প্রায় সত্যি এই গল্পটা আমায় বলেছিলেন, সমুদ্র স্যার। স্যারকে আমি বলেছিলাম গল্পটা একটা গ্রুপে লিখব।
★
শিশু সকালটা ক্রমশ কিশোর হয়ে উঠছে। ডাক্তার সেনগুপ্ত উত্তর বাংলার প্রান্তিক এক স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। তিনি চিকিৎসক প্রশাসক। সরাসরি ডাক্তারি করেন না। এ’খানে এসেছেন সরকারি কাজে। জেলা সদর থেকে সরকারি গাড়িতেই আসার কথা। কিন্তু এখন আসছেন কলকাতার বাড়ি থেকে। তাই ট্রেন।
সপ্তাহান্তে ফিরে যান কলকাতার বাড়িতে। সংসারের টানে তো বটেই, আট বছরের কন্যাটিও টানে খুব। তাঁকে এখন যেতে হবে স্থানীয় হেলথ সেন্টারে। চাকরি প্রার্থীদের ইনটারভিউ রয়েছে। বড় কোনও পোস্টের ইন্টারভিউ না, আইসিডিএস কর্মী নেওয়া হবে বেশ কিছু। তারই শেষ পর্বের ওয়াক ইন ইন্টারভিউ।
স্টেশন থেকে হেলথ সেন্টার প্রায় তিন কিলোমিটার। রিক্সা চাই। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে গোটা কয়েক রিক্সার মধ্যে যাকে বেছে নিলেন, সে একটু বয়স্ক। আসলে বেচারাকে দেখে একটু মায়াই লাগল। আস্তে চালাবে। তা চালাক। হাতে সময় রয়েছে। দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে চারপাশটা।
রিক্সায় উঠলে দরাদরি করে ওঠা নিয়ম। জিজ্ঞেস করতে বলল, “যা নেবার তাইই নেব বাবু, ওঠেন তো!”
রিক্সা যাচ্ছে, ঢিমে গতিতে, যেমনটি ভাবা গেছিল। রাস্তার ধারে মফসসল শহরে, অকৃপণ প্রকৃতি সবুজ ঢেলেছে প্রচুর।
রিক্সাওয়ালার সঙ্গে আলাপ করা যাক। – এ’বার এদিকে চাষের খবর কি কত্তা? অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করলেন সেনগুপ্ত।
– আজ্ঞে, যা বরষা হল। ক্ষতি হল বেশ।
– বৃষ্টি হলে তো ভালো!
– কিন্তু অনেক বৃষ্টিতে সেই সব ভালো ভেসে গেছে।
এই সব নানান কথা বলতে বলতে হেলথ সেন্টার এসে গেল।
সেনগুপ্ত ভেতরে গেলেন। ছোটো চাকরি কিন্তু ক্যান্ডিডেট প্রচুর।
অন্য যাঁরা থাকবেন ইন্টারভিউয়ে, তাঁদের মধ্যে সরাসরি সরকারি চাকরি করা আর একজন মানুষ হচ্ছেন এসডিও। বাকিরা? সেও ওই সরকারি অর্ডার মোতাবেক লোকাল মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান আর এমএলএ। এই দু’জনই স্থানীয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। দুজনের কাছেই আজকের জন্য নামের গোপন লিস্ট রয়েছে। দু’জনের দল একই। উপদল আলাদা। কাজেই লিস্টও আলাদা।
কে কতজনকে ঢোকাতে পারেন চাকরিতে তার অলিখিত কমপিটিশন হবে ইনটারভিউয়ের সময়। চেনা ছবি।
সেনগুপ্ত আর এসডিও দু’জনের কাজ প্রাণপণে সেই বেনোজল আটকানো।
জনপ্রতিনিধিদের নানা দায়িত্ব। কাজেই দেরি করে আসবেন। এ’টা, মানে এই সময়ে না আসাটা বহুদিনের প্রথা। সেনগুপ্ত শুনেছেন, এই দেরি করে আসাটাই এঁদের চাপ সৃষ্টির প্রথম ধাপ। সেই ক্রিকেটের মাঠে দেরি করে ঢোকার মত ব্যাপারটা।
হেলথ সেন্টারের বড় ডাক্তার ‘বিএমওএইচ”টির অফিসিয়াল সরকারি কর্তা হচ্ছেন সেনগুপ্ত। তিনি এসে চুপিচুপি সেনগুপ্তকে বলে গেলেন, “স্যার লাঞ্চে বোরোলি মাছের ব্যবস্থা করেছি। তাড়াতাড়ি সেরে নেবেন।”
আর তাড়াতাড়ি! এমএলএ আর চেয়ারম্যান দু’জনেই দেরি করে ঢুকলেন প্রায় একসাথে। ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে দু’জনেরই গোপন গুপ্তচর ফোনে খবর দিচ্ছিল।
“স্যার, ওনার গাড়ি থানার মোড় পেরোলো। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঢুকে পড়ুন।” কিম্বা, “ভিড় জমে গেছে চমৎকার। আপনি ঢুকলে কি হাল্কা করে একটু স্লোগানের ব্যবস্থা করব?” উত্তেজনায় টানটান পরিস্থিতি।
ইনটারভিউ শুরু হল। শুরুর থেকেই চমক। চমকে যাচ্ছেন সেনগুপ্ত। সামান্য চাকরির জন্য অসামান্য সব ক্যান্ডিডেট। অসামান্য মানে কাগজপত্রে। সবারই কাগজ আছে। ডিগ্রির, এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাকটিভিটির, আর সুপারিশ মানে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের। সবারই চরিত্র এত পবিত্র নির্মল, যেন পুরো তপোবনে এসে পড়েছি এই রকম ভাবের উদয় হচ্ছে মনের মধ্যে।
জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নগুলোও হচ্ছে অসামান্য। যেন কিছুতেই অন্যজনের লিস্টের কেউ মাথা তুলতে না পারে! সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন সেই নেতারা।
এসডিওটি অবাঙালি। অল্পবয়সী। বাঙালি চাকুরে সেনগুপ্তের মত মিনমিনে নয়। সোজা সাপটা বলে দিল শুরুতে, “এম্লে সাহেব আর চেয়ারম্যান সাহেব, শুনেন, বুঝাই যাচ্ছে এরা সব কাগজপত্র ওয়াইজ সমান। কম বেশি নাই কুনো। তো অ্যাত্তোগুলান পোস্ট তো নাই। এর বাইরেও কাওর কুনো পজিটিভ কিছু থাকলে তবেই সিলেক্ট হবে।”
যাঁদের উদ্দেশে বলা, সেই দু’জন তবু ক্যান্ডিডেট ঢুকলেই লিস্টে নাম দেখে নিচ্ছেন।
ইন্টারভিউ চলছিল। একটা মেয়ে ঢুকল। কাগজপত্রে অন্যদের মত একই কেস। কেমিস্ট্রিতে এমএসসি। অন্য সার্টিফিকেট বরং অন্যদের থেকে একটু কমই।
এমএলএ আর চেয়ারম্যান দুজনেই যে যার লিস্ট দেখে মাথা নাড়ল। কারওর লিস্টেই নাম নেই। মানে এর চাকরি হবার চান্স প্রায় নেইই। তবু, ওই যে এসডিওর জেদ। সেই পজিটিভের খোঁজে প্রশ্ন শুরু হল।
জনপ্রতি সময় তো বেশি না। মিনিট পাঁচেক। কিন্তু এর বেলা সময় বেশি লেগে গেল।
টুকে বিএ পাশ এমএলএ জিজ্ঞেস করল, “এমএসসি নর্থ বেঙ্গল?
নতমুখ মেয়ে মাথা নাড়ল।
-“হে হে হে, কলকাতা কী যাদবপুর হলে চেহারা দেখেই বোঝা যেত।”
কী বোঝা যেত কে জানে! আর সেটা বোঝা গেলে আইসিডিএসের ওই চাকরিতে কী সুবিধা হত তাও কে জানে।
আবার জিজ্ঞেস করল এমএলএ -“বল তো তরাইয়ে রয়াল বেঙ্গল টাইগার দেখা যায় না কেন?”
মেয়ে নিরুত্তর। টেবিলের ওই পাশে থাকার সুবিধে হল যা খুশি প্রশ্ন করা যায়। উল্টোদিকের অসুবিধে হল উত্তর যা খুশি দেওয়া যায় না। নইলে এমএলএকে বলা যেত “যে কারণে সুন্দরবনে বাইসন দেখা যায় না, ইছামতীতে বোরোলি মাছ মেলে না”।
এবার চেয়ারম্যানের পালা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন -“নগরায়ন জিনিসটা ভালো না খারাপ বলো দেখি?” এই প্রশ্নের সঙ্গেও আইসিডিএসের দূরতম যোগ নেই।
সেনগুপ্তের মনে হল তিনিই উত্তরটা দিয়ে দেন ক্যান্ডিডেটের হয়ে।
“নগরায়ন খুব, খুবই খারাপ জিনিস স্যার। নগরায়ন হয়েছে বলেই না আপনার মত চেয়ারম্যান পাওয়া গেছে”।
এ’বার সেনগুপ্তর পালা। বিষয়ে ঢোকার চেষ্টা করলেন।
“ধরো খাওয়া দাওয়ার পরে তোমার সেন্টারের সেই বাচ্ছাগুলির মধ্যে কেউ কেউ একটু ঘুমোতে চাইলো, আর বাকিরা হইচই করছে। না বকে ঝকে তাদের শান্ত করতে পারবে ?”
খুব শান্ত গলায় উত্তর এলো, “হ্যাঁ স্যার, পারবো”
-“কিভাবে ?”
-“গান শুনিয়ে।”
-“তুমি গান জানো?”
-“ওই একটু আধটু।”
-“তোমার একটাও গানের সার্টিফিকেট দাওনি তো”
মাথা নাড়ল মেয়ে, -“নেই, আমার মায়ের কাছে শিখেছি।”
-“ওহ্, কিছু মনে না করলে একটা যে কোনো গানের একটু খানি শোনাবে? তাই বলে আবার বাচ্চাদের গান নয়, বড়দের গানই শোনাও।
ইন্টারভিউ বোর্ডের বাকি সদস্যরা ততক্ষণে এই প্রশ্নোত্তরে কিঞ্চিৎ উৎসাহী হয়ে পড়েছেন সেটা তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বোঝা গেল। এসডিওর মুখে কেবল সামান্য হাসি।
মেয়েটি খালি গলায় গান ধরলো। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে। কুড়ি বাইশ বছরের একটি মেয়ে। উল্টোদিকে বাঘা বাঘা সব শ্রোতা, গানের কিছু বুঝুন না বুঝুন। তাঁদের চোখ মেয়েটির কালো চুলের সাদা সিঁথির দিকে।
প্রায় অন্ধকার উত্তরবঙ্গের হেমন্তের বিকেলে সরকারি অফিসের বিবর্ণ ঘরখানি সুরের মূর্ছনায় কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল বলে বোঝানো যাবে না। দু কলির বদলে খালিগলায় গোটাদুয়েক গান শোনার পরে মেয়েটিকে গান থেকে ছুটি দেওয়া হল।
হতবাক এসডিও ভুলেই গেছিলেন, তাঁকেও কিছু প্রশ্ন করতে হবে। সেনগুপ্ত মনে করিয়ে দিলেন।
আইসিডিএস তো বটেই, ভারত সরকার আর রাজ্য সরকারের যাবতীয় শিশু কল্যাণ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন করলেন এসডিও সাহেব।
অবাঙালি অফিসার। মাঝে মাঝে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে ফেলছিলেন। থেমে থেমে, হয় তো তত সাবলীল নয় ইংরেজিতে, সব প্রশ্নের ঝরঝরে উত্তর দিল সেই মেয়ে।
ইনটারভিউ প্রায় শেষ। মেয়ে কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে ফাইলে।
চারজন ইন্টারভিউয়ার একমত হয়ে ঢেলে নম্বর দিলেন।
সেনগুপ্তর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলল একটু শেষবেলায়।
প্রশ্ন করলেন, -” সিনেমা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করব তোমায়? সত্যজিতের কোন সিনেমা তোমাকে ভাবিয়েছে খুব?”
মেয়ে এতক্ষণে অনেক সাবলীল। এই রকমের গোত্রছাড়া প্রশ্নেও না ঘাবড়ে বলল, -“প্রায় সব ছবিই। তবে সবচেয়ে ভাবিয়েছে নায়ক।”
অনেক প্রশ্ন করা যেত। কিন্তু সময় কমে এসেছে। পর্ব শেষ করতে হবে। এককালে ফিল্ম সোসাইটি করা ডাক্তার তবু আর একটা প্রশ্ন না করে পারলেন না। -“নায়ক হিরো আর প্রতিনায়ক মানে ভিলেন তো সবাই চেনে। নেপথ্য নায়ক কাকে বলে জানো?”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মেয়ে, -“জানি”
-“তেমন কারও নাম বলতে পারবে?”
– হ্যাঁ স্যার, আমার বাবা আর মা”
-“কেন বলছ?”
-“আমার মা বাবা খুবই গরীব। দিনরাত খেটে, প্রয়োজনে আধপেটা থেকেও তাঁরা একমাত্র সন্তান আমাকে বড় করেছেন যথাসাধ্য। মেয়ে বলে কোনও কার্পণ্য করেননি। কোনও সময়েই অভাবের অজুহাত দেননি।”
সেনগুপ্ত মুখ ফসকে বলেই ফেললেন, “ঠিক আছে তুমি তো থাকছই। পরে কখনও এলে দেখা করব তাঁদের সঙ্গে।”
এসডিও জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াই ইউ আর নট ট্রায়িং ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সামস?”
কাগজ গুছোনো শেষ। মেয়ে সবিনয়ে এই শেষ প্রশ্নেরও উত্তর দিল, -“স্যার, আই অ্যাম আ ক্যান্ডিডেট ফর ডাব্লিউবিসিএস দিস ইয়ার।”
অন্য পরীক্ষকরা আগেই ফিরে গেছেন। বোরোলি মাছ আরও নানা উপকরণের লাঞ্চ সেরে সেনগুপ্ত ফিরবেন। বেরিয়ে দেখেন ক্যান্ডিডেটদের থিকথিকে ভিড় কমে এসেছে। সদর থেকে তাঁকে নেবার জন্য গাড়ি এসে গেছে।
বাইরে বেরিয়ে সকালের সেই রিক্সাওয়ালার সাথে দেখা। সে চিনতে পেরে এগিয়ে এল। -“স্টেশন যাবেন? আমি কিন্তু পারব না, প্যাসেঞ্জার আছে। অন্য রিক্সা ডেকে দেব বাবু?”
-“না আমি অন্য জায়গায় যাব, ব্যবস্থা আছে।”
এই সব কথাবার্তা চলছে, সেনগুপ্ত দেখতে পেলেন সেই ইনটারভিউয়ে ফার্স্ট হওয়া মেয়ে এগিয়ে আসছে।
চোখচোখি হতে, রিক্সাওয়ালাকে দেখিয়ে বলল -“স্যার, আপনি নেপথ্য নায়কের সঙ্গে আলাপ করবেন বলেছিলেন। এই যে, ইনিই। আমার বাবা। আমাকে নিতে এসেছেন। আর একজন বাড়িতে। গানের টিউশনি করেন। গানের ক্লাস চলছে তাঁর।”