দশম অধ্যায় – শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উন্মেষ
(মেডিক্যাল কলেজের প্রধান বিল্ডিংয়ে প্রবেশের মুখে হিপোক্রেটিসের মূর্তি। একপাশে সংস্কৃতে (Vedic), অন্য পাশে আরবিতে (Unani) শপথ উৎকীর্ণ করা আছে)
১৮৫৬ সালে ল্যান্সেট-এ (১৯ এপ্রিল) ডঃ হেনরি বেনেটের লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হল “এ রিভিউ অফ দ্য প্রেজেন্ট স্টেট অফ ইউটেরাইন প্যাথলজি” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনের শেষে “অ্যাপেনডিক্স” হিসেবে সংযোজন করলেন – “যখন এ লেখাটি প্রকাশ করছি তখন একজন ভারতীয় প্র্যাকটিশনারের কাছ থেকে, যদিও আমার কাছে তিনি একবারেই অপরিচিত, একটি মূল্যবান কমিউনিকেশন পেয়েছি। এখানে বিস্তারিতভাবে ভারতীয় মহিলাদের জরায়ু এবং জরায়ুর মুখে কি ধরণের প্যাথলজিকাল পরিবর্তন হয় সে বিষয়ে সম্যকরূপে আলোকপাত করা হয়েছে।” (ল্যান্সেট, ১৯ এপ্রিল, ১৮৫৬, পৃঃ ৪২৪-৪২৫)
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে মাইক্রোস্কোপের নতুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে হেনরি বেনেটের গুরুত্বকে গবেষকেরা ঐতিহাসিকভাবে পৃথক স্বীকৃতি দিয়েছেন – “The first textbook in any language entirely devoted to preparative and manipulative techniques was Quekett’s Practical Treatise on the Use of the Microscope (1848). It is thus no coincidence that courses in histology for medical practitioners took off in the 184০s. Guy’s Hospital Medical School in London included such work from 1843, while J. H. Bennett (1812-75) in Edinburgh … offered courses from 1845.” (Brian Bracegirdle, “The Microscopical Tradion”, in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ১৯৯৩, Vol. 1, পৃঃ ১১১)
ডঃ হেনরি বেনেটকে চিঠিটি লিখেছিলেন মেডিক্যাল কলজের প্রসূতিবিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ ডানকান স্টুয়ার্ট। স্টুয়ার্ট তাঁর চিঠিতে লেখেন – “মেডিক্যাল কলেজে একদা আমার সহযোগী বাবু মধুসূদন গুপ্ত এরকম কৌতূহলোদ্দীপক মেমোরেন্ডাম আমার জন্য প্রস্তুত করেছেন – ৫০ জন ভারতীয় মহিলার পোস্টমর্টেম করে, যাদের মৃত্যু অন্য কোন কারণে হয়েছে। আমাদের এই পর্যবেক্ষণ আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।” এরপরে মধুসূদন গুপ্তের যত্ন নিয়ে, খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তৈরি করা টেবিল ল্যান্সেট-এ ছাপা হয়েছিল। (ল্যান্সেট, ১৯ এপ্রিল, ১৮৫৬, পৃঃ ৪২৫)
আমরা একটু খোলা মনে ভাবলে বুঝবো, মধুসূদন গুপ্তের এই পথিকৃৎ প্রচেষ্টা কার্যত প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে জন্ম নেওয়া (একই সঙ্গে সমধর্মী বিকাশ ইংল্যান্ডেও হচ্ছিল) “হসপিটাল মেডিসিন”-এর স্তরের। ১৮৩০-এর দশক থেকেই মেডিসিন ক্লদ বার্নার্ড, রুডলফ ভির্কো, হেলমহোলৎস, মুলার, কার্ল লুডভিগদের হাত ধরে প্রবেশ করছে যাকে এখন বলা হয় “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর দুনিয়ায়। এমনকি আমরা আগের অধ্যায়েও যেখানে সুয়েজ খালে অবাধ বাণিজ্যের জন্য ব্রিটিশরা তাদের কলেরা নীতি ও তত্ত্বের গোড়া ধরে পরিবর্তন ঘটালো, সেখানেও আলোচিত হয়েছে কিভাবে মেডিসিনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়েছে ফিজিক্সের টেলিগ্রাফিক ব্যবস্থা, কেমিস্ট্রির disinfection সংক্রান্ত নতুন জ্ঞান এবং কোষ ও মাইক্রোস্কোপকে নতুনভাবে চেনা ও বোঝার নতুন অধ্যায়।
এই নতুন অধ্যায় সম্পর্কে রাসেল মলিজ (Russel Maulitz) বলেছেন – “The emergence of the particular form of histopathology that has lasted to the present day, its primogeniture properly credited to Muller’s student, Rudolf Virchow, may be seen in part, but only in part, as a paradigm shift from the Schwannian notion of blastema to Virchow’s concept of cellular continuity.” (“The Pathological Tradition”, in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ed. W. F. Bynum and Roy Porter, Vol. 1, পৃঃ ১৮১) পরে আরও পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন – “Without the microscope, the cell could be considered in merely impressionistic terms. By emphasizing the role of the instrument, cellular pathology provided the focus for the development of pathology as a separate speciality.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮২)
এ কথাগুলোর বলার অর্থ, আন্তর্জাতিক জগতে একই সময়ে মেডিসিনের বিজ্ঞানের একটি শাখা (আবার এর অতিরিক্তও বটে) হয়ে ওঠার কী কী ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিল সে বিষয়গুলোকে বুঝে নেওয়া। এতে মধুসূদন গুপ্তের অধ্যবসায়ী কাজ আদৌ লঘু হয়না। কিন্তু উপনিবেশিক দেশে যদি উপনিবেশের কেন্দ্রের মতো একই ধরণের জ্ঞানচর্চা হত তাহলে মধুসূদনের মতো আরও অনেক মেধা পূর্ণ বিকাশের সুযোগ পেত।
মেডিক্যাল কলেজের রিপোর্ট – ১৮৯৯-১৯০০
১৮৯৯-১৯০০ সালের রিপোর্টে জানানো হল – “The most important fact in the matter of medical education in connection with the Education Department was that from June 1899 the control of medical education passed from the hands of the Director of Public Instruction to those of the Inspector-General of Civil Hospitals, Bengal.” (GRPI 1899-1900, পৃঃ ১০৬) অর্থাৎ ১৮৩৫ সাল থেকে মেডিক্যাল শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ছিল ডিরেক্টর অফ পাবলিক এডুকশনের হাতে। সে নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরিত হয়ে বাংলার ইন্সপেক্টর-জেনারেল অফ সিভিল হসপিটালের হাতে এল। এবং এটাও জানানো হল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত রয়েছে কেবলমাত্র একটি মেডিক্যাল কলেজ – মেডিক্যাল কলেজ, ক্যালকাটা। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৬)
মেডিক্যাল কলেজে তখন ৩ ধরণের ক্লাস চালু ছিল – (১) যারা ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা পাশ করে কলেজে পড়াশুনো করছে, (২) মিলিটারি ছাত্রদের মেডিক্যাল শিক্ষার বিভাগ, এবং (২) ফিমেল সার্টিফিকেট ক্লাস, যেখানে এনট্রান্স পরীক্ষায় পাশ নারী শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এ কলেজের ছাত্ররাই কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় বসার অধিকারী। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৬)
কলেজের নিজস্ব ছাত্রের সংখ্যা এই সেশনে ৪৫৫ জন ছিল। রিপোর্টে মন্তব্য করা হয় – “বাস্তবত ছাত্রদের মাঝে যে মেডিক্যাল শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে এমনটা বলা যাবেনা।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭)
ম্যাট্রিক পাশ করে যে সমস্ত ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে তাদের শিক্ষাগ্রহণের সময়কাল ৫ বছরের বেশি। প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের পরে ছাত্রদে ওপরের ক্লাসে ওঠার জন্য কলেজের টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং পঞ্চম বর্ষের ছাত্রদের যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট এলএমএস, ফার্স্ট এমবি এবং সেকেন্ড এলএমএস ও সেকেন্ড এমবি পরীক্ষায় বসতে হয়। “Promotion from the third-year to the fourth year class is given on the results of the University examination. Students of the first and second-year classes who fail a second time, at the same stage, to gain promosion (sic) to the next higher class are removed from the college.” অর্থাৎ, একই ক্লাসে দুবারের বেশি ফেল করলে ছাত্রদের কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৮)
নীচে নারী শিক্ষার্থীদের টেবিল দেওয়া হল।
নীচের টেবিলে মহিলা ডাক্তারেরা কে কোথায় চাকরি পেয়েছেন তার টেবিল দেওয়া হল।
এ প্রসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যসূচির কিছু পরিবর্তনের খবর দেওয়া উচিত। ১৯০৪ সালে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আমূল কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয় Indian Universities Act, 1904 নামে – কার্জনের শাসনকালে। এর ফলে মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হল। ১৯০৬ সালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএস ক্লাস অবলুপ্ত হল (Proceedings no. 600 of GOI, Home Dept., 11th August)। ১৯১৩ সালে শেষ ব্যাচের এলএমএস পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইনের আগে মেডিক্যাল কলেজে দুটি ক্লাস ছিল – জুনিয়র এবং সিনিয়র। জুনিয়র ক্লাসে পড়ানো হত অ্যানাটমি, কেমিস্ট্রি, বোটানি, মেটেরিয়া মেডিকা, ফিজিওলজি ও কম্প্যারেটিভ অ্যানাটমি এবং জুলজি। সিনিয়র ক্লাসের পাঠ্যতালিকায় ছিল মেডিসিন, সার্জারি, মিডওয়াইফারি, মেডীকয়াল জুরিসপ্রুডেন্স, প্যাথলজি, অপথ্যালমিক মেডিসিন ও সার্জারি, হাইজিন, ডেন্টাল সার্জারি, ক্লিনিকাল মেডিসিন এবং অপারেটিভ সার্জারি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল হসপিটাল প্র্যাকটিস। ১৯০৮ সালে কম্প্যারেটিভ অ্যানাটমি এবং জুলজিকে অপসারিত করে বায়োলজির নতুন অধ্যাপক পদ তৈরি করা হল। এতে বোঝা যায় মেডিসিন শিক্ষায় বায়োলজির গুরুত্ব বাড়ছে।
শুধু তাই নয়, প্র্যাকটিকাল ক্লাস যুক্ত হল এর সঙ্গে। ১৯০৯ সালে যখন এভাবে ক্লাস করার অনুমতি সরকারিভাবে পাওয়া গেল তখন আর ই লয়েড এ বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব নিলেন। তাঁর সাথে ১ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং ২ জন ডেমনস্ট্রেটরও নিযুক্ত হলেন এই বিভাগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আপৎকালীন পরিস্থিতিতে লয়েড যখন ইংল্যান্ডে ফিরে যান তখন বায়োলজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন ডঃ একেন্দ্রনাথ ঘোষ। তবে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। (Centenary, পৃঃ ৬৭)
১৯০৬ সাল পর্যন্ত ফিজিক্স পৃথক সাবজেক্ট হিসেবে পড়ানো হতনা। কেমিস্ট্রির অধ্যাপকই ১০-১৫টি লেকচার দিতেন ফিজিক্সের নিতান্ত সাধারণ প্রাথমিক বিষয়গুলোর ওপরে। ১৯০৭ সাল থেকে ফিজিক্স পৃথক বিষয় হিসেবে পড়ানো শুরু হল। ১৯১২ সালের জুন মাসে ফিজিক্সের অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হল। ১৯২৭ সালে ফিজিক্সের নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি হল। ১৯১৪ থেকে ফাইনাল এমবি পরীক্ষা বছরে দুবার করে নেওয়া শুরু হল। ১৯১৬ সালে কলেজে ভর্তির ন্যূনতম মান স্থির হল I.Sc. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৮)
এরপরে ১৯২১ এবং ১৯২৬ সালে কলেজে ভর্তি হবার নিয়মকানুন ও আবশ্যিক বিষয়ের আরও পরিবর্তন ঘটানো হয়। সেকেন্ড এমবি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ২টি নতুন ও অতিরিক্ত পরীক্ষা যুক্ত হল – (১) ফার্মাকোলজি এবং মেটেরিয়া মেডিকা “including Pharmacopoeial Chemistry”, এবং (২) “Elementary Bacteriology and Pathology”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯)
১৯২৩ সাল নাগাদ ভারতের অতি বেশি মৃত্যুহার নিয়ে ইংল্যান্ডে যথেষ্ট শোরগোল পড়ে। এর পরিণতিতে ভারতের মেডিক্যাল শিক্ষার হাল বোঝার জন্য ইংল্যান্ড থেকে প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। দুর্ভাগ্যজনক বিতর্কের ফলশ্রুতিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ডিগ্রির যে স্বীকৃতি General Medical Council of Great Britain দিয়েছিল সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ৩০ নভেম্বর, ১৯২৪ সালে। ১৯২৭ সালে সাময়িকভাবে স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু এই স্বীকৃতি আবার প্রত্যাহৃত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০ সালে। “Ultimately an Act, known as Act No. XXVII of 1933, has been passed by the Indian Legislature in September, 1933. A Medical- Council has been constituted to exercise the same functions as the General Medical Council in Great Britain, which will now grant recognition to medical qualifications offered by medical institutions in British India.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৩)
এসবের পরে মেডিক্যাল কলেজে যে সমস্ত বিষয়ে অধ্যাপকের পদ চালু হল সেগুলো এরকম – (১) বোটানি এবং জুলজি – ১ জন, (২) কেমিস্ট্রি – ১ জন, (৩) ফিজিক্স – ১ জন, (৪) অ্যানাটমি – ১ জন, (৫) ফিজিওলজি – ১ জন, (৬) ফার্মাকোলজি – ১ জন, (৭) প্যাথলজি – ১ জন, (৮) মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স – ১ জন, (৯) অপথ্যালমিক সার্জারি ১ জন, (১০) মেডিসিন – ১ জন, (১০) ক্লিনিকাল মেডিসিন – ১ জন, (১১) সার্জারি – ১ জন, (১২) ক্লিনিকাল সার্জারি – ১ জন, (১৩) হাইজিন – ১ জন, (১৪) ডেন্টিস্ট্রি – ১ জন, (১৫) মিডওয়াইফারি – ১ জন, এবং (১৬) ক্লিনিকাল মিডওয়াইফারি – ১ জন।
১৯০৬-এর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তিত নতুন নিমানুযায়ী, মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যসূচি ছিল এরকম –
(১) প্রথম বছরের ছাত্ররা পড়বে বিজ্ঞানের গোড়ার বিষয়গুলো, যেমন ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি, বোটানি, ফিজিক্স এবং জুলজি – বুনিয়াদি বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয় অধিকতর গুরুত্ব পেল,
(২) পরবর্তী ২ বছরে পড়বে অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি, ফার্মেসি, মেটেরিয়া মেডিকা ও থেরাপিউটিকস এবং অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি। ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার বিভিন্ন অরগ্যানিক যৌগকেও আয়ত্ব করতে হবে।
(৩) কোন স্বীকৃত হাসপাতালে অন্তত ৩ বছর মেডিসিন (সাথে থেরাপিউটিকস, স্পেশাল প্যাথলজি এবং মানসিক রোগ), এবং সার্জারি (সাথে অপথ্যালমোলজি, মিডওয়াইফারি ও গাইনেকোলজি) হাতেকলমে শিখবে। এগুলোকে বলা হত “মেজর সাবজেক্টস বা পার্ট ১”। এবং জেনারেল প্যাথলজি (এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্যাক্টেরিওলজি ও প্যারাসিটোলজি), মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স এবং হাইজিন। এদেরকে একসঙ্গে বলা হত “মাইনর সাবজেক্টস বা পার্ট ২”। মেজর সাবজেক্টস-এর পরীক্ষা বছরে একবার নেওয়া হত। মাইনর সাবজেক্টস-এর পরীক্ষা নেওয়া হত বছরে ২ বার। এই দুটি পরীক্ষা আলাদা আলাদা করে কিংবা একসাথেও নেওয়া যেত।
এ সময়ে বাংলায় ৩ ধরণের মেডিক্যাল ডিগ্রি অনুমোদিত ছিল – (১) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে এমবি ডিগ্রি, (২) স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির সদস্যপদ (এই ডিগ্রি পুরনো এলএমএস ডিগ্রির তুল্য ছিল এবং ১৯৩২ পর্যন্ত এদের পাঠ্যক্রমের সময়কাল ছিল ৫ বছর। ১৯১৭ সালে প্রথম সদস্যপদের পরীক্ষা নেওয়া হয়), এবং (৩) লাইসেনশিয়েট অফ স্টেট মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি (এতে পাঠ্যক্রমের সময়কাল ছিল ৪ বছর। প্রথম লাইসেনশিয়েট পরীক্ষা নেওয়া হইয় ১৯১৫ সালে)। Centenary-তে মন্তব্য করা হয়েছিল – “It is significant to note that Licentiates themselves are now trying to get their course of studies in medical schools extended to 5 years, as has already been done in Madras.” (পৃঃ ৭১-৭২)
১৯২৮ সালে ফাইনাল এমবি পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে নতুন চেহারায় এরকম হল – মেডিসিন, অ্যাপ্লায়েড অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি, ক্লিনিকাল প্যাথলজি ও থেরাপিউটিকস, সার্জারি, নাক-কান-গলার রোগ, অপথ্যালমোলজি, ডেন্টিস্ট্রি, অর্থোপেডিকস, ভেনেরাল ডিজিজেজ (যৌন রোগ), মিডওয়াইফারি। এভাবে “the regulations for the Calcutta Degree are planned on the same general lines as those for the London Degree though they are not identical in every detail. The minimum length of the course is 6 months longer than the minimum length of the London Course (5 and 1/2 years).” (Centenary, পৃঃ ৭০)
পাঠ্যক্রমে উপরোক্ত পরিবর্তনগুলো হবার পরেও আবার সিলেবাসের পরিবর্তন হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া শেখার সময় ৫ বছর থেকে বেড়ে ৬ বছর হল। নতুন পাঠ্যক্রমে যেসব বিষয়ের ওপরে লেকচার দেওয়া হবে বলে স্থির হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে – প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসি, মাইনর সার্জারি ও ব্যান্ডেজিং, ক্লিনিকাল মেথডস, কুষ্ঠ, চর্মের বিভিন্ন রোগ এবং রেডিওলজি। এই পরিবর্তনের সময়কাল ১৯২০-৩০-এর দশক।
অনেকগুলো বিষয়ের ওপরে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের পদ তৈরি হল – (১) বায়োলজি, (২) ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি, (৩) অ্যানাটমি, (৪) ফিজিওলজি, এবং (৫) প্যাথলজি। এই বিষয়গুলোর ওপরে ডেমনস্ট্রেটর পদও তৈরি করা হল। অর্থাৎ অধ্যাপকের অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের এই দুধরণের পদবিন্যাস – মেডিক্যাল শিক্ষার কাঠামো মজবুত ও আধুনিক হয়ে উঠছে।
মেডিক্যাল কলেজের ৬ বছরের শিক্ষাক্রমের সময়সীমা এভাবে নির্ধারিত হয়েছিল –
প্রথম বছর – কেমিস্ট্রিতে ৬৮টি লেকচার, ৬০টি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। ফিজিক্সে ৭৩টি লেকচার এবং ৬০টি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ও ডেমনস্ট্রেশন। বোটানিতে ২৫টি লেকচার এবং ৩৩টি প্র্যাকটিক্যাল ডেমনস্ট্রেশন। জুলজিতে ২৫টি লেকচার এবং ২৯টি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। এছাড়াও মানুষের অস্টিওলজির (হাড়গোড়ের) ওপরে ডেমনস্ট্রেশন এবং “সুপিরিয়র এক্সট্রিমিটি”-র (দেহের উর্ধাংশ) ডিসেকশন করতে হত।
দ্বিতীয় বছর – বায়ো-ফিজিক্স ও বায়ো-কেমিস্ট্রি সহ ফিজিওলজিতে ৫০টি লেকচার। হিস্টলজিতে ৫৬ ঘন্টা প্র্যাকটিক্যাল করতে হত। এমব্রায়োলজি (embryology) সহ অ্যানাটমিতে ৫০টি লেকচার এবং “ইনফেরিয়র এক্সট্রিমিটি” (দেহের নিম্নাঙ্গ), thorax and abodomen-এর ডিসেকশন বাধ্যতামূলক ছিল।
তৃতীয় বছর – বায়ো-ফিজিক্স ও বায়ো-কেমিস্ট্রি সহ ফিজিওলজিতে ৫০টি লেকচার। ফিজিওলজিকাল কেমিস্ট্রি এবং এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিওলজিতে ৫৬ ঘন্টার প্র্যাকটিক্যাল। এমব্রায়োলজি (embryology) সহ অ্যানাটমিতে ৫০টি লেকচার। হাড়ের ওপরে ডেমনস্ট্রেশন এবং head, neck and superior extremity-র ডিসেকশন। মেটেরিয়া মেডিকায় ২০টি লেকচার এবং প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসিতে ১২টি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস।
মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমে বায়ো-ফিজিক্স এবং বায়ো-কেমিস্ট্রির প্রবেশ হল।
চতুর্থ বছর – ব্যাক্টেরিওলজি ও parasitology সহ প্যাথলজিতে ৭৮টি লেকচার। প্র্যাকটিক্যাল প্যাথলজি ও ব্যাক্টেরিওলজিতে ৬০টি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। ফার্মাকোলজিকাল কেমিস্ট্রি ও এক্সপেরিমেন্টাল ফার্মাকোলজি সহ ফার্মাকোলজিতে ৫০টি লেকচার। থেরাপিউটিকস সহ মেডিসিনে ৬০টি লেকচার। ক্লিনিকাল মেডিসিনে ৩০টি লেকচার। “Minor surgery and bandaging”-এ ৩০টি লেকচার। মেটেরিয়া মেডিকা এবং প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসিতে ২০টি লেকচার। “Administration of Anaesthetics”-এ ১০টি কেস দেখতে হত এবং হসপিটাল ইনস্ট্রাকশনে ১ বছর প্রশিক্ষণ নিতে হত।
পঞ্চম বছর – থেরাপিউটিকস সহ মেডিসিনে ৬০টি লেকচার, অর্থোপেডিকস সহ সার্জারিতে ৬০টি লেকচার, অপথ্যালমিক সার্জারিতে ২০টি লেকচার, জুনিয়র মিডওয়াইফারিতে ১০টি লেকচার, টিউবারকিলোসিস, শিশুদের রোগ ও ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ সহ ক্লিনিকাল মেডিসিনে ৬০টি লেকচার, মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সে ১০টি লেকচার, হাইজিনে ৩০টি লেকচার, ভ্যাক্সিনেশনের থিওরি এবং প্র্যাকটিসের ওপরে ৬টি লেকচার, মানসিক অসুখের ওপরে ৮টি লেকচার, রেডিওলজিতে ১২টি লেকচার অ্যাটেন্ড করতে হত। এছাড়া ছিল ডেন্টাল সার্জারি ডেমনস্ট্রেশন, পুলিস মর্গে ১২টি ডেমনস্ট্রেশন, মিডওয়াইফারিতে ২০টি ডেমনস্ট্রেশন, এবং “Administration of Anaesthetics”-এ ১০টি কেস দেখতে হত এবং হসপিটাল ইন্সট্রাকশনে ১ বছর প্রশিক্ষণ নিতে হত।
টিউবারকিলোসিস এবং ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ আলাদা গুরুত্ব নিয়ে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হল।
ষষ্ঠ বছর – ভেনেরাল ডিজিজ (যৌন রোগ) এবং Administration of Anaesthetics সহ ক্লিনিকাল সার্জারিতে ২৫টি লেকচার এবং ৬ মাসের প্রশিক্ষণ, Ante-natal condition and infant hygiene সহ অ্যাডভানসড মিডওয়াইফারিতে ১০টি লেকচার, Museum demonstrations in special Pathology-তে ৮টি লেকচার, লেপ্রসিতে ৬টি, অ্যাপ্লায়েড অ্যানাটমিতে ২০টি, অপারেটিভ সার্জারিতে ১৫টি, নাক-কান-গলার রোগে (ENT) ১২টি, ডার্মাটোলজিতে একটি ছোট কোর্স এবং “spring term”-এ “hospital work”-এর প্রশিক্ষণ নিতে হত। (Centenary, পৃঃ ৭৬)
ওপরের পূর্ণাঙ্গ চিত্র থেকে বোঝা যায়, মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া শিখতে ও সমাপ্ত করতে কি কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হত। এরকম শিক্ষাক্রমের ভার অনেক ছাত্রই বহন করতে পারত না, মাঝপথে ছেড়ে দিত। কিন্তু যারা পাশ করে বেরতো তারা মেডিক্যাল শিক্ষার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখায় উপযুক্ত প্রশিক্ষিত হয়ে উচ্চ মানের ডাক্তার হয়ে সমাজে আত্মপ্রকাশ করত। এখানেই মেডিক্যাল কলেজের বৈশিষ্ট্য, এখানেই কলেজের নিজস্বতা ও আভিজাত্য – সে সময় অব্দি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ১৯২১ সালে ফার্মাকোলজির নতুন অধ্যাপক পদ তৈরি হল। রামনাথ চোপরা ফার্মাকোলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। এঁকে ভারতে “ফাদার অফ ফার্মাকোলজি” বলা হয়। ১৯২৮ সালে তাঁর পুস্তক Anthelmintics and their Uses in Medical and Veterinary Practice প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩ সালে তাঁর লেখা Indigenous Drugs of India এবং ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় A Handbook Of Tropical Therapeutics।
রামনাথ চোপরা শুধু নয়, ভারতীয় অধ্যাপকেরা এসময় দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হতে শুরু করেন – যেমন, অ্যানাটমিতে হীরালাল বোস, ফিজিক্সের অধ্যাপক হিসেবে তারকদাস কর, কেমিস্ট্রির অধ্যাপক হিসেবে চুণীলাল বোস, একেন্দ্রনাথ ঘোষের কথা এর আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯৩০ সালে মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ভারতীয় প্রিন্সিপাল হলেন Dwaraka Prasad Goil (D. G. Crawford, Roll of the Indian Medical Service, 1615-1930, Vol. 2, পৃঃ ৫২৮) এক অর্থে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকদের “ভারতীয়করণ” শুরু হল। এঁরা ছাড়াও যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন স্যার কেদারনাথ দাস (তাঁর উদ্ভাবিত obstetric forceps জগদবিখ্যাত), পশুপতি বসু (যিনি এমডি পরীক্ষায় ১৯৩২ সালে ১০০০ নম্বরের মধ্যে ৯৬৮ নম্বর পেয়েছিলেন, যে রেকর্ড ২০০৭ সাল পর্যন্ত অক্ষত ছিল) প্রমুখ।
যাহোক, এসময় দিয়ে এমবি এবং এমডি ডিগ্রির সাথে নতুন একাধিক ডিগ্রি কোর্স চালু হল – M.O. (Master of Obstetric Medicine), M.S. (Master of Surgery) এবং D.P.H (Diploma in Public Health)। “The method of teaching was also improved pari passu with the successive changes in the University regulations … The laboratories were literally supplied with apparatus, models and microscope and, for the first time in the history of the College, students were provided with microscope for practical work in Morbid Histology, Bacteriology, Practical Physiology and Physiological Chemistry … a whole-time Professor of Anatomy in 1911. A whole-time Professor of Physics was appointed in 1912.” (Centenary, পৃঃ ৬৬) এর আগে কলেজে মাত্র ১৪টি মাইক্রোস্কোপ ছিল। ফলে প্রথম ১৪ জন ছাত্র মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে পারত, বাকিরা থাকত শূণ্যহস্ত।
রবার্ট কখের ভারতে আগমন, আন্তর্জাতিক জগতে জীবাণুতত্ত্বের প্রসার, খোদ ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল বা ল্যান্সেট-এ ভৎর্সিত হওয়া ইত্যাদি সমস্ত ঘটনার সমাপতনে এবং ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন এলো – এমনকি প্রতিটি ছাত্রের জন্য একটি করে মাইক্রোস্কোপও বরাদ্দ হল।
এ সময় ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু হল। যারা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হবে তাদেরকে প্রথম বছর থেকেই ক্লাস করতে হত। কিন্তু যারা বিএসসি পাশ করে ভর্তি হত তারা যেহেতু বিজ্ঞানের গোড়ার বিষয়গুলো শিখে এসেছে তারা সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ক্লাস করতে পারত।
এছাড়া এসময় অব্দি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য “ফিমেল সার্টিফিকেট ক্লাস” চালু ছিল – ৪ বছরের শিক্ষাক্রম। এই ক্লাসটি General Medical Council of the Great Britain কর্তৃক স্বীকৃত ছিল। ১৯১৬ সালে নতুন নিয়মাবলী মেনে ক্লাসটি অবলুপ্ত হয়। একটি সরকারি রিপোর্টে বলা হচ্ছে – মহিলাদের জন্য ভারতে কোন আলাদা মেডিক্যাল কলেজ নেই। নারী-পুরুষ একসঙ্গে ক্লাস করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার থেকে জানা যায় যে ৩ জন মহিলা ব্যাচেলর অফ মেডিসিন ডিগ্রি পেয়েছেন। লেডি ডাফরিন ফান্ড দ্বিতীয় শ্রেণীর ডিগ্রি পেয়েছে ৭৫ জন মহিলা। (Progress of Education in India, 1897-98 to 1901-1902, Vol. I, 1904, পৃঃ ৩১৩) “ফিমেল সার্টিফিকেট ক্লাস”-এ, এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২ জন ছাত্রী ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৪)
উনিশ শতকের শেষভাগ – নতুন সোসাইটির জন্ম এবং কখের তত্ত্বের ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া
১৮৮১ সালে তৈরি হয়েছিল ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটি। যদিও মনে রাখতে হবে উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই ব্রিটেনের জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে তৈরি বিভিন্ন ডিবেটিং সোসাইটি এবং আলোচনা সভার অনুসরণে/অনুকরণে ভারতীয়দের উদ্যোগে বেথুন সোসাইটি, তত্ত্ববোধিনী সভার মতো সভা ও সোসাইটি ইত্যাদি যেমন জন্ম নিচ্ছিল, তেমনি এদেশে চিকিৎসারত ইংরেজ চিকিৎসকেরাও বহুসংখ্যক সোসাইটি গড়ে তোলে – দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চিকিৎসকদের মধ্যে জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য এবং ইউরোপের চিকিৎসকমহলে এখানকার অগ্রগতিকে তুলে ধরার জন্য। আমি এ বিষয়ে প্রথম খণ্ডে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। (জয়ন্ত ভট্টাচার্য, মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস – ১৮২২-১৮৬০, ২০২২)
১৮৮৭ সালে জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল মাইক্রোস্কোপিকাল সোসাইটি-তে (লন্ডন এবং এডিনবার থেকে যুগপৎ প্রকাশিত) একটি ছোট্ট খবর প্রকাশিত হয় “মাইক্রোস্কোপিকাল সোসাইটি অফ ক্যালকাটা” শিরোনামে। এ সংবাদে বলা হল – “A Microscopical Society has, on the suggestion of Mr. W. J. Simmons, been founded at Calcutta, with an entrance fee and annual subscription of five rupees.” (পৃঃ ৬৬৭) সে সময়ে ৫ টাকা নেহাত ফেলনা ছিলনা। নিয়ম হিসেবে ঠিক হয়েছিল, মাসে একবার করে মিটিং হবে। এটাই ছিল ভারতের প্রথম মাইক্রোস্ক্রোপিকাল সোসাইটি। বলা হল, “There must be a very large and very interesting field for microscopical work in that part of the world”। পোস্টমর্টেম এবং প্যাথজিকাল চর্চার জগত ছাড়িয়ে এবার মেডিসিন প্রবেশ করছে “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর জগতে – এমন ইঙ্গিত ধরা রইলো এ বিবরণে।
যাহোক, এবার আমরা উপরে যে দুটি সোসাইটির কথা উল্লেখ করেছি সে বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করব। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ (এপ্রিল ১, ১৮৮১) “দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটি” শিরোনামে একটি দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় – ক্যালকাটা মেডিক্যাল সোসাইটি-র তৃতীয় মিটিং যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজে।
একটু খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যাবে ডঃ হার্ভে, বিহারীলাল চক্রবর্তী, ডঃ ম্যাকলিওড, রায় বাহাদুর কানাইলাল দে, মৌলবী তমিজ খান বাহাদুর, গোপালচন্দ্র চ্যাটার্জি, মি. ওয়ালেস, সার্জেন কে পি গুপ্ত সহ আরও কয়েকজন চিকিৎসকের উপস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে (পৃঃ ১১২-১২১)। কিন্তু ১৮৮১ সালের মিটিংয়েও পুরনো ধরণে বিভিন্ন রোগ এবং রোগীর বর্ণনা, চিকিৎসার ধরণ এবং উল্লেখযোগ্য কিছু কেসের বিবরণে সীমাবদ্ধ থাকছে। তখনও ল্যাবরেটরি-কেন্দ্রিক আলোচনা এবং ভাবনার সূত্রপাত হয়নি। সহজ কথা হল, জ্ঞানতাত্ত্বিক যে পরিবর্তন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবল বেগে অগ্রসর হচ্ছিল সে পরিবর্তনের কোন উল্লেখযোগ্য ঢেউ এদেশে তখনও এসে পৌঁছয়নি, বৌদ্ধিক জগতে ধরা দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে ১৮৮৩ সালে ইজিপ্টের কলেরা মহামারি নিয়ে কাজ করার পরে (ততদিনে মিশরে কলেরা মহামারি প্রশমিত হয়েছে) রবার্ট কখ ভারতে এসে পৌঁছন ১৮৮৩ সালের শেষে। ভারতে তখন কলেরার প্রাদুর্ভাব চলছে। তিনি মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর কাজের মধ্যে ছিল – “performance of necropsies and the comparison of the microscopical findings with those seen in Egypt; attempts to grow the characteristic bacillus in pure cultures with a view to using them to produce experimental infections in animals; and investigations of the soil, water, and air, and of any special characteristics of the population and its environment in epidemic districts.” (Norman Howard-Jones, “Robert Koch and the cholera vibrio: a centenary”, British Medical Journal Volume 288, 4 February 1984, pp. 379-381, পৃঃ ৩৭৯)
১৮৮৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কখ জার্মান সেক্রেটারি অফ দ্য স্টেট ফর দ্য ইনটেরিওর-কে জানালেন, এই ব্যাসিলাসটি “আকৃতিতে সোজা (straight) নয়, “অল্প একটু বাকা, commar-র মতো”। ৪ মার্চ তাঁর ৭ম ডিসপ্যাচে লিখলেন যে তিনি মোট ৪০ জন কলেরা রোগীর ওপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন, এবং কলেরায় মৃত ৫২ জনের ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করেছেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮০)
হাওয়ার্ড-জোনস জানাচ্ছেন, এর আগের ৪টি স্যানিটারি কনফারেন্সে “convened expressly to formulate uniform maritime quarantine regulations” কোন ঐক্যমত্যে পৌঁছুনো যায়নি (আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আলোচনা এখানে স্মরণ করব)। যদিও ১৮৭৪ সালের চতুর্থ কনফারেন্সে যেখানে ২১টি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা সর্বসম্মতভাবে ভোট দিয়েছিলেন যে “চারপাশের ঘিরে থাকা বাতাস হল কলেরার জন্ম দেওয়া agent-এর প্রধান বাহক”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮০) হাওয়ার্ড-জোনস একে “almost mystical conception of cholera in many quarters” বলেছেন।
২৬ জুলাই, ১৮৮৪ সালে বার্লিনে “Conference for the discussion of cholera question” অনুষ্ঠিত হল প্রথমসারির জার্মান বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা। এ সভায় সেসময়ের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী Max von Pettenkofer (যিনি তাঁর বিচিত্র এবং অদ্ভুত কলেরার “গ্রাউন্ড ওয়াটার” তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে আছেন) অনুপস্থিত ছিলেন। JAMA (জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন)-র মতো নামী জার্নালে পেটেনকফারের তত্ত্ব নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে – “He had rather fixed opinions relative to the nature of cholera and typhoid and their means of transmission which have since been abandoned by all physicians and bacteriologists. All that can be said of him in these modern times is that he defended his views so vigorously and sincerely that they served as a stimulus to the discovery of the actual truth.” (JAMA, এপ্রিল ২১, ১৯২৮, পৃঃ ১৩২০)
যাহোক, কখের তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো এবং কঠোর আক্রমণ আসে ব্রিটেনের তরফে। ৬ আগস্ট, ১৮৮৪ সালে একটি ব্রিটিশ মিশন পাঠানো হয় কলকাতায় – কখের আহরিত ফলাফল সরেজমিনে দেখার জন্য। এই মিশনের সদস্য ছিলেন Emmanuel Klein, Heneage Gibbs এবং একজন টেকনিশিয়ান। তাদের রিপোর্টে বলা হয় পেটেনকফার হচ্ছেন কলেরা নিয়ে বর্তমানকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত অথরিটি। এরা “not only flatly repudiated Koch’s thesis but also dismissed the role of drinking water. To consider the report the Secretary of State for India appointed a committee of 13 distinguished physicians, eight of whom submitted memorandums endorsing the conclusions of Klein and Gibbes. One member, Sir William Gull, declared his conviction that “cholera as cholera does not produce cholera.” Another, Sir John Burdon-Sanderson (as he later became), stated in a public lecture that Koch’s investigations had been “an unfortunate fiasco.” (হাওয়ার্ড-জোনস, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮০)
এরপরে রোমে ১৮৮৫ সালের মে মাসে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক স্যানিটারি কনফারেন্সে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা সফলভাবে “blocked any “theoretical discussion on the aetiology of cholera,” though Koch himself was one of the German delegates.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮০)
এক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হল হাওয়ার্ড-জোনস নিজে একজন ব্রিটিশ, পরে জেনেভায় বসবাস করেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (WHO) তরফে The scientific background of the International Sanitary Conferences, 1851-1938 (1975)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক। ফলে প্রযুক্তি নয়, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির জীবানুতত্ত্ব নিয়ে ব্রিটিশের এই অবস্থান মেডিসিনের ক্ষেত্রে নতুন গবেষণাকে কতটা উৎসাহিত করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশের দ্বিধা ছিলনা। যে কারণে মাইক্রোস্কোপিকাল সোসাইটির জন্ম হয়েছে। কিন্তু মাইক্রোস্কোপ দিয়ে নতুন গবেষণা কি হয়েছে, সেইটে হল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। হাওয়ার্ড-জোনস তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেছেন – (১) ভারত থেকে কলেরা যে ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজে করে বিভিন্ন দেশে ছড়াচ্ছে এ বিষয়ে ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের প্রবল আপত্তি ছিল, এবং (২) একই বছরে কলেরার উৎসস্থল ভারতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদলের সরেজমিনে তদন্ত করাকে দেশীয় সার্বভৌমত্বের ওপরে আঘাত বলে ব্রিটিশ ডেলিগেটরা প্রতিরোধ করে। (The scientific background of the International Sanitary Conferences, 1851-1938, পৃঃ ৩১)
হাওয়ার্ড-জোনসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল – “Almost two decades later, at the sixth International Sanitary Conference in 1885, British delegates were to deprecate with an almost religious fervour the idea that cholera could be exported from India. The paradox is that, while their scientific thinking was hopelessly anachronistic, the measures that they advocated and adopted were completely in line with present practices.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৪) এখানেই ব্রিটিশের পরস্পর বিরোধী অবস্থান হল যে বাণিজ্যের লাভ এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য প্রযুক্তিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করবে, আবার বিজ্ঞানের তত্ত্ব এই লাভের ক্ষেত্রে ক্ষতি হবার কোনরকম সম্ভাবনা থাকলে যেকোন মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বন্ধ করে দেবে।
এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রাখলে আমাদের অনুমান করা খুব শক্ত নয় যে ভারতে জীবাণুতত্ত্বের প্রসার ঘটা অন্তত উনিশ শতকের শেষভাগ অব্দি প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু কখের কলকাতায় আগমন এবং মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কাজ হয়তো কলকাতার মাইক্রোস্কোপিকাল সোসাইটির জন্মের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকবে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে – “Koch’s discovery meant that access to clean water was necessary to prevent the spread of cholera. To that end, filtered water lines were placed in Calcutta. Soon the incidence of disease fell. Koch’s discovery was a public health triumph.” (Steve M. Blevins, Michael S. Bronze, “Robert Koch and the ‘golden age’ of bacteriology”, International Journal of Infectious Diseases, 14 (2010) e744–e751, পৃঃ e749) এবং কলকাতার বাস্তব ক্ষেত্রে, কখের আবিষ্কারকে নস্যাৎ করলেও, কলকাতায় এরপরে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৬৮ সালে এশিয়ার প্রথম ঘরে ঘরে জল সরবরাহের ব্যবস্থা শুরু হয় কলকাতায়। ১৮৮৮-১৮৯৩ সালের মধ্যে পলতায় নতুন প্ল্যান্টের সাহায্যে পরিস্রুত জল সরবরাহের ব্যবস্থা শুরু করা হয়।
১৮৯১ সালের এপ্রিল মাসের সংখ্যায় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ “মাইক্রোস্কোপিকাল সোসাইটি অফ ক্যালকাটা” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে বলা হয় – “The Calcutta Microscopical Society is the only one east of the Suez Canal and was founded in June 1887.” ১৮৮০ সালেই এরকম একটি সোসাইটি তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হবার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় এক পত্রিকায় চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত হতে ৭ বছর সময় লাগল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০) সোসাইটির কাজের একটি নিদর্শন হিসেবে জানানো হল – “Mr. Simmons has brought to notice the records of his observations on the parasites which infest the white ant in Bengal; on the mango weevil, and on certain of the less known Infusoria, such as the Podophyras, Amoebae, and more recently on a Rhizopod, which so far as we know has heretofore only been found in the fresh-waters of North America by Dr. Leidy and in India by Mr. Simmons.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১১)
আজ আমরা মেডিক্যাল কলেজের যে নতুন অ্যানাটমি বিল্ডিং দেখি সেটাকে গড়ে তোলার প্রধান কৃতিত্ব তৎকালীন অ্যানাটমির অধ্যাপক স্যার হ্যাভেলক চার্লসের – ১৮৯৬ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে। ১৯১০ সালে নার্সদের পুরনো কোয়ার্টার্স ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি হয়। একই বছরে শেষ হয় প্রিন্স অফ ওয়েলস হাসপাতাল তৈরির কাজ। ১৯২৩ সালে নতুন Eye Hospital তৈরি হয়। ১৯২৬ সালে বাংলার কুখ্যাত গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন এর উদ্বোধন করেন। ১৯২৬ সালেই এক্স-রে ডিপার্টমেন্ট এবং এজরা হাসপাতাল চালু হয়। ১৯২৫ সালে প্যাথলজি বিল্ডিংয়ের একতলা এবং দোতলা নতুন করে তৈরি করা হয় বায়োলজি এবং ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির স্থান সংকুলানের জন্য।
১৭ জুলাই, ১৮৮২ সালে ইডেন হাসপাতাল তৈরি হলেও ১৯৩১ সালে এর সম্প্রসারণ ঘটে। ১৯৩১ সালেই ENT এবং Dental Department স্থানান্তরিত হয় পুরনো চোখের হাসপাতালের জায়গায়। ৩০ ডিসেমবর, ১৯৩২ সালে All India Institute of Hygiene and Public Health প্রতিষ্ঠিত হল। D.P.H. ক্লাস নেওয়া শুরু হল এখানে, এবং D.T.M. এবং L.T.M. ক্লাস শুরু হল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। (Centenary, পৃঃ ৮৮-৮৯)
মাইক্রোস্কোপ, হাসপাতাল, জীবাণুতত্ত্ব – সাম্রাজ্যবাদের নতুন জ্ঞানাঞ্চল ট্রপিক্যাল মেডিসিন
ল্যাবরেটরি মেডিসিনের গুরুত্ব মেডিসিনের জগতে সংশয়াতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরিণতিতে বিভিন্ন অজানা রোগের উৎস হিসেবে নিত্যনতুন জীবাণু আবিষ্কৃত হতে শুরু করল। মেডিসিনের জগতে প্রাধান্যকারী পূতিবাষ্পের তত্ত্ব (miasmatic theory) বিদায় নিল। এতদিন যে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলকে, প্রধানত এশিয়া এবং আফ্রিকাকে, মনে করা হত চিরস্থায়ী ইউরোপীয় উপনিবেশের অনুপযুক্ত “exotic” “torrid zone” হিসেবে তার পরিবর্তে এসব অঞ্চলে যে ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে তার উৎস হিসেবে নির্ণীত হল বিভিন্ন ধরনের জীবাণু বা ভেক্টর, ছত্রাক বা ব্যাক্টেরিয়া। ফলে এদের জব্দ করার নতুন সব উপায় আবিষ্কৃত হতে শুরু করল। মেডিসিনের প্রধান শাখা ক্লিনিক্যাল মেডিসিন আরও প্রসারিত রূপে আবির্ভূত হল, যার নতুন নাম দেওয়া হল “ট্রপিক্যাল মেডিসিন”। মেডিসিনের এই নতুন শাখার হাতিয়ার হল মাইক্রোস্কোপ এবং জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology) হল রোগের জার্ম থিওরি। নন্দিনী ভট্টাচার্য বলেছেন – “The institutionalization of ‘Tropical Medicine’, a medical specialism that was distinguished by laboratory medicine energized by the insect-vector theories of filaria, malaria, sleeping sickness and affirmed by the final conquest of Africa and most of Asia, also established the links between ‘tropical’ diseases and the environment, parasites, insect hosts and partly immune ‘native’ populations. This reinforced the links between tropical colonies and disease.” (“Disease and Colonial Enclaves”, Contagion and Enclaves: Tropical Medicine in Colonial India, 2012, পৃঃ ২)
১৯১০ সালে ইংলেশম্যান সংবাদপত্রে মার্চ মাসে প্রকাশিত আসামের চায়ের বাগানে কর্মরত ডাক্তার McCabe Dallas-এর একটি চিঠিতে প্রস্তাব দেওয়া হল যে কলকাতায় ট্রপিক্যাল ডিজিজের গবেষণা সংক্রান্ত একটি রিসার্চ ইন্সটিটিউট তৈরি করা হোক। এরপরে এ বিষয়ের ওপরে একের পর এক চিঠি প্রকাশিত হতে থাকে – “the Medical College Hospital could provide the necessary clinical material, and the enhanced pathological and physiological laboratories the scientific site. The author of the leading article was Leonard Rogers, who as professor of pathology at the Medical College was involved in pressing the GoB (গভর্নমেন্ট অফ বেঙ্গল) for improved teaching and research space in the biology laboratories, and he had taken the opportunity of bringing the desirability of strengthening government research facilities into the public arena.” (Helen Power, “The Calcutta School of Tropical Medicine: Institutionalizing medical Research in the Periphery”, Medical History, 1996, 40: 197-214, পৃঃ ২০১)
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ গুরুত্ব দিয়ে “Proposed School of Tropical Medicine in Calcutta” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হল (এপ্রিল ২৩, ১৯১০)। এ কাজের জন্য মেডিক্যাল কলজের গুরুত্ব বোঝাতে বলা হল – “In the Medical College Hospital that city possesses the premier hospital and medical school in the East … Enough has been said to indicate that Calcutta presents unique facilities, as far as clinical cases are concerned, for a school of tropical medicine. The other essential is suitable laboratory accommodation, and in the well known pathological and physiological laboratories of the Medical College Hospital this already exists … The English schools of tropical medicine have done invaluable pioneer work, and are essential for the training of those about to enter on their labours in hot countries.” (পৃঃ ১০১০)
তাহলে দাঁড়ালো এই যে একটি মেডিক্যাল কলেজ চাই, সেখানকার ল্যাবরেটরি ও মাইক্রোস্কোপের সুবিধে পেতে হবে, যেভাবে যুদ্ধের চেয়ে বেশি শ্বেতাঙ্গ এখানকার রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে তার জন্য নতুন অনুসন্ধান চালাতে হবে এবং একটি নতুন জ্ঞানাঞ্চল তৈরি হবে বিস্তীর্ণ “ট্রপিক্যাল” অঞ্চলকে বোঝার তাগিদে – সাম্রাজ্যবাদকে আরও শক্ত ভিতের ওপরে প্রসারিত করার জন্য। ততদিনে জীবাণুতত্ত্ব এই জ্ঞান উৎপাদনের নতুন হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এবং ভারতে এই নতুন বৈজ্ঞানিক কর্মযজ্ঞের ভরকেন্দ্র ছিল মেডিক্যাল কলেজ।
মেডিক্যাল কলেজের আরেকটি পরোক্ষ প্রভাব ছিল ট্রপিক্যাল মেডিসিন মেডিক্যাল শিক্ষার একটি শাখা এবং আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্ম নেবার ক্ষেত্রে। Charles Padrey Lukis ১৯১০ সালে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। ডিরেক্টর জেনারেল হবার আগে মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল এবং মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পুস্তক Tropical hygiene for Anglo-Indians and Indians এবং ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হল Tropical hygiene for residents in tropical and subtropical climates।
হেলেন পাওয়ার জানাচ্ছেন – “He wanted to assemble a further set of suitably-trained men, arguing that experts should be immediately available during crises, and that it was impractical to wait up to two years for sanction from the Secretary of State in London. With Sir Harcourt Butler’s help, he set up the Indian Research Fund Association (IRFA), directly responsible to and funded by the GoI, and administered by a scientific advisory board. This was similar to the Medical Research Council, which was formed in Britain two years after Lukis and Butler’s success in India, and shows that India was not dilatory in all matters of medical organization.” (Power, “The Calcutta School of Tropical Medicine”, পৃঃ ২০০)
১৯০৬ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাব তৈরি হয় – এশিয়াটিক সোসাটির মেডিক্যাল সেকশন হিসেবে। ওখানে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা হত। ১৯০৮ সালে এই ক্লাবেরই একটি ঘরে Clinical Research Association শুরু হয়েছিল। ভারতের পূর্বাঞ্চলে সরকারি সহযোগিতার বাইরে অসরকারি ডাক্তারদের উদ্যোগে গবেষণাকর্মকে উৎসাহিত করার এটাই প্রথম প্রচেষ্টা।
হেলেন বাইনুমের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী – “Research in tropical medicine, as exemplified by the investigation of parasites and their insect vectors, was well suited to the increasing role of the laboratory in medical practice, teaching and research.” (Helen Bynum, “The Calcutta School of Tropical Medicine: Foundation to Opening, 1910-21” in Science and Modern India: An Institutional History, c. 1784-1947, ed. Uma Dasgupta, 2011, pp. 591-622, পৃঃ ৫৯২)
একসময় যেমন ব্রিটিশ, ডাচ, ড্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি বিভিন্ন “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” তৈরির ধূম পড়েছিল, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সেরকম আমেরিকা ইউরোপের দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন তৈরির হিড়িক পড়লো। ১৮৯৯ এবং ১৮৯৮ সালে যথাক্রমে লন্ডন এবং লিভারপুলের স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমেরিকা ম্যানিলাতে ১৯০২ সালে একই উদ্দেশ্যে পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি তৈরি হল। জার্মানদের তরফে সমধর্মী উদ্যোগে ১৯০০ সালে হামবুর্গে Institut fur Schiffs- und Tropenkrankheiten প্রতিষ্ঠিত হল। ব্রাসেলসে ১৯০৬ সালে। কুয়ালালামপুরে ১৯০০ সালে। আফ্রিকায় তৈরি হল Wellcome Tropical Laboratory। কায়রো এবং তিউনিসেও তৈরি হল Pasteur Institute। ফ্রান্সে ১৮৯০-এর দশকের পরে তৈরি হল “ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিন” এবং পর্তুগালে ১৯০২ সালে। আমেরিকায় “আমেরিকান সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন” প্রতিষ্ঠিত হল ১৯০৩ সালে। ১৯২১ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন আত্মপ্রকাশ করল। ১৯১৩ সালে বিশ্বে ট্রপিক্যাল মেডিসিন নিয়ে প্রথম কংগ্রেস হল লন্ডনে – তৎকালীন দুনিয়ায় জ্ঞানের কেন্দ্রে।
এ প্রসঙ্গে একটি ভুল শুধরে নেবার প্রয়োজন আছে। হেলেন পাওয়ার এবং হেলেন বাইনুম দুজনেই পুনম বালার একটি পুস্তককে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে ১৮২৪ সাল থেকে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদেরকে এলএমএস এবং এমবি ডিগ্রি দেবার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। এরকম মারাত্মক ভুল কিভাবে পুনম বালা সহ ৩ জনই করলেন এটা বিস্মিত করার মতো। মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে ১৮৩৫ সালে, এবং ১৮৬১ সাল থেকে এই ডিগ্রিগুলো দেওয়া হয়। এ এক চরম ঐতিহাসিক প্রমাদ।
যাহোক, “ট্রপিক্যাল মেডিসিন”-এর জনক স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার Tropical Diseases পুস্তকের ভূমিকায় জানিয়েছিলেন – “The title which I have elected to give to this work, TROPICAL DISEASES, is more convenient than accurate. If by “tropical diseases” be meant diseases peculiar to, and confined to, the tropics, then half a dozen pages might have sufficed for their description”। তাহলে দুটি বিষয় বোঝা গেল – (১) ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ এই শব্দবন্ধ যত না সঠিক তার চাইতে বেশি সুবিধেজনক, এবং (২) হাফ ডজন পাতায় এই বিশেষ রোগের বর্ণনা করে ফেলা যায়, যদি শুধুমাত্র “ট্রপিকস”-এর বিবরণ দেওয়া যায়। তাহলে প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার বৃহৎ পুস্তক লিখতে হল কেন? এর উত্তর দিয়েছেন ম্যানসন – “I employ the term “tropical” in a meteriological rather than geographic sense” – অর্থাৎ ভৌগোলিক অর্থের পরিবর্তে আবহাওয়া সংক্রান্ত অর্থে এই টার্মকে ম্যানসন ব্যবহার করেছেন। এরপরে বললেন – “In the tropics, as in temperate climates, in the European and in the native alike, nearly all disease is of specific origin … Modern science has clearly shown that nearly all diseases, directly or indirectly, are caused by germs.”
তিনি জানালেন প্রকৃত অর্থে “two or three comparatively unimportant diseases strictly deserve that title”। অস্যার্থ, ট্রপিক্যাল ডিজিজের চরিত্রগতভাবে গোত্রভুক্ত দুটি বা তিনটি রোগ। তাসত্ত্বেও এই বৃহদাকৃতি পুস্তক রচনার কারণ “the expression “tropical diseases” be held to include all diseases occurring in the tropics, then the work would require to cover almost the entire range of medicine; for the diseases of the temperate climates are also, and in almost every instance, to be found in tropical climates.”
কার্যত যেটা হল তাহল একদিকে “tropical diseases” দিয়ে আলাদা করে ভৌগোলিকভাবে ‘নেটিভরা’ এক বিশেষ অঞ্চলের বাসিন্দা তথা সাদা সাহেবদের ‘অপর’ (other) এটা যেমন জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে প্রতিষ্ঠিত হল, অন্যদিকে তেমনি “the diseases of the temperate climates are also, and in almost every instance, to be found in tropical climates” এই সূত্রায়নের ফলে মূল ধারার মেডিসিনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ। পরিণতিতে মূল ধারার ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের পরিধি আরও বিস্তৃত হল – প্রভুত্বকারী ইউরোপীয় মেডিসিনের ‘self’-এর মাঝে আত্মীকৃত হল ‘other’ ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ। এর জন্য ইউরোপীয় স্যানিটেশন এবং হাইজিনকে নেটিভদের জীবনযাত্রার অঙ্গীভূত করে তুলতে হবে। এর ফলশ্রুতি হল – “An essential aspect of these activities was, moreover, to instil the population at large with an adequate understanding of the principles of governing health and sickness … Medicine thus acquired a political status inasmuch as it gained a new relevance to the interests of the state.” (Stephen Jacyna, The Western Medical Tradition 1800 to 2000, 2006, p. 82) আধুনিক রাষ্ট্রের ‘গভার্নেন্স’-এর বিভিন্ন টেকনিক আয়ত্ব করার মধ্য দিয়ে সভ্যতার সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে থাকা ইউরোপীয়দের কাছাকাছি পৌঁছুনোর চেষ্টা করতে পারবে অন-আধুনিক ‘নেটিভ’রা।
লিওনার্ড রজার্সের অধিনায়কত্বে কলকাতায় ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতিষ্টিত হল ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৪ সালে। নেচার-এ লিওনার্ড রজার্সের কৃতিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছিল – “outstanding contributions not only to tropical medicine in general, but particularly and almost uniquely to the practical application of therapeutic measures in the treatment of some of the most important major tropical diseases.” (Nature, May 14, 1938, p. 864)
কলকাতার এই স্কুলটি মেডিক্যাল কলেজের একটি অংশ ও শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯১৪ সালে কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও স্কুলটি চালু হয় ১৯১৫ সাল থেকে। এর কিছুদিন পর থেকে (১৯৩২?) ডিপ্লোমা ইন ট্রপিক্যাল মেডিসিন (D.T.M.) এবং লাইসেনশিয়েট ইন ট্রপিক্যাল মেডিসিন (L.T.M.)-এর পঠনপাঠন চালু হয়। (Centenary of the Medical College, ১৯৩৫, পৃঃ ৮৪-৮৯)
যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন সাংগঠনিক মত পার্থক্যের কারণের লিওনার্ড রজার্স এই স্কুল থেকে বিদায় নেন।
(ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গোড়ার দিকের চিত্র)
কলকাতার স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে পথিকৃৎ গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে লন্ডনের ব্লুমসবেরিতে প্যাট্রিক ম্যানসনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডন স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন – ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের একটি অংশ হিসেবে। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় পূর্বোল্লেখিত বিখ্যাত পুস্তক। আর এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৯ সালে। এই স্কুল তৈরির জন্য এক ধনী পার্সি বোমানজি দীনশ পেটিট ৬,৬৬৬ পাউন্ড অর্থসাহায্য করেছিলেন। পরে ১৯২৪ সালে এক রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে এই স্কুলটির নামকরণ হয় লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন। এখানেও দেখতে পাচ্ছি ‘অপর’ ট্রপিক্যাল ডিজিজেজ আত্মীকৃত হচ্ছে ‘self’ মূলধারার মেডিসিনের মধ্যে। ২০১৯-২০ সালে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আয় ছিল ২৪৩ মিলিয়ন পাউন্ড।
প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, ভারতের হতভাগ্য, নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাঁচা জনতার জন্য এই ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ‘দরদী’ হস্তক্ষেপ এদেরকে সভ্য এবং আধুনিক সমাজের নাগরিক করে তুলবে – এরকমটা সেসময়ের সাম্রাজ্যবাদী ধারণা ছিল। জোসেফ চেম্বারলেন, যিনি ১৮৯৫-১৯০৩ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারি অফ দ্য স্টেট ফর কলোনিজ ছিলেন, এরকম সাম্রাজ্যবাদের নতুন নামকরণ করেছিলেন “constructive imperialism”। যদিও মাইকেল ওয়রবয়েসের মতো গবেষক এই নতুন টার্মের মধ্যে দেখেছেন যে ট্রপিকস পরিপক্ক হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের উপযুক্ত প্রয়োগের ফলে এবং বিকশিত হবে মেট্রোপলিসের লাভের জন্য। (Michael Worboys, “Science and British colonial imperialism, 1895-1940”, DPhill thesis, University of Sussex, 1979)
ওয়রবয়েস অন্যত্র বলেছেন – “In the crucial period of transition, from 1870 to 1890, biomedical science was essentially undifferentiated, and there were various ways in which knowledge and practice might have been divided. Specializaton was then the result of contingent factors, a situation exemplified by tropical medicine.” (Worboys, “Tropical Diseases”, in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ed. W. F. Bynum and Roy Porter, 1993, Vol. 1, pp. 512-536) সহজ কথা হল, ট্রপিক্যাল মেডিসিন উনবিংশ শতকের শেষভাগে মেডিসিনের শিক্ষাক্রমে “স্পেসালাইজেশন”-এর সূচনাও ঘটিয়েছিল।
Romanticism and Colonial Disease গ্রন্থে অ্যালান বিউয়েল (Aalan Bewell) একটি নজর করার মতো পর্যবেক্ষণ রেখেছেন – “The British experience of disease raised questions about where colonial contact begins and ends as the imperial metroplole with its heterogeneous, impoverished, and anonymous populations seemed more and more to be a simulacrum of the periphery.” (পৃঃ ১২-১৩) অস্যার্থ, উপনিবেশের দরিদ্র জনতার মতোই উপনিবেশিক কেন্দ্রের দরিদ্র জনতার মাঝে যেন “colonial diseases”-এর প্রতিচ্ছায়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। পরে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন – “There was a mutual refraction of colonial and metropolitan medical theory … The pathothologizing of the urban working class occurred in tandem with the pathologizing of colonial peoples.” (পৃঃ ২৭০) উপনিবেশের প্রান্তের জনতাকে যেমন রোগের এবং প্যাথলজির পিণ্ড হিসেবে দেখা হত সেরকম দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হত উপনিবেশের কেন্দ্রের শ্রমিক শ্রেণী ও দরিদ্র জনতাকে। এখানে শাসকের তৈরি করা ট্রপিক্যাল মেডিসিন এক পংক্তিতে নিয়ে আসে এদেরকে, বিভাজন মুছে দেয় কেন্দ্রের এবং প্রান্তের সহায়হীন, দুর্বল ও দরিদ্র জনতার মাঝে।
বর্তমান সময়ে ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজে রূপান্তরিত হবার যে পরিণতি আমরা দেখছি সে এক স্বতন্ত্র বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিন্ন আলোচনার ক্ষেত্র। এক্ষেত্রে PLoS-এর মতো মান্য জার্নালে প্রকাশিত অন্তত দুটি প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য – Peter Hoetz, “Nuclear Weapons and Neglected Diseases: The “Ten-Thousand-to-One Gap”, এপ্রিল ২৭, ২০১০, এবং “United States Military Tropical Medicine: Extraordinary Legacy, Uncertain Future”, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩।
মেডিক্যাল কলেজের আরেক ইতিহাস-খণ্ড
১৯০৫-১৯১০ পর্যন্ত বিস্তৃত জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ঢেউ কি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের স্পর্শ করেছিল? হ্যাঁ, করেছিল। এই সময়ের এক উজ্জ্বল সন্তান ডঃ যদুগোপাল মুখার্জী। তিনি বাঘা যতীন এবং অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এমনকি সেসময়ের বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে বাঘা যতীন শহীদ হবার পরে যদুগোপালের মাথার দাম ২০,০০০ টাকা ঘোষণা করা হয়। শেষ অবধি ১৯২৩ সালে ধরা পড়েন। মুক্তির পরে তাঁকে বাংলা থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি রাঁচিতে দরিদ্র মানুষদের যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় নিজেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত রেখেছিলেন – স্বাধীনতার পরে সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করে। যদিও উল্লেখ করা দরকার, তিনি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। পাশ করেছিলেন কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ (বর্তমানে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ) থেকে ১৯২১ সালে।
(যদুগোপাল মুখার্জি – সৌঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)
এছাড়া আমরা মেডিক্যাল কলজের অতি বিখ্যাত ছাত্র নীলরতন সরকার এবং বিধানচন্দ্র রায়ের নামের সাথে এত পরিচিত যে এখানে আলাদা করে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে ডঃ বিজয়কুমার বসুর নাম। ১৯৩৬ সালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি এমবি পাশ করেন। সে বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জাপানি আক্রমণে পর্যুদস্ত চীনের মানুষের সাহায্য করার জন্য জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রচুর ওষুধ নিয়ে ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিসের নেতৃত্বে পাঁচজন চিকিৎসকের এক মেডিক্যাল টিম চীনে পাঠায়। সেই মেডিক্যাল মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডাঃ বিজয় কুমার বসু এবং এই মিশন উত্তর-চীনে কমিউনিস্ট অধিকৃত ইয়েমেনে অষ্টম চীনা স্থলবাহিনীর সামরিক হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁদের দীর্ঘ পাঁচ বৎসরের সেবাকার্যের মাঝে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ডাঃ কোটনিস চীনে মারা যান এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয় কুমার বসু দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। সাম্যবাদী চিন্তা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং মানবতাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী তিনি বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পঞ্চাশের দশকে বাংলার এই মন্বন্তরে তার সেবাকার্য বিশেষভাব স্মরণীয়। অনেক জনকল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। সহযোদ্ধা ডাঃ কোটনিসের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তুলেছিলেন “সারা ভারত কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি”। এর আগেই ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ডাঃ কোটনিসের উপর চলচ্চিত্র প্রস্তুত করতে তিনি খাজা আহমেদ আব্বাস ও ভি শান্তারামকে সাহায্য করেন। পরে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারত-চীন মৈত্রী সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ভারত সফরে এসে মেডিক্যাল মিশনের প্রতিনিধিদের চীনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ডাঃ বসু চীনে যান। সেই সফর চলাকালীন তার সাইনুসাইটিস অসুখ বেড়ে যায়। চীনের চিকিৎসকেরা তাঁকে আকুপাংচার চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলেন। ডাঃ বসু তখন কার্যত বিনা খরচের চিকিৎসা আকুপাংচারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ত্ত করেন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে কলকাতায় আকুপাংচার পদ্ধতিতে চিকিৎসা শুরু করেন। কলকাতার চিকিৎসক এবং পরে সাধারণ মানুষকেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির শিক্ষা দেন। মূলতঃ তারই প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের কিছু সরকারি হাসপাতালে এই পদ্ধতির চিকিৎসা শুরু হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে প্রথম আকুপাংচার সমিতি “Acupuncture Association of India” গঠন করেন এবং তিনি আমৃত্যু এর প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন। তিনিও ভারত ও চীন দুই দেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দুই দেশের মানুষের কাছে সম্মানিত ছিলেন। চীনে মেডিক্যাল মিশন নিয়ে তার রচিত গ্রন্থ হল কল অফ ইয়েনানঃ এ স্টোরি অফ দি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল মিশন টু চায়না। ১৯৮৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। সমস্ত সম্পত্তি সরকার এবং আকুপাংচার সোসাইটিকে দান করা হয়।
শ্রীলতা চ্যাটার্জির গবেষণা জানাচ্ছে ১৯২১ সাল নাগাদ – “Gandhi himself, at a meeting at Mirzapore Park, appealed to the students to leave their studies. The Calcutta Medical College students who had been immune to propaganda by the leaders were overwhelmed by his appeal.” (Congress Politics in Bengal (1919-1939), 2002, পৃঃ ৭১-৭২)
শ্রীলতা আরও জানাচ্ছেন – “Someswar Prasad Chaudhuri recalled how as a young medical student he was greatly moved by Deshabandhu’s speech in a meeting at Hedua and, disregarding all the attractions of further studies in Europe, responded to his call. He joined the newly opened National Medical College.” (পৃঃ ৭২)
এভাবেই মেডিক্যাল কলেজে প্রসারিত হয়েছিল ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ।
অনেক অজানা তথ্য জানলাম, বিশেষত কলেরা গবেষণা, মূল্যবান লেখনী, ধন্যবাদ স্যার
অসাধারন তথ্যপূর্ণ সুখপাঠ্য উপস্থাপনা – লেখক কে অভিনন্দন
অসাধারণ। তথ্যপূ্র্ন লেখনি।
অসামান্য। এতটাই বিশাল এর ব্যাপ্তি, আমি ভাবতে পারি না। বাংলার চিকিৎসা জগতের ইতিহাস চর্চার একটা চীরন্তন ক্লাসিকের জন্ম হচ্ছে।
আমরা দেখছি!
আরও একটি তথ্যভান্ডার পেশ করলেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।ডাঃ বিজয় বসু সম্বন্ধে আরও একটু জনা হোল। ডঃ যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়কেও আমরা আরও জানলাম।
মজা লাগল মহিলা ডাক্তারী ছাত্রীদের সম্বন্ধে প্রথম টেবিলে। nationalityর ক্ষেত্রে European বা Native christian ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থা নেটিভরা খ্রীষ্টান হলে তাদের ন্যাশনালিটি থাকে না।
ধন্যবাদ, ডঃ জয়ন্ত।