আমি বাঙালি। একদম আর দশজন বাঙালির মতো। দুলালচন্দ্র ভড়ের তালমিছরি, ইলিশ, চিংড়ি, ব্রাজিল, মেসি রোনাল্ডো, ভ্যালেন্টাইন ডে, ভানু-রবি ঘোষ, মান্না হেমন্ত, হাত বোলানোর মত একটুখানি ভূড়ি নিয়ে একদম কেচ্ছাপ্রিয় সেন্টু খাওয়া চা এর দোকানের বাঙালি।
আরো কিছু দোষাবলী আছে। ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
ডাক্তার হয়েছি তো কি হয়েছে। এসব ছাড়া যে চলবে না- সে বিষয়ে নিজের প্রতি আমার একশো শতাংশ খাঁটি বাংলা’র গ্যারান্টি আছে।
তবে গর্ব করার মত ইচ্ছেও আছে। অন্ততঃ চা-এর দোকানের নলেজ মস্তিষ্কে সাজিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে!!
তাইতো লোকাল ট্রেন, মাছের বাজার আর চা-এর দোকান, আমার খুব প্রিয় তিনটি জায়গা। এবং সুযোগ পেলে প্রথম দুটিতে যেতে ভুল করিনা। আর তিন নম্বরটি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, সকাল বিকাল ভরসা।
আর একটা বদভ্যাসও আছে। এটা অনেক দিনের পুরনো শখের বদভ্যাস। আশেপাশে অপরিচিত কেউ বসলে, তার সম্বন্ধে নিজের মনে কতগুলো আইডিয়া বানাই। যেমন, এর পেশা কি, খুঁতখুঁতে স্বভাব কিনা, বাড়িতে বউয়ের সাথে ঝগড়া করে কিনা, কবিতা লিখতে পারে কিনা, গালাগালি করতে পারে কিনা এইসব। বলতে পারেন, চুপিচুপি গোয়েন্দা গিরি করি মানুষ নিয়ে।
হ্যাঁ, এই কাজটিও বাঙালির স্বভাব। আমারও। আর বুঝতে না পারলে ফেলুদার শরণাপন্ন হই মনে মনে। লালমোহনবাবু আর ফেলুদাকে তখন আমি দেখতে পাই। মজার ব্যাপার হলো, ওনারা কথাও বলেন আমার সাথে!
কি ভাবছেন?? ঢপ মেরে আলুর চপ খাইয়ে দেব?? একদম নয়। প্রমাণ দিয়ে দেব? বসুন।
টোটোতে চারজন বসে আছি। আমি আর আমার বন্ধু।
মুম্বাই হামলা নিয়ে কথা চলছে বাকি দু’জনের মধ্যে।
ফেলুদা কে মনে করলাম। বলে দিল!!
কথা শুনেই আমার বন্ধুকে কানে কানে বললাম, ইন্সুরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট, পাক্কা।
অল্প সময়ের মধ্যেই একজন পাশের লোকের সাথে কথা বলার ফাঁকে একটা কার্ড হাতে ধরিয়ে দিল। আমাদেরও দিল। কেন কে জানে। তাকিয়ে দেখি , যা ভেবেছি তাই!!!
কিন্তু একটা সমস্যা আছে । বাকিদের কাছে সেখানে আমি গোল খেয়ে যাই অনায়াসে।
সব জায়গাতেই আমি বলতে পারি কম, শ্রোতা হয়েই খুশি থাকি বেশিরভাগ সময়। শ্রোতা হিসেবে একটু গর্ব অবশ্যই করতে পারি (ছাড়বো কেন বলুন? সুব্রত কি পেলেকে ছেড়েছিল?? ছাড়েনি তো!! তো আমি কেন ছাড়বো?)।
চা-এর দোকানে বসে থাকি।
এখন তো আবার হাতে থাকে মোবাইল। যখন তখন খবর দেখি। কেচ্ছা কাহিনী গুছিয়ে লেখা থাকে পত্রিকার পাতায়। তেমনি বসে আছি। হাসপাতালের সামনে চা-এর দোকান।
এক নোবেলজয়ী ধর্ষিতার গল্প পড়ছিলাম। কি হলো? ভুরু কুঁচকে কি ভাবছেন??এসব আবার এলো কোত্থেকে?? আসে আসে, জানতিও পারি না। ফেসবুক পাঠায়।
কাল একজন নলেজ ঝেড়ে আমাকে মচকাতে চেয়েছিল,আজ থাকলে দেখাতাম মজা।
বিষয়টি বিতর্কিত। ধর্ষিতাকে নোবেল দেয়া উচিত কিনা এই নিয়ে তিন কাপ চা শেষ করেও তাকে কাল বোঝাতে পারিনি। ভাবলাম, একটু পড়ে রাখি ঘটনাটা।
একটু হালকা চালে বুদ্ধিজীবী সাজি। যদিও নোবেল পুরস্কার কমিটিতে আমার অবদান গিনেস বুকে লেখার মতো, (বড় একখানা গোল্লা) তাতে কি এসে যায়। স-মাল(চা)-আলোচনায় বিতর্ক সৃষ্টি করেই দিই।
এই নোবেল পুরস্কার দেয়া আমার পছন্দ হয়নি।
প্রশ্ন করবেন তো?? ফেমিনিস্টরা তিন কাপ চা খান। আর যা পারুন বলুন। আমি শুনছি। পছন্দ হয়নি তো হয়নি। কি জঘণ্য বর্ণনা নোবেলজয়ীদের ইতিহাসের!!
আমার একটাই যুক্তি: নোবেল পুরস্কার দেখিয়ে দিল, এখনো, ধর্ম-রাষ্ট্র সব কিছুর বাইরেও ভেতরে, নারীই ধর্ষিতা।
ধর্ষণ বন্ধ করার উপায় তৈরি করার জন্য জাতি ধর্ম বর্ণ রাষ্ট্রকে নোবেল দেয়ার মত কাউকে পাওয়া যায় না কেন??? এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেন ধর্ষিতার ক্ষতবিক্ষত যোনিতে নোবেলের প্রলেপ লাগাতে হয়??? পছন্দ নয় আমার।
আপনারা চা-এর কাপে সুনামি তুলুন। আমি এবারে শ্রোতা। (প্রসঙ্গতঃ এটা সত্যি ঘটনা। একজন ধর্ষিতা, যাকে নোবেল দেয়া হয়েছিল আগের বছর।)
এমনি ভাবনার মাঝেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন তিন মূর্তি। এসেই পাশের বেঞ্চে জায়গা দখল।
রোগীর বাড়ির লোক? মনে হচ্ছে না তো!!
এরা আসলেই রোগীর বাড়ির লোক কিনা, সে বিষয়ে ফেলু মিত্তিরকে একটু স্মরণ করলাম মনে মনে।
লালমোহনবাবু দৈববাণী করলেন: হাইলি সাসপিশাস!!
মিত্তিরবাবু বললেন: গিভ দেম ফাইভ মিনিট। নিজেরাই পরিচয় দেবেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে মোবাইলের স্ক্রিনে টাচ মেরে সোজা থ্যান্কু বলে দিলাম। জবাব এলো স্মাইলি তে। তার অর্থ হলো, সবকিছুতেই মিত্তির বাবুর শরণ কেন রে বাবা!! একটু সময় দিন, নিজের পরিচয় মানুষ নিজেই দেয়। বাঙালির স্বভাব কৌতূহলী মনের পরিচয়তো ফেলুদা নিজেই।
ভাবলাম, আমিই বা বাদ যাই কেন? মনে মনে বলি- গোয়েন্দা গিরি তো ভাগ্যে জোটেনি। অগত্যা চা এর দোকান!
আমার চোখের বদলে কান চকচক করছে। ঠিক বলবে। স্থির বিশ্বাস, এই তিন মূর্তি কিছু না কিছু বলবেই!! মোবাইলে চোখ রেখে কান খাড়া করে আছি !!
চা অর্ডার দিয়ে শুরু হল।
– শোন, মেডিকেল হাসপাতালে এই হয়!!
(কি হয়? কি হয়? আরে ভাই পুরোটা বল। বুঝলাম, কোনো কথার সুতো এরা হাসপাতালের ভেতর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে এসেছে! এবার চা এর মাঞ্জা দিয়ে পেঁচিয়ে বুদ্ধির লাটাইয়ে জমা করবে!)
-কি আর বলবো বল!! হলো পেটে ব্যাথা!! করাচ্ছে ই সি জি!! সব বড় বড় ডাক্তার !!
-নিতাই ডাক্তারই বলেছিল, একগাদা পরীক্ষা করাবে। টাকার শ্রাদ্ধ। বক্তা দ্বিতীয় জন।
তৃতীয়জন সুযোগ পেল।- আরে আমিতো বিমলের বউকে বলেছিলাম, দেখার লোক নাই, মেডিকেলে গিয়ে দেখবে কে?
ফেলু মিত্তিরের গলা খাকারি শুনলাম।
আমি একলা মাথা নাড়ি।
হুম… ঠিক!! না, রোগীর বাড়ির লোক নয়!!
লালমোহনবাবু দৈববাণী করলেন ফের: সাকসেস ইজ মাইন!
বুঝলাম, আমার মাথায় একটা মাইন পোঁতা হল। কখন ফাটবে কে জানে!!
একপ্রস্থ না শুনে ওঠা যাবে না। দেখি কে পা দেয় মাইনের উপর!!
-কাল রাতে একগাদা ওষুধ দিয়েছে। আজ আবার ওষুধ কিনতে হবে। প্রথম জন একটু নরম গলা।
-আরে, মেডিকেল হাসপাতালে এটাই করে। একবারে হাই ডোজ দিয়ে দেয়। কখনো দেখেছিস নিতাই ডাক্তার দিনে তিনবার ইনজেকশন দেয় ব্যথার জন্য?!!
-আরে নিতাই ডাক্তারই ঠিক। অল্প অল্প ডোজ দেয়। শরীরে মানায়।
আমার শরীরে এখানে-সেখানে হালকা অস্বস্তি লাগে। কি যেন ফুটছে!! সূচ ঢুকছে? ছারপোকা?
ঠোঁট ফাঁক করে ভাবছি বলবো- নিতাই ডাক্তারের শ্রী-রুপ খান একটু দেখাবেন?? এমন সময় পুরো মাড়িয়ে দিল তৃতীয় জন।
– বেশি ওষুধ না লিখলে কমিশন বেশি হয় না বুঝলি!! কোম্পানির দালালগুলো সারাদিন ঘুরে বেড়ায় দেখিসনি!!
এতো জোরে আর এতো তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় জন শুরু করলো যে আমার এন্ট্রি মারা হল না।
-সব রক্তচোষা জোক রে। ওষুধের খাবে, টেস্টের খাবে, আর বলবে হাসপাতালে কিছু নেই!!
কিন্তু আজ আমার এন্ট্রি মারতেই হবে।
এতো কিছু কানের সামনে বলে যাচ্ছে, আর আমি এই হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে চুপ করে শুনে যাবো?!!
হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে আমি তো মর্নিং ওয়াকের ড্রেসে আছি। তাহলে তো এন্ট্রি মেরে এদের ঘন্টি বাজাতে সমস্যা নেই।
আজে বাজে বকে যাচ্ছে। একটা কথার সাথেও মেডিকেল সায়েন্সের তো দূর , ফিকশনের গল্পেরও মিল নেই। ভাবলাম ফের একবার ফেলু মিত্তিরকে জিজ্ঞেস করি: এনাদের প্রফেশনটা যদি একটু বলতেন সুবিধা হত।
দেখলাম, উনি আর লালমোহনবাবু মিলে কেসটা কালচার করছেন!!
যা বাবা!! এমন তো কথা ছিল না!! অবশ্য ফেলু মিত্তির এমনি করেই থাকেন। চুপ করে কেস স্টাডি করে চলেন। তারপর একদিন ঠিক সময়ে রহস্য উদঘাটন!!
তো কেতিত্ব হাতছাড়া হবার ভয়ে জলদি এন্টি মারি ঘুরপথে। না, নিজে ডাক্তার, কথাটি মুখেও আনবো না।
-দাদা যা বলেছেন। হাসপাতালে আসাই উচিত না একদম …
চার নম্বর পাশে পেয়ে দেখলাম উৎসাহ চার চারে ষোলগুণ বেড়ে গেছে।
বললাম: কিসের রোগী দাদা?? ( মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এক মিনিট লাগবে তোমার রোগীর অবস্থা জানতে!! ফোনে একটা মাত্র নাম্বার ডায়াল করতে যা সময়!! কিন্তু না। আমি এখন ডাক্তার নই!!)
-অ্যাকসিডেন্ট দাদা। ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে দিয়ে কাল থেকে আজ সকালে একটু ব্যথা কমেছে। তো হাড়ের ডাক্তার বলেছে ক্যান করাতে।
(ক্যানটা পেপসিরও না , বিয়ারেরও না, বহুবার শোনা টার্ম, আসল রুপ স্ক্যান!! এটা শুনে খারাপ লাগে না, কারণ সাধারণ মানুষ জানে না)
আমি বলি: তা ক্যান করাতে অসুবিধা কি??
ও তো শুনেছি ফ্রিতে হয় (নিজে সারাদিন রাত ক্যান করি, রিপোর্ট করি, আর এ আমাকে ক্যান বোঝাচ্ছে!!)।
তৃতীয় জন- আরে দাদা, ফ্রি তে হয় ঠিকই। ডাক্তার সরকারের থেকে টাকা পায় বেশি ক্যান করানোর জন্য।
-অ হ তাই নাকি?? এতো পুরো ক্যান কেলেংকারি!!
কপালে ভাঁজ আর হাসি একসাথে।
-যা বলেছেন। (সাপোর্ট পাওয়া সুখের হাসি!)
মনে মনে বলি: দাদা, নেপোয় মারে দই , এর মাঝে বদ্যি পেলে কই?
তো আমার আর এক কাপ চা আসে। তিন মূর্তিও তিন কাপ অর্ডার দেয়।
-আপনার রোগী কোন ওয়ার্ডে দাদা?
চোখ বন্ধ করে দেখলাম লালমোহনবাবুর দাঁত দেখা যাচ্ছে। মিত্তিরের কপালে ভাঁজ। ঠোঁট বাঁকিয়ে মনে মনে বলি: অতো সহজ নয় গো মিত্তির। বাঙালি আমিও। এতো সহজে ধরা পড়বো না।
-ভাঙা ওয়ার্ডে।
-মানে আমাদের রোগীর ওয়ার্ডে?
ভাবি। কি ব্যাপার এতো উৎসাহ কেন?
বললাম: আপনাদের কোন ওয়ার্ডে?
-ওই যে লালবাড়ির দোতলায়।
বুঝতে পেরেছি। আসলে ওটা আমার ডিপার্টমেন্টের উপরের তলায়!!
-ও না, আমার এদিকে ভাঙা ওয়ার্ডে। বলেই একটু চোখ মারলাম লালমোহন বাবুকে!!
-তা দাদা, আপনাদের রোগীর ওষুধের ডোজ কেমন দিচ্ছে?? আমার তো হাই ডোজ ছাড়া …. ( কথা খুঁচিয়ে তুলি!)
-সেটাই তো বলছিলাম দাদা। একে তো ব্যাথার ওষুধ। পাঁচশো হাজার ডোজ। তার উপর দু’হাজার স্যালাইন চালানো হয়ে গেছে!
ফেলু মিত্তির মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন। বাপের জন্মে দু’হাজার স্যালাইন দেয়া শোনেননি তো!!
লালমোহনবাবু, প্রায় রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ফেলুদা বললো: সাইলেন্টলি স্টাডি করুন।
(এই স্যালাইন নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা বিশাল ভুল ধারণা আছে, দু’হাজার স্যালাইন শুনলে যেমন বিশাল কিছু মনে হয়, আসলে তা নয়! চারটে স্যালাইনের বোতল শেষ হলেই দু’হাজার হয়!! দু’হাজার মিলি। এগুলো কোয়াকদের অবদান। মানুষকে বলা, দু’হাজার স্যালাইন দিলাম!! আসলে মানুষের দৈনিক প্রয়োজনের তুলনায় এই পরিমাণ ফ্লুইড খুব বেশি নয়।)
চা-এর দোকানের মাসি আমাকে চেনে। রেগুলার সকালের খদ্দের। একবার কি যেন বলতে যাচ্ছিল, দেখে বুঝতে পেরেই বললাম – তুমি কথা না বলে আমাকে আর এক কাপ চা দাও তো!!
মাসি মজা পায়। হেসে চুপ করে যায়।
বললাম: আচ্ছা, আপনাদের নিতাই ডাক্তার কি পাশ বলুন তো? শুনে মনে হল, ওনার চিকিৎসাই একদম ঠিক।
প্রথমজন: এম বি বি এস, এ এম, আর এম পি।
ফেলুদাকে কেউ মাথার চুল ছিঁড়তে দেখেছেন?? আমি এই মাত্র দেখলাম। ডিগ্রী বুঝতে না পারলে তো বাঙালির এক নাম্বার গোয়েন্দার মুকুট গেল বলে!
আমি মুচকি হাসি। মিত্তিরবাবু, ওসব বোঝা আপনার কম্মো না। আমি কিন্তু জানি ।
লালমোহনবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের টাকে হাত বোলান।
কিন্তু এদিকে আমার নাকে চা ঢোকার উপক্রম হলো। কাপটা রেখে বলি: তা উনি কি মেডিসিনে না হাড়ে … কোনটায়??
-সব করেন দাদা। এখানেই যত ঢং। নিতাই ডাক্তারের অল্প ডোজের মেডিসিনের যা কাজ, এই পাঁচশো হাজারে ও হবে না !!
তৃতীয় জন: তার উপর পরীক্ষার কথা বল!! আজ অব্দি কাউকে ক্যান করাতে বলেনি !! এক আধটু রক্ত পরীক্ষা, বাস!!
বাসই বটে। পেন্নাম নিতাই ডাক্তার। তোমাকে সামনে পেলে ….
লালমোহনবাবু বললেন,ডাঃ মজুমদার, ক্যান ছাড়া যদি চিকিৎসা হতে পারে, দেন হোয়াই ইউ …
শেষ না হতেই ফেলুদা: লালমোহনবাবু, আপনি কি জানেন, হোয়াট ইজ ক্যান??
লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম: ইটস স্ক্যান।স্ক্যান ইয়োর ব্রেন ওয়ানস, প্লিজ।
আমার সকালের চা-এর দোকানে কাটানো সময় শেষ প্রায়। ঘরে ফিরে হাসপাতালে আসবো।
কিন্তু এদের পেশা যে জানা হলো না !
ডিরেক্ট কোশ্চেন না করে উপায় নেই।
আপনারা কে কি কাজ করেন??
যিনি নিতাই ডাক্তারের ডিগ্রী বলেছিলেন, তিনি স্কুল মাস্টার। বাকি দুজনের মধ্যে একজন ব্যবসা করেন। আর একজন পড়াশোনা করে (চাকরি পান নি মনে হয়) টিউশন পড়ান!
-আসলে কি জানেন দাদা, এই নিতাই ডাক্তাররাই ভালো। এবার রোগী অশিক্ষিত পাশের বাড়ির লোক। বারবার বলছে, মেডিকেল হাসপাতালে যাবো। আমরা পাড়াপড়শি, একটু আধটু পড়াশোনা করেছি, সব জেনে বুঝেও আর কি বলতে পারি , নিয়ে এলাম!! না হলে এ তো রক্ত চোষার জায়গা।
ফেলুদাকে থাম্বস আপ দেখালাম। ভাবলাম, চলে যাবেন। কিন্তু না!! আমার সাকসেস দেখবেন বলে বসে আছেন!!
আর তো সহ্য করা যায় না।
-আপনাদের নিতাই ডাক্তারের পুরো নাম ঠিকানা আছে??
-কেন দাদা, দেখাতে যাবেন নাকি? ব্যাপক ডাক্তার! যেতে পারেন !
-পুলিশে দেব!!! আর সেই সাথে আপনাদের তিনজনকেও।
-মানে?? প্রথমজন। চমক সপ্তমে তখন।
-কি হলো??!! বাকি দু’জন একসাথে।
-শুনুন, আপনাদের নিতাই ডাক্তারের ডিগ্রীর দাম বাইশ হাজার। চাইলে যে কেউ হতে পারে!! এই আপনাদের যে কেউ!! খবর রাখেন কিছু?? পুলিশ খবর পেলে এই এখুনি তুলে নিয়ে আসবে। আপনারা একজন স্কুলমাস্টার, একজন টিউটর!!
শিক্ষাটাকে কোথায় নামিয়ে এনেছেন আপনারা জানেন?? আপনার নিতাই ডাক্তার জানেও না কোন ওষুধের কি ডোজ!! অল্প দেয় এইজন্য যাতে কারো সমস্যা না হয় তাই!! নির্বোধের ভাবনা ।
অনেক অসুখ এমনি ভালো হয় ,আর আপনারা ভাবেন ওই ডাক্তারই ভালো!
ধরা পড়ে গেলাম ভেবে লালমোহনবাবু প্রায় দাঁত বের করবেন, বললাম: ওয়েট।
আচ্ছা, আপনাদের কেউ জিজ্ঞেস করেছেন এম বি বি এস এ এম কি জিনিস?? কোন কলেজে পড়েছে??
সব চুপচাপ। আমি আজ আর শ্রোতা নই। আজ আমি নিয়ম ভাঙ্গার জন্য দুঃখিত।
হাসপাতালে এসে যা তা বকে যাচ্ছেন , আর ভাবছেন গ্যারামের বিশাল বুদ্ধিজীবী!!
জানেন, এখানে আসতে গেলে কি করতে হয়?
আপনার নিতাই ডাক্তার ক্যানের মানে বোঝে যে করতে দেবে?? কোথায় ক্যান করে ডাক্তাররা বেশি টাকা পায়?? প্রমাণ আছে?? বেতন ছাড়া সরকার ডাক্তারকে কি দেয়, জানেন?? শুধু এই আপনাদের মত লোকদের জন্য আজ ডাক্তাররা খারাপ হয়ে গেলো! সামান্য নলেজ নেই, হাওয়ায় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে গ্যাস ছাড়ছেন। ক্যানে ভরুন ওসব।
ফেলুদা খুশি। লালমোহনবাবু থ!!
দাঁড়ান একটু। এখনো বলিনি।
তিন মূর্তি উশখুশ করছে।
বললাম: শুনুন, চাইলে এইসব ভুলভাল খবর ছড়ানোর জন্য আপনাদের বিরুদ্ধে কেস ঠুকতে পারি। কারণ, এগুলো পাবলিকের জন্য ক্ষতিকর। সরকারি কর্মচারী ডাক্তারদের অপমান। অতএব সাবধান থাকবেন।
-আপনি কি করেন দাদা? স্কুল মাস্টার।
নরম গলা। বুঝলাম , হাই ডোজ পড়েছে।
আমি বলার আগেই চা-এর দোকানের মাসি বলে দিল-শোনো বাপু, হাসপাতালে এসে ডাক্তারদের সাথে লাগতে যেও না। ওরা যা করে ভালোর জন্যই করে। দিন রাত খাটে।
কিছু বলার আগেই আমি ঘরে যাবার জন্য পা বাড়াই। ফেলুদাকে ফের থাম্বস আপ দেখালাম।
লালমোহনবাবু দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে। টাকটা বেড়ে গেছে।
ফেলুদা বললো: লালমোহনবাবু, আপনার এই নিতাই ডাক্তারকে কেমন মনে হল?
লালমোহনবাবুঃ হাইলি সাসপিশাস !!
ফেলুদা বললো : সাচ্ পিশাচ।
দারুন লাগলো
জানি প্রচুর যুক্তি দিয়ে দেবেন (আপনারা আবার তিনজন)। কিন্তু যখন দেখি,বিদেশে বেড়াবার লোভে একই কোম্পানির ওষুধ বা টেষ্টরিপোর্ট করা থাকলেও আবার তাঁর নির্দেশিত জায়গায় প্রচুর টাকা খরচ করে প্রায় একই টেষ্ট রিপোর্ট করানো, তখনই কি রকম ঘেঁটে ঘ হয়ে যাই।
যদিও সবাই নয়, কিন্তু জানবেন, ক্ষীর অতি উত্তম খাদ্য যেমন, তেমনি ওটা পচে গেলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।