বাজারে এখন বড় প্রশ্ন আমাদের বাপ কে! হিপোক্রিটাস না চরক! প্রশ্নটা যদিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমার জানা নেই। বাড়ির দেওয়ালের রঙ নীল-সাদা না লাল সেটা রোগীর চিকিৎসায় খুব একটা পার্থক্য ঘটায় না, পরিকাঠামোটা কীরকম সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও গত কয়েক বছরে ‘পরিকাঠামো’ নিয়ে আলাপ আলোচনা এদেশে হয়না, তাই সেই প্রশ্ন আর নতুন করে নাই বা করলাম। সরকার যে প্রশ্নের আলোচনা চাইছে সেটাই না হয় হোক।
সরকার পক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী চরক মহাশয়ই ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার জনক এবং তাঁর নামে শপথ নিয়েই আমাদের চিকিৎসক জীবনের যাত্রা শুরু করা উচিত। আমি যদিও দু’জনকেই বিশেষ চিনি না, আমার ডাক্তারিতে দু’জনেরই প্রভাব কতটুকু, সেটা অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা পড়বে না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, বিজ্ঞানের কোনো সীমানা হয় না। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সর্বনাশই ডেকে আনে। পারমাণবিক শক্তি নিয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক মারণলীলা যেমন দেখিয়েছে, সেরকমই হালে কোভিড ভ্যাকসিনের অসমবণ্টনের ফলও ভালো হয়নি। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও দেশের সীমারেখা মেনে চলাটা অস্বাভাবিক। এসব ধ্যানধারণা কোনো সুস্থ মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত হতে পারে না।
ঐতিহাসিক হিসেব অনুযায়ী হিপোক্রিটাস চরকের তুলনায় প্রাচীনতর। হিপোক্রিটাস চিকিৎসাক্ষেত্রের প্রথম ব্যক্তিত্ব, যিনি রোগের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির সন্ধান করেছিলেন, তাই তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলে বন্দিত। তবে সেই বিজ্ঞানের ধারাতেই ওনার সমস্ত ধ্যানধারণাই আজ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য দেশে বিজ্ঞানের ধারার এটাই বৈশিষ্ট্য- সতত বিবর্তনশীল।
ল্যামার্ক, ডারউইন, ডালটন, নিউটন- এ^দের সবার মতবাদেরই কিছু ভুল-ত্রুটি পাওয়া গেছে, সংশোধন হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে চরকের ‘বায়ু-পিত্ত-কফ’ কতটা এগিয়েছে সেটা আয়ুর্বেদাচার্যরাই বলতে পারবেন। তবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘গুরুবাক্য শেষ কথা’ ধরণের যে ধারা রয়েছে, সেটাই আধুনিকতার পরিপন্থী বলে আমার মনে হয়। ‘চরক শপথে’ও এই দ্যোতনা রয়েছে। বিজ্ঞান স্রোতহীন নদীতে পর্যবসিত হলে তাতে শৈবালদামই জন্মায়, সমাজের উপকার বিশেষ হয় বলে জানা নেই।
চরক-সুশ্রুত ভারতের গর্ব। তাঁরা খ্রীষ্টপূর্ব পৃথিবীতে চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন ধারা আনতে চেয়েছিলেন, নিজেদের মত চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা বিশ্ববন্দিতও বটে- কিন্তু তাঁদের চিকিৎসার ধারা মাঝখানে পথ হারিয়েছে, সে যে কারণেই হোক। আজকের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য প্রভাবই অধিক লক্ষ্যণীয়- তার কারণ একটাই, সময়োচিত বিবর্তন। কিছুদিন আগে একটা তথ্য জেনে বেশ হতবাক হলাম, হৃদযন্ত্রের ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া যে হার্ট অ্যাটাকের কারণ সেটা আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার জনক উইলিয়াম অসলার-ও জানতেন না, এই ধারণা এসেছে সদ্য এই ১৯৫০ সালে, ভারতের স্বাধীনতারও পরে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় এই ৭০ বছরে যা উন্নয়ন হয়েছে, সমগ্র ভারতবর্ষে হয়তো তা হয়নি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। এখনো যে কোনো রোগের চিকিৎসায় আমেরিকা/ ইউরোপের গাইডলাইনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় আমাদের, নিজস্ব দিকনির্দেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের আগ্রহের বড় অভাব। ভারতবর্ষ যে কোনো রোগের ক্ষেত্রেই রাজধানী বলা যায়, রোগ সম্পর্কিত এত্তো তথ্য দেশের কোণায় কোণায় উড়ে বেড়াচ্ছে- সেসব তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাধারা গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন, আমরা এখন সেসব ছেড়ে শপথের কচকচানিতে মন দিয়েছি।
সবার জন্য স্বাস্থ্য দূর অস্ত, এদেশে টাকাপয়সা দিয়েও লোকজন সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। হয় কোয়াকের হাতে পড়ছে, নয় কোনো দালালের খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, নয় কর্পোরেটের থাবায় নিঃস্ব হচ্ছে। সামান্য উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা- তাতেও বিশ্বজুড়ে অর্ধেক লোক জানেন না তাঁদের এই রোগ আছে, যাঁরা জানেন তাঁদেরও অর্ধেক চিকিৎসা পান, যাঁরা চিকিৎসা পান তাঁদেরও অর্ধেক মানুষের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্যান্য জটিল রোগের উপাখ্যান তো ছেড়েই দিলাম।
যাঁর নামে শপথ নিলে এই দুরবস্থার সামান্য হলেও উন্নতি হবে, যাঁর নামে শপথ নিলে সরকার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে সামান্য হলেও ভাববেন, আমি তাঁর নামেই শপথ নিতে রাজি ??