিসফিস করে একে তাকে বাবার চরিত্র ঠিক নেই, এই সব বোঝাতো। মা গজগজ করত। কিন্তু বাবাকে বিশ্বাসও করত খুব।
চাকরিতে বাবা সাফল্য তেমন কিছু পায়নি। এর পরে অনু যখন স্কুল শেষে পড়তে কলকাতায় আসবে, বাবা তখনও একই পোস্টে।
গর্বিত ভাবে একদিন দুখানা কাগজ আনল। “বুঝলি, তোর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট নিলাম। আমার সাহেবের থেকে আর জয়েন্ট বিডিও সাহেবের কাছ থেকেও। দেখবি, খুব কাজে লাগবে।”
অনু মনে মনে হেসেছিল। সবে বাঞ্ছারামের বাগান সিনেমাটা দেখেছে ও আর ওর বন্ধুরা। ওর একটা কচিমত প্রেম সদ্য অঙ্কুরিত হয়েছে। বন্ধুরা আড়ালে ওকে ওই সিনেমায় যেমন ছিল, “শালা,লুজ ক্যারেকটার মাল ” বলে ডাকে। সেই ক্যারেকটারের আবার সার্টিফিকেট!
অনেকপরে কোনওক্রমে প্রোমোশনের পর ওই বিডিও অফিসেরই বড়বাবু, মানে হেড ক্লার্ক হয়েছিল বাবা। তাও সমসাময়িক অন্যদের থেকে দেরিতে, প্রায় বেলা শেষে।
দিন গেল দিনের মত। অনু একটা ছোটোমত চাকরি করে। ওর বাবার মনের আশা মিটিয়ে তত বড় কিছু হতে পারেনি। ক্যারেকটার সার্টিফিকেট কাজে লাগেনি।
হরিসাধন রিটায়ার করল। সময়ের নিয়মেই সে মারা গেল একদিন।
★
শ্মশানে বিরাট লাইন। তাও কাগজপত্র বানাবার পর লাইন এগোচ্ছিল। ঘণ্টা তিনেক লাগবে। সেই লাইন এল এক সময়।
কিন্তু এর মধ্যেই এক মুশকিল। জেলার এসপির শাশুড়ি মারা গেছেন। তাঁকেও এখানেই আনা হচ্ছে এই শ্মশানে। সেই দেহ এসে পৌঁছোতেই বিশাল তৎপরতা। ডিএম, মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান, এমএলএ, আরও কাদের কাদের সব ফোন।
কেউ কেউ তো এসেই হাজির। এসপি আসবেন এখুনি। শ্মশানের লোকজনেরা শশব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আপাতত অন্যদের অপেক্ষা করিয়ে এসপির শাশুড়ির কাজটাকে এগিয়ে দেওয়া হবে। বিশাল পুলিশ কর্ডন। পুরোটা সামলাচ্ছেন ডিএসপি শুভময় রায়।
শুভময় রায়, শ্মশানের অফিসে কাগজপত্র ঠিক করাচ্ছেন। শ্মশানের ঘাটবাবু, উত্তেজনায় কী করবে… কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না, “এই তো স্যার, মানে নো প্রবলেম। লাইনে ছিল এই বডিটা, এই যে হরিসাধন পিপলাই। ওরটা ইয়ে করে আপনার বডি ওর আগে দাহ করে দিচ্ছি স্যার।”
কথা বলার ছিরি দেখে ঘাটের পুরুত মুখ ঘুরিয়ে হাসি লুকোলো।
মৃতের নাম হরিসাধন পিপলাই? নামটা শুনেই চমকালেন শুভময়। নামটা ঠিক না, পদবিটা। একটু আনকমন পদবী তো, তাই। হরিসাধনের বাড়ির লোককে খুঁজলেন।
অনু ছিল কাছাকাছিই। শুভময় জিজ্ঞেস করলেন তাকে,
“ইনিই কি বেলডাঙা টু ব্লকের মানে শক্তিপুর বিডিও অফিসের বড়বাবু ছিলেন কোনও সময়ে?”
অনু মাথা নেড়ে সায় দিল। “হ্যাঁ, উনিই।”
শুভময় ঘাট বাবুকে বললেন, “এঁরা তো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন। এঁদের কাজটা আগে হয়ে যাক।” আমি এসপি সাহেবকে ফোনে বলে দিই। তাড়াহুড়ো কিছু নেই।
অপেক্ষমান অনুকে বললেন, “চলুন, আপনার বাবার কাছে যাই একবার।”
বিস্মিত লোকজনের সামনে, অত খাকি পোষাকের পুলিশের সামনে, হরিসাধনের মৃতদেহের কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন ডিএসপি শুভময়।
এসেছেন ইউনিফর্মেই। নীচু হয়ে হরিসাধনের মুখটা একবার দেখলেন। হাত বোলালেন। চোখে কি জল একটু? বোঝা গেল না। সামলে নিয়ে টুপি খুলে দু পা পিছিয়ে গিয়ে পুলিশি কায়দায় স্যালুট করলেন হাত মুঠো করে, খাকি পোষাক পরা শুভময়।
কয়েক মিনিট পরে লিভার টানতেই, চন্দনের নাম করে ছেটানো কাঠের গুঁড়ো আর তথাকথিত ঘি চর্চিত হরিসাধন ইলেকট্রিক চুল্লির গনগনে আগুন-ভেলার দিকে চলে গেল।
শুভময় ধরা গলায় অনুকে বলছিলেন, “জানো, এই মানুষটা না থাকলে, আমার গায়ে এই পুলিশের উর্দি উঠতই না কোনওদিন। আমার বাবা রবিরঞ্জন রায় বিনা কারণে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। তার পরের বছর আমার হায়ার সেকেন্ডারি। পড়া প্রায় বন্ধ হয় হয়। সেই তখন আমাদের পুরো সংসার খরচ দিতেন একই অফিসে কাজ করা তোমার বাবা। উনি তখনও হেডক্লার্ক হননি।
উনিই এই অফিস সেই অফিস দৌড়োদৌড়ি করে, একে ধরে তাকে ধরে বছর চারেক পর সেই চাকরি উদ্ধার করে দেন বাবাকে। আমি ততদিনে গ্র্যাজুয়েট হয়ে এস.আই। উনি না থাকলে আমার পড়াও হত না। চাকরিও না।”
হরিসাধনের একমাত্র সন্তান অনু কাঁদছিল আকুল হয়ে। হরিসাধন সত্যি পুলিশের কাছ থেকে গার্ড অফ অনার পেয়ে গেল, চলে যাবার সময়।
সারা জীবন অসফল মানুষটা জেনে গেল না তার এমন প্রাপ্তিটা।