সেবার শীতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। ডেবরা হাসপাতালে জয়েন করার পরে কাছের এক সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলে এসে আবদার করলেন উনার বাবাকে একবার দেখে দিতে হবে। সবে মাত্র জয়েন করেছি। স্বল্প বয়স। ডিগ্রি এম বি বি এস মাত্র। প্রাতঃস্মরণীয়দের ভীড়ে হঠাৎ আমাকে স্মরণ কেন? আমার অব্যক্ত কুন্ঠা নিরসন করলেন ভদ্রলোক নিজেই। আসলে বাবাকে চেম্বারে নিয়ে আসা কষ্টকর। বাড়িতে গিয়ে দেখে দিয়ে আসতে হবে। বাবা নিজে দীর্ঘদিন কোয়াক প্র্যাকটিস করতেন। দক্ষিণের হাসপাতালে নিয়মিত দেখানো হয়। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে সেই যে বিছানা নিয়েছেন, উঠবার জো নেই। প্রতি সপ্তাহে রক্তের সোডিয়াম পটাসিয়াম রিপোর্ট করা হয়। মাত্রা প্রায়শই কম থাকে। তাই প্রায় সপ্তাহেই সোডিয়াম পটাসিয়াম ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করতে হয়। তখন দিন দুয়েক হয়তো একটু ভালো থাকেন। আবার যেই কে সেই। কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। উদ্ভ্রান্তের মত থাকেন। বিস্রস্ত কথাবার্তা বলেন। বিছানায় মাঝে মধ্যেই অজ্ঞানের মত হয়ে পড়ে থাকেন। এই অবস্থায় দক্ষিণ ভারত নিয়েও যেতে পারছি না। তাই বাড়িতে গিয়ে যদি একটু দেখে দেন।
“ইন্টারেস্টিং কেস”। নতুন কিছু জানার আগ্রহে রাজি হয়ে গেলাম। বাড়িতে গেলে ভিজিট নেব না- এই শর্তে একটু অবাক হলেও ভদ্রলোক উপয়ান্তর না দেখে আমাকে উনার বাইকের পেছনে বসিয়ে নিলেন।
পেল্লায় বাড়ি। জৌলুষময়। কারুকাজ করা খাটের এককোনে সিঁধিয়ে আছেন ভদ্রলোকের বাবা। পাশের চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওষুধপত্র। আর চোখে পড়ার মত ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির প্রোটিন পাউডারের প্যাকেট। মুখে গোঙানির রব। হালকা গ্যাঁজলা জমে আছে মুখের এক কোণে। গলায় মোটা সোনার চেন। দশ আঙুলে প্রায় ছয় সাতখান ঝকঝকে আংটি। আমি কব্জির কাছে হাত দিয়ে পালস দেখলাম। প্রায় জ্ঞানহীন হাতের উপরে প্রেসার কাফ জড়িয়ে বিপি দেখলাম১১০/৭০। অর্থাৎ কিনা নরমাল। পেট কিছুটা ফুলে আছে বটে। ঢাউস পেটে টোকা দিয়ে দেখলাম জল জমে থাকার লক্ষণ স্পষ্ট। লিভারটা কিছুটা বেড়েই আছে বলে মনে হলো। পা-দুটিও ভারি। চোখে অ্যানিমিয়ার লক্ষণ ঈষৎপ্রতীচ্য। চোখের নিচ ফোলা। আমার খোঁচাখুঁচিতে শূন্য দৃষ্টিতে একবার জরিপ করার চেষ্টা চালালেন প্রাকবৃদ্ধ মানুষটি।
এরপর টেবিলে রাখা ওষুধগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে কুন্ঠামিশ্রিত খাটো গলায় পরিজনেদের জিজ্ঞেস করলাম “অ্যালকোহল খেতেন উনি?”
আমার প্রশ্নে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে জবার এলো-“হ্যাঁ- তবে সে তো আজ বছর খানেক হলো বন্ধ। উঠেই বসতে পারেন না এখন। খাবেন কি করে?”
এরপর পুরানো সব প্রেসক্রিপশন ঘেঁটে টেবিলে রাখা ওষুধ গুলোর সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলাম। চিকিৎসা ঠিকই আছে বলে মনে হলো। দিনে তিনবার করে সেকেন্ডারি বাইল অ্যাসিড চলছে। পটাসিয়াম সোডিয়ামের সাপ্লিমেন্ট চলছে। ব্রেনে থাকা মাইল্ড ইস্কেমিয়ার ওষুধও চলছে। দুবেলা গ্যাসের ওষুধও চলছে নিয়মিত। রিফাক্সিমিন চলছে।কিন্তু ল্যাক্টিউলোজ?
“ল্যাক্টিউলোজ তো টেবিলে দেখছি না।” জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক বললেন- “বাবা তো এমনিতেই বিছানায় অসাড়ে পায়খানা করে ফেলেন। তাই পায়খানার ওষুধটা বন্ধ করে দিয়েছি স্যার। খুব অসুবিধা হলে মাঝেমধ্যে খাওয়াই।”
চমকে উঠলাম। “আর এই প্রোটিন সাপ্লিমেন্টগুলো খাওয়াচ্ছেন কেন? প্রেসক্রিপশনে তো লেখা নেই।”
“আসলে বাবার শরীর খারাপ থাকায় পরিজনেরা এগুলো নিয়ে আসেন। বাবা তো খুবই দুর্বল। তাই বাবার কথামতোই এগুলো দিনে দুবেলা খাওয়াই।”
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। ফেলুদার মত মাথা নাড়িয়ে বললুম “রাইলস টিউব নিয়ে আসুন”।
জোগাড় হলো চটজলদি। নাক দিয়ে রাইলস টিউব পরিয়ে ল্যাক্টিউলোজ চালান করা হলো পেটে। বাকি ওষুধপত্র প্রেসক্রিপশনে লিখে কেতাবি ঢংয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।
বিছানায় পায়খানা করে ফেলা রোগীকে ল্যাক্টিউলোজ? তার মানে আরও পায়খানা করে ফেলবে তো?
পরিজনেদের এসব জিজ্ঞাস্য আমার আত্মবিশ্বাসী চোখের নিচে চাপা পড়েছে আগেই। তার উপর আবার ভিজিট না নেবার শর্তে এসেছি। ফলে কেউই আর মুখ খুললেন না।
যাবার আগে ডায়েটের চার্টে – প্রোটিন আর লবণ পরিহার করতে বলে বেরিয়ে এলাম প্রাসাদোপম বাড়িটা থেকে।
বিকেলে ফোন এলো। “মিরাকল ঘটে গেছে ডাক্তারবাবু। বাবা উঠে বসেছেন। নিজে হাতে খাবার খেতে চাইছেন। কিন্তু প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট তো আপনি না বলে গেছেন। দিতে চাইছি না বলে রাগারাগি করছেন। কি করি বলুন তো? আপনি একটু বাবাকে ফোনে বুঝিয়ে বলুন না” এই বলে ছেলে ফোন ধরিয়ে দিলো বাবাকে।
ফোনের অপরপ্রান্তে গোঙানির রবের উত্তরে আওয়াজ উঁচিয়ে বললাম- “অ্যালকোহল খেয়ে লিভারের বারোটা বেজেছে। ডিকম্পেন্সেটেড ক্রনিক লিভার ডিজিজ। পোর্টাল হাইপারটেনসন হয়েছে সেজন্যই। প্রোটিন খেয়ে শরীরে যে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া তৈরি হচ্ছে তা যাচ্ছে ব্রেনে। সে থেকেই এই প্রায় জ্ঞান হারানো পরিস্থিতি। চিকিৎসা পরিভাষায় হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি। ল্যাক্টিউলোজ এখানে অ্যামোনিয়াকে অ্যামোনিয়ামে পরিণত করে শরীর থেকে বের করে দেবে। ফলে অ্যামোনিয়া আর ব্রেনে ঢুকে গোল পাকাতে পারবে না। ফলতঃ ল্যাক্টিউলোজ বন্ধ করা চলবে না। আর প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া তৈরী করিয়ে নিজের শরীরের আর ক্ষতি করবেন না।”
আমার উত্তরে প্রাকবৃদ্ধ নিরুত্তর হয়ে রইলেন। পাশ থেকে ছেলে বলে উঠলেন – “থ্যাঙ্কিউ স্যার।” প্রশান্তির উষ্ণ আবেশ জড়িয়ে ধরলো আমার চারিপাশ।