দেশে শিক্ষার হাল অথবা শিক্ষার বিষয় নিয়ে এই লেখা নয়। সেসব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলে গেছেন। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে উদাহরণও দিয়েছিলেন। যদিও খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। তার উপর গত কয়েক দশক জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন ও মন্তেসরি স্কুল। জার্মান ভাষায় ‘ কিন্ডার গার্টেন’ কথাটার মানে হল ‘শিশুদের (খেলার জন্য) বাগান’। খেলা দূরে থাক, বই-খাতার ভারেই এখন শিশুদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
গোটা ছয়-সাত ক্লাসের বই, হোমওয়ার্কের খাতা, ক্লাস ওয়ার্কের খাতা, পেন- পেন্সিল- নোটবুক- জলের বোতল- টিফিন বাক্স নিয়ে ন্যূনতম আট থেকে দশ কেজি ওজন। কখনো কখনো একটা ক্লাসের টীচার ছুটি নিলে তাঁর পরিবর্ত টিচারের বইখাতাও ছাত্রছাত্রীদের আগাম বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
আমার পুত্র তখন দশ বছর। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। খুব পিঠে ব্যথা বলছে। ছেলের শরীরের ওজন ৩৮ কেজি। তখন ওর স্কুলব্যাগখানি ওজন করে দেখলাম ১২ কেজি। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, তদুপরি অস্থিবিশেষজ্ঞ। আমারও অসুবিধা হচ্ছিল ওই স্কুলব্যাগ তুলতে!
এখন প্রশ্ন হল, ভারী ওজন বহন করলে শিশুর শরীরে কি কি সমস্যা হতে পারে?
সমস্যা দুই ধরণের।
প্রথমতঃ, তাৎক্ষণিক সমস্যা। পিঠে অস্বস্তি, যন্ত্রণা হয়। কোমর ও ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে। শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। যার ফলে পিঠের মাংসপেশী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ দীর্ঘকালীন সমস্যা। খুব ভারী ওজনকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যালেন্স করতে গিয়ে মাথা সামনে ঝুঁকে যায় ও মেরুদণ্ড বেঁকে যায় । মেরুদণ্ডের ডিস্কের উচ্চতা কমে যায়। হাড়ের ক্ষয় হয়। বেশিদিন এভাবে চললে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরুদণ্ড বেঁকে যেতে থাকে। এ তো গেলো মেরুদণ্ডের গল্প। কাঁধের উপরেও খারাপ প্রভাব আছে। স্কুল ব্যাগের ওজনের ৬৫% পড়ে কাঁধে। ব্যাগের স্ট্র্যাপ কাঁধের উপর চেপে বসে মাংস পেশীগুলোর ক্ষতি করে। ঘাড়ে ব্যথা, মাথায় যন্ত্রণা, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হতে পারে।
তাহলে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলব্যাগের ওজন কত হওয়া উচিত?
গবেষণায় দেখা গেছে শরীরের দশ শতাংশের চেয়ে বেশী ওজন বহন করলে মেরুদণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। একটি ১২ বছর বয়সী বালক বা বালিকার ওজন ৪০ কেজি হলে তার স্কুলব্যাগের সর্বোচ্চ ওজন হওয়া উচিত ৪ কেজি। মহারাষ্ট্র সরকার আইন করে স্কুলব্যাগের ওজন সর্বোচ্চ দশ শতাংশে বেঁধে দিয়েছেন। ওড়িশা সরকারও এই ধরণের আইন করেছেন। দিল্লি সরকার ক্লাস অনুযায়ী স্কুলব্যাগের সর্বোচ্চ ওজন বেঁধে দিয়েছেন। যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে দেড় কেজি, দশম শ্রেণীতে পাঁচ কেজি ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও এই সব আইনকানুন কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব।
৭ থেকে ১৩ বছরের ছাত্রছাত্রীদের ৮৮ শতাংশই দেখা গেছে দেহের ওজনের অর্ধেকের বেশি ওজন বহন করছে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আর কে নারায়ণ ১৯৮৯ সালে তাঁর সংসদীয় বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘ছাত্রছাত্রীরা বইখাতার ভারে শিম্পাঞ্জির মতো হাঁটাচলা করছে।’
কিভাবে স্কুলব্যাগের ওজন কমানো যায় তা ভাবতে হবে। উন্নত দেশে ডিজিটাল ব্ল্যাকবোর্ডে পড়াশোনা হয়। ছাত্রছাত্রীরা আই প্যাড, আমাজন কিন্ডল, ডিজিটাল ট্যাবলেট ইত্যাদি ব্যবহার করে। তাদের অত ওজন বইতে হয় না। আমাদের দেশে এখনই সেটা সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের অন্য সমাধানের কথা ভাবতে হবে।
ভালো মানের এবং হালকা ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে
- স্ট্র্যাপ দুটো দুই কাঁধে সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে।
- শিশুর বইখাতা, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে।
- একমাত্র প্রয়োজনীয় বইখাতা ছাড়া অন্য কিছু নেওয়া চলবে না।
- অপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্লাসে বা লকারে রেখে আসা যেতে পারে।
- সিলেবাসের বইগুলো মাস অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। ১২ মাসের জন্য ১২ টা ছোট ছোটো ভাগ।
- এমনকি কেরালার কয়েকটা স্কুলে যেমন করেছিল, স্কুলব্যাগ বহন করার জন্য আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- এছাড়া শিশু দের নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করতে উৎসাহ দিতে হবে।
অত্যন্ত দরকারী তথ্য। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তা মানেননা। এমনকি বারবার বলেও কোন সুরাহা পাওয়া যায়না।