সুখ বড় একচোখা। যে মন্ডপের সামনে আলো আছে, ঢাকের বাদ্যি আছে, মন্ত্রোচ্চারণের ভেতর মা জেগে আছেন সেখানে অসংখ্য ঝলমলে মানুষ ঘুরে বেড়ায়। তারা পুরোনো বন্ধুদের হাসির ভেতর, নতুন সম্পর্কের ওমের ভেতর থেকে সুখ টেনে নেয় বুকের নীচে। তাদের বুকের থেকেই আবার সুখ গলে গলে পড়ে ঘাসের ভেতর, ফুটপাথের পাশে, জলের ওপর।
সুখ বড় উভমুখী। সে কিশোরী প্রেম থেকে বন্ধুর এগরোল হয়ে, মফস্বলের আটচালা থেকে তিলোত্তমার জৌলুস হয়ে, আমাদের নতুন জামা থেকে রিল বন্দুকের মনকেমন ছুঁয়ে পড়ে থাকে একটা বিস্তীর্ণ জনপদে।
কিন্তু সে জনপদ একটা এনক্লোজড সিস্টেম। বছরের এই চারটে দিনের ভেতর যে মফস্বলের এত স্মৃতি, স্বর্গছেঁড়া আকাশ, অষ্টমীর অঞ্জলি, হলুদ শাড়ি মেয়েটির প্রথম হেসে ওঠা ভরে রাখা আছে তারা যেন সেই জনপদের একান্ত নিজস্ব। তাদের কাছে একটু চুপ করে গিয়ে বসতে, সে উৎসবের ভেতর একবার গাছের মতো গিয়ে দাঁড়াতে বুক হু হু করে। কিন্তু উপায় নেই কিছুতেই।
আমার এখানে পুজো নেই। এ শহরে পুজো হয় না। হয় নবরাত্রি। পাড়ার দোকানে ভুলবশতও যদি গিয়ে বলি, ছ’টা ডিম দেবেন, তাহলে চিরহাস্য দোকানী ভুরু কুঁচকে তাকায় ধর্মহীন মানুষের দিকে। সবকিছুই খুব স্বাভাবিক, বছরের অন্য চারটে দিনের মতোই। ডিউটি, মানুষ, অটো, প্যান্টালুনস, জ্যাম, ভিখিরি।
তবু হঠাৎ সকালে ব্রাশ করতে করতে সেন বাড়ির জেঠিমার সাথে দেখা হয়ে যায় যেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন, কবে এলি বাবা? থাকবি তো পুজোর পুরোটা? বিকেলে কোথা থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসে। সন্ধ্যায় হস্টেলের বন্ধুদের সঙ্গে ঝটিতি প্ল্যান হয় সারারাত প্যান্ডেল হপিংয়ের। জনপদ পেরিয়ে, সময় পেরিয়ে চারটে ঝলমলে দিন তার শরীর ভর্তি নির্ভার আনন্দ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। শুধু তাদের জড়িয়ে ধরতে গেলে দু’হাতের ভেতর থেকে গলে পড়ে, ঝরে পড়ে অসীম শূন্যতা।
সুখ ক্লাস ইলেভেনের রাগী ইংরেজি টিচার। তিনি পেছনের বেঞ্চে ঘন্টা পড়ার অপেক্ষায় বসে থাকা ছেলেদের দিকে ফিরেও তাকান না। মনের আনন্দে ফার্স্ট বেঞ্চকে পড়িয়ে যান উইলফ্রেড আওয়েন। আবার যেদিন চোখে পড়ে আমাদের, কান ধরে বের করে দেন বারন্দায়। বারান্দায় কবিতা পৌঁছয় না, যুদ্ধ পৌঁছয় না, স্যারের স্নেহ পৌঁছয় না। ক্লাসরুম একটা এনক্লোজড সিস্টেম। সেখানে তোরা সবাই উজ্জ্বল মুখে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে আছিস। আমি ঠিক পাশেই বারান্দায়, তবু কিছুতেই তোদের সুখকে ছোঁয়ার উপায় নেই। একদিন স্যারই কীভাবে যেন বুঝিয়ে দেন সুখ যখন তোমার, সে যখন জড়িয়ে আছে তোমায় তখন তুমিও কিন্তু অন্য জীবন নিয়ে অন্ধ। অতয়েব তুমি দুঃখকে, অসহায়তাকেও স্বীকৃতি দিও। ঝলমলে ইথার থেকে বহুদূরে একাকী পড়ে থাকা তোমার বেদনাকে আপন কোরো। মিথ্যে সুখযাপনের ভেতর কোনও ‘কুলনেস’ নেই, গর্ব নেই, যুক্তি নেই।
যারা ভালো আছে, সুখে আছে, ঔজ্জ্বল্যে আছে তাদের তো কোনও মানে বইয়ের দরকার নেই। কিন্তু যারা আমার মতো দূর বারান্দায় অসহায় দাঁড়িয়ে আছিস, না তো উৎসবমুখর ক্লাসরুমে গিয়ে বসতে পারছিস আর না তো একছুটে নিজেদের মাঠে নেমে পড়তে পারছিস তারাও ভালো থাকিস সবাই। সব জনপদে পুজো আসে না। হাওয়ায় উড়তে থাকা সব ক্যালেন্ডারের পাতায় ঢাকের আওয়াজ আর যৌথ এগরোল লেখা থাকে না। আমরা এই মন ভার হয়ে থাকা সন্ধ্যেকেই স্বীকার করি না হয়। অসম্ভব নিথর রাতের বেদনাকেই আপন করি।
একটু পরে ঠিক ঘন্টা পড়বে। তখন ক্লাসরুমের ঢাকনা খুলে উৎসব আর প্রিয়জনের স্নেহ মিলেমিশে যাবে বারান্দায়, সেখান থেকে গলে পড়বে মাঠে। আজ এমনিতেও শেষ দিন, হাফ ছুটি। কাল থেকে সাইকেল নিয়ে একসাথে ঠাকুর দেখতে বেরোবো সবাই। এবার তিনটে জামা হয়েছে, ঠাকুমা হাতে গুঁজে দিয়েছে একটা কড়কড়ে একশো টাকা। সেন জেঠিমা বলে গেছে, অঞ্জলি দিতে দেরি করবি না বাবা, ন’টার মধ্যেই চলে আসিস।
যারা উজ্জ্বল জনপদের থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে পড়ে আছে, মন্ডপের উল্টো দিকের অন্ধকারের ভেতর চুপ করে বসে আছে, প্রেম-বন্ধু-পরিবার ছেঁড়া মাটির ভেতর জেগে আছে উদাসীন, এই উৎসবে তারাও থাকুক কোথাও একটা। আর যারা হলুদ শাড়িতে অথবা দু’হাতের ভেতর পুরোনো বন্ধুকে হঠাৎ জড়িয়ে আছে তারা ভালো থাকুক আরও।
একদিন আলো আলো ক্লাসরুমের ভেতর আমাদের সবার দেখা হয়ে যাবে ঠিক। স্যারের চুলে পাক ধরবে। চশমা ঠিক করতে করতে তিনি তখন পড়াচ্ছেন উইলফ্রেড আওয়েন, জেরম কে জেরম। আমাদের বলছেন, সবটুকুই জীবন, শুধু তাকে স্বীকৃতি দাও।
সবাই পুজো ভালো কাটান। স্নেহে, বিশ্বাসে, ঔজ্জ্বল্যে কাটান।