এশিয়া মহাদেশের প্রথম আধুনিক ইউরোপীয় মেডিক্যাল কলেজ হল আমাদের আলোচিত এই কলেজ যেখান থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহুসংখ্যক বিশ্ববিশ্রুত গবেষক এবং চিকিৎসক পাস করে বেরিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি এবং নির্ভরযোগ্য তৎকালীন সংবাদপত্রে কলেজটিকে একাধিক নামে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অভিহিত করা হয়েছে – মেডিক্যাল কলেজ, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ, নিউ মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজ অফ বেঙ্গল। কিন্ত শেষ অবধি প্রায় ৩০০ বছর ধরে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ।
আমার ধারণা, এশিয়া মহাদেশের গায়ে লেগে থাকা ইজিপ্ট বা মিশরে ফরাসী চিকিৎসক ক্লট বে (Antoine Clot Bey) আধুনিক মেডিসিন শিক্ষার যে দিশা দেখান সেটা সম্ভবত মেডিক্যাল কলেজ তৈরির একটি পরোক্ষ প্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকবে – কারণ ক্লট বে-র কথা মেডিক্যাল কলেজের একাধিক বার্ষিক রিপোর্টে, বিশেষ করে, ১৮৩৯ সালে মেডিক্যাল কলেজের ইউরোপীয় মেডিসিনে প্রথম গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষার পরে কলেজের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন যে রিপোর্টে করা হয়েছিল সেখানে আলাদা করে এঁর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।।
এছাড়া সে সময়ে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ জুড়ে যে আর্থসামাজিক এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিবর্তন হয়েছিল একদিকে তার প্রভাব এবং অপরদিকে, ভারতে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয় তার সম্মিলিত প্রত্যক্ষ ফসল এই কলেজ। এবং এই কলেজ তৈরির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করেছে – (১) বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কম খরচে উপযুক্ত মানের চিকিৎসক এদেশে তৈরি করে নেওয়া অর্থাৎ economy of education, এবং (২) মেডিক্যাল কলেজে ৪-৫ বছর কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে জায়মান আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের উপযোগী সুবোধ, সুশীল এবং অনুগত নাগরিক তৈরি করা (প্রজা থেকে নাগরিক সত্তায় উত্তরণ)। এরিক স্টোকস তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ The English Utilitarians and India (১৯৫৯)-এ বলছেন – “There was again an imperialism of the dependent empire that was extraordinarily subtle in its approach, eschewing the blunt imposition of foreign rule, and attempting to work indirectly through indigenous institutions and ruling classes.” (পৃঃ ৩০৯) মেডিক্যাল কলেজও এরকম একটি প্রতিষ্ঠান ছিল।
Report of the General Committee on Public Instruction (1839)-এ বলা হয়েছিল, “The experiment under consideration, it is believed, is similar to that successfully tried in Egypt by Clot Bey.” এখানে প্রশ্ন আসবে এই Clot Bey কে? নেপোলিয়ানের যুদ্ধের পরে মিশর যখন ফরাসীদের দখলে আসে তখন ওখানে আধুনিক ইউরোপীয় পদ্ধতিতে মেডিসিন শিক্ষার প্রচলন করা হয়। এমনকি ডিসেকশনও শুরু করা হয়। এ ব্যাপারে পথিকৃৎ ছিলেন একজন ফরাসী সার্জন Antoine Clot। ক্লট বে-র আলোচনা আবার এসেছে ১৮৩৯ সালে ক্যালকাটা মন্থলি জার্নাল-এ (3rd Series, vol. 5, p.84) “The Medical College” শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে। বলা হল – “we believe, by Clot Bey, an honoured name amongst the scientific pioneers of civilization our professors may proudly appropriate to themselves … in the regeneration of Egypt, medicine has been, and ought to be, one of the most powerful instruments.”
আমার আলোচনায় আমি সময়ানুক্রমিক ইতিহাসের পরিবর্তে জোর দিয়েছি যেসব বিষয়ের ওপরে সেগুলো পরপর সাজালে অনেকটা এরকম – (১) মেডিক্যাল কলেজ কোন স্বয়ম্ভু প্রতিষ্ঠান নয় যে হঠাৎ একদিন উপনিবেশিক শাসকদের ইচ্ছে হল এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করে ফেলল। যখন মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়েছে সেসময় আন্তর্জাতিক মেডিসিনের ইতিহাসে “হসপিটাল মেডিসিন”-এর যুগের অভ্যুদয় হয়েছে। (২) দেখতে চেয়েছি কোন বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই কলেজ তৈরি আবশ্যিক ছিল উপনিবেশিক শাসকদের কাছে। (৩) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিকিৎসার জ্ঞানের জগত (cosmology) কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল, যার অভিঘাত মেডিক্যাল কলেজের জন্মের পশ্চাদপটে কাজ করেছিল। (৪) কিভাবে মেডিক্যাল জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছিল যার পরোক্ষ অভিঘাত পড়েছিল মেডিক্যাল কলেজ তৈরির ওপরে। (৫) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ৩০ বছর জুড়ে (মোটের উপরে) প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে মেডিসিনের ইতিহাসের যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল তাকে অভিহিত করা হয় “হসপিটাল মেডিসিন” হিসেবে। পূর্বতন “বেড সাইড” মেডিসিন থেকে নতুন “হসপিটাল মেডিসিন”-এর পার্থক্য ছিল প্রধানত হাসপাতালে রোগীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে রোগীর জবানিতে রোগের ইতিহাস শোনা (যাকে symptoms বলা হয়), মৃত্যুর পরে রোগীর দেহের শবব্যবচ্ছেদ করে (autopsy) ডাক্তারের ডায়াগনোসিসের সাথে দেহাভ্যন্তরে অঙ্গসংস্থানের মাঝে যে প্যাথলজিকাল পরিবর্তন হয়েছে তাকে খুঁজে বের করা (যাকে signs বলা হচ্ছে), মেডিসিনের জগতে ক্রমোৎপাদিত এই জ্ঞানের সমাহার নতুন পরিসংখ্যানের কাজে ব্যবহার করা শুরু হল, এবং, সর্বোপরি, মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজগুলোতে নতুন জ্ঞানপ্রবাহকে নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ষা করার জন্য ঐতিহাসিকভাবে একেবারে নতুন একটি শিক্ষাক্রম চালু হল।
এতদিন ধরে দেহের উপরিতলের উপসর্গ ধরে গ্যালেনীয় humor কিংবা আয়ুর্বেদের ত্রি-দোষ তত্ত্বের ধারণা দিয়ে রোগকে ব্যাখ্যা করার যে যুগ ও পদ্ধতি ছিল তা চিরতরে নির্বাসিত হল। এক নতুন যুগের সূচনা হল। একে Erwin Ackerknecht-এর ধারণাকে অনুসরণ করে বলা হয় “হসপিটাল মেডিসিন”-এর যুগ। আমরা আধুনিক মেডিসিন বলতে যা বুঝি তা প্রকৃতপক্ষে প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্ম নেওয়া “হসপিটাল মেডিসিন”-এর যুগ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, প্রাচীন গ্রীস এবং রোমে চিকিৎসার জগতে গৃহীত humor-এর ধারণায় ধরে নেওয়া হত – “The Human body contains blood, phlegm, yellow bile, and black bile. These are the things that make up its constitution and cause its pains and health. Health is primarily that state in which these constituent substances are in the correct proportion to each other, both in strength and quantity, and are well mixed.” (হিপোক্রেটিস, On the Nature of Man) আয়ুর্বেদে এসে তাহল ত্রি-দোষ তত্ত্ব, যেখানে ধরে নেওয়া হয় “বায়ুঃ পিত্তং কফশ্চোক্তঃ শারীরো দোষসংগ্রহঃ” – অর্থাৎ বায়ু, পিত্ত ও কফের বিকৃতি থেকে শরীরে সর্বপ্রকার রোগের উৎপত্তি হয়। (চরক সংহিতা, সূত্রস্থানম্) দেহের অভ্যন্তরে রোগের কাল্পনিক উৎপত্তির স্থান নিল রোগের অঙ্গস্থানিকতা (organ localization of disease)।
এসবের সম্মিলিত ফলে মেডিসিনের প্রায়োগিক এবং দর্শনের জগতে অনপনেয় কিছু পরিবর্তন এলো। প্রথম, দেহের অভ্যন্তর ডাক্তার এবং ছাত্রের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হওয়াতে “depth of the body” পর্যন্ত clinical gaze পৌঁছুলো, দেহের ত্রিমাত্রিক ধারণা (যা দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো এবং ভেসালিয়াসের হাত ধরে ১৫শ শতাব্দী থেকে মেডিসিনের জগতে উন্মোচিত হচ্ছিল) নতুন মাত্রা পেল। দেহাভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শুধু নয় টিস্যু অবধি প্রসারিত হল এ দৃষ্টি। বাইরের জগতের মতোই দেহের অভ্যন্তরও অবারিত এবং দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। দ্বিতীয়, মেডিসিনের জগতে ফিজিসিয়ান এবং সার্জনদের মধ্যে যে বিভাজন ছিল তা মুছে গিয়ে এক নতুন সত্তার চিকিৎসকের জন্ম হল ঐতিহাসিকভাবে যিনি একাধারে ফিজিসিয়ান এবং সার্জন, উভয়ই। তৃতীয়, রোগী একজন ব্যক্তির পরিবর্তে মেডিসিনের চোখে প্রতিভাত হতে শুরু করল “diseased body” হিসেবে – প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ইত্যাদির সমাহারে একটি নৈর্ব্যক্তিক কেস নম্বর মাত্র। পুরনো ধরনে রোগীর বলা কাহিনী বা উপসর্গের ওপরে নির্ভর করা নয়, ডাক্তার একে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিত বিপুলহারে নিজের নিরীক্ষণ (inspection), হাত দিয়ে দেখা (palpation), percussion এবং, সর্বোপরি, স্টেথোস্কোপের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। স্টেথোস্কোপ আধুনিক মেডিসিনের সমার্থক হয়ে উঠল। পূর্বালোচিত, ঐতিহাসিকভাবে রোগীর নিজের বলা বিবরণ পেছনে যেতে শুরু করল, গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল।
নতুন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তার আর রোগীকে দেখছেন না, দেখছেন রোগকে – রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যে বিযুক্তিকরণ হতে শুরু করল। অষ্টাদশ শতাব্দীর পথিকৃৎ চিকিৎসক এবং অ্যানাটমিস্ট উইলিয়াম হান্টার একে বলেছেন “necessary inhumanity”। চতুর্থ, জোন লেনের (Joan Lane) ভাষায় বললে – “The changes in hospitals in the nineteenth century were in important areas; medical teaching and the whole profession expanded as never before, the acute sick came to outnumber the long-term chronic patients and specialist hospitals increasingly provided the newest kind of treatment. At the same time a shift in influence occurred and the hospitals became more ‘medicalised’ as subscribers gradually lost their power to recommend patients and governors their day-to-day control of the institution.” (Lane, A Social History of Medicine: Health, Healing and Disease in England, 1750-1950, 2001, পৃঃ ৮৭)
ইউরোপের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো সম্পন্ন হতে কয়েক শতাব্দী লেগেছে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবহার ও আচরণগত, অর্থনৈতিক এবং মূল্যবোধের জগতে ক্রমবিবর্তিত acculturations-এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মেডিসিনের জগতে ছাত্র, চিকিৎসক এবং চিকিৎসিত মানুষ প্রশিক্ষিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে নতুন আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী সুশীল, অনুগত, বাধ্য ও নিয়ম-মানা নাগরিক হয়ে উঠেছে।
ভারতের ক্ষেত্রে মেডিসিনকে ইউরোপের মতো এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়নি। প্রায় ২০০০ বছর ধরে আয়ুর্বেদ-শাসিত এবং নির্ধারিত “স্কল্যাস্টিক মেডিসিন”-এর পরেই ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ (বা শুধুই মেডিক্যাল কলেজ) প্রতিষ্ঠার মধ্য (১৮৩৬) দিয়ে শুরু থেকেই হসপিটাল মেডিসিন এবং পরবর্তীতে “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর চর্চা ও প্রয়োগের সূচনা হল এদেশে। ভারতের ছাত্রসমাজ এবং জনসমাজ সোশ্যাল সাইকির ক্ষেত্রে এর জন্য প্রস্তুতির কোন সময় পায়নি – ভারতের ক্ষেত্রে এ ঘটনা প্রকৃত অর্থে “এনগ্র্যাফটেড” ছিল। ফলে এক অর্থে এটা একধরনের সাংস্কৃতিক “শক” ছিল ভারতীয় জনতার কাছে – অন্তত এর জন্মলগ্নে।
ভারতে যে “engrafted modernity”-র যাত্রা মোটের ওপরে ১৮৩০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে প্রায়-আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হয় সে রাষ্ট্রের জন্মের জন্য ইউরোপের মতো কয়েক শতাব্দির সামাজিক মন্থনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়নি ভারতীয় জনসমাজকে। আধুনিক রাষ্ট্রে স্ব-নিয়ন্ত্রক ব্যক্তির (the emergence of the individual in history) যে অভ্যুদয় হয়েছিল ভারতে সেটা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন চেহারায় এসেছে। বরঞ্চ, এদেশের তথা এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা ও আভ্যন্তরীন পরিমণ্ডলের নতুন টেকনিক এবং পদ্ধতি আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী বাধ্য, অনুগত এবং সুশীল নাগরিকের জন্ম দিয়েছে – প্রজা সত্তা খসে গেছে আত্মপরিচয় থেকে।
এই অর্থে মেডিক্যাল কলেজ উপনিবেশিক রাষ্ট্রের আধুনিকতা নির্মাণের যে প্রোজেক্ট তার সহকারী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
কলেজে ক্লাস করার জন্য ঘড়ির সময় ধরে আসা, নিয়মিত ক্লাসে হাজিরা দেওয়া এবং শিক্ষাক্রমের নিয়ম মেনে প্রশ্নপত্রের উত্তর ও নিয়মিত পাঠাভ্যাস তৈরি করা সবকিছুর সম্মিলিত ফল হিসেবে জন্ম নিল আধুনিকতার উপযোগী এক নতুন শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিকতার নিয়মাবলী (discipline and governance)।
এজন্য মেডিক্যাল কলেজের এবং আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার ইতিহাস শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ কোন শিক্ষাদানের ইতিহাস নয়। এ ইতিহাস নতুন রাষ্ট্রের উপযোগী নতুন নাগরিক তথা সিটিজেন তৈরির ইতিহাস। পরবর্তীতে সমগ্র ভারত জুড়ে ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে governance-এর নতুন টেকনিক ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃত সমাজজীবনে।
কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের জন্মের আগে এর একটি gestation period / period of nativity তথা গর্ভাবস্থা ছিল। একদিনে হঠাৎ করে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এই গর্ভাবস্থা অতিবাহিত হয়েছে প্রধানত নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন (NMI), সংস্কৃত কলেজের মেডিক্যাল ক্লাস এবং কলকাতার মাদ্রাসায় ইউরোপীয় জ্ঞানের চর্চার মধ্য দিয়ে।
NMI যুগে (১৮২২-১৮৩৫) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে যেসব দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল তার কোন প্রত্যক্ষ অভিঘাত না থাকলেও আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে যে রূপান্তর চলছিল তার পরোক্ষ ছাপ অবশ্যই লক্ষ্য করা যায়। এজন্য, একদিকে যেমন এই স্কুলের ছাত্রদের পোস্টমর্টেম নিজের চোখে দেখতে হত এবং শিক্ষককে হাতেকলমে সহযোগিতা করতে হত, অন্যদিকে রোগীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কেস হিস্টরি নেওয়া, ওষুধ ও পথ্যের নির্দেশ লেখা এবং ওষুধ তৈরির কাজও করতে হত। এজন্য আমি সময়টিকে বলেছি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে পূর্ণ বিকশিত হসপিটাল মেডিসিন-এর গর্ভাবস্থা বা gestation period। এখানে উল্লেখযোগ্য, যারা সেসময়ে এই স্কুলে এবং প্রথমযুগের মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন তাঁদের অধিকাংশই এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত। ফ্রান্সের বাইরে ভিয়েনা এবং এডিনবার সেসময়ে মেডিক্যাল শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠান ছিল। ভারতে “বেড সাইড” মেডিসিনের সূচনা হল এসময়ে।
নতুন পর্যায়ের মেডিসিনের উদ্ভব হবার আগে হাসপাতালগুলো কেবল নিজেদের ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর সামাজিক প্রভাব অনুভূত হয়নি। রেনেসাঁ কিংবা আরও ভালো করে বললে প্যারিসে নতুন পর্যায়ের মেডিসিনের সূচনা এবং হাসপাতালগুলোতে যে প্র্যাকটিস করা হত তার সুদূরপ্রসারী সামাজিক ফলাফল ছিল। সামাজিকভাবে হাসপাতাল চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠা ছাড়াও হাসপাতালে প্রশিক্ষিত ছাত্রের দল ছড়িয়ে পড়েছে সমাজজীবনে। নতুন মেডিসিনের বোধ সঞ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয় হাসপাতালের সাথে জুড়ে গেল জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের প্রসঙ্গ। নতুন ধরনের পাবলিক হেলথের ধারণা মানুষকে জীবনচর্যার ক্ষেত্রে নতুন বোধ আয়ত্ত করতে শেখাল। এক নতুন “medical consciousness”-এর জন্ম হল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত এই নতুন ধরনের মেডিসিনের উদয় হয়েছিল প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে। আরউইন অ্যাকার্কনেখট প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে নতুন মেডিসিনের জন্মবৃত্তান্ত বলেছেন – “The last decades of the eighteenth century and the first of the nineteenth saw important transformations, enlargements, reforms, and improvements of the Paris hospital system. These were essentially a consequence of the tremendous influx of uprooted and penniless boys and girls from the country and of the Industrial Revolution.” (Erwin Ackernecht, Medicine at the Paris Hospital, 1794-1848, p. 15)
নতুন মেডিসিনের সারকথাকে ফরাসী দিকপাল চিকিৎসক বিশা (Bichat) খুব অল্পকথায় প্রকাশ করেছেন এভাবে – “You may take notes for twenty years from morning to night at the bedside of the sick … and all will be to you a confusion of symptoms … a train of incoherent phenomena … but start cutting bodies open and, hey presto, this obscurity will soon disappear.” (Roy Porter, The Greatest Benefit to mankind, 1998, পৃঃ ৩০৭) একে আরও স্পষ্ট করে বললেন – “dissect in anatomy, experiment in physiology, follow the disease and make the necropsy in medicine; this is the three-fold path, without which there can be no anatomist, no physiologist, no physician.” এই কথাগুলো হচ্ছে “হসপিটাল মেডিসিন”-এর বীজমন্ত্র। মেডিসিনের এ অধ্যায় আগের সমস্ত পর্যায় থেকে গুণগতভাবে পৃথক, পূর্ণত আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। মেডিসিনের জগতে এবার প্রধান ভূমিকায় এল অ্যানাটমি এবং ডিসেকশন। এবং একইসঙ্গে রোগীর বয়ান নয়, ডাক্তারের চোখে কি ধরা পড়ছে সেটা মেডিক্যাল জ্ঞান নির্মাণের প্রধান উপাদান হয়ে গেল।
দেহের উপরিতল থেকে মেডিক্যাল জ্ঞান এবার প্রবেশ করতে শুরু করবে দেহের অভ্যন্তরের গভীরতায় বা third dimension of the body-তে।
মেডিক্যাল কলেজে ছাত্ররা যখন ইংরেজি ভাষায় সম্পূর্ণত অজানা দেহাভ্যন্তরের তথা অ্যানাটমির রহস্য জানছে কিংবা দেহের অভ্যন্তরের ফিজিওলজি বুঝছে কিংবা কেমিস্ট্রির ক্লাসে ল্যাবরেটরিতে হাতেকলমে রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে তখন একটি নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের (epistemological praxis) অধিবাসী হয়ে উঠছে তারা। আধুনিকতার কৃৎকৌশল ও উপকরণ গ্রহণ করার উপযোগী নতুন মানসিক জগৎ তথা psyche তৈরি হয়েছে, যাকে psychic acculturation বলা যেতে পারে। ND Jewson একে নতুন “medical cosmology” বলে ব্যাখ্যা করেছেন (“The disappearance of the sick-man from medical cosmology, 1770-1870”, International Journal of Epidemiology, ১১ মে, ২০০৯, পৃঃ ৬২২-৬৩৩)।
পরিণতিতে নতুন ভাষার নতুন শব্দভাণ্ডার এবং প্রকাশভঙ্গিমা একধরনের verbal acculturation ঘটাচ্ছে। শবব্যবচ্ছেদ, অপারেশন এবং দেহাভ্যন্তরের উন্মোচন জন্ম দিচ্ছে বিশেষ ধরনের visual acculturation। একই সাথে “ফিলসফি অফ অবসার্ভেশন” তথা দেখার দর্শন বদলে যাচ্ছে।
মেডিসিনে প্রযুক্তির ব্যবহারের সূচনা
দেহাভ্যন্তরের “শব্দ” যে দেহ সম্পর্কে নতুন ধারণা ও বোধের জন্ম দিতে পারে এ ঘটনা ল্যানেকের আবিষ্কৃত স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে প্রথমবারের জন্য চিকিৎসার জগতে প্রতিষ্ঠিত হল।
(ল্যানেকের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের স্টেথোস্কোপ)
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে দেহের বিভিন্ন অংশে প্রশিক্ষিত হাতে টোকা দিলে (percussion) যে দেহের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন “শব্দ” দিয়ে রোগজনিত বিভিন্ন প্যাথলজিকাল পরিবর্তনের সঠিক আভাস পাওয়া যায়, এ বিষয়টি Joseph Leopold Auenbrugger ১৭৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর বই Inventum Novum ex Percussione Thoracis Humani-র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ পুস্তকে Auenbrugger বলেছিলেন – “I here present the reader with a new sign which I have discovered for detecting diseases of the chest. This consists in percussion of the human thorax, whereby, according to the character of the particular sounds then elicited, an opinion is formed of the internal state of that cavity.” অর্থাৎ, দর্শনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে (উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় দর্শনে ভর্তৃহরির উল্লেখ করা যায়, আবার পশ্চিমী দর্শনেও শব্দ এবং শব্দানুভূতির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে) “শব্দ” একটি আলাদা ক্যাটিগরি বা পৃথক সত্তা হিসেবে গৃহীত হল মেডিসিনে।
(Auenbrugger-এর উদ্ভাবিত auscultation পদ্ধতির ফলিত রূপ)
এরকম আরেকটি বিশেষ প্রযুক্তি হল মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র। মোটামুটি ১৭শ শতাব্দি থেকে বিভিন্ন উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে আজকের উন্নততম মাইক্রোস্কোপে এসে পৌঁছেছে। ১৮৫০-৬০-এর দশকে ব্যবহৃত এই যন্ত্র দেহের কোষকে বিশেষভাবে বুঝতে পথিকৃৎ ভূমিকা নিল।
(উপরে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি ব্যবহৃত সাধারণ মাইক্রোস্কোপের চিত্র। নীচে কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপের চিত্র)
এর মধ্যে ১৮৫৮ সালে মেডিসিনের দুনিয়ায় আবির্ভূত হল “সেল প্যাথলজি”-র ধারণা এবং প্রকাশিত হল সোশ্যাল মেডিসিনের জনক রুডলফ ভির্শোর (Rudolf Carl Virchow) যুগান্তকারী পুস্তক Cellular Pathology As Based Upon Physiological and Pathological Histology (তাঁর দেওয়া ২০টি লেকচারের সংকলন)। সহজ কথায় বললে, তিনি দেখালেন যে সমগ্র দেহে রোগ হয়না। রোগের সূচনা হয় একটি কোষ থেকে। এভাবে ভাবনা বৈজ্ঞানিক মহলে সেসময়ে নিতান্ত অভিনব এবং বৈপ্লবিক ছিল। এবং তাঁর এই তত্ত্ব প্রায় ২০০০ বছর ধরে মেডিসিনকে শাসন করে আসা “হিউমোরাল” তত্ত্বের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিল আনুষ্ঠানিকভাবে। একইসাথে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে নতুন করে দেখতে শেখা সাধারণ “চোখ”কে প্রশিক্ষিত করে তুললো বিভিন্ন কোষের বৈচিত্র্যের বিভিন্নতা অনুধাবনে। পেশাদারি প্রশিক্ষণের সঙ্গে অপেশাদারের দৃষ্টির পার্থক্য ঘটে গেল। ফুকো একে চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন – “The living night is dissipated in the brightness of death.” (Foucault, The Birth of the Clinic: An Archaeology of Medical Perception, 2003, পৃঃ ১৪৬)
অস্যার্থ, মেডিসিনের কাছে জীবনের অন্ধকার বা অজানা অঞ্চল মৃত্যুর পরে উজ্জ্বলতা নিয়ে প্রকাশিত হল।
ভির্শোর পুস্তকে ব্যবহৃত ক্যান্সার কোষকে বোঝানোর এই চিত্র এ কথাগুলোকে আরও বিশদে ব্যাখ্যা করবে।
(Carcinoma of the skin – R. Virchow, Wellcome L0003981)
তাঁর বইয়ের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় ভির্শো বললেন – “a view of the cellular nature of all vital processes, both physiological and pathological, animal and vegetable, so as distinctly to set forth what even the people have long been dimly conscious of”। বইয়ের প্রথম লেকচারে বললেন – “I have therefore considered it necessary, and I believe you will derive benefit from the conception, to portion out the body into cell-territories (Zellenterritorien).” (Cellular Pathology, ইংরেজি সংস্করণ, ১৮৬০, পৃঃ ১৪) প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ভির্শোই প্রথম লিউকেমিয়া, কন্ড্রোমা, ochronosis, embolism, thromboembolism, “zoonosis” ইত্যাদি রোগের নামকরণ করেন ও বর্ণনা দেন। বায়োলজির বিভিন্ন টার্ম যেমন ক্রোমাটিন, নিউরোগ্লায়া, agenesis, amyloid degeneration, spina bifida ইত্যাদি নাম উদ্ভাবন করেন এবং এগুলোর ব্যাখ্যা দেন। Virchow–Robin spaces, Virchow–Seckel syndrome, এবং Virchow’s triad তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে।
আমরা বুঝতে পারছি কিভাবে ক্লিনিকাল গেজ বা দৃষ্টি ক্রমশ দেহের উপরিতল থেকে দেহের অজানা অভ্যন্তরকে প্রতিটি পরতে বুঝতে সাহায্য সাহায্য করল।
আরেকটি প্রযুক্তির কথাও এখানে উল্লেখ করতে হবে – থার্মোমিটার তথা ক্লিনিকাল থার্মোমিটার। ডাচ বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট প্রথম দেহের তাপমাত্রা মাপার উপযোগী যন্ত্রটি উদ্ভাবন করলেন ১৭১৪ সালে। এরপরে এল সেলসিয়াস থার্মোমিটার। ১৮৬৬ সালে টমাস ক্লিফোর্ড অ্যালবাট বর্তমানে ব্যবহৃত ক্লিনিকাল থার্মোমিটারের উদ্ভাবন করলেন। প্রথমদিকে প্রায় ১০ ফুট লম্বা থার্মোমিটার দিয়ে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা মাপতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগত। অ্যালবাটের উদ্ভাবন সে সময়কে কমিয়ে আনল ৫ মিনিটে। থার্মোমিটারও আকৃতিতে ছোট হল।
(বাঁদিকে একেবারে প্রথমদিকে ব্যবহৃত থার্মোমিটারের চিত্র। নীচে ক্লিনিকাল থার্মোমিটারের আদিরূপ)
দেহের উপরিতলও নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক পথে পরিমাপযোগ্য হল। ক্লিনিকাল থার্মোমিটারের সর্বপ্রথম কার্যকরী ব্যবহার শুরু করলেন ১৮শ শতকের ইউরোপের প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক Hermann Boerhaave – “He was the first to apply thermometer-registered body temperatures to clinical diagnosis.” (S Y Tan, এবং M Hu, “Hermann Boerhaave (1668 – 1738): 18th Century Teacher”, Singapore Med J 2004 Vol 45(1): 3-5) দেহের অভ্যন্তরকে জানার প্রক্রিয়া এর আগেই শুরু হয়েছিল।
মেডিসিনের এই নতুন অধ্যায়ের অনুসারী হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্রের গভার্নেন্সের তথা প্রশাসনিকতার (সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধায়ের অনুসরণে) একটি ধরন হিসেবে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হল পাবলিক হেলথ – স্বাস্থ্যের এই নতুন রূপ চরিত্রে সেক্যুলার এবং এর আধুনিকতার বিভিন্ন টেকনিকের সাহায্যে জনসমাজে দেহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রকরণে প্রশিক্ষিত করে তুলল। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার, ইউরোপ এবং আমেরিকায় যে গুরুত্ব দিয়ে পাবলিক হেলথের কথা ভাবা হয়েছে ভারতবর্ষের মতো উপনিবেশে পাবলিক হেলথের সেরকম কোন গুরুত্ব ছিলনা। প্রধানত “শুদ্ধ” শ্বেতাঙ্গদের সাথে “অশুদ্ধ” “কালা” নেটিভদের পার্থক্য সুচিহ্নিত করা এবং এদেশের জলবায়ুর বিশিষ্টতার কারণে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি যাতে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে এবং, পরিণতিতে, সামরিক বাহিনীর মৃত্যুহার না বাড়ায় ও রাজার কোষাগারে টান না পড়ে – শুধুমাত্র এটুকুতেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিল জনস্বাস্থ্য তথা পাবলিক হেলথের পরিসর।
হসপিটাল মেডিসিনের পরের ধাপটিকে বলা হয় “ল্যাবরেটরি মেডিসিন” – “In 1848, a new medicine, “laboratory medicine,” made its appearance in Paris under the leadership of Louis Pasteur, Claude Bernard, and the Societe de Biologie.”। (Erwin Ackernecht, Medicine at the Paris Hospital 1794-1848, p. xiii)
আন্তর্জাতিক জগতে মেডিক্যাল শিক্ষার দিকবদলের টুকরো চিত্র
ভারতে তথা কলকাতার শিক্ষার জগতে – সাধারণ উচ্চতর শিক্ষা বা মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো পেশাদারী শিক্ষার ক্ষেত্রে – যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো মৌলিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে (যদিও উপনিবেশে এসে কিছু প্রতিসরণ ঘটেছে) শিক্ষার কেন্দ্রস্থল ইংল্যান্ডে কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে তার নিরিখে। ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পিয়ার তাঁর “Bentinck and Education” প্রবন্ধে বলছেন – “it is in changes in England rather that in India that the cluse of this change of policy must be sought.” (in Modern India, ed. Thomas R. Metcalf, 1994, pp. 240-260) আরেকটি মন্তব্য করেছিলেন স্পিয়ার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে – “The West loves a sign, and when it finds no large buildings labelled “the Smith College” or “the Jones High School” it is apt to assume there is no such thing as education in the land.” (পৃঃ ২৪৭) স্বাভাবিক ভাবেই ভারতবর্ষে শিক্ষার ক্ষেত্রে এই “বিশালত্বের” অভাব এদেশে শিক্ষাহীনতারই নামান্তর হয়ে ওঠে। এর পাশে ইউরোপীয় আদলে বিশালাকৃতি হিন্দু কলেজ বা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষা যে সঠিক পথে এগোচ্ছে তার একটি সূচক হবে – যেমনটা স্পিয়ার বলেছেন।
স্পিয়ারের বক্তব্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যায় যদি ১৮২৬ সালে তৈরি ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের প্রথাবিরোধী প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন বা UCL (জেরেমি বেন্থাম যে প্রতিষ্ঠান তৈরির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন) এবং এর আদলে তৈরি মেডিক্যাল কলেজের চিত্রদুটি পাশাপাশি রাখা যায়।
(উপরে UCL-এর মেইন ক্যাম্পাস। নীচে মেডিক্যাল কলেজ ১৮৬০-এর দশকের আশেপাশে)
১৮৫০ থেকে ১৮৭০-এর দশকের মধ্যে “The laboratory sessions in Germany were called ubungen, or practical exercises, and in Britain and America the first ventures in laboratory teaching were invariably described as courses in “practical chemistry” or “practical physiology.”… By 1856, fifty-nine of them had gone to Giessen alone to study chemistry under Liebig. One of them, A. W. Hofmann, founded the first systematic teaching laboratory in Britain at the Royal College of Chemistry. By 1848 some of the leading scientists of the nation—Charles Lyell, Charles Babbage, and David Brewster—were calling on Oxford and Cambridge to make drastic changes in their teaching of science and to introduce Germanic methods into Britain. … The greatest interest in the new pedagogy before 1870 was found in Edinburgh and London. At University College in London, George Harley, an assistant to William Sharpey, was teaching a course in practical physiology and histology to students as early as 1857.” (Thomas Neville Bonner, Becoming a Physician: Medical Education in Great Britain, France, Germany and the United States, 1750-1945, 1995, পৃঃ ২৩৯, ২৪৪, ২৪৬)
অর্থাৎ, ১৮৫০-এর দশক থেকে বিশেষ করে মেডিসিনের শিক্ষা ল্যাবরেটরি-কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে – ইতিহাস আমাদের সেকথা জানাচ্ছে। মধ্য ১৮৩০-এর দশক থেকেই সুবিখ্যাত ব্রিটিশ চিকিৎসক টমাস হজকিন (যাঁর নামে Hodgkin’s lymphoma নামকরণ হয়েছে) meliorist (মানুষের চেষ্টাতেই পৃথিবীর এবং মানুষের মঙ্গল হবে এই ধারণা) অবস্থান থেকে “medical education, health education, and health care reform were to pathological anatomy as form was to content” এই চেষ্টা শুরু করেন। তাঁর ধারণায় ছিল – “The several elements of his meliorist stance – improvement of the lower orders, of the air and light of London or Calcutta, or of medical studies – were parts of an important, larger configuration of interests”। (Russel C. Maulitz, Morbid Apperances: The Anatomy of Pthology in the Early Nineteenth Century, 2002, পৃঃ ২১৩-২১৪)
ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের শিক্ষক Carswell ১৮৩১ থেকে প্যাথলজিকাল অ্যানাটমিকে শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু “market among the students for the sort of global, histopathological system”-এর অভাবের জন্য এ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৯) কিন্তু মেডিসিন পড়ার ঝোঁক ছাত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ছিল। ১৮৩৯ সালে ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনের আয় ছিল ৬৪৪৪.১০ পাউন্ড, সেখানে ফ্যাকাল্টি অফ আর্টসের আয় ছিল ২২৭৮.১২ পাউন্ড। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২০) নীচের টেবিল থেকে এই পার্থক্য বোঝা যাবে।
এই টেবিল থেকে বোঝা যাচ্ছে বেশিসংখ্যক ছাত্র যে শাখাগুলোতে ভর্তি হচ্ছে সেগুলো হল – অ্যানাটমি (সর্বাধিক), প্র্যাক্টিকাল অ্যানাটমি, মরবিড অ্যানাটমি, প্র্যাক্টিস অফ মেডিসিন ইত্যাদি। ওখানে ছাত্রদের গাঁটের কড়ি খরচ করে শিখতে হত বলে মেডিসিনের বাজারে যে সাবজেক্টগুলোর গুরুত্ব বেশি সেগুলোর চাহিদা বেশি ছিল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষাগ্রহণ ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণত অবৈতনিক ছিল। ১৮৫৯ সালে “paying students” বলে একটি আলাদা বর্গ তৈরি করা হয়। কিন্তু সে খরচও সামান্য ছিল। আমি পরে এ নিয়ে বিশদে আলোচনা করব। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহল প্র্যাক্টিক্যাল অ্যানাটমি এবং প্যাথলজির ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হল ১৮৬০-এর পর থেকে – ও দেশের মতো মেডিক্যাল কলেজেও। যদিও মাত্রার দিক থেকে পার্থক্য ছিল। এমনকি যে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে বিষয়গুলো শেখানো হত তার মাঝেও চরিত্রগত পার্থক্য ছিল।
নীচের টেবিল থেকে বোঝা যাবে লন্ডনে ছাত্রদের খরচ কেমন হত মেডিসিনের পড়াশুনো চালানোর ক্ষেত্রে।
(টেবিল দুটি নেওয়া হয়েছে Morbid Apperances পুস্তক থেকে – পৃঃ ২২০, ২২২)
আরেকটি বিপত্তিও সেসময়ে ইংল্যান্ডের মেডিসিনের জগতে ছিল – ফিজিশিয়ান, সার্জন এবং অ্যাপোথেকারিদের আলাদা আলাদা শিক্ষণপদ্ধতি, প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন idiom, আলাদা আলাদা কোড। এ বিষয়গুলো ফ্রান্স এবং জার্মানির প্রাগ্রসর শিক্ষাপদ্ধতির প্রভাবে ইংল্যান্ডেও অপসৃত হতে শুরু করে। এসমস্ত ভিন্নতা নতুন ধরনের মেডিক্যাল শিক্ষায় তৈরি ডাক্তারদের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। Maulitz বলছেন – “What Xavier Bichat, the Mozart of medicine, and after him Bayle and Laennec, offered was an alternative scheme for thinking about the body and its morbid appearances. They created a new landscape of disease. It was a landscape derived, perhaps, from native French elements, or perhaps from elements found elsewhere.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৫)
মজার কথা হল, মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষারম্ভের শুরু থেকেই এই বিভাজনগুলো অনুপস্থিত ছিল। নতুন প্রজাতির ডাক্তারদের মাঝে এগুলো সব লীন হয়ে একজন ডাক্তার একাধারে ফিজিশিয়ান, সার্জন এবং অ্যাপোথেকারি হিসেবে শিক্ষিত হতে শুরু করলো।
১৮৫৭ সালে তৈরি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিক্যাল শিক্ষা আর স্বাধীন রইলোনা। ইউনিভার্সিটি শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হল। এখানে উল্লেখযোগ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেনেট মিটিং (৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৮) স্থানের অভাবে মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল রুমে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধানে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করা হল – “As regards its Constitution, the University adopted, in the first instance, the form, government, and regulations of the University of London, and gradually, as necessity arose, changed and adopted them to the requirements of its own students.” (University of Calcutta Minutes for the Year 1885-86, Calcutta, পৃঃ ১৫২) ছাত্রদের প্রয়োজনে স্থানীয় পরিস্থিতি মাথায় রেখে যে পরিবর্তনগুলো করা হয়েছিল সেগুলো এরকম – (১) ১৮৬১ সালে First Examination in Arts (FA) চালু হল, এবং (২) ১৮৬১ সালে মেডিসিন, আইন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ লাইসেনশিয়েট ডিগ্রির প্রচলন করা হল।
এরকম আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় প্রেক্ষিত মাথায় রেখে আমরা এবার ১৮৬০ পরবর্তী মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসকে জানবো। আন্তর্জাতিক জগতে ক্রমপরিবর্তনশীল বিজ্ঞান ও মেডিসিনের জগতের সাথে অনেকাংশে সঙ্গতি রেখে মেডিক্যাল কলেজের সিলেবাসের ক্ষেত্রে, প্রাক্টিক্যাল ক্লাসের গুরুত্বের ক্ষেত্রে, এমনকি প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়েছে। এরপরের অধ্যায়ে সে ইতিহাস উন্মোচিত হবে।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার যে ১৮৫৮ সালে ইংল্যান্ডে মেডিক্যাল রেজিস্টার এবং জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হল। প্রকাশিত হল পৃথিবীবিখ্যাত Gray’s Anatomy-র প্রথম সংস্করণ। ১৮৬০ সালে Etienne-Jules Marey প্রথমবারের জন্য আধুনিক রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের (sphygmograph/ sphygmomanometer) প্রবর্তন করলেন। এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে মেডিক্যাল কলেজের সামগ্রিক ১৮৬০ পরবর্তী সময়ে। ১৮৬০-পূর্ববর্তী সময়ে সর্বাধিক গুরুত্ব ছিল ডিসেকশন এবং ক্লিনিকাল ক্লাসের ওপরে। ১৮৬০-পরবর্তী সময়ে জোর পড়েছে দেহাভ্যন্তরের কোষ, অঙ্গসংস্থান এবং ল্যাবরেটরি শিক্ষার ওপরে। পরিবর্তনের এ কাহিনী নিয়েই আলোচনা হবে আমার পুস্তকে।
তথ্য এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি পাঠযোগ্য প্রবন্ধ। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ।
অনবদ্য উপস্থাপনা
অনবদ্য । এই সিরিজের লেখাগুলি প্রত্যেকটি অমূল্য সম্পদ। আগামী দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মাইল স্টোন হয়ে উঠবে ।
Always look forward to your well researched essays. But it suffers from one big deficiency. Though Calcutta was Capital of EIIC- ruled India — your coverages are too much Calcutta and Bengal centric. Research papers on such salient issues should have much broader perspectives — in relation to what was happening in those formative period — in places like Bombay and Madras — simultaneously. We expect — brilliant chronicler that you are — your net should be wider and collect relevant historical facts in its drawing catchment — equally important events from else where — to help us getting a pan Indian picture of how British colonial juggernaut was rolling on — in this less discussed scenario of early days of Western Scientific Medical Care and its fecundative educational experiments. Needless to affirm how avidly I wait for your successive write ups. You amaze me! — n.da
আপনার লেখা না পড়লে অনেক কিছু জানতে পারতাম না, অত্যন্ত পরিশ্রম করে তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, ধন্যবাদ স্যার
ডাক্তার বাবু আপনার লেখা পড়ে বহু অজানা জিনিস জানতে পারলাম। অসাধারণ। 🙏🙏
খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারলাম, ধন্যবাদ 🙏
চিত্তাকর্ষক ইতিহাস, পড়তে পড়তে ভাবছিলাম বিজ্ঞানযাত্রার বিবর্তন কি অসাধারণ। লেখার গুণে সুখপাঠ্য এ ইতিহাস পাঠকের নজর কাড়বেই। আর ইতিহাস তো সবার পাঠ্য।
ভারতবর্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূচনা ও বিস্তার সেই সময়ের আর্থ সামাজিক অবস্থানকে বিচার করে লেখক তাঁর গবেষণা মূলক লেখায় তুলনাহীন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
চিকিসাবিজ্ঞানের ইতিহাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কিছু গবেষণাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে।
আশা করি ভবিষ্যতে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করবে
Excellent
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্রমোন্নয়নের ইতিহাস যেভাবে ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য সাধারণ পাঠকদের বোধগম্য করে সিখ্ চলেছেন তাতে আমি অভিভূত। এই লেখাতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন, তার আবিষ্কার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে তার সমন্বয় গড়ে তোলার অধ্যায় শুরু হল।
চমৎকার।