পেট তো আর বসে থাকবে না মশাইরা, ক্লান্ত শরীরটাকে ঠেলেঠুলে নিয়ে তাই রোজ সক্কালে বেরোতেই হয়। সে অবশ্য আজ বলে নয়, সারাটা বচ্ছর।
রিক্সায় উঠতে যাবো, দাড়িওলা বয়স্ক মানুষটি বলেন ~হ্যাঁ – আ – আ – চ্ছো!
ভুরু কুঁচকে বলি ~ মাস্ক কোথায় আপনার?
~এই যে দিদিমুণি। একগাল হাসেন তিনি। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেরোয় দলা পাকানো কাপড়ের টুকরোখানা। পুরনো হয়েছে বলে আলগা হয়ে ঝুলতে থাকে ঠিক নাকের নীচটাতে..
আমি বেজায় ভীতু মানুষ। নিজের হাতে, হাতে ধরা ব্যাগে স্যানিটাইজার ছেটাই।
কার্জন গেটে পৌঁছে দেখি টাটকা ফুলকপির দরাদরি চলছে। পাশেই একটা বাইক সোঁ করে পাক খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রায় আমার গা ঘেঁষেই। ভয়ে ভয়ে বলি ~মাস্ক?
~আপনি পরেছেন তো? তাতেই হবে।
চুপ করে যাই।
রোগিণী আসেন পেটের বাচ্চাটির খোঁজখবর নিতে। ঘরে ঢোকার অপেক্ষা! ঢুকেই মাস্কটি খুলে নিয়ে শুরু করেন ~বলছিলাম কী ম্যাডাম এই বড়িটা লিখেছেন, তা কোন ক্ষতি হবে না তো?
তাড়াতাড়ি বলি ~মাস্ক পরেই বলুন না! দিব্যি শুনতে পাচ্ছি।
~মাস্ক পরলে বড্ড দম আটকে আসে যে!
একটা N95 আর একটা সার্জিক্যাল মাস্কের পেছন থেকে আমার হাসি তাঁর চোখে পড়ে না, পড়ার কথাও নয়। তারপর সারাটা দিন জ্বর সর্দি কাশির ওষুধ লিখি আর চেয়ারখানা ঠেলে ঠেলে পেছোতে থাকি.. আরও একটু দূরে..
কোভিড ওয়ার্ডে জ্বরের তাড়সে ছাব্বিশের বাচ্চা মেয়ে ভুল বকে আর একটানা বাড়ি যাবার দাবি জানায়। ভুতুড়ে সাদা পোশাকের ডাক্তার আঙুলের অক্সিজেন মাপে, সিস্টার ট্রে নিয়ে দৌড়য়। পি পি ই কিটের মধ্যে আমি ঘামতে থাকি। তিনটে তলা হেঁটে ওঠার পরে অক্সিজেনের অভাবে ঝাপসা দেখি, পাশের জন হাতটা ধরে নেয়।
দিন কাটতে থাকে। গত ন’মাসে পাঁচশ’ বাহাত্তর জনের চলে যাবার খবর আসে। অনেক ঘন্টা পড়ে ওরা ডাক্তারি পাশ করেছিলো, তারও পরে অনেক ঘন্টা কাটিয়েছে হাসপাতালেরই কোভিড বা নন কোভিড ওয়ার্ডে..
বাঙালি ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করে, গরিবের পেটের ভাতেও। আমি ভেবে যাই ‘ষড়যন্ত্র’ কার? ভেবে যাই মাত্র মাস কয়েক আগে রেল স্টেশনে এক ন্যাংটা বাচ্চার মরা মায়ের পা ধরে টানার ছবিটা দেখে গলা দিয়ে ভাত নামেনি ঠিক ক’জনের? দেশের মানুষ সরকারি হাসপাতালে বেড পায় না বলে, ঠিক ক’জন ছোটেন না বেসরকারি হাসপাতালে?
ছাড়ুন ওসব কথা। সাধের বাইক বা গাড়ি হাতছাড়া হবার ভয়েই না হয় হেলমেট পরেন বা সিটবেল্ট বাঁধেন আপনি। বিশ সালের হিসেবটা ধরছি না, লকডাউন ছিলো কিনা! ঊনিশ সালে পথ দুর্ঘটনায় আমার দেশে মৃত্যু 1.54 লক্ষ। আর বিশ সালে এতোদিন লকডাউন করেও মাত্র ন’মাসে কোভিড মৃত্যু 1.34 লক্ষ। ভেবে দেখুন গাড়ির দামটা বেশি নাকি জীবনের!
মাস্ক পরুন। দোহাই আপনার, মাস্ক পরুন। কারণ আপনার সাধ্য আছে মাস্ক কেনার আর তা নাকের ওপর অবধি পরারও। ষড়যন্ত্রের আলোচনাটা না হয় মাস্ক পরেই করলেন এই বছর। ভেবে দেখুন, ভেন্টিলেটর নামের পয়সা নষ্ট করা যন্ত্রটা থেকে প্রায় কাউকেই ফেরাতে পারছে না অপদার্থ ডাক্তার আর নার্সের দল। আপনিই যদি না থাকেন সেই আলোচনাটুকু শেষ করবে কে শুনি?
ছবি ঋণঃ হোয়াটস অ্যাপ।