আপনারা যারা নতুন নতুন রান্নাবান্না শিখে রাঁধছেন তাদের অবশ্যপাঠ্য আজকের জার্নাল।
আপ্তবাক্যটি দয়া করে সবাই মনে রাখবেন… অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর…
বহুকালের চালু আপ্তবাক্য আজ খেয়াল পড়ে গেল। কেন? কী ভাবে? হাসপাতালের জার্নালের মত ব্যাপারে এই সব ঘরোয়া কথা উঠছে কেন?
আচ্ছা, উঠবে নাই বা কেন? হাসপাতালে কি শুধুই অসুখ রোগী আর চিকিৎসা কর্মী? বড় জোর রোগীর বাড়ির লোকজন?
আজ্ঞে না, হাসপাতাল মানে আমাদের মলিন ঘরকন্নারও গল্প, হাসপাতালে যুক্ত বেচারাদের জীবনযাপন… সব কিছুরই গল্প।
পুরোটা বলি একটু বিস্তারেই।
গল্পটা মনে পড়ল আজ নিজে হাতে তড়কা রান্না করার পরে। কখনও কখনও আমাকে সোদপুর যেতে হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘোলার একজায়গা থেকে তড়কা কিনে আনি মাঝে মাঝে। সেই তড়কা সেখানে রান্না হয় চোখের সামনে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি। কখনও রেসিপির সূক্ষ্ম ভাঁজগুলো জিজ্ঞেস করে জেনে নিই। এইভাবে একদিন মনে হল ‘পাখিটার শিক্ষা সম্পূর্ণ হইয়াছে’। সেই কনফিডেন্সের পরিণতিতে আজকে আমি নিজের বাড়িতে এক দুঃসাহসিক তড়কা অভিযান করেছিলাম। তার প্রেক্ষাপটেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
চাকরি জীবনের শুরুতে আমার গিন্নি বাংলাদেশ সীমান্তের দূর গ্রামীণ পোস্টিংয়ের সেই কোয়ার্টারে আমার সঙ্গেই ছিলেন।
আপনারা জানেন তিনি আমার সহপাঠিনী। আমার চাকরি সবে শুরু হয়েছে। আর কিছুকাল বাদে তাঁরও চাকরি জীবন শুরু হবে। সে অন্য প্রসঙ্গ।
সুনন্দা সেই প্রাক্-এমবিবিএস জীবন থেকেই রন্ধন পটিয়সী। আমরা অনেকেই যেমন শোয়ার আগে বেড ল্যাম্পটি জ্বেলে কোনও একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি, তিনিও তাই করতেন। তাঁর সংগ্রহের সেই বইগুলো সবই রান্নার বই। এই বিষয়ে নানান বইয়ের বিশাল সংগ্রহ তাঁর। প্রজ্ঞাসুন্দরী, লীলা মজুমদার, বেলা দে ছাড়িয়ে আধুনিক কালের সিদ্দিকা কবীর… আরও কত কত জানা অজানা নামের দেশি বিদেশি রান্নার বিবরণ সমেত দুই বাংলার বই সেগুলো। কাকদ্বীপ থেকে কামাসকাটকা, পাঁচ মহাদেশের আমিষ নিরামিষ চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়র বিবরণ।
তাঁর সেই নেশার কারণে বাড়িতে রান্নার লোক রাখার অভ্যেসই তৈরি হয়নি আমাদের। নিজে হাতে রাঁধতেন তিনি। এই সেদিন অবধিও রান্না ছিল তাঁর প্যাশন।
পাস্ট স্টেন্স মানে ছিল শব্দটা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। অন্য রকম সন্দেহ করবেন না পাঠক।
তিনি আছেন। হ্যাঁ, দিব্য আছেন। কিন্তু পোস্ট কোভিড ডিপ্রেশন না কী যেন ছাতার মাথা অজুহাতে তিনি অধুনা রান্নাঘর থেকে বিযুক্ত। রান্না একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন। শুধোলে বলেন,
– অনেক করেছি, এতদিন। আমি সব রান্না ভুলে গিয়েছি।
কাউকে একটা হাল তো ধরতেই হবে। নইলে প্রায় ডুবন্ত এই নৌকো ফেঁসে যাবে। এই পরিস্থিতিতে ডিপ্রেসড হবার অধিকারই নেই আমার!
আমার ঘুম ভাঙে আজ কী ব্রেকফাস্ট দেব এই চিন্তা মাথায় নিয়ে।
এহ বাহ্য, কাহিনিতে ঢুকি। যে সময়ের কথা বলছি সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে আমি মোটেই রাঁধতে জানতাম না। আসলে অজুহাত ছিল সেটা। সিম্পল ভাতে ভাত আলুসেদ্ধ করাও দুরূহ বলে প্রচার করতাম। আমাকে বিয়ে হওয়ার আগে থেকে লালন করা সুনন্দা নামের মেয়েটা যখন ছেলেপুলে হবার বাহানায় আমার কর্মস্থলের কোয়ার্টার থেকে আমার মা-বাবার হেডকোয়ার্টারে ফিরলেন, তখন আমার খাওয়াদাওয়া লাটে ওঠার জোগাড়। নিদেন পক্ষে ওই আলুসেদ্ধ ভাতের জোগাড় তো করতে হয়।
বাড়িতে অন্যান্য ঠিকে কাজ করত উঠতি যুবক লাল্টু। তাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে ওই ভাতে ভাত ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ রান্নার কাজে লাগিয়ে দিলেন গিন্নিমা। ট্রেনে ওঠার সময়ে বারবার শুধোলেন, – তোর হাতে ডাক্তার বাবুকে রেখে যাচ্ছি লাল্টু। পারবি তো? ও কিন্তু আজ অবধি হাত পুড়িয়ে খায়নি কখনও।
লাল্টু ঘাড় কাত করে দায়িত্ব নিল।
কিছুদিন পরে সামান্য নোটিশেই কলকাতা যেতে হল। মহাপুরুষের আবির্ভাব লগ্ন আগত প্রায়।
সুনন্দা ভর্তি হয়েছে ইতিহাস প্রাচীন মেডিকেল কলেজের ইডেনে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে ‘ওই মহামানব আসে…’ গান। কিন্তু সে অন্য গল্প। পরে কখনও হবে এখন।
আপাতত আমার কোয়ার্টারের কাহিনিতে ফিরি।
এবারে কলকাতা যাবার আগে লাল্টুকে ছুটি দিয়ে গেলাম। – ‘আমি ফিরলে পরে খবর দেব, আসিস!’
তা ফিরেও এলাম সিজারের সেলাই কাটা সুনন্দা ইডেন থেকে নবজাতককে নিয়ে আমার মা-বাবার কাছে ফেরার পরে। আবারও বেশ ক’দিন লাল্টুর রাঁধা অমৃতভক্ষণ করতে হবে। তাকে খবর পাঠিয়েছি আসার জন্য।
সে আগামীকাল আসবে। আজ স্টেশনবাজারের মা দুর্গা হোটেল থেকে আনা রুটি তড়কা খাবো। কিনে এনে খেলামও। সেই তড়কা, কী বলব মশাইয়েরা, অমৃত নয় কিন্তু তার চেয়ে কমও নয়। এমনই তার স্বাদ।
পরের দিন লাল্টু হাজির। আমি মানসিক ভাবে ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ ভাত খাবার জন্য তৈরি। হ্যাঁ, দুবেলাই।
শ্রীমান কিন্তু বিকেল বেলায় তার ভিন্ন রকমের রন্ধন ইচ্ছা জ্ঞাপন করল। – কাকু, আজ এবেলা তড়কা রাঁধি?
– বলিস কীরে ব্যাটা, তুই তো আলুডিমসেদ্ধই ঠিক ভাবে রাঁধতে পারিস না। তড়কার মত জটিল জিনিসে পুরো ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবি তো!
লজ্জা লজ্জা অভিমানাহত চোখে তাকাল কৈশোর ছাড়ানো সদ্য যুবক লাল্টু। – কাকু, আমি কি রাঁধতে না শিখেই রাঁধব বলিচি? এই ছুটির দশদিন আমি বাড়ি যাইনিকো মোটেই। স্টেশনবাজারের মা দুর্গা হোটেলে কাজ শিখতে ঢুকেছিনু। ওখানেই তড়কা বানাতে শিকে নিইচি আজ্ঞে!
শুনে কৌতূহল হল। বটে… বটে… তবে তো একে একটা চান্স দিতেই হয়! সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়তেই আমার রাঁধুনির চোখ চকচক করে উঠল। – জানতাম আপনি রাজি হবেনই। আমি তাই তড়কার ডাল জলে ভিজিয়ে দিইচি সেই কখন!
খেতে বসে সেই অমৃত স্বাদ কিন্তু পেলাম না। এমনিতে নুন মিষ্টি ঝাল মশলা সবই ঠিক। কিন্তু দোকান থেকে কিনে আনা সেই গতরাত্রের মত নয়। কী যেন একটা মিসিং।
লাল্টু বারবার জিজ্ঞেস করছিল রান্না কেমন হয়েছে জানতে। আহা, নবীন উদ্যোগী। ওর মন ভাঙতে ইচ্ছে করছিল না। তবু ব্যাটা ছাড়তে চায় না বলে শেষে বলতেই হল। তেমন জুতের যে হয়নি সেই ব্যাপারটা।
প্রতিক্রিয়া শুনে অবধি ও বিড়বিড় করছিল। – যে যে ভাবে ওঁয়ারা রাঁধত সবই তো পরপর কল্লাম! ভেজা ডাল নুন হলুদ দিয়ে প্রেশারে পনেরো মিনিট। তারপরে ধরুন গে করাইয়ে সরষের তেলে পেঁয়াজ আদাবাটা টমাটোর দিয়ে কড়া করে সাঁতলে তাপ্পরে সেদ্দ ডালটা দিয়ে তড়কা মশলা দিয়ে ফের কিছুক্ষণ। সবই ঠিকঠাক। তবে কেন জমল না কাকু?
প্রশ্নটা আমাকে করল না নিজেকে করল ঠিক বোঝা গেল না।
মিনিট কয়েক বাদে চোখে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল যেন তার। – ও, বুঝেছি। মনে পড়েচে! ওই সুরুয়াটা দেওয়া হয়নি।
– সুরুয়া? সেটা আবার কী রে।
– আজ্ঞে বলতে লজ্জা কচ্চে সেই ব্যাপারটা!
– আহা, লজ্জা কীসের বল না…
– বলি তবে, ওই সুরুয়াটা রান্নার ওস্তাদ তৈরি করত ইয়ে দিয়ে!
– ইয়েটা আবার কী?
– মানে, ওই দোকানে তো শুধু তড়কা না, ভাত মাংস সবই বিক্রি হয়। কাস্টমার তো মাংসের হাড় ছিবড়ে কিছু ফেলেই যায়। ওই দোকানে সে সব হাড় ছিবড়ে ফেলে না দিয়ে একটু বেছেবুছে খানিক তেলে সাঁতলে জল মশলা দিয়ে ফের খানিক প্রেশার দিয়ে একটা সুরুয়া বানায় ওস্তাদ। সেই সুরুয়ার দু হাতা তড়কা রান্নার শেষে দিয়ে দেয়। দিয়ে ফের কিছুক্ষণ ফুটোয়। আমি আপনার এই রান্নাঘরে ওঁয়াদের ওই সুরুয়া কোথায় পাব বলুন?
আমার তখন গতকালের তড়কার প্রায় অমৃতস্বাদ মনে করে বমি উঠে আসে আর কী!
আজকে আমার তৈরি তড়কা খাইয়ে গিন্নি আর ছোটোপুত্রকে অভিভূত করবার বাসনায় যখন প্রশ্ন করলাম স্বাদ কেমন, তারা দুজনেই অতৃপ্তির মাথা নাড়া দিয়ে জানাল স্বাদের ঘাটতির ব্যাপারটা।
আমার মনে পড়ল আমার তড়কার দোকানেও রান্নার শেষে একটা বড় সসপ্যান থেকে দুহাতা মাংসের ঝোল জাতীয় তৈলাক্ত কিছু দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়া হয় তড়কাটাকে।
আমার প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই সুরুয়ার কাহিনি মনে পড়ে গেল।
আমার কাস্টমারদের আমি আর সেই সব পুরোনো কথা বলে বিব্রত করলাম না।
সোজা কথা। সুরুয়া নেই। স্বাদও নেই।
খেলে খাও … না খেলে না খাও!