সিলেবাসের পরিবর্তন এবং UCL-এর স্বীকৃতি– ১৯৪৪-৪৫ থেকে ১৯৪৭-৪৮ – অংশ ৬
মেডিক্যাল কলেজের ১৮৪৪-৪৫ শিক্ষাবর্ষের আনুপূর্বিক রিপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে বলে নেওয়া দরকার এসময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হল কলেজের ৪ জন ছাত্রের – ভোলানাথ বোস, গোপালচন্দ্র শীল, দ্বারকানাথ বোস এবং সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীর – উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন যাত্রা। রিপোর্টে বলা হল – “One of the most important and gratifying occurrences of the past year, has been the munificent offer of Dwarkanath Tagore, to take to England and educate at his own expense, two pupils of the Medical College.” (GCPI 1844-45, পৃঃ ১১৮) আমাদের মনে পড়বে ১৮৩৯ সাল থেকেই কৃতী ছাত্রদের বাছাই করে ইংল্যান্ডে পাঠানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। ১৮৪৫-এ সফল হল।
দুজন ছাত্রের খরচ দ্বারকানাথ ঠাকুর বহন করেছিলেন। একজন ছাত্রের খরচ সরকার বহন করেছিল। ডঃ গুডিভ ৭,৫০০ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন চতুর্থ ছাত্রের জন্য এবং এদের লন্ডনে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে গুডিভের সংগ্রহের ৭,৫০০ টাকার মধ্যে ৪,০০০ টাকা দিয়েছিলেন বাংলার নবাব নাজিম। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৯) ৮ মার্চ, ১৮৪৫-এ কলকাতা থেকে স্টিমার বেন্টিঙ্কে চড়ে এঁরা যাত্রা করলেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
এদের মধ্যে ভোলানাথ বোসের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার। লর্ড অকল্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত ব্যারাকপুর স্কুলে তিনি পড়াশুনো করেছিলেন। তার মেধার জন্য অকল্যান্ড স্বয়ং তাকে ১৮৪০ সালে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসেন মাসিক ১০ টাকা বৃত্তিতে। ভারতে ফিরে আসার প্রাক-মুহূর্তে তিনি অকল্যান্ডের একটি মরমী চিঠি পান। ১৩ জানুয়ারি, ১৮৪৮-এ ভোলানাথকে অকল্যান্ড লিখেছিলেন –
“My dear Bholanath,
I will not allow you to leave England without writing a few lines to you to say that I wish you well. I would add too that you have given very great satisfaction to me and to your other friends, by the earnestness with which you have pursued your studies, and by distinctions which have attended your success in them.
I should like you to take away with you some token of remembrance from me, and I will beg you purchase one that may be agreeable to you with the enclosed draft.
Yours most truly, &c.,
Auckland”
অকল্যান্ডের উপহারের টাকায় ভোলানাথ একটি সোনার ঘড়ি কেনেন। তাঁর উইল অনুযায়ী এই ঘড়িটি পারিবারিক সম্পত্তি বলে রক্ষিত হয়েছিল। (রামগোপাল সান্যাল, Reminiscences and Anecdotes of Great Men of India, Both Official and Non-official for the Last One hundred Years, 1894, Part 1, পৃঃ ৭২-৭৪)
এই চারজন ছাত্র গিয়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন (UCL)-এ ভর্তি হন। মনে রাখা দরকার, এঁদের আগে “কালাপানি” পেরিয়ে ইংল্যান্ডে রামমোহন, দ্বারকানাথ এবং আরও কেউ গিয়েছেন। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কারণে। শিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রা এই প্রথম। মেল গরম্যান বলছেন – “The choice of this institution bears comment. Its medical school was widely regarded as the most progressive and innovative in Europe, and consequently attracted the highest calibre of students in England and from abroad. The faculty of the Calcutta Medical College were well aware of this high standing, and constantly sought to imitate its best features. It never occurred to them to choose one of the lesser schools of London or the province, so confident were they of their students that they selected deliberately the toughest competition.” (মেল গরম্যান, “Introduction of Western Science into Colonial India”, Proceedings of the American Philosophical Society, vol. 132, no. 3, Sep., 1988, পৃঃ ২৯০) অস্যার্থ, মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষ এই চারজন ছাত্রের মেধা, কৃতিত্ব এবং শিক্ষার জন্য পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে সেসময়ের ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, অগ্রগণ্য, উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন ও রক্ষণশীলতা মুক্ত UCL-এর বাইরে তুলনায় ন্যূন অন্য কোন ইউনিভার্সিটি বা কলেজের কথা চিন্তাতেই আনেননি। সবচেয়ে শক্ত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছিলেন ছাত্রদের জন্য।
ওখানে গিয়ে কি অর্জন করলেন এই ছাত্ররা? এজন্য ১৮৪৭-এর প্রথমার্ধে গুডিভ ইংল্যান্ড থেকে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন তার দিকে চোখ রাখতে হবে। ভোলানাথ বোস comparative anatomy-তে গোল্ড মেডেল এবং সার্জারি, প্র্যাক্টিস অফ মেডিসিন এবং ধাত্রীবিদায় সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। সূর্যকুমার চক্রবর্তী অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, মেটেরিয়া মেডিকা ও কেমিস্ট্রিতে এবং গোপালচন্দ্র শীল সার্জারি ও মেডিসিনে সার্টিফিকেট পান ওদেশের মেধাবী ছাত্রদের সাথে সমানে টক্কর দিয়ে খোদ UCL থেকে। (GRPI 1847-48, পৃঃ ৮১) Lord Brougham বার্ষিক পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে তিনজন ভারতীয় ছাত্র অর্জন করেছিলেন “nine honourable marks of distinction, independent of the Gold Medal by Bholanath Bose; an amount of honor highly creditable to their talents and industry”। (প্রাগুক্ত) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভোলানাথ বোটানিতেও গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন।
গুডিভ তাঁর ১৮৪৭-এ পাঠানো রিপোর্টে জানালেন, ভোলানাথ নভেম্বর মাসে এমবি ডিগ্রির ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁর ডাক্তারি পড়াশুনোর বাইরেও ল্যাটিন শেখার (UCL-এর ক্ষেত্রে আবশ্যিক) জন্য সমস্ত অধ্যাবসায় নিয়োজিত করেছেন, শুধু প্রয়োজনে ভাষা শিক্ষার জন্য নয় নিজের আভ্যন্তরীন তাগিদ ও আগ্রহ থেকেও। গোপালচন্দ্র ল্যাটিন শিক্ষার জন্য যেমন তেমনি হাসপাতাল ডিউটিতেও একইরকম পরিশ্রম করেছেন। UCL-এ হাউস সার্জন হবার প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন। প্রথম হয়েছিলেন ঐ কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ইংরেজ ছাত্র। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮২)
এমবি ডিগ্রির প্রথম পরীক্ষায় ভোলানাথ এবং সূর্যকুমার দুজনেই প্রথম বিভাগে পাস করেন। এরপরে ভোলানাথ এমডি ডিগ্রির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং সসম্মানে পাস করেছেন। সুর্যকুমার ৬ মাস সময়ের মধ্যে ফরাসী এবং জার্মান ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। গোপালচন্দ্র হাসপাতাল শিক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৩) আরও শ্লাঘার বিষয় হল “These young men are now members of the Royal College of Surgeons of England, both Bachelors, and one of them Doctor of Medicine of the London University, the highest professional degree which can be procured in Europe.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৩-৮৪)
মেল গরম্যান ভারতের ইতিহাসে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছাত্রদের বিরল কৃতিত্ত্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন করছেন এভাবে – (১) এ ঘটনা দেখালো “in a dramatic and conclusive manner that Indians could master science and medicine on a level with Europeans.” (২) এই ছাত্ররা UCL থেকে ডিগ্রি এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন্স থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করে দেশে ফিরে আসার পরে আধুনিক বিজ্ঞানে জীবন্ত রূপকল্প হিসেবে এঁরা গণ্য হয়েছেন এবং ভবিষ্যতের ছাত্রদের কাছে “রোল মডেল” হয়ে উঠেছে, এবং (৩) “their example set the stage for a veritable flood of Indian students to England for study in all fields, a movement which continues to this day”। (গরম্যান, “Introduction of Western Science into Colonial India”, পৃঃ ২৯০)
একটি উদাহরণ এক্ষেত্রে দেওয়া যায়। এঁদের দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরে ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে ৭০০-র বেশি ছাত্র জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়ন করার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়েছিল। (Bruce Tiebout McCully, English Education and the Origins of Indian Nationalism, 1966, পৃঃ ২১৫)
বার্ষিক রিপোর্ট ১৮৪৪-৪৫
GCPI 1844-45-এর রিপোর্টে আমরা একাধিক ভারতীয়ের নাম পাচ্ছি শিক্ষকের তালিকায়। মধুসূদন গুপ্ত – নেটিভ ডেমন্সট্রেটর অফ অ্যানাটমি, মিলিটারি ক্লাসে সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন শিবচন্দ্র কর্মকার – মেডিসিন এবং মেটেরিয়া মেডিকার শিক্ষক, রেসিডেন্ট সার্জন প্রসন্নকুমার মিত্র – Female and Lying-in hospital, রেসিডেন্ট ছাত্র দয়াল চন্দ্র বসাক – Female and Lying-in hospital। (GCPI 1844-45, পৃঃ ৯৮)
মোট ছাত্র সংখ্যা ৯১ – স্টাইপেন্ডিয়ারি ছাত্র ৫০, রবার্টসন স্কলার ২, ফ্রি এবং সিংহলের ছাত্র ৩৪ ইউরোপীয় ছাত্র ৫। হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মণ – ১৯ জন, কায়স্থ – ২১ জন, বৈদ্য – ৮ জন, কৈবর্ত – ২ জন, তাঁতী – ২ জন, বেনিয়া – ৩ জন, শুঁড়ি – ১ জন, তেলি – ১ জন, এবং সদগোপ – ১ জন। আগে যে secularity এবং secular social hierarchy-র কথা আলোচনা করেছি তার সুস্পষ্ট অবয়ব পাওয়া যাচ্ছে ছাত্রদের সামাজিক অবস্থানের বিন্যাস থেকে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৮)
সিলেবাসের রিমডেলিং (পুনর্গঠন)
কাউন্সিল অফ এডুকেশন এবং সরকার উভয়ের তরফে একটি চিঠিতে বলা হয়েছিল – “The approaching departure of Professors Goodeve and Raleigh, has been deemed an eligible opportunity for remodelling the system of instruction pursued at the Medical College, so as to bring within the regulations of the Royal College of Surgeons of England, that institution may be duly registered and recognized, and those of its pupils who may hereafter visit Europe for the purpose of graduating or obtaining the diploma of surgeons, may be enabled to derive the benefit of the time passed here, being allowed to count in other schools and hospitals, as they are at present.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১) অর্থাৎ রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস-এর স্বীকৃতি পেলে এখানে যে সময় পড়ার জন্য ব্যয়িত হয়েছে সেটা ওখানেও গণ্য হবে। ফলে ইংল্যান্ডে গিয়ে আবার নতুন করে গোড়া থেকে শুরু করতে হবেনা। শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে সেসময়ের বিচারে এ ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেডিক্যাল কলেজের তথা ভারতের ছাত্ররা সরাসরি ওদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষার কেন্দ্রে প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়া প্রবেশ করতে পারছে। জ্ঞানের কেন্দ্রে স্বীকৃতি পাচ্ছে জ্ঞানের প্রান্ত।
আমরা এর আগে দেখেছি মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে উইলিয়াম ও’শনেসির মৌলিক গবেষণা কিভাবে উপনিবেশিক বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান হয়ে ওঠার যাত্রাপথ তৈরি করেছিল। এমা রবার্টসের পর্যবেক্ষণ থেকে জেনেছি এদেশে চিকিৎসা করার জ্ঞান কিভাবে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে ওদেশের পরিবেশে ব্যবহার করেছে। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীতেও উইলিয়াম সন্ডার্স বা চার্লস কার্টিসের মতো চিকিৎসকেরা ইংল্যান্ডের চিকিৎসার জ্ঞান দিয়ে যে এদেশের রোগ বোঝা সম্ভব নয় এ ধারণা একাধিক ক্ষেত্রে ব্যক্ত করেছেন। (দ্রষ্টব্যঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য, “Anatomical Knowledge and East-West Exchange” in Medical Encounters in British India, ed., Deepak Kumar and Raj Sekhar Basu, OUP, 2013, pp. 40-60)
যাহোক, মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাদানের মূল বিষয়, ডিসেক্টিং রুমস, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি গ্রেট ব্রিটেনের যেকোন প্রাদেশিক কিংবা ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড কিংবা আয়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির মেডিক্যাল স্কুলের তুল্য ছিল। কিন্তু প্রধান ঘাটতি ছিল কি কি সাবজেক্ট পড়ানো হবে এবং সঠিক কি পদ্ধতিতে পড়ানো হবে সেক্ষেত্রে। (GCPI 1844-45, পৃঃ ১০১)
ইউরোপের প্রথম সারির সমস্ত মেডিক্যাল স্কুলের/কলেজের নিয়ম ছিল কোন একজন শিক্ষক একাধিক সাবজেক্ট পড়াতে পারবেননা। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি, এবং মেটেরিয়া মেডিকা ও মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স। আরও একটি বিষয় ছিল “none of the systemic courses of lectures shall consist of less than 70 lectures or demonstration upon each subject.” (প্রাগুক্ত) অর্থাৎ কোনভাবেই ৭০টির কম লেকচার বা ডেমন্সট্রেশন হলে চলবেনা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অ্যানাটমি এবং ধাত্রীবিদ্যাকে পৃথক করে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করা হল। এর সাথে কেমিস্ট্রির মূল বিষয়গুলোকে আলাদাভাবে শেখানোর প্রস্তাব রাখা হল কলেজ কাউন্সিলের তরফে। কেমিস্ট্রিকে জুড়ে দেওয়া হল মি. রবার্টসনের ফার্মেসি ক্লাসের সাথে। এই নতুন শাখার নাম হল “কেমিস্ট্রি অ্যান্ড প্র্যাক্টিক্যাল ফার্মেসি”। উইলিয়াম ও’শনেসি চলে যাবার মেডিক্যাল কলেজের যে কেমিস্ট্রির ক্লাস এবং ল্যাবরেটরি হিন্দু কলেজ তথা গোটা বিশ্বের আলোচনার বিষয় ছিল সে কেমিস্ট্রির শিক্ষা লক্ষ্যণীয়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। (প্রাগুক্ত) কলেজ কাউন্সিলের তরফে নির্দিষ্টভাবে জানানো হল – “Mr. Robertson should give the courses required by the Royal College of Surgeons of England. That every student should, in addition, compound in the dispensary of the Medical College, under the superintendence of Mr. Daly, the House Surgeon and Apothecary: that the present anomalous and useless appointment of Lecturer on Minor Surgery should be abolished”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১) একইসাথে নতুন একটি অধাপকের পদ তৈরি করা হল “প্রোফেসর অফ মেটেরিয়া মেডিকা অ্যান্ড মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স” নামে। “It is deemed of great importance that every course of lectures should be of the nature and duration, adopted as the standard of the Royal College of Surgeons.” (প্রাগুক্ত)
কলেজের নতুন অধ্যাপকেরা হলেন গুডিভের স্থলে সার্জন টি জে প্যাটারসন (প্রোফেসর অফ অ্যানাটমি অ্যান্ড ফিজিওলজি) এবং ডঃ ডানকান স্টুয়ার্ট (প্রোফেসর অফ মিডওয়াইফারি)। এছাড়া পূর্বতন ডেমনস্ট্রেটর অফ অ্যানাটমি রিচার্ড ও’শনেসিকে প্রোফেসর অফ সার্জারি করা হল, অ্যালান ওয়েবকে করা হল ডেমনস্ট্রেটর অফ অ্যানাটমি এবং প্রোফেসর অফ মিলিটারি সার্জারি (টু দ্য সেকেন্ডারি ক্লাস)। এছাড়াও কলেজের মিউজিয়ামের কিউরেটর হিসেবে দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০২)
রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনসের রেগুলেশন অনুযায়ী মেডিক্যাল কলেজের নতুন কোর্সের লেকচারের কাঠামো হল এরকম –
অ্যানাটমি অ্যান্ড ফিজিওলজি – মোট ১২০টি লেকচার, শীতের সময় সপ্তাহে ৪টি করে এবং গরমের সময় সপ্তাহে ৩টি করে।
ডেমনস্ট্রেশন অ্যান্ড অ্যান্ড ডিসেকশন – ডিসেকশন হবে ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ অব্দি সপ্তাহে ৩টি করে এবং ডেমনস্ট্রেশন ১৫ মার্চ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের ১৫ জুন অব্দি পুরো সময় জুড়ে সপ্তাহে ৩টি করে।
সার্জারি – কোর্স শুরু হবে ১৫ জুন থেকে এবং ৭০টি লেকচারের কম হবেনা।
থিওরি অ্যান্ড প্র্যাক্টিস অফ মেডিসিন – ৭০টি
কেমিস্ট্রি এবং প্র্যাক্টিক্যাল ফার্মেসি – ৭০টি
মেটেরিয়া মেডিকা এবং থেরাপিউটিকস – ৭০টি
মিডওয়াইফারি উইথ প্র্যাক্টিক্যাল ইলাস্ট্রেশনস – ৭০টি
বোটানি – ৭০টি
মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স – মেটেরিয়া মেডিকার সাথে টক্সিকোলজিও পড়ানো হবে। এছাড়া বাকী অংশের জন্য ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ অব্দি সপ্তাহে একটি করে ক্লাস নেওয়া হবে।
এছাড়া, আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, কলেজের ডিসপেনসারিতে ছাত্ররা শিখবে কিভাবে “compound medicine” করতে হয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০২)
ছাত্ররা আগের মতো বিভিন্ন হাসপাতালে (ইউরোপীয়ান জেনারেল হসপিটাল এবং নেটিভ হসপিটাল) এবং কলেজের আউটডোর ডিসপেনসারিতে কাজ শিখবে। ভ্যাক্সিনেশন শেখানোর জন্য কলেজে একজন “টিকাদার” নিয়োগ করা হয়েছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৩) রিপোর্টে বলা হল কলেজে ফিভার হাসপাতাল তৈরি হলে ছাত্রদের প্র্যাক্টিক্যাল এবং ক্লিনিক্যাল শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে। এবং যদি এগুলো সফলভাবে করা যায় তাহলে মেডিক্যাল কলেজ গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ প্রভিন্সিয়াল মেডিক্যাল স্কুলের সমকক্ষ হয়ে উঠবে বলে স্পষ্ট অভিমত জানানো হল। (প্রাগুক্ত)
ওপরের তালিকা থেকে বোঝা যায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টগুলোর জন্য প্রতি সেশনে ১২০টি করে এবং অন্য বিষয়গুলোর জন্য ৭০টি লেকচার আবশ্যিক হল। একদিকে রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনসের অনুমোদিত শিক্ষাক্রমকে অনুসরণ করার জন্য এবং অন্যদিকে ইউরোপ ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের অন্তত প্রভিন্সিয়াল মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমতুল্য করে তোলার জন্য শিক্ষাক্রম ঢেলে সাজানো হল।
ওপরে উল্লেখিত শিক্ষক অ্যালান ওয়েবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৮৩৭ থেকে ১৮৪৭-এর মেডিক্যাল কলেজে ৩,৫০০ শবদেহ আনা হয়েছিল ডিসেকশনের জন্য। (Allan Webb, Pathologia Indica, or the Anatomy of Indian Diseases, 2nd edition, in 2 parts, ১৮৪৮, পৃঃ ২৩৭) এই দেহগুলো আসত কোথা থেকে? আমরা এর আগে দেখেছি নিরাশ্রয়, দরিদ্র, হতভাগ্য মানুষেরা যারা ফুটপাথে বা গঙ্গার ঘাটে মরে পরে থাকত কিংবা কোন পরিচয়হীন মানুষ হিসেবে মারা যেত তাদের দেহ চলে আসত ডিসেকশন টেবিলে। এমনকি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া দেহও ছিল ডিসেকশনের অবজেক্ট। এজন্য ইংল্যান্ডে যেভাবে ১৮৩২ সালে পার্লামেন্টে অ্যানাটমি অ্যাক্ট করে ডিসেকশনের জন্য শবদেহর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছিল তখন ভারতে নামগোত্রহীন হতভাগাদের মৃতদেহ এত বিপুল পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছিল যে এর জন্য কোনরকম কোন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়েনি।
এর পাশাপাশি যদি অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ রুথ রিচার্ডসনের ডেথ, ডিসেকশন অ্যান্ড দ্য ডেস্টিটিউট-এ দেওয়া সমগ্র ইংল্যান্ডের হিসেব দেখি তাহলে বৈপরীত্যটি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়বে।
শুধুমাত্র বাংলার একটি মেডিক্যাল কলেজে গোটা পঞ্চাশেক ছাত্রেরা যতসংখ্যক শবদেহ পেয়েছে ডিসেকশনের জন্য একই সময়কাল জুড়ে ইংল্যান্ডের মোট হিসেব তার চেয়ে কম। কত সহজে এখানে মৃতদেহ পাওয়া – যেমন আজ, তেমন প্রায় ৩০০ বছর আগেও ছিল। গবেষক মার্ক হ্যারিসন এই প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন – “In Britain, the supply of bodies for dissection was still severely restricted, but there was no such constraints in the colonies, where cadavers were plentiful.” (Mark Harrison, Medicine in an Age of Commerce: Britain and its Tropical Colonies, 1600-1830, 2011, পৃঃ ৪) ১৮৪৫ সালের প্রথম দুমাসে ডিসেকশনের জন্য ১৬৫টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।
১৮৪৫ সালে মেডিক্যাল কলেজে “সাবঅর্ডিনেট মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট” তৈরি করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্যে ভারতে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য বিপুলসংখ্যক মিলিটারির জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে – স্বল্প প্রশিক্ষিত হলেও কাজ চালানোর মতো ডাক্তার। এজন্যই মেডিক্যাল কলেজে মিলিটারি ক্লাস বা বাংলা ক্লাস খোলা বা “সাবঅর্ডিনেট মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট তৈরি করা। দুটি উদ্দেশ্য যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল – (১) ডাক্তার তৈরির ব্যয় বাঁচানো, এবং (২) ভারতে সামাজিক ও ভৌগোলিক উপনিবেশ তৈরির জন্য উপযুক্ত রসদ সৃষ্টি করা।
GCPI 1844-45-এর রিপোর্টে বলা হল – “The exigencies created by the war in Affghanistan (sic) and China, led to a temporary increase in of the number of all grades of the subordinate Medical Department”। (পৃঃ ১১২) আরও বলা হল – “Detachments are constantly moving about in this country, such as invalids, recruits, convalescents, single companies of artillery, &c. … During the late war, two apothecaries were sent to China from Calcutta in Medical charge of Transports with troops on board, in consequence of the great paucity of medical officers at the presidency at that time.” (পৃঃ ১১৪)
এ সময় থেকে ডিপ্লোমা এবং গ্র্যাজুয়েট এই দুধরনের ডিগ্রি দেবার সিদ্ধান্ত হয়। কলেজের শিক্ষাকাল ৫ বছর করা হয়। এছাড়া, কলেজ কম্পাউন্ডের মধ্যে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থার বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৬) উল্লেখযোগ্য, সামান্য সময় আগে ঘটা চিনের যুদ্ধের (বা চিনকে আক্রমণের) সময় “three Sub-assistant Surgeons volunteered to take charge of transports, filled with camp followers.” (পৃঃ ১১৯)
ইংল্যান্ডের Fort Pitt-এর মতো কলকাতাতেও একটি সেন্ট্রাল মিউজিয়াম খোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়, এবং সেটি মেডিক্যাল কলেজে “by directing – through the Medical Boards of the three presidencies – all medical officers in charge of civil and military hospitals to furnish to the Calcutta Museum, morbid preparations of interest.” (পৃঃ ১২২) মোট ৮৭৫টি স্পেসিমেন ছিল মিউজিয়ামে, যার মধ্যে ৫৬টি জানুয়ারি ১৮৪৪-এর পরে সংগৃহীত হয়েছে।
ছাত্রদের স্বাস্থ্য এবং প্রমোদের জন্য একটি জিমনেশিয়াম তৈরি করা হয়। এখানে আমাদের প্রথম অধ্যক্ষ ব্রামলের প্রস্তাব এবং উদ্যোগের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই। এ বছরে “Graduates in Medicine and Surgery of the Bengal Medical College has been granted by Government to all passed students of the Institution”। লক্ষ্য হল – “both to give them a status and consideration among the native community, and as a just reward for the strict and searching examination to which each is subjected, prior to receiving diploma.” (পৃঃ ১২৩)
পরীক্ষা নেবার সময়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এতদিন পর্যন্ত যে সময়ে এবং যতদিন ধরে পরীক্ষা নেওয়া হত সেটা “found to interfere seriously with the practical duties of the dissecting room … was recommended to be changed the 1st of November to the 15th of March”। (প্রাগুক্ত) পরবর্তী বছর থেকে শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত সেশন হবে ১৫ জুন থেকে ছেদহীনভাবে পরবর্তী বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত – রবিবার এবং দেশীয় ছুটির দিন ছাড়া। এতে পড়াশুনোর জন্য ৯ মাস এবং পরীক্ষার জন্য ১ মাস পাওয়া যাবে। (প্রাগুক্ত)
পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন করা হয়, যেমনটা অধিকাংশ ইউরোপীয় ইউনিভার্সিটিতে অনুসৃত হয়, সেভাবে। লিখিত এবং ডিসেক্টিং রুমে প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াও “every final student is subjected to special trial for twenty minutes at least, in each and every department of study … The ordeal is much more difficult and extended than that to which candidates for the diploma of the Royal College of Surgeons of England are subjected”। (পৃঃ ১২৩-১২৪) Royal College of Surgeons of England-এ যে যে পরীক্ষা নেওয়া হত তার সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের পার্থক্য ছিল কেবল ল্যাটিন, ন্যাচারাল হিস্টরি এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি।
হাসপাতালে উপস্থিতির ক্ষেত্রে তিনজন ছাত্রের নাম আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছিল – দয়ালচন্দ্র বসাক, গোপালচন্দ্র শীল এবং শ্রীনাথ সেন। রুস্তমজি মেডেলের জন্য গোপালচন্দ্র শীল, হরমোহন মুখার্জি এবং যাদবচন্দ্র ঘোষ পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হন। মেডেলের জন্য ছাত্ররা “were directed to dissect the surgical anatomy of the neck.” সবাই ভালো পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু গোপালচব্দ্র শীলের পরীক্ষা পরীক্ষকদের মতে “very excellent” হয়েছিল বলে এই মেডেল পান। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৪)
গুডিভ স্কলারশিপ পেয়েছিলেন দয়ালচন্দ্র বসাক। এই শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রতিটি লিখিত প্রশ্নের জন্য নির্দিষ্ট নম্বর দেবার পদ্ধতি শুরু হল – “Taking 10 as the number of superior merit, attributable to Bholanath Bose”। অন্যদের ক্ষেত্রে “as having attained mediocrity”। অবশ্য mediocrity-র বাইরেও বেশ কয়েকজন ছাত্র ছিল। (পৃঃ ১২৫) রামকমল সেন মেডেল (বোটানিতে) পেয়েছিলেন তারকচন্দ্র লাহিড়ী। হরনাথ মিত্র পেয়েছিলেন Bird Medal।
নতুন পর্যায়ে কেমিস্ট্রির ক্লাস নিতে শুরু করলেন এ রবার্টসন। তাঁর পড়ানো সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হল – “his instruction would do honour to any school in Europe”। (পৃঃ ১২৭)
এরপরে অধ্যাপক এগার্টনের তত্ত্বাবধানে বার্ষিক পরীক্ষা হয়। লিখিত পরীক্ষায় দুটি প্রশ্ন ছিল। মেডিসিন, সার্জারি, ধাত্রীবিদ্যা, কেমিস্ট্রি, মেটেরিয়া মেডিকা এবং বোটানিতে viva voce তথা মৌখিক পরীক্ষা হয়। সসম্মানে উত্তীর্ণ হন হরনাথ মিত্র, R. Keane, F. D. Vose, উজির খান, তারকচন্দ্র লাহিড়ী, দ্বারকানাথ চ্যাটার্জি, কালীচরণ লাহিড়ী, R. Andree, C. E. Peyster। তবে মন্তব্য হিসেবে একথাও বলা হয় যে ১৮৪৪-এর বার্ষিক পরীক্ষায় পূর্ণচন্দ্র সাহা, দীনবন্ধু দে এবং মিস্টার ল্যাজারাস যে মানের পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবারের পরীক্ষার্থীরা তাঁদের তুলনায় ন্যূন। (পৃঃ ১৩১)
ছাত্রদের বিভিন্ন প্রাইজের তালিকা নীচে দিলাম।
১৮৪৪-৪৫-এর পূর্ববর্তী বছরের বাৎসরিক রিপোর্টে এবং তারও আগে মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন নতুন ফিভার হসপিটাল খোলার প্রস্তাব নিয়ে বারংবার কথা হয়েছে। ১৮৪৪-৪৫ শিক্ষাবর্ষে কলেজের সেক্রেটারি ডঃ মোয়াটের চিঠির জবাবে স্যার জে পি গ্র্যান্ট জানান যে সরকারের পক্ষে এর আর্থিক দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। (পৃঃ ১৩৩) এসময়েই মতিলাল শীল মেডিক্যাল কলেজের একেবারে গায়ে সেসময়ের মূল্যমানে ১২,০০০ টাকা মূল্যের জমি দান করেন ফিভার হসপিটাল খোলার জন্য। এ ঘটনার অব্যবহিত পরে এডুকেশন কাউন্সিল ফিভার হসপিটাল খোলার লক্ষ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। (প্রাগুক্ত)
মজার কথা হল, এদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টাকায় আধুনিক মেডিসিন শিক্ষার অগ্রগতি ঘটছে। কিন্তু কৃতিত্বের সম্পূর্ণ ভাগীদার থেকেছে বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার।
তখন যেসব জায়গায় মানুষ (দেশীয় এবং ইউরোপীয় উভয়েই) অসুস্থ হলে চিকিৎসা পেত সেগুলো হল – (১) জেনারেল হসপিটাল, (২) নেটিভ হসপিটাল, (৩) পুলিস হসপিটাল, (৪) Leper Asylum, (৫) মেডিক্যাল কলেজের পুরুষ এবং মহিলা হসপিটাল, এবং (৬) শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের ডিসপেনসারিতে। রিপোর্টে হিসেব দেওয়া হল – “The average amount of sickness existing in Calcutta at all times and from every cause, in a fixed and floating population, which has been estimated at 3,00,000 persons, is 18,000, and of these at least one-fifth, or about 3,000 persons die before the end of each year from acute attacks of Fever”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৪) অর্থাৎ ৩ লক্ষ লোকের বাস যে শহরে সেখানে বিভিন্ন কারণে ১৮,০০০ মানুষ অসুস্থ হয়। এরমধ্যে ৩,০০০ মানুষ জ্বরের সংক্রমণে মারা যায়।
এখানে দুটো বিষয় ভেবে দেখবো। প্রথমত, জ্বরের কোন শ্রেণীবিভাগ নেই, জ্বর হিসেবেই বিভিন্ন রোগ বিবেচিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বছরে ৩,০০০ মানুষ যারা মারা যাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আশ্রয়হীন, হাসপাতালই এদের থাকা-খাওয়ার জায়গা। স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুর পরে এই মানুষগুলো মেডিক্যাল কলেজের ডিসেকশন টেবিলে ঠাঁই পাবে। এদেশে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো অ্যানাটমি অ্যাক্ট করার প্রয়োজনই পড়েনা।
এ রিপোর্টে আরেকটি লক্ষ্যণীয় জায়গা হল রোগের কারণ বোঝাতে গিয়ে “exposure to noxious exhalations” এবং “miasmata ever present”-এর কথা বলা হয়েছে। প্রাক-হসপিটাল মেডিসিন যুগের রোগের উৎস হিসেবে miasma বা দূষিত বায়ুর তত্ত্বের প্রভাব ১৮৪৫ সালের রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি, যখন organ localization of disease প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কলেজের শিক্ষাক্রমে। এভাবেই ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের প্রভাব আরেকটি অধ্যায়ের মাঝে থাকে – সে সোশ্যাল সায়ান্স বা মেডিক্যাল সায়ান্স যাই হোক না কেন।
ফিভার হাসপাতালের ব্যাপারে আরেকটি হিসেবেও এই রিপোর্টে দেওয়া হল – “that a small Hospital, containing only 200 beds, would be capable of receiving and discharging 600 patients labouring under the acute forms of Fever every month, or 7,200 patients in the year. If the Hospital should contain 300 beds – and a smaller one would be quite inadequate to the demands for assiatance – the number relieved in a month would be 900, or in a year 10,800, a small proportion of the sick”। অর্থাৎ ২০০ বেডের একটি হাসপাতাল হলে প্রতিমাসে ৬০০ রোগী এবং বছরে ৭,২০০ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। আর বেডের সংখ্যা ৩০০ হলে এ সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৯০০ এবং ১০,৮০০ হবে। যদিও এ সংখ্যাও মোট অসুস্থ রোগীর সংখ্যার ক্ষেত্রে অপ্রতুল। তাসত্ত্বেও “a large number of persons to be annually rescued from the certainty of death, and placed where each is within a reasonable hope of recovering, and where it is certain that the great majority will recover” বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়। (পৃঃ ১৩৫)
এই রিপোর্টের শেষে কাউন্সিল অফ এডুকেশনের তরফে স্বাক্ষরকারী ছিলেন – সি এইচ ক্যামেরন, এফ মিলেট, জে আলেক্সান্ডার, সি সি ইগার্টন, রসময় দত্ত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং এফ জে মোয়াট। (পৃঃ ১৩৮) এদেশের সমাজপতিরাও মেডিক্যাল কলেজের পরিচালনায় স্থান পেয়েছেন। এবং স্থান সংগ্রহ করার জন্য এদের অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে – কখনো দ্বারকানাথের মতো অনেক টাকার প্রাইজ দানে এবং দুজন ছাত্রের বিদেশ যাত্রার খরচ বহন করে কিংবা মতিলাল শীলের মতো ১২,০০০ টাকার জমি দান করে বা বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার উন্নতির জন্য বিভিন্নখাতে বিপুল খরচ বহন করে। আরেকটি কাজও এরা ক্রমাগত করে গেছেন – তখন ইংল্যান্ডের ডিবেটিং সোসাইটির আদলে যেসমস্ত সভা এবং আলাপ-আলোচনার গ্রুপ তৈরি হয়েছে (যেমন তত্ত্ববোধিনী সভা বা বেথুন সোসাইটি) সে জায়গাগুলোতে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, সামাজিক জীবনের সম্ভাব্য সবক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষার অনুকূলে জনমত তৈরি করে গেছেন।
বার্ষিক রিপোর্ট ১৮৪৫-৪৬
GCPI 1845-46-এর রিপোর্ট উল্লেখযোগ্য একাধিক কারণে। তার আগে আরেকবার মনে রাখতে হবে, ১৮৪৪-৪৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিক্যাল কলেজকে ইংল্যান্ডের সর্বোত্তম ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান UCL, রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন্স এবং Worshipful Society of Apothecaries-এর তুল্য করে তোলার লক্ষ্যে কাঠামোগত, শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষাদানের পদ্ধতির রিমডেলিং করা শুরু হয়েছিল।
এই রিপোর্টে শিক্ষকদের তালিকায় Female and Lying-in Hospital-এ রেসিডেন্ট সার্জন হিসেবে দয়ালচন্দ্র বসাক এবং গুডিভ স্কলার হিসেবে তমিজ খানের নাম পাচ্ছি, ইউরোপীয় শিক্ষকদের বাইরে।
মোট ছাত্রসংখ্যা ৯৩ জন। এদের মধ্যে ৫০ জন স্টাইপেন্ডিয়ারি ছাত্র, রবার্টসন স্কলার ২ জন, ফ্রি এবং সিংহলী ছাত্র ৩৫ জন, ইউরোপীয় সাবঅর্ডিনেট ডিপার্টমেন্টের ৬ জন। (GCPI 1845-46, পৃঃ ১০৭) সেন্টেনারি অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ-এ এক্ষেত্রে একটি তথ্যপ্রমাদ আছে বলে মনে হয়। আমরা ১৮৪৪-৪৫-এ Female and Lying-in Hospital-এর প্রথম রেসিডেন্ট সার্জন হিসেবে প্রসন্নকুমার মিত্র এবং ছাত্র রেসিডেন্ট সার্জন হিসেবে দয়ালচন্দ্র বসাকের নাম পাচ্ছি। সেন্টেনারি-তে প্রথম রেসিডেন্ট সার্জন হিসেবে ভোলানাথ বোসের উল্লেখ রয়েছে।
হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ১৯, কায়স্থ ১৮, বৈদ্য ৭, কৈবর্ত ২, তাঁতী ৩, বেনিয়া ১, তেলি ১, সদগোপ ১ জন। (পৃঃ ১০৭) নীচে মোট ক্লাস এবং ছাত্রদের উপস্থিতির টেবিল দেওয়া হল। (পৃঃ ১০৮)
এপ্রিল, ১৮৪৬-এ বোটানির অধ্যাপক গ্রিফিথ পদত্যাগ করায় তাঁর জায়গায় জে ম্যাকলেল্যান্ডকে বোটানির অধ্যাপক করা হল। রিপোর্টে জানানো হল – “Among the most gratifying, striking and important events of the session which has recently closed, has been the recognition of the Bengal Medical College by the Royal College of Surgeons of England, the University of London, and the Worshipful Society of Apothecaries.” এবং এটাও শ্লাঘার সাথে জানানো হল ব্রিটিশ ভারতে এই হল প্রথম প্রতিষ্ঠান “being granted the privilege of preparing pupils for the academic and professional rewards of corporate and chartered bodies in England.” (পৃঃ ১১০)
এর ফলে মেডিক্যাল কলেজের স্নাতকরা ইংল্যান্ডে ডিপ্লোমা, ডিগ্রি কিংবা লাইসেন্সের জন্য মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি ভর্তি হবার অধিকার অর্জন করল – “The college posseses the means of affording all the purely professional instruction necessary, without residence or study in any other country or institution; the value of the boon accorded can therefore scarcely be overestimated.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০)
১৮৪৬-৪৭-এ UCL-এর মেডিসিন বিভাগের ডিন অফ ফ্যাকাল্টি অধ্যাপক উইলিয়ামসের রিপোর্ট উল্লেখ করে ডঃ গুডিভ জানালেন যে আগস্ট, ১৯৪৬-এ বোটানি পরীক্ষায় ভোলানাথ বোস ৭০ জনের বেশি ছাত্রের মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলেন। মাত্র ২ নম্বরের জন্য রৌপ্য পদক পাননি। প্রোফেসর লিন্ডলে আক্ষেপ করেছিলেন যে তাঁর কাছে দেবার মতো আরেকটি রৌপ্য পদক নেই। তবে অকল্যান্ড খুশি হয়ে একটি মূল্যবান বই উপহার দিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত)
সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী comparative anatomy-তে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষক ডঃ গ্র্যান্ট নিজের লেখা সমস্ত পুস্তকের একটি করে কপি সূর্যকুমারকে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে প্রকাশিত বহু গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক উপহার দেন। তিনি সূর্যকুমারকে সঙ্গে করে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত)
গোপালচন্দ্র শীল প্র্যাক্টিক্যাল অ্যানাটমিতে অসম্ভব দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। অধ্যাপক Quaine-এর মতো কিংবদন্তী শিক্ষক তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলেন “to dissect the subjects for his lectures – a post of considerable honor in the anatomical class.” (প্রাগুক্ত)
দ্বারকানাথ বোসের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানাতে পারেননি। (প্রাগুক্ত)
নভেম্বর, ১৮৪৭-এ ভোলানাথ এবং দ্বারকানাথ প্রথম বিভাগে UCL-এর এমবি পরীক্ষা পাস করেন। ভোলানাথ বোসের চমকপ্রদ মেধার জন্য UCL-এর কিছু নিয়মকানুন শিথিল করে এমডি পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয় এবং যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। এঁদের তিনজন জানুয়ারি, ১৮৪৮-এ ভারতে ফিরে আসেন। ১৮৪৯-এর পাঞ্জাব যুদ্ধের সময় এঁরা তিনজনই অংশ নিয়েছিলন। গোপালচন্দ্র শীল দেশে ফিরে অল্পদিনের মধ্যে মারা যান। দ্বারকানাথ দেশে ফিরে মেডিক্যাল কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেমন্সট্রেটর অফ অ্যানাটমির পদে নিযুক্ত হন। ভোলানাথ ৩০ বছরের বেশি প্র্যাক্টিস করেছিলেন। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন হিসেবে চাকরি করেন। ১৮৮৫ সালে বিপুল বিত্ত রেখে মারা যান। তাঁর সম্পদ জনহিতার্থে ব্যয়িত হয়। ব্যারাকপুরে ভোলানাথ বোস চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি চালু হয়। সুর্যকুমার ১৮৪৮-এ MRCS ডিগ্রি এবং ১৮৪৯-এ UCL-এর এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৫৫ সালে IMS পরীক্ষায় প্রথম হন। ২৪ জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে তিনি গেজেটেড অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের পদমর্যাদা লাভ করেন। একই বছরে সার্জন পদমর্যাদায় উন্নীত হন। ১ জুলাই, ১৮৭৩-এ সার্জন মেজর পদাভিষিক্ত হন। এর আগে ১৮৫০ সালে মেডিক্যাল কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিজিসিয়ান পদে নিযুক্ত হন। (Centenary, পৃঃ ২৭-২৮)
শিক্ষাক্রমকে ইউরোপীয় ধরনের সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য ছাত্রদের “the largest possible amount of time to devote to practical anatomy”-তে ব্যয় করার ব্যবস্থা রাখা হল। (GCPI 1845-46, পৃঃ ১১৩) নীচে নতুনভাবে সজ্জিত ক্লাসের হিসেব দেওয়া হল।
রিপোর্টে জানানো হল স্বেচ্ছায় “some of the senior native, Ceylon, and free Christian students to proceed on service to the Sutlej”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৩) আমরা আফগানিস্তান যুদ্ধের কথা নিশ্চয়ই স্মরণ করবো। এরসাথে যদি আগে আলোচিত চিন বা পাঞ্জাবের campaign-এ মেডিক্যাল কলেজের গ্র্যাজুয়েটদের অংশগ্রহণের কথা মাথায় রাখি তাহলে পূর্বে আলোচিত প্রসঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কিভাবে সুশীল, বাধ্য এবং অনুগত আধুনিক নাগরিক তৈরির সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।
“নেটিভ হলিডেজ”-এর একটি লিস্ট দেওয়া হয়েছিল। ছুটির দিনগুলো এরকম – দোলযাত্রা ১ দিন, শ্রীরাম নবমী ১ দিন, চড়ক পুজো ১ দিন, প্রথম রথযাত্রা ১ দিন, দ্বিতীয় রথযাত্রা ১ দিন, জন্মাষ্টমী ১ দিন, মহালয়া ১ দিন, দীপান্বিতা ১ দিন, জগদ্ধাত্রী পুজো ১ দিন। মোট ৯ দিন। এছাড়া দুর্গাপুজোর জন্য ১০ দিনের ছুটি বরাদ্দ ছিল। (পৃঃ ১১৪)
ফিভার হসপিটাল তৈরির জন্য ৩৪,০৩৮ টাকা অর্থ সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ভারতীয়দের কাছ থেকে। বেনারসের রাজা সত্যচরণ ঘোষাল ফিভার হাসপাতালের জন্য ১০,০০০ টাকা দিয়েছিলেন। এই হাসপাতাল ৩০০ বেডের হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া আউটডোর ডিসপেনসারির দায়িত্বে ছিলেন Mr. Daly। তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী – “The clinical clerks were also practiced in daily business of shop pharmacy, and underwent weekly examinations on this subject as well as on the treatment of diseases.” (পৃঃ ১১৫)
ড্রেসারদের আউটডোর ডিসপেনসারিতে ক্ষত ড্রেসিং করা, প্লাস্টার বানানো, ব্যান্ডেজ লাগানো ইত্যাদি কাজগুলো করতে হত। এছাড়াও “bleeding, tapping for hydrocele, cupping, tooth-drawing, passing the catheter, putting up gractures” ইত্যাদি শিখতে হত। ডঃ স্টুয়ার্টের তত্ত্বাবধানে Female and Lying-in Hospital-এ দুজন “lay-sisters of charity” কাজ করতে শুরু করেন। “These ladies superintended the dieting, clothing and general economy of the hospital, without interfering with or participating in its purely medical arrangements.” (পৃঃ ১১৬)
কলেজ মিউজিয়ামের স্পেসিমেন এসময়ে বেড়ে ১,৩০৬টি হয়। লাইব্রেরির পুস্তক সংখ্যা ৩,৯২৭ ছিল। (পৃঃ ১১৭)
অ্যানাটমি পরীক্ষার ক্ষেত্রে – “Each student was given the ligaments, and other passive organs of locomotion of a joint to dissect, and demonstrate; and afterwards he was examined on a particular part in osteology, the subjects of the dissections and demonstrations and examinations being determined by lot.” (পৃঃ ১৩০)
একইরকম গুরুত্ব দিয়ে কেমিস্ট্রি, বোটানি, মেডিসিন, মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, মিডওয়াইফারি, মেটেরিয়া মেডিকা এবং সার্জারির পরীক্ষা নেওয়া হয়। (পৃঃ ১৩১-১৩৬) এ পরীক্ষার শেষে কলেজ কাউন্সিলের তরফে আউটডোর ডিসপেনসারি নিয়ে মন্তব্য করা হয় – “The college dispensary is utterly inadequate to teach them all, or even a little of the compounding requisite, and the number of cases which the hospital wards are capable of containing, is too limited to afford an extended or complete field for clinical observations, more especially in the surgical department.” (পৃঃ ১৪০-১৪১)
বার্ষিক পরীক্ষার পরে একজন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সি পি মারকাস তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য একটি বিশেষ পুরষ্কার পান। রাজা অপূর্বকৃষ্ণ একটি স্বর্ণ ও দুটি রৌপ্য মেডেল কৃতী ছাত্রদের দেবার জন্য কলেজ কাউন্সিলকে দেন। অকল্যান্ড ভারত ছেড়ে যাবার আগে তাঁর তৈরি ব্যারাকপুর স্কুলের (ভোলানাথ বোস যে স্কুলের একজন অত্যুজ্জ্বল ছাত্র) ছাত্রদের মধ্যে যারা মেডিক্যাল কলেজে স্থান পাবে তাদের জন্য প্রাইজের ব্যবস্থা করে যান। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কালিদাস নন্দী কৃতিত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অকল্যান্ডের দেওয়া পুরষ্কারের ৫০ টাকা পান। (পৃঃ ১৪৪)
বাৎসরিক প্রাইজ দেওয়ার অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নর জেনারেল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণে জানান যে সে বছরের পরীক্ষায় ২৫ জন ছাত্রের মধ্যে ২৪ জন উত্তীর্ণ হয়েছে।
১৮৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক রিপোর্ট
১৮৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষের মেডিক্যাল কলেজের অ্যানুয়্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী মিলিটারি ক্লাসে দুজন দেশীয় শিক্ষকের নাম পাচ্ছি – মধুসূদন গুপ্ত (সুপারিন্টেনডেন্ট এবং টিচার অফ অ্যানাটমি অ্যান্ড সার্জারি) ও শিবচন্দ্র কর্মকার (টিচার অফ মেডিসিন অ্যান্ড মেটেরিয়া মেডিকা)। Female and Lying-in hospital-এ রেসিডেন্ট সার্জন ছিলেন দ্বারকানাথ বোস, M.R.C.S.E. এবং গুডিভ স্কলার তমিজ খান। (Annual Report of Medical College of Bengal [ARMCB], Session 1846-47, পৃঃ ১-২)
এই শিক্ষাবর্ষে ইংলিশ ক্লাসে মোট ছাত্রসংখ্যা ছিল ৭৫। স্টাইপেন্ডিয়ারি – ৩৬ জন (এর মধ্যে ৫ জন মুসলিম, যাদের ৪ জন গত শিক্ষাবর্ষে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ভর্তি হয়েছিল), রবার্টসন স্কলার ২ জন, ফ্রি এবং সিংহলী ছাত্র ৩৪ জন এবং ইউরোপীয় সাবঅর্ডিনেট মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ৩ জন। (পৃঃ ২)
ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ১১ জন, কায়স্থ ১৫ জন, বৈদ্য ৩ জন এবং তাঁতী ৩ জন। মিলিটারি ক্লাসে মোট ১১৯ জোণ ছাত্র ছিল। এদের মধ্যে ১০৯ জন মুসলমান এবং ১০ জন হিন্দু (যদিও নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মিলিটারি ক্লাস নিয়ে আলোচনা করব না)। নীচে কতসংখ্যক ক্লাস হয়েছ, ছাত্রদের হাজিরা কেমন এবং ডিসেকশন সংক্রান্ত টেবিল দেওয়া হল। (পৃঃ ৩)
কলেজ কাউন্সিলের বক্তব্য ছিল – “The pupils in rotation perform the duties of clinical clerks and dressers, and keep record of cases, which are periodically submitted to the Council.” (ARMCB, Session 1846-47, পৃঃ ৫) লক্ষ্যণীয় হল, ১৮৪৬-৪৭ সেশনের পূর্ববর্তী ২ বছরে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছিল। এর কারণ হিসেবে বোঝা গেল “standard of qualification for admission to the College was raised”। (পৃঃ ৬) এছাড়াও শিক্ষার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করার পরেও পাস করে বেরিয়ে আকাঙ্খিত মাইনের চাকরি না পাওয়া এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল। এজন্য সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনদের মাইনে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। (পৃঃ ৭) এছাড়াও ইংলিশ ক্লাসের জন্য “nine gold and two silver medals – a clinical prize of books, and a pocket case for the best Surgeon’s Dresser”-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। (পৃঃ ৮)
ইতিমধ্যে UCL-এর তরফে পাঠানো ডঃ উইলিয়ামসের দ্বিতীয় রিপোর্টে জানা যায় যে ভোলানাথ বোস কেমিস্ট্রিতে First silver medal এবং chemical essay-তে সেকেন্ড সার্টিফিকেট এবং মেটেরিয়া মেডিকাতে ফার্স্ট সিলভার মেডেল পেয়েছেন। সূর্যকুমার কম্প্যার্যাটিভ অ্যানাটমিতে গোল্ড মেডেল এবং অ্যানাটমি ও ফিজিওলজিতে সার্টিফিকেট পেয়েছেন। মেডিসিন এবং ফিজিওলজিতে সার্টিফিকেট পেয়েছেন গোপালচন্দ্র শীল। দ্বারকানাথ বোস ধাত্রীবিদ্যায় সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন। (পৃঃ ১৪) আজকের বিচারেও এঁদের এই সাফল্য বিস্ময়জনক, এমনকি অবিশ্বাস্যও বটে। কিন্তু লক্ষ্যণীয়ভাবে চোখে পড়ে উইলিয়াম ও’শনেসি যে মৌলিকভাবে চিন্তা করার এবং গবেষণা করার সূচনা মেডিক্যাল কলেজে করেছিলেন এঁদের অবিশ্বাস্য সাফল্য সত্ত্বেও সে ধারার গবেষণামুখী ঝোঁক এঁদের ক্ষেত্রে চোখে পড়েনা। একমাত্র সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী বোধহয় ব্যতিক্রম। তাঁর গবেষণাপত্র ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল সহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়।
আমি এ অংশটি এখানে শেষ করছি। পরের অংশে ১৮৪৬-৪৭ সালের বাকি অংশ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত আলোচনা করব।
তথ্য নিষ্ঠ লেখা। বহু পরিশ্রম সাপেক্ষ।আমি ডাক্তার। কিন্তু এত তথ্য আমার জানা ছিল না। লেখক ডাঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য কাছে কৃতজ্ঞ। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।
অসামান্য !
চমৎকার। উচ্চতর শিক্ষার জন্য কালাপানি পার হওয়া শুরু হোল।
নতুন যুগের সূচনা সত্যি করে শুরু হোল সেই ১৮৪৫ সালে।
মেধা চিহ্নিতকরণ, তারপর চার জন বাছাই করা ছাত্রকে সরকারী ও বেসরকারী সংগৃহীত অর্থে বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত শিক্ষার সুযোগ দেওয়া-ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা।
উল্লেখ্য, এই প্রচেষ্টার সুফল নিতে কিন্তু জাত পাত সমস্যা হয় নি।
চমৎকার এগুচ্ছে স্মরণীয় প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস চর্চা।
ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে।
৩০০ বছর পরেও আমাদের কলেজের গড়ে ওঠার দিনগুলোর কাহিনী খুবই চিন্তাকর্ষক ..লেখক কে অনেক ধন্যবাদ
Once again, hats off to your detailed research and presentation. Historically, Bengal and the Bengalees were the pioneers of bringing the Western education to India as Hu-en Tsang contributed to Chinese education from India.
মূল্যবান লেখা।
আমরা বারে বারে শুনি যে সে সময় মেয়েরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে পারতেন না সামাজিক কারণে। অনেক মেয়েদের ডাক্তার হতে চাওয়াও এই কারণে। সেই প্রেক্ষিতে মহিলা রোগের জন্য একেবারে প্রথম দিকেই পুরুষ ডাক্তার নিয়োগ করা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা খুব নজর টানল। প্রসন্ন বাবুর অভিজ্ঞতা কোথাও লিপিবদ্ধ করা আছে কিনা জানতে ইচ্ছে করছে। রেফারেন্স বই এর সন্ধান মিলবে?
রেফারেন্স বই আপাতত আমার জানা নেই। তবে প্রসন্নকুমার ১০০-র বেশি ডেলিভারি করিয়েছিলেন। বেশিরভাগটাই তাঁর প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে।
মানসিক ভাবে জয়ন্ত আমার মনের মানুষ। অথচ আমরা দুজলনে আমরা মুখো মুখী চোখ খুলে নিজেদের কোনদিন দেহিনী —- অথচ ভ্রাতৃবন্ধু একাধারে। আমি ৯০ — জয়ন্ত ৬৫। আলাপের ঘটকালি করলেন — সুদূর Alberta; Canada থেকে Dominik Wujastyk — a front line worker of Intrrnational fame — o Indology in true scientific sense. He himself had been a Physics student from Imperial College, London and Master from Oxford. আমি নিজে সুশ্রুত সামহিতা -র ওপরে একটু নাড়াচাড়া করি। অনেক কিছুই না বলা বাণী /বা উচিত কথা না বলা ভালো ( আয়ুর্বেদ ও বর্তমান সময় — অমর চিত্র কথার কাঠামো ই উচিত কাজ )। এই দুঃসময় ও এই ফুর্তির সময় — জয়ন্ত ভট্টাচাৰ্য — কে ৬/৭ বছর আগে — হটাৎ পেলাম — আমার অনুষিদ্ধন্তিক প্রচেষ্টায়। বহু ভাবেই সে — আমার অজানা, দুর্বদ্ধ বিষয় গুলিকে — জলবত তরলম করে দিয়ে। কলিকাতা মেডিকেল কলেজ সম্পর্কিত তাঁর লেখাগুলি — তথ্যবহুল Epistomological রচনা বা ” চিত্রকথা কাহিনী নয়”। এই ভারতীয় বাংলাতে সীতাহীন — দূর রায়গঞ্জএ বসে তার বৈজ্ঞনিক ঐতিহাসক লেখমি আমাকে অবাক করে —– অর স্তভিত হয়ে — সবকিছু হাতের কাছে পেয়েও — আজকে আমরা — শম্ভু দে, উপেন ব্রহ্মামচারী, বা পয়সার অভাবে সেদিনের Tram Garir – tin naya poisar — টিকিটে ঘুরে বেড়ানো Researcher Dr K. D. Chattetji — রা বাংলা দেশ থেকে হারিয়ে গেলেন। জয়ন্ত তুমি ” মেঘে ঢাকা তারা। চলি জাও — জোর কদমে — যদিও পথ কন্টক পূর্ণ — নির্মাল্য দা