আবার সে আসিয়াছে ফিরিয়া। যার নাম উচ্চারণ একসময় নিষিদ্ধ ছিল, সকল বাধা নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে ফিরে এসেছে। এবং এসেই সকলকে ঘোরতর বিপদে ফেলেছে। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আমার মতো হতভাগ্য খুপরিজীবি চিকিৎসকেরা।
সবে করোনার চতুর্থ নাকি পঞ্চম ঢেউয়ে (সব হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে) নাকানিচুবানি খেয়ে ডাঙায় উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম কটা দিন রোগীর চাপ কম থাকবে। ফেসবুকে আবোল তাবোল লিখব আর ফুটেজ খাব। অমনি মূর্তিমান বিভীষিকার মতো ডেঙ্গু এসে হাজির। করোনাকে আর তেমন ভয় লাগে না। বরঞ্চ রোগীর করোনা ধরা পড়লে আজকাল আশ্বস্ত হই। বলি, ‘চিন্তার কিছু নেই।’ কিন্তু ডেঙ্গুকে বাস্তবিকই ভয় পাই। এই রোগের মতিগতি বোঝা মুশকিল। বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, ডেঙ্গুর ভদ্র সভ্য হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই। ব্যাটা যদি করোনার মতো সহজেই শুধরে যেতো আমাদের মতো ঢাল তলোয়ার হীন নিধিরাম সর্দার ডাক্তারদের ভারী সুবিধা হতো।
এই দেখুন গল্প শোনাতে বসে আবার রোগ নিয়ে বকর বকর শুরু করেছি। এগুলো বয়স বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। যবে থেকে চল্লিশ পেরিয়েছি এই সমস্যা শুরু হয়েছে। ধান ভাঙতে শিবের গীত শুরু করছি।
মোদ্দা-কথা হলো খুপরিতে ভিড় ক্রমশ বেড়েই চলেছে এবং অর্ধেক রোগী জ্বরে কাঁপছেন। যে রোগীর জ্বরের তীব্রতা যতো বেশি, সেই রোগীর বাড়ির লোকের মেজাজ তত খারাপ। কেন তাঁর খারাপ রোগীকে আগে দেখে দেওয়া হবেনা তাই নিয়ে বাইরে পার্থর সাথে ঝগড়া করছেন।
আমি কোনো দিকে কান না দিয়ে মাথা গুঁজে রোগী দেখে যাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে তাতেও শান্তি নেই। মাঝে মাঝেই রোগীরা চেয়ারে বসে বসে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝুপ করে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির লোকেরা হই চই বাঁধিয়ে দিচ্ছে। আমি লোকজনের ভিড় ঠেলে ছুটছি। তাঁকে চ্যাংদোলা করে বারান্দায় চিৎ করে শোয়ানো হচ্ছে। বাড়ির লোককে বলছি পা দুটো উঁচু করে ধরতে। তাঁরা সেসব না শুনে জল ঢেলে ঢেলে বারান্দায় বন্যা পরিস্থিতি করে দিয়েছেন।
এসবও তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু যেটা একেবারেই সহ্য করা যাচ্ছে না, সেটা হলো পার্থ মাঝে মাঝেই চেম্বারের জানলা খুলে উঁকি দিয়ে বলছে ‘স্যার, এন্টেরো কুইনল মাথায় রাখবেন।‘
আমাদের ক্লাবের মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য বাড়ির বাড়তি ও অব্যবহৃত ওষুধের আবেদন জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। তাতে এক ভদ্রলোক দুই বিশাল পেটি ভর্তি এন্টেরো কুইনল দিয়ে গেছেন। এই পরিমাণ এন্টেরো কুইনল দিয়ে গোটা মধ্যমগ্রামের আন্ত্রিক পরিস্থিতি সামলে দেওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। ভদ্রলোক কোথা থেকে এতো এন্টেরো কুইনল জোগাড় করলেন সেটা একটা রহস্য।
কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ এন্টেরো কুইনলের মালিক হওয়ার পর থেকেই আমাশার রোগী আশ্চর্যজনক ভাবে কমে গেছে। মেডিকেল ক্যাম্প গুলোতে একজনও পেট খারাপের রোগী আসছেন না। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্তও অর্ধেক রোগীই পেটের সমস্যা নিয়ে আসতেন। এদিকে এন্টেরো কুইনলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে মাত্র দু মাস বাকি। তাঁর মধ্যে এই বিপুল ওষুধ কিভাবে খরচ করব তাই ভেবে পাগল পাগল লাগছে।
পার্থ আবার জানলা ফাঁক করে বলল, ‘স্যার, এন্টেরো কুইনল।’
রেগে মেগে বললাম, ‘তা আমি কী করব। সবাইকে ঐ ওষুধ খাওয়াবো নাকি। ইনি ঠ্যাঙে ফোঁড়া নিয়ে দেখাতে এসেছেন।‘
পার্থ আহত ভাবে বলল, ‘আপনিই তো মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিতে বলেছেন।‘
পার্থর কথা শেষ হতে না হতে বাইরে ‘এই পড়ে গেল, ধর ধর।’ আওয়াজ । তারপর ধপাস করে শব্দ। আবার কেউ উলটেছে। এরকম টপাটপ অজ্ঞান করা জ্বর বাপের জন্মে দেখিনি। বাধ্য হয়ে খুপরির বাইরে এলাম।
যিনি উলটেছেন, তাঁকে আমি ভালোভাবে চিনি। বামনগাছিতে বাড়ি। ইনি আবার চোখে দেখতে পান না। এনার স্ত্রীও চোখে দেখেন না। তবে তাঁদের একটি ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে আছে। সে দিব্যি চোখে দেখে।
গৌর আর পার্থ মিলে লোকটিকে প্রায় চ্যাংদোলা করে বারান্দায় তুলল। তাঁর স্ত্রী কিছুই বুঝতে পারছেন না। শুধু কী হলো কী হলো করছেন। ছোট্ট মেয়েটি ভয় পেয়ে সিটিয়ে গেছে।
যদিও মেয়েটি মোটেও ভিতু নয়। বয়স তার কতো হবে। সাত বা আট। আমার ছোটো মেয়ের থেকে একটু বড়ো। সে মা- বাবার হাত ধরে সারাদিন লোকাল ট্রেনে ঘোরে। স্বামী স্ত্রী দুজনে গান গেয়ে ভিক্ষা করেন। স্বামী একটা সাইকেলের বেলের খোলসে খুচরো পয়সা দিয়ে টুং টুং করে আওয়াজ তোলেন। স্ত্রী ভাঙ্গা গলায় যে গানই ধরেন শুনতে আর্তনাদের মতো লাগে। আর মেয়েটি বাদাম ভাজা, ঝুড়ি ভাজা , লেবু লজেন্স বিক্রেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
লোকটির জ্ঞান ফিরেছে। তিনি উঠে বসে জল খেতে চাইলেন। পার্থ বোতল এগিয়ে দিল। ছোট্ট মেয়েটি পরম মমতায় বাবার মুখে জল ঢেলে দিচ্ছে। বড়ো সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু যতই সুন্দর হোক চেয়ে দেখার সময় নেই। আরেকজন উল্টালেই হুলুস্থুল বেধে যাবে।
লোকটিকে দেখে দিলাম। মেয়েটিকে বললাম, ‘এখুনি নিয়ে যাসনা। পাশের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে বাবাকে একটু শুইয়ে রাখ। সুস্থ হলে তারপরে যাস।‘ মেয়েটি ঘাড় নাড়ে। তার ছোট্ট কাঁধে অনেক দায়িত্ব। অসুস্থ বাবা আর অন্ধ মাকে পথ চিনিয়ে ট্রেনে করে বামনগাছি নিয়ে যেতে হবে। আমি জানি দিব্যি পারবে। আমি টেবিলের ড্রয়ার হাঁটকাই। একটাও লজেন্স খুঁজে না পেয়ে মনটা খারাপ লাগে। মেয়েটাকে আজ কিছুই দেওয়া হল না।
রোগী দেখে যাচ্ছি যন্ত্রের মতো। সাড়ে তিনটে- চারটের মধ্যে শেষ করতেই হবে। এর পরেই মধ্যমগ্রাম স্কুলের উল্টোদিকে চেম্বার। সেখানে যদি পৌঁছাতে দেরী হয় এবং দু চারজন অজ্ঞান হয়ে যায় কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে।
প্রায় শেষ করে এনেছি। আরেকজন অন্ধ রোগী ঢুকলেন। গৌর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। ডায়াবেটিসের রোগী। সুগার একটু বেড়ে আছে।
ওষুধ পত্র লিখে দেওয়ার পর ভদ্রলোক পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগ বার করলেন। আমি বললাম, ‘ভিজিট দিতে হবে না। আপনি যান।‘
‘কেন? দিতে হবে না কেন?’
‘আমি প্রতিবন্ধীদের কাছ থেকে ভিজিট নিই না।’
ভদ্রলোক একটু রাগত ভাবে বললেন, ‘আপনি আমাকে প্রতিবন্ধী বলছেন কেন? কী দেখে আমাকে প্রতিবন্ধী মনে হচ্ছে?’
আমতা আমতা করে বললাম, ‘আসলে তো আপনি চোখে দেখতে পান না…’
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, ‘ওই নিয়েই আমি পড়াশুনো চালিয়ে গেছি। একটা ছোটোখাটো চাকরিও করছি। প্রতিবন্ধী কোটায় নয়, নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি। আপনি ভিজিট না নিলে খুব খারাপ লাগবে ডাক্তারবাবু। আমি কারো দয়া চাইনা।’
কী আর করব, হাত পেতে নিলাম। টাকাটা আলাদা করে রেখে দিয়েছি। টাকায় লেগে থাকা ঝকঝকে অহংকারটুর জন্যই রেখে দিয়েছি। এটা দেখলেই মিথ্যে অহংকারগুলো পালানোর পথ পাবে না।