কয়েকদিন ধরেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না অনুপমা দেবীর। সামনের অগাস্টেই চুয়াত্তরে পড়বেন। তবে সুগার, প্রেসার এসবের ঝুটঝামেলা ওনার কোনোদিনই নেই। শরীরটা চিরদিনই ঐ রবিঠাকুরের ভাষায় ‘বিশ্রী রকমের ভাল’।
তাই এবার গা ব্যথা, মাথা ধরা, একটা ম্যাজম্যাজে ভাব হওয়াতে অবাক হয়েছিলেন নিজেই। প্রথমটা কাউকে বলেননি। কিন্তু তারপর বিকেল থেকে বুকের বাঁদিক্টায় একটা জ্বালা-জ্বালা অনুভূতি এবং অবশেষে বাঁদিকের বুক, পিঠ এবং হাত বরাবর কনকনে যন্ত্রণাটা শুরু হতেই বেশ ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বলব না, বলব না করেও রাত আটটা নাগাদ বড় বৌমাকে বলেই ফেললেন কষ্টটার কথা।
তারপর ঘটনাক্রম সহজেই অনুমেয়।
বড় বৌমা থেকে বড় ছেলে, তার থেকে বাড়ির সবাই এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে পাড়ার ডাক্তারবাবু।
প্রেসার ঈষৎ বেশি। এছাড়া সেরকম কিছু নেই। কিন্তু ঐ বুকের যন্ত্রণাটা কিন্তু বেড়েই চলেছে। আধখানা সরবিট্রেট জিভের তলায়। নাঃ। কোনো লাভ হল না। নো রিস্ক। সিদ্ধান্তটা এবার নিয়েই ফেলা হল। আরো রাত হলে এরপর ট্যাক্সি মেলাও মুশকিল হবে।
অবশেষে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ শহরের এক নামী হাসপাতালের ন’তলায় আই সি সি ইউ-তে ভর্তি হয়ে গেলেন অনুপমা সমাদ্দার। শুরু হল সবরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ইসিজিতে, নাঃ কিছু নেই। ব্যথাটা কিন্তু একটুও কমছে না, বরং একটু একটু করে বেড়েই চলেছে।
রাতটা কেটে গেল কোনোরকমে। ঘুমের ওষুধে শুধু একটু আচ্ছন্ন ভাবই থাকল। ঘুম আর হল না। একে তো হাসপাতালের অচেনা বিছানা, তার ওপর এই ব্যথাটা।
সকালেও অবস্থা তথৈবচ। গা ম্যাজম্যাজ তো করছিলই, এবার এসে গেল জ্বর। সকালে রাউন্ডে এসে বড় ডাক্তারবাবু ভ্রু কুঞ্চন। কিছুই মিলছে না।
দুপুরে গা স্পঞ্জ করাতে গিয়ে ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়ল নার্সের। বুকের বাঁদিকে, বগলের তলায় লাল লাল ছোট-ছোট ফুস্কুড়ির মতো কী যেন বেরিয়েছে। পিঠের দিকে আরো কয়েকটা। ওই জায়গাগুলোতে হাত দিতে দিচ্ছিলেন না অনুপমা দেবী। বড্ড ব্যথা। হাত দিলে সাংঘাতিক কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন লক্ষ লক্ষ পিন ফুটছে ওখানে।
পোকা কামড়ালো নাকি? চারপোকা? এত পরিচ্ছন্ন আই সি সি ইউ-তে চারপোকা?
বিকেলের দিকে ছোট ছোট ফোস্কা যেন দল বেঁধে বেরোতে শুরু করল। বুকে, বগলে, পিঠে। শুধু বাঁদিকটা জুড়ে। যন্ত্রণায় পাশ ফিরতে পারছেন না তিনি। সন্ধেবেলা ‘কল’ দেওয়া হল স্কিন স্পেশালিস্টকে। ততক্ষণে কয়েকটা ফোস্কায় আবার পুঁজ ভরে উঠেছে। ত্বকবিশেষজ্ঞ এসে দেখলেন পরীক্ষা করেঃ এতো জোস্টার হয়েছে। হারপিস জোস্টার।
সেই রাতেই আই সি সি ইউ থেকে ছুটি হয়ে গেল অনুপমা দেবীর। হার্টে তাঁর কিছু হয়নি।
ওষুধ পড়ল। ছ’তলায় কেবিনে এসে, ঘুমিয়ে পড়লেন অনপমা দেবী। যন্ত্রণার উপশমে ততটা নয় বরং রোগ নির্ধারণের পর, উৎকন্ঠার অবসানে।
গল্পটার এখানেই শেষ। এবার জানা যাক কী এই হারপিস জোস্টার?
এক কথায় বলতে গেলে একটি ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ। কি সেই ভাইরাস? জলবসন্ত বা চিকেনপক্সের জন্য দায়ী যে, সেই ভাইরাস।
ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস। শুধু চিকেন পক্সের ক্ষেত্রে সংক্রমণটা প্রাথমিক এবং বহিরাগত। আর জোস্টারের ক্ষেত্রে ভাইরাসের পুনঃ-ক্রিয়াশীলতার জন্য অন্তর্গত সংক্রমণ।
একটু খুলে বলা যাক।
ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস বা VZV প্রাথমিকভাবে সংক্রমণের পর ত্বক থেকে চলে যায় সেন্সরি নার্ভ এন্ডিং-এ। এবং সেখান থেকে সেন্সরি ফাইবার বেয়ে সেন্সরি গ্যাংলিয়াতে। এই গ্যাংলিয়াগুলি আসলে বহু স্নায়ু-কোষতন্তুর সমাবেশ। ভাল মানুষের মতো সেন্সরি গ্যাংলিয়াতে ঘুমিয়ে থাকে এই ভাইরাস। একে বলে লেটেন্ট স্টেট। এই নিদ্রা-দশা চলতে পারে বহু বছর। তারপর একদিন সময় সুযোগ মতো ঘুম ভাঙ্গে VZV-র। এবং গ্যাংলিয়ার শয্যা ছেড়ে স্নায়ু তন্তু বরাবর নেমে এসে ফের হামলা চালায় ত্বকে। একেবারে ছোবল। এবার তার সব শক্তি কেন্দ্রীভূত হয় সাধারণত একটি বা দুটি ডার্মাটোমে। ডার্মাটোম হল ত্বকের সেই নির্দিষ্ট অংশ যার সংবেদনশীলতা নির্ধারণ করে একটি নির্দিষ্ট নার্ভ। কিন্তু, ঘুম কেন ভেঙ্গে যায় তার? বহু বছরের সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় কে? হতে পারে কোনো আঘাত, বা অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি, অসুস্থতা, প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এমন কোনো ওষুধের ব্যবহার, মেরুদণ্ডে রেডিয়েশনের প্রয়োগ ইত্যাদি। এছাড়াও চিকেনপক্স রোগীর ছোঁয়াচ লেগেও পুনঃক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে ভাইরাসটি।
আর যাঁদের কোনোদিনই চিকেন পক্স হয়নি, তাঁদেরও হতে পারে জোস্টার। সরাসরি সংক্রমণে। তবে হ্যাঁ, স্বস্তির কথা, জলবসন্তের চেয়ে কম সংক্রামক এই জোস্টার।
বসন্তরোগের জীবাণুঘটিত হলেও শুধু যে বসন্তেই দেখা যায় এই অসুখটি তা কিন্তু নয়। বরং অল্প বিস্তর হতে থাকে সারা বছর জুড়েই। তবে তারই মধ্যে মার্চ-এপ্রিল আর অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে যেন একটু বেশি।
জোস্টার হবে কার?
বলা খুব শক্ত। তবে খুব ছোটদের সাধারণত হয় না। আর একবার হলে মোটামুটিভাবে সারা জীবনে আর হবে না এটাও বলা যায়।
অনুপমা দেবীর গল্পটা আরেকবার পড়লে স্পষ্ট হবে রোগটির রকম-সকম। তাও বলি। রোগের সংক্রমণ আর লক্ষণ প্রকাশের মধ্যে প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের সময় বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড। এরপর দিন দু’তিনের প্রোড্রোমাল সিম্পটমস বা পূর্বলক্ষণ, যেমন—গা ম্যাজ ম্যাজ করা, মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, গলা ব্যথা, খুশ খুশে কাশি, একটু জ্বর এইসব। অনেকের ক্ষেত্রে আবার কোনোরকম আগাম জানান না দিয়েই সরাসরি আক্রমণ করে হারপিস।
র্যাশটা হয় প্রথমে একটু লালচে। তারপর ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা যায়। মাত্র ৪ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যেই এই ব্যাপারটা হয়ে যায়। পরের দু-চার দিনের মধ্যে এরকম আরো কয়েকটি ফুসকুড়ি থেকে ফোস্কার দল বিজবিজ করে গজিয়ে ওঠে।
তবে গোটা ব্যাপারটাই সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত শরীরের একটা দিকে, একটা বা দুটো নার্ভের এলাকা বরাবর।
বুকে, কোমরে বা মুখে, কপালে যে কোনো জায়গাতেই হতে পারে হারপিস। সঙ্গে থাকে অসহ্য যন্ত্রণা।
সাধারণত সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে সেরেও যায় হারপিস। কোনো জটিলতা দেখা না দিলে কোনো দাগও থাকে না। তবে হ্যাঁ, জটিলতা দেখা দিলেও দিতে পারে। যেমন ঘটতে পারে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ। পেকে যেতে পারে। তার থেকে হতে পারে বিশ্রী দাগ। এছাড়া যাঁদের প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র শরীরে একটি অংশে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে যেতে পারে সারা দেহেই। এমনকী রক্ত-ভরা ফোসকাও উঠতে পারে। এছাড়াও নিউমোনিয়া, সেপ্টিসিমিয়া, এনকেফেলাইটিস, এমনকী হেপাটাইটিস, নেফ্রাইটিস, আর্থ্রাইটিস, প্যানক্রিয়াটাইটিসও হতে পারে এ থেকে।
আবার গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে হারপিস হলে নবজাতকের সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই বেশি। আর গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে হলে বিপদটা অন্যরকম। সেক্ষেত্রে নানারকমের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে শিশুটি। একে বলে ‘কনজেনিটাল ভ্যারিসেলা সিনড্রোম’। আর একটি সমস্যা হতে পারে হারপিস থেকে। বিপদ না বলে একে আপদ বলাই ভাল। পোস্ট-হারপেটিক নিউর্যালজিয়া। হারপিস সেরে যাবার দু’মাসেরও পর রোগী বা রোগিণীর শরীরের সেই অংশে ব্যথা বা অসম্ভব চুলকানি থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রে। বয়স্কদের ক্ষেত্রেই এই PHN হবার সম্ভাবনা বেশি। এর চিকিৎসা অনেকসময়েই সময়সাপেক্ষ। এছাড়াও যদি অপথ্যালমিক স্নায়ুটি আক্রান্ত হয় এ রোগে, তাহলে কেরাটাইটিস, কর্নিয়ায় ঘা, আইরাইটিস এমনকী দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে সেই চোখে।
জোস্টারের চিকিৎসা
বিশ্রাম, একটু ব্যথার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক প্রয়োগে অনেকক্ষেত্রেই উপশম হয় কষ্টের। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের। অ্যাসাইক্লোভির বা ফ্যামসাইক্লোভির প্রয়োগ করতে হতে পারে।
অনুপমা সমাদ্দার যেমন হার্ট অ্যাটাক ভেবে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন আই সি সি ইউ-তে, জোসটার তেমনি ঠকিয়ে দিতে পারে আরো কিছু ক্ষেত্রে। র্যাশ বেরোনোর আগে পেটের ওপরের ডান দিকে ব্যথা থেকে মনে হতেই পারে গল ব্লাডারের ব্যথা বা ডিওডিনাল আলসারের কথা। এমনকী রেনাল কোলিক বা অ্যাপেন্ডিসাইটিসও মনে হতে পারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। এছাড়া মেরুদণ্ডে স্লিপ-ডিস্ক বা চোখের গ্লকোমার মতো যন্ত্রণাও ধাঁধায় ফেলতে পারে কখনো।
তাই ধাঁ করে রোগ নির্ধারণ করে না ফেলে এই চর্মরোগটির কথাও মাথায় রাখা উচিত।
কোন চর্মরোগ? ওই যে বললাম।
নাম তার, জোসটার।
হারপিস জোসটার।
হারপিস এ এন্টিবায়োটিক এর ভূমিকা কিভাবে থাকে? এটি তো ভাইরাল ডিসিস !
সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের হ্যাপা সামলাতে
ভালো যাও
হাত লেগে ‘যাও’ শব্দটা এসে গেছে।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েই যায় ! তাই…
ভালো।
Sir , er jantrana ta maratak. Mone hoy heartfelt hoy jabe. Thank you for your suggestions.
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
These are actually great ideas in concerning blogging.
Your site is very helpful. Many thanks for sharing!
আমি এখন হার্পিস জোস্টার ভাইরাসে আক্রান্ত খুব অসস্তি লাগছে
ভীষণ উপকৃত হলাম । কোনো ধারণা ছিল না , যেটা আপনার লেখা পড়ে হলো। অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে।
Wonderful piece of writing.Enriched my knowledge regarding this disease .Excellent.
নমস্কার ডাক্তারবাবু,
আমার herpes zosterহয়েছে ৫দিন।
ঔষধ খাচ্ছি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ২দিন থেকে।
কত দিন পরে ভালো হবো।
আমাকে একটু সাহায্য করুন।
ধন্যবাদ আপনাকে। আমার ঠিক একই সমস্যা পেটে ব্যথা নিয়ে হসপিটালে গেছিলাম। অনেক টেস্ট করার পরও তেমন কিছু পায়নি। শুধুমাত্র ফ্যাটি লিভার। পরবর্তীতে ঠিক সেম জিনিসগুলো শরীর দিয়ে বের হয়েছে পেটের ডান দিকে এবং পিঠের ডান দিকে।