নবম অধ্যায় – সুয়েজ খাল, কলেরা গবেষণা এবং জীবাণুতত্ত্বের স্থবিরতা
মেডিক্যাল কলেজ শতবার্ষিকী সংকলন থেকে জানা যাচ্ছে – ১৮৭৮ সালে Dr. S. B. Partridge রক্তপাতহীন পদ্ধতিতে “scrotal elephantiasis” সারালেন “by tying an Esmerch’s cord round the neck of the scrotum.” ১৮৮৪ সালে J. D. O’Brien হার্নিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি থলে (sac) খুলে অপারেশনের পদ্ধতি গ্রহণ করেন। (Centenary, পৃঃ ৫১) Scrotal elephantiasis সে সময় কিরকম চেহারার ছিল এবং কিভাবে শারীরিক অক্ষমতার জন্ম দিত তার পরিচয় পাওয়া যাবে নীচের চিত্রদুটি থেকে।
কিন্তু এগুলোকে মৌলিক গবেষণা বলা শক্ত। এসব সার্জারি ইউরোপ এবং আমেরিকায় অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজে সে ধরণগুলোরই কিছু এদিক ওদিক করে প্রথমবারের জন্য করা হল। ১৮৩১ সালেই ল্যান্সেট-এ “Operations for Scrotal Elephantiasis” শিরোনামে (Volume 16, Issue 409, P. 439-440, July 02, 1831) গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজে বাস্তবে এ পদ্ধতির প্রতিফলন দেখা গেল প্রায় ৪৫ বছর পরে। এ সময়ের মধ্যে ল্যান্সেট কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে আরও অনেক উন্নততর পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আরেকটি তথ্যও Centenary-তে গুরুত্ব দিয়ে জানানো হয়েছে যে কেনেথ ম্যাকলিওড এসময় প্রথম সার্জারিতে সেলাই করার জন্য “cat gut”-এর ব্যবহার শুরু করেন। এরপরেই “Listerism Introduced” শীর্ষক খবরটি আলাদা অনুচ্ছেদ হিসেবে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে – “১৮৭৬-৮১ সময়কালে “লিস্টেরিজম” সম্পর্কে প্রভূত আগ্রহ তৈরি হয়। ১৮৭৭ সালের একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে সার্জারির সময়ে কোন অ্যান্টি-সেপটিক সতর্কতা নেওয়া হয়নি।” (Centenary, পৃঃ ৫২) এখানে আমি “লিস্টেরিজম” নিয়ে দু’একটি কথা বলব।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ডাবলিনে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে (৯ আগস্ট, ১৮৬৭) জোসেফ লিস্টার “On the Antiseptic Principle in the Practice of Surgery” শীর্ষক গবেষণাপত্র তথা প্রবন্ধ পাঠ করেন। একই শিরোনামে গবেষণাপত্রটি ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল এবং ল্যান্সেট-এ একইদিনে (২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৭) প্রকাশিত হয়। এ গবেষণাপত্রে লিস্টার জানান – “In the course of an extended investigation into the nature of inflammation, and the healthy and morbid conditions of the blood in relation to it I arrived, several years ago, at the conclusion that the essential cause of suppuration in wounds is decomposition, brought about by the influence of the atmosphere upon blood or serum retained within them, and, in the case of contused wounds, upon portions of tissue destroyed by the violence of the injury.”
তাঁর অভিজ্ঞতায় লিস্টারের মনে হয়েছিল যে “decomposition in the injured part might be avoided without excluding the air, by applying as a dressing some material capable of destroying the life of the floating particles.” এক্ষেত্রে তিনি কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনলের বিশেষভাবে তৈরি দ্রবণ এবং কাপড়ের পটি ব্যবহার করেছিলেন – “which appears to exercise a peculiarly destructive influence upon low forms of life, and hence is the most powerful antiseptic with which we are at present acquainted.” এরপরে তিনি বেশ কতকগুলো কেসের ক্ষেত্রে সাফল্যের অর্থাৎ অপারেশন এবং ক্ষতের জায়গা দূষিত না হয়ে ওঠার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে – “I have found that when the antiseptic treatment is efficiently conducted, ligatures may be safely cut short and left to be disposed of by absorption or otherwise.”
তাঁর সর্বশেষ মন্তব্য হল অ্যান্টি-সেপটিক পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে এখন সার্জিকাল ওয়ার্ড কিংবা হাসপাতাল আর পূতিগন্ধময় হয়ে থাকেনা – “have completely changed their character; so that during the last nine months not a single instance of pyaemia, hospital gangrene, or erysipelas has occurred in them.”
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় – ক্লোরোফর্ম বা ইথার আবিষ্কার যখন হয়েছে এবং ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছে তারপরে মাত্র ২-৩ মাসের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজে অ্যানাস্থেটিক হিসেবে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছিল ইথার এবং ক্লোরোফর্মের (দ্রষ্টব্যঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য, মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস (১৮২২-৬০), ২০২২)। অথচ স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পরে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের সাথে যাতায়াতের সময় অনেক সংক্ষিপ্ত হবার পরেও জোসেফ লিস্টারের উদ্ভাবিত পদ্ধতি মেডিক্যাল কলেজে প্রয়োগ হতে ১০ বছর সময় লেগে গেল। কেন? আমি আলোচনার পরবর্তী অংশে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে আত্মসমীক্ষা
চিকিৎসা-সম্মিলনী (বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য, ১২৯৬ বা এপ্রিল-জুন ১৮৮৯) পত্রিকায় মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবি পাশ করা সেসয়ের কম-বেশি নামী চিকিৎসক শ্যামনগর নিবাসী যদুনাথ গঙ্গোপাধ্যায় “বাংলার চিকিৎসক সমাজ” নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন (পৃঃ ১৭৮-১৯২)। এই প্রবন্ধে সে সময়ের বাংলার চিকিৎসক সমাজের “অধঃপতিত” অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এবং এই চিকিৎসকদের প্রায় সবাই ছিলেন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা এমবি কিংবা এলএমএস।
লেখকের মতানুযায়ী, উইলিয়াম বেন্টিংকের হাতে প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা ছিল। “কিন্তু আজি যদি তিনি জীবিত হইয়া উঠিতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন যে, বাঙ্গালার চিকিৎসককুল, শিশুর ন্যায় অদ্যাপি ও ইউরোপীয় শিক্ষকগণের পদানুসরণ করিতেছেন … নিজের স্বাধীনচিন্তা, স্বকৃত অনুসন্ধান, অভিনব মত কিছুই নাই, অভিজ্ঞতা লাভ করিবার ব্যগ্রতা নাই … আমরা যেন মৃৎপিণ্ড, ইংরাজের জ্ঞানালোক প্রাপ্ত হইয়াছি বটে, কিন্তু সে আলোক প্রতিফলন করিতে সমর্থ নহি।” (পৃঃ ১৭৮-১৭৯)
লেখকের তীব্র ধিক্কার প্রকাশিত হয় – “এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একজন চিকিৎসকও গবেষণা বা আবিষ্কারের জন্য খ্যাতনামা হয়েন নাই … হা ধিক্, যদি মহেন্দ্রলাল সরকার না থাকিতেন তাহা হইএল কলিকাতায় যে কেহ চিকিৎসা শিক্ষা করে, তাহা বাহিরের লোক জানিতেই পারিতেন না … এই সুদীর্ঘ কালের ভিতর একখানিও নতুন পুস্তক বাহির হয় নাই।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৯) তিনি গবেষক-চিকিৎসকদের মধ্যে দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সূর্য্য গুডীব চক্রবর্তী, ও’শনেসি প্রমুখদের নামোল্লেখ করেছেন।
তাঁর আক্ষেপ “যে বঙ্গীয় যুবকগণ বিশ্ব বিদ্যালয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারেন” সেই “বাঙ্গালী জাতির ডাক্তার প্রভৃতি চিকিৎসকগণ ইউরোপীয় চিকিৎসকগণের সমকক্ষ হইতে পারিলেন না?” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮০-১৮১) “মার্কিন ও ইউরোপ যেরূপ দ্রুতপদে চিকিৎসার উন্নতির দিকে ধাবমান হইতেছেন, বঙ্গীয় চিকিৎসকগণ কেবলমাত্র দর্শক হইয়াই কেন কাটাইলেন? – চিকিৎসক মাত্রেরই ইহা চিন্তা করা উচিত।” (পৃঃ ১৮০-১৮১)
লেখকের ধারণানুযায়ী এর জন্য অনেকগুলো কারণ কাজ করছে – (১) “চিকিৎসকগণের দরিদ্রতা ও অর্থ চিন্তা।” এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যে লেখক ধনী ও দরিদ্র এই দু ধরণের ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। দরিদ্র ডাক্তারদের যদি অর্থ চিন্তা প্রধান হয় তাহলে ধনীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে – “যাঁহারা অর্থোপার্জনে কৃতকার্য হইয়াছেন, তাঁহারা পূর্বেই বিদ্যাভাস ভালবাসিতেন না, এখন তো সঙ্গতি হওয়াতে আর বিদ্যাচর্চার কিছুই প্রয়োজন বোধ হয় না।” (পৃঃ ১৮২)
এরপরে দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন – “দেশীয় চিকিৎসকগণের সুশিক্ষা ও সৎপ্রবৃত্তির অভাব … ডাক্তারেরা লেখাপড়া জানে না … তাঁহারা না জানে ভাল ইংরাজি, না বুঝে নিজ মাতৃভাষা।” (পৃঃ ১৮২) এ ধরণের পর্যবেক্ষণ আমাদের বোঝায় যে মেডিক্যাল কলেজের ১৮৬০-এর দশকের পরবর্তী সময়ে শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণ, অনুসন্ধিৎসু মন, রোগীর প্রতি ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে একেবারে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের বিকাশের ধারা একরৈখিক নয়, নয় শ্লাঘার ব্যাপারও (অনেক সময়েই)।
আমরা একমাত্রিক পথে মেডিক্যাল কলেজের উজ্জ্বল ইতিহাস সবসময়ে খুঁজে পাব না। যদি জোর করে এরকম চেষ্টা করি তাহলে সেটা হবে একইসঙ্গে অনৈতিহাসিক, অনৈতিকও বটে।
যাহোক, পূর্বোক্ত প্রবন্ধে লেখক জানাচ্ছেন যে “রোগীগুলিকে কেবল অর্থোপার্জনেরই উপায় বলে” মনে করলে “মন সঙ্কীর্ণ হইয়া যায়, রোগীকে পণ্যদ্রব্য বোধ মধ্যে হয়, মনুষ্যের দুর্দশা দেখিয়া ক্লেশ হয় না” ইত্যাদি। (পৃঃ ১৮৩-১৮৪) এরপরে লেখক “বঙ্গীয় চিকিৎসকগণের জ্ঞানোন্নতির” তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করলেন “একতা ও সহানুভূতির অভাব”। (পৃঃ ১৮৪)
তাঁর যুক্তির সমর্থনে ভারী কৌতুকজনক উদাহরণ দিলেন – “ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটী দুই শত বৎসর পূর্বে সভা করিয়া “আকাশ হইতে শস্য পতিত হইয়াছে, তাহা বপন করিলে কিরূপ উপকার হইবে” এবং “ভেক দগ্ধ করিয়া তাহার ভস্ম লাগাইলে পচা ঘা কতদিনে সারিবে” এইরূপ অলীক কথার বিচার করিতেন; সমবেত চেষ্টার গুণে আজি ইলন্ডের সেই সভাতে অগাধ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের কথা উত্থাপিত হইতেছে।” লেখকের মতানুযায়ী, মফঃস্বলের অবস্থা আরও মন্দ। এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ সপর্শকাতর বিষয় উত্থাপন করলেন লেখক – কিভাবে “পসারগ্রস্ত চিকিৎসক (সফল চিকিৎসক)” রোগীর বাড়ীতে এলেই “গরপসারীর (অসফল চিকিৎসক) রোগীটি কাড়িয়া লয়েন”। (পৃঃ ১৮৬)
পঞ্চম প্রতিবন্ধকতা, লেখকের মতে, “ভারতীয় জাতির স্থিতিশীলতা ও ইউরোপীয়ের উন্নতিশীলতা … ইউরোপ ও মার্কিণের উন্নতির গতি মেল ট্রেণের ন্যায়, আমাদের গতি কচ্ছপের ন্যায়”। (পৃঃ ১৮৭-১৮৮) এ অবস্থা থেকে উৎক্রমণের জন্য তাঁর একটি পরামর্শ ছিল “উদার ভাবে সত্যানুসন্ধান … সত্য কোন মতবিশেষের ভৃত্য নহে।” (পৃঃ ১৯০-১৯১)
এই প্রবন্ধের লেখক যদুনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (এমবি) “ভারতীয় জাতির স্থিতিশীলতা ও ইউরোপীয়ের উন্নতিশীলতা … ইউরোপ ও মার্কিণের উন্নতির গতি মেল ট্রেণের ন্যায়, আমাদের গতি কচ্ছপের ন্যায়” নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তার কেন্দ্রীয় স্থানে আছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় তথা বাঙ্গালি চিকিৎসকদের চিন্তার stasis বা স্থবিরতা, যাকে লেখক “স্থিতিশীলতা” বলে অভিহিত করেছেন। কেন এই stasis বা স্থবিরতা বা স্থিতিশীলতা ঘটল তার সম্ভাব্য কারণ এবার আমরা অনুসন্ধান করতে পারি।
গবেষকদের দৃষ্টি এ বিষয়ের দিকে প্রথম নির্দিষ্টভাবে আকর্ষণ করেছেন শেলডন ওয়াটস (Sheldon Watts) তাঁর “From Rapid Change to Stasis: Official Responses to Cholera in British-Ruled India and Egypt: 1860 to c. 1921” (Journal of World History, Vol. 12, No. 2 (Fall, 2001), pp. 321-374) গবেষণাপত্রে ২০০১ সালে। আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়নি, বাংলায় তো নয়ই। ওয়াটসের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৮৬৮ সালের মাঝামাঝি কলেরা নিয়ে গবেষণা এবং স্যানিটেশনের মৌলিক নীতির পরিবর্তন হয় – “One of these reversals, extremely costly in non-white lives and earlier ignored by historians, took place in the middle months of 1868. The reversal involved attitudes in Britain … and cholera.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২১) সরকারিভাবে কলেরানীতির বিপরীতমুখী যাত্রার (reversal) ফলে বিজ্ঞান ক্ষতিগ্রস্ত হল, ক্ষতিগ্রস্ত হল বৈজ্ঞানিক গবেষণা। এবং সমস্ত পরিবর্তনের ভরকেন্দ্রে ছিল – সুয়েজ খাল দিয়ে বাণিজ্য অবাধ হবে নাকি কোয়ারেন্টাইনের জন্য অন্তত ১০ দিন ভারত থেকে আগত জাহাজ আটকে থাকবে?
(১৮৬৯ সালের সুয়েজ খাল)
ওয়াটসের আরেকটি গবেষণাপত্রে তিনি বলেছেন – “After 1866, fears of the British Government that Egyptian and Ottoman International Quarantine Boards – comprising representatives of 13 mainland European member states plus Turkey, Egypt and Great Britain – would delay passage through the Suez Canal of vessels sailing ‘homeward’ from Bombay, had a devastating effect on cholera control policies in India and on scientific research in the UK. British policy contradicted the scientific findings of the Cholera Conference in Constantinople (1866) and the Vienna Conference (1874). The British held that Indian cholera was not a contagious disease, not caused by a germ (’germ theory’), not carried afield in the human gut. This was to deny the efficacy of quarantine. The result was to deter UK scientists from further work on ‘germ theory’.” (Sheldon Watts, “Cholera and the maritime environment of Great Britain, India and the Suez Canal: 1866–1883”, International Journal of Environmental Studies, Vol. 63, No. 1, February 2006, 19–38, পৃঃ ১৯)
এ পরিসরটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের “জার্ম থিওরি” নিয়ে (রোগের কারণ এবং সংক্রমণ বোঝার ক্ষেত্রে সেসময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব) পরবর্তী গবেষণা কর্ম প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লো। অথচ ১৮৬৪ সালে উদ্ভাবিত লিস্টেরিজম এবং এর আগে ১৮৫৪ সালে জন স্নো-র “pioneering epidemiologic investigation proved the mode of transmission of a waterborne disease”। (Theodore H. Tulchinsky, “John Snow, Cholera, the Broad Street Pump; Waterborne Diseases Then and Now”, in Case Studies in Public Health. 2018 : 77–99, পৃঃ ৮৩)
আরউইন অ্যাকার্কনেখট (Erwin Ackerknecht) তাঁর “Anticontagionism between 1821 and 1867” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন – “A Cholera Quarantine Conference, organized in Paris by Melier in 1851, was practically without result, mostly because of English anticontagionist opposition under Sutherland.” (International Journal of Epidemiology 2009; 38: 7–2, পৃঃ ১৪)
সহজ করে বললে, ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপে, বিশেষত ইংল্যান্ডে, দীর্ঘ সময় ধরে সংক্রমণ-বিরোধী (Anticontagionist) মতামত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। মেডিসিনের ইতিহাসের ছাত্ররা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন ইংল্যান্ডের কলেরা সংক্রমণ নিয়ে জন স্নো এবং সাদারল্যান্ডের মতদ্বৈধতার কথা। সুয়েজে কোয়ারেন্টাইন করে সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এর প্রলম্বিত ছায়া পড়েছিল। তাছাড়া বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ তো ছিলই।
লিস্টার এবং জন স্নোর আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপ, যৌক্তিকভাবে হতে পারত, কলেরার জীবাণু এবং জীবাণুতত্ত্বের আবিষ্কার। সে কাজটি স্তব্ধতার মুখ দেখল। আমাদের অপেক্ষা করতে হল ১৮৮৩-৮৪ সালে রবার্ট কখের ভিব্রিও কলেরি জীবাণুর আবিষ্কার পর্যন্ত। যদিও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে বলতে হয় ১৮৫৪ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী Filippo Pacini প্রথম এ জীবাণু আবিষ্কার করেন। কিন্তু স্বীকৃতি পান নি। ১৯৬৫ সালে অণুজীবের নামকরণের আন্তর্জাতিক কমিটি Vibrio cholerae Pacini 1854 নামটি গ্রহণ করে।
আরেকটি গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, ১৮৬৯ সাল থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত ভারত সরকারের স্যানিটারি কমিশনারের “সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট” ডেভিড ডগলাস কানিংহাম (D. D. Cuningham) ছিলেন “কখের অদম্য বিরোধী, ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর উদ্ভাবিত এই সত্যটি যে ব্যাসিলাস হচ্ছে কলেরার প্রকৃত কারণ; যখন উনিশ শতকের শেষে কলেরা ব্যাসিলাস সংক্রান্ত কখের দাবী (কলেরা জীবাণুর আবিষ্কারক রবার্ট কখ) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল ততদিনে কানিংহামের লেখালেখি প্রায় কোন চিহ্ন না রেখে অস্তে চলে গেল। কখের সাথে কানিংহামের সংঘাত কেবল তখনই বোঝা যাবে যখন ভারতের কলেরা কাহিনী অক্ষত অবস্থায় পুনরায় বিবৃত হবে।” (Jeremy D. Isaacs, “D D Cunningham and the Aetiology of Cholera in British India, 1869-1897”, Medical History, 1998, 42: 279-305, পৃঃ ২৮০)
এসবের সম্মিলিত অভিঘাতে, লেখার শুরুতে মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যে আত্মসমীক্ষার উল্লেখ করা হয়েছে সে ধারায়, ল্যাবরেটরি-কেন্দ্রিক জীবাণুতত্ত্বের চর্চা প্রবলভাবে ব্যাহত হল। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে সেসময় মেডিসিন প্রবেশ করেছে “হসপিটাল মেডিসিন” অতিক্রম করে “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর জগতে – প্রথম দুটি অধ্যায়ে আমি এ বিষয়ে যথেষ্ট বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ভারতে তথা মেডিক্যাল কলেজে মেধার অপচয় হল – কোন নতুন উদ্ভাবন নেই ১৮৬৮ পরবর্তী সময়ে সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে। কেবলমাত্র ইউরোপীয় সার্জারির অনুকরণ ও নির্বিচারে, অন্ধভাবে ওদেশের মেডিসিনের প্রয়োগ।
(১৮৭১ সালে ভারতে কলেরা মহামারির একটি চিত্র)
বস্তুত, একটি বিশেষ রোগের সাথে (পড়ুন কলেরা) ব্রিটিশ রাজনীতি, স্যানিটেশন সংক্রান্ত নীতি এবং আন্তর্জাতিক মহলের অসংখ্য বিতর্ক জড়িয়ে গেল। এবং এর ভরকেন্দ্রে রয়েছে ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হওয়া সুয়েজ খাল। আমরা খানিকবাদেই দেখব, প্রাথমিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লাভালাভের প্রশ্ন বিজ্ঞানের গতিপথ, আবিষ্কারের লক্ষ্যমুখ এবং রাষ্ট্রিক নীতি নির্ধারণ করেছে। মেডিসিন-রাজনীতি-বাণিজ্য সবকিছু জুড়ে গিয়ে জন্ম নিল, পরবর্তীতে যাকে বলা হচ্ছে, মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স।
এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে কোন স্তরের গবেষণা হবে, মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আদৌ হবে কিনা এ প্রশ্নগুলো পরস্পর-সংযুক্ত হয়ে পড়লো।
বৈজ্ঞানিক চিন্তার stasis বা স্থবিরতা (স্থিতিশীলতার) উৎস সন্ধান
ভারতে এবং বাংলায় কলেরা মহামারি (পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে যা অতিমারির চেহারা নিয়েছিল) নিয়ে কমবেশি ২০০ বছর ধরে বাংলা, ইংরেজি এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে, একের পর এক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ততোধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি একবিংশ শতকেও ক্রমাগত নিত্যনতুন ব্যাখ্যা নিয়ে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে কলেরা নিয়ে লেখা চলছে। সুপ্রচুর বিভিন্ন স্যানিটারি কমিশনের রিপোর্ট আছে, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার কলেরা নিয়ে বই আছে।
১৮১৫ সালের আগে ১টি মাত্র রিপোর্ট তথা গবেষণাপত্র রয়েছে এই বিশেষ রোগটি নিয়ে। ১৮১৬ থেকে ১৮৫১ সালের মধ্যে ২৪টি “এন্ট্রি” ছিল কলেরা নিয়ে। আর ১৮৫১ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে সে সংখ্যা বেড়ে হয় ১,৩৯০। (Valeska Huber, “The Unification of the Globe by Disease? The International Sanitary Conferences on Cholera, 1851–1894” The Historical Journal, 49, 2 (2006), pp. 453–476, পৃঃ ৪৫৮)
কলেরা সেসময় কতটা উদ্বেগ এবং ত্রাস তৈরি করেছিল আন্তর্জাতিক মেডিসিনের জগতে এবং বাণিজ্য এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে, এমনকি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রেও সেটা বোঝা যাবে ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্সগুলোর দিকে দৃকপাত করলে।
১৮৫১ সালের কনফারেন্স হল প্যারিসে – ২৩ জুলাই, ১৮৫১ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫২ পর্যন্ত চলেছিল, “adopts a draft Sanitary Convention and draft International Sanitary Regulations”। মনে রাখা দরকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জৌলুস এবং একাধিপত্য প্রদর্শনীর জন্য লন্ডনে অনুষ্ঠিত হল Great Exhibition – ১৮৫১ সালেই।
১৮৫৯-এ প্যারিসে – ৯ এপ্রিল থেকে ৩০ আগস্ট। ১৮৬৬-তে ইস্তানবুলে – ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৮৭৪-এ ভিয়েনাতে। ১৮৮১-তে ওয়াশিংটনে – এই কনফারেন্সে আমেরিকা প্রথম অংশগ্রহণ করল। ১৮৮৫ সালে রোমে। ১৮৯২ সালে ভেনিসে। ১৮৯৩ সালে জার্মানির ড্রেসডেনে। ১৮৯৪ সালে প্যারিসে। ১৮৯৭ সালে ভেনিসে। উনবিংশ শতকের এই ১০টি ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স নিয়ে আমি অল্পবিস্তর আলোচনা করব।
এখানে উল্লেখযোগ্য হল – “The British delegates to the 1866 Constantinople Sanitary Conference reported back enthusiastically in favor of quarantinist measures.” (Peter Baldwin, Contagion and the state in Europe, 1830-1930, 2004, পৃঃ ১৫০) যারা ১৮৬৬ সালে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কলেরা প্রতিরোধের জন্য “কোয়ারেন্টাইন”-এর পক্ষে সওয়াল করছে, তারাই পরবর্তীতে সুয়েজ খাল খুলে যাবার পরে ঘোরতর কোয়ারান্টাইন-বিরোধী হয়ে উঠল। আমরা নেপথ্যের কারণগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি।
১৮৬৫ সালে, সুয়েজ খালের খুলে যাওয়া তখনও ৪ বছর দূরে, আলেক্সান্দ্রিয়াতে কলেরা মহামারি শুরু হল। সুয়েজ খাল খুলে যাবার পরে এই মহামারিকে রোখার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে কোয়ারেন্টাইনকে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি বলে গ্রহণ করা হল। এর ফলে যে সমস্ত জাহাজ বিশেষ করে ভারত থেকে আসছে তাদেরকে বেশ কিছুদিন আলাদা করে কোয়ারেন্টাইনে রেখে বিপন্মুক্ত বোঝা গেলে চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
(সুয়েজ খালে কোয়ারেন্টাইনের পুরনো চিত্র)
Baldwin-এর মন্তব্য – “That country which most consistently opposed such restrictions because of their harm to commercial relations was, not surprisingly, Britain … Its role as the greatest shipping power and its commercial relations with the empire, especially India, made quarantine commercially undesirable.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৬) এবং যে সমস্ত দেশ কোয়ারেন্টাইনের পক্ষে ছিল তাদের তীব্র বিরোধিতা করে ব্রিটিশরা কোয়ারেন্টাইন তুলে নেবার পক্ষে জোরদার সওয়াল করে পরবর্তী কনফারেন্সগুলোতে – “theirs was a country which suffered more in commercial terms from restrictive practices than from an epidemic.” (Baldwin, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৭)
ঐতিহাসিক মার্ক হ্যারিসন ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ Public health in British Indiaঃ Anglo-Indian Preventive Medicine 1859-1914-তে জানিয়েছিলেন – “The economic problems experienced as a result of quarantine in 1882 were particularly acute as the year had been a poor one for trade. Depressed markets in Britain had seriously damaged Bombay’s export economy, which, according to shipping experts, was ‘devoid of animation … In India, the government did its best to cover up the severity of the cholera epidemic afflicting Bombay and its hinterland.” (পৃঃ ১২৪) অর্থাৎ, সেসময় ব্রিটিশ বাণিজ্যের মন্দা চলছিল। এরকম পরিস্থিতে কোয়ারেন্টাইনের জন্য সুয়েজে ঢোকার মুখে অন্তত ১০ দিনের জন্য জাহাজ আটকে থাকা ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার সামিল ছিল। ফলে কোয়ারেন্টাইনের বিরোধিতা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত কলেরা সংক্রমণের মেডিক্যাল ব্যাখার বিপরীত এবং “বিচিত্র” ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৮২-র কনফারেন্সে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্যভাবে রাজানুগত দুজন প্রতিনিধিকে নির্বাচন করা হয় – একদা মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির সর্বময় কর্তা Sir Joseph Fayrer এবং Timoty Lewis “because of the congruence of their views with the political objectives of the Indian administration”। (হ্যারিসন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৭)
কি ছিল সেই ব্যাখ্যা? প্রধান ব্যাখ্যাটি ছিল কলেরার দুটি ধরণের মাঝে বিভাজন করতে হবে – “epidemic“ এবং “sporadic”। ভারতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধরণটিকে সরকারি মেডিক্যাল ব্যাখ্যা বলে চালানো হচ্ছিল – “It appears to his Lordship as useless and irrational to place in quarantine at Suez a perfectly healthy ship arriving from Bombay because there are a few sporadic cases of cholera among the 750,000 inhabitants of that city, as it would be to place in quarantine at Antwerp healthy arrivals from the Thames because London is hardly ever totally free from small pox or scarlet fever.” (Valeska Huber, Channelling mobilities: migration and globalisation in the Suez Canal Region and beyond, 1869 1914, 2013, পৃঃ ২৫৮)
এবং এ কাজ ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসন এবং গ্রেট ব্রিটেনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা যৌথভাবে করেছিল। ওয়াটস জানাচ্ছেন – “It is useful to point out here that, over the years, the British government and its apologists gave the appearance of being unaware that a cholera policy reversal had ever happened. To maintain general amnesia, they silenced critics at the Royal Army Medical College at Netley who knew what the score was.” (Sheldon Watts, “From Rapid Change to Stasis”, পৃঃ ৩২৩) রাষ্ট্রের অনুমোদিত এবং গৃহীত মেডিক্যাল পন্থার বিরোধী সমস্ত ভিন্ন মতকে নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি গবেষকদের গবেষণাপত্রও প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। প্রায় ১৫০ বছর আগে ঘটা ঘটনায় আমরা এখনকার ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। সমস্ত নীতিনির্ধারণের চালিকা শক্তি হচ্ছে বাণিজ্যিক লাভালাভ এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে ডাক্তারদের অবস্থান তখন যথেষ্ট সমীহ অর্জন করেনি। বিশেষ করে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য ছিল। রাজনীতি এবং প্রশাসনের উচ্চকোটির ব্যক্তিবর্গই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ ১৮৮৩ সালের ১১ আগস্ট “Political Powerlessness of the Profession: A Proposal” শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ছিল। ডেভিড আর্নল্ড তাঁর Science, Technology and Medicine in Colonial India (2004) গ্রন্থে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও ভারতে চিকিৎসকদের সামাজিক অবস্থানের কম গুরুত্ব এবং তুলনায় আইনজীবী এবং সরকারি চাকুরেদের বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন (পৃঃ ৬৫)। আরেকটি বিষয়কেও তিনি পাঠকদের নজরে এনেছেন – “The authority invested in the medical hierarchy could be effectively deployed to crush dissent and enforce compliance, as shown by the stifling of opposition to the anti-contagionist views held by J. M. Cuningham, Sanitary Commissioner with the Government of India from 1866 to 1884.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৮-৫৯)
মেডিক্যাল পেশার সামাজিক ওজনের লঘুত্ব সম্পর্কে প্রায় হুবহু একই কথা Toby Gelfand বলেছেন তাঁর “The History of the Medical Profession” প্রবন্ধে। তিনি বলছেন – “the social prestige of medical men according to the British gentlemanly ideal remained inferior to other liberal professions in law, the ministry, and the military.” (Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ed. W. F. Bynum and Roy Porter, Vol. 2, পৃঃ ১১৩৫)
সুয়েজ খালের রাজনীতি এবং স্যানিটারি নীতি নিয়ে আরও কিছু কথা
সুয়েজ খাল এবং একে ঘিরে স্যানিটারি নীতি নিয়ে মার্ক হ্যারিসন অন্য একটি লেখায় মন্তব্য করেছেন – “স্যানিটারি ডিপ্লোম্যাসির ক্ষেত্রে সুয়েজ খাল একটি বাঁক (turning point) হিসেবে কাজ করেছে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নতুন ধারণার উন্মেষ ঘটিয়েছে। এ ধারণার ভিত্তিতে ছিল মধ্য প্রাচ্য একধরণের sanitary filter হিসেবে কাজ করবে।” (মার্ক হ্যারিসন, “The great shift: Cholera theory and sanitary policy in British India, 1867-1879” in Society, Medicine and Politics in Colonial India, ed. Biswamay Pati and Mark Harrison, pp. 37-59, পৃঃ ৩৭) উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৮৬৮ পর্যন্ত ভারতে স্যানিটারি কমিশনারের পদের দায়িত্বে ছিলেন একজন নন-মেডিক্যাল আমলা লেফটন্যান্ট কর্নেল G. B. Malleson। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২)
(কলেরার আন্তর্জাতিক প্রকোপের মানচিত্র)
সুয়েজ খাল খুলে যাবার পরে মিশর এবং অটোমান “boards of health” জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে কলেরা সংক্রমণের ভয়ে কঠোর নিয়মকানুন চালু করে। পরবর্তী বছরগুলোতে এই নিয়মাবলী আরও কঠোর হয় – “with a quarantine of around 30 days being imposed on all ships deemed to be in an unhygienic state or from ports considered likely to be infected … The major shipping companies – the Peninsular and Oriental Company and the British India Steam Navigation Company – also complained bitterly of the effects of the new regulations on their trade.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০)
এখানে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কুটিল খেলা শুরু হল একাধিক স্তরে – (১) ব্রিটিশরা কলেরাকে অ-সংক্রামক (বা ছোঁয়াচে নয়) বলে মেডিসিনের যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গেল, এবং সাময়িকভাবে সফলও হল, (২) ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কমিটি থেকে ক্রমান্বয়ে মিশর, অটোমান এবং এশীয় প্রতিনিধিদের সরিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো জায়গা দখল করল (উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৮৯১ সালে মিশরের প্রতিনিধির সংখ্যা ১৭ জন থেকে কমে ৩ জন হল, এবং মোট প্রতিনিধির সংখ্যা ২৩ থেকে কমে ১৭ হল – Huber, Channelling Mobilities, পৃঃ ২৪৬), (৩) এর পরিণতিতে আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থা একদিকে যেমন de-nationalized হল, এবং অন্যদিকে ইউরোপীয় প্রাধান্যের প্রতিভূ হিসেবে “আন্তর্জাতিক”ও হল, (৪) কোয়ারেন্টাইন প্রতিস্থাপিত হল “clean bill of health” আছে বা নেই এটা দিয়ে – “In the International Sanitary Conferences of 1894 and 1897 a series of new regulations about cholera and plague were implemented about the Suez.European vessels that had a clean bill of health were given immediate practique without any restrictions or requirements” (Birsen Bulmus, Plague, Quarantines and Geopolitics in the Ottoman Empire, 2102, পৃঃ ১৪৬), (৫) অন্তত ভারত সরকারের ব্রিটিশ নীতি কলেরার সংক্রামক চরিত্র এবং জীবাণুতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে কঠোর বিরোধিতার নীতি নিল যা গবেষণার অন্য ক্ষেত্রগুলোকেও প্রভাবিত করল। যদিও ভারত সরকারের কলেরা নীতি ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী এবং এপিডেমিওলজিস্ট মহলে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছে। বহুক্ষেত্রেই নীতির ভিন্নতা ছিল – একই সাম্রাজ্যের মধ্যে বাস করা সত্বেও।
উপরে উদ্ধৃত যদুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মসমীক্ষার সময়কাল ১৮৮৯ সাল। সে সময় পর্যন্ত stasis তথা স্থবিরতা কাজ করে চলেছে মেডিক্যাল কলেজে নতুন গবেষণার ক্ষেত্রে। সে আক্ষেপই ধরা পড়েছে ওপরে উদ্ধৃত “বাংলার চিকিৎসক সমাজ” লেখায়।
ভারতে কলেরা নিয়ে গবেষণা ও ধারণার ভিন্নতা
গোড়াতে দুটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার –
(১) ১৮৭৫ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি “had purchased cut-price government shares in the Suez Canal (funded by the banking magnate Lionel de Rothschild) that amounted to 44% of its total stock. Subsequently, when Egypt was declared bankrupt in the following year, Britain was its principal creditor Furthermore, up to 80% of Egyptian exports went to Britain by 1880 and 44% of all its imports originated there. ” এরপরে নিতান্ত অবান্তর অজুহাতে ১৮৮২ সালে ব্রিটিশরা মিশরে প্রবল বোমা বর্ষণ শুরু করে, মিশরের দখল নেয়। পরিণতিতে সুয়েজ খাল দিয়ে ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে আর কোন বাধাই রইল না। (David J. Mentiply, “The British Invasion of Egypt, 1882”, March 2009, https://www.e-ir.info/2009/03/23/the-british-invasion-of-egypt-1882/)
(২) কলেরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বিজ্ঞানের কতকগুলো নতুন আবিষ্কার ও প্রয়োগকে ত্বরাণ্বিত করেছে। যেমন, টেলিগ্রাফিক ব্যবস্থা ব্যবহার করে জাহাজে কলেরা রোগী আছে কিনা সে খবর আগাম পোর্ট অথরিটির কাছে পৌঁছে দেওয়া – ইনফর্মেশন টেকনোলজির বিস্তৃত ব্যবহার শুরু হল। নতুন করে মেডিক্যাল সায়ান্সের পরিধি বিস্তৃত হল – “chemical disinfection”, “disinfection machines” এবং এগুলোর উপযুক্ত সময়কালীন প্রয়োগ ঘটতে শুরু করল।
ল্যান্সেট-এ জানুয়ারি ১৭, ১৮৭৪-এ রিপোর্ট করা হল ভারত সরকারের স্যানিটারি কমিশনার জেমস ম্যাকনাব কানিংহাম ইংল্যান্ডের এপিডেমিওলোজিকাল সোসাইটি-তে ভারতের কলেরা নিয়ে নিজস্ব পেপার পড়েছেন। ৪ এপ্রিল, ১৮৭৪-এর সংখ্যায় ল্যান্সেট-এ এর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল “দ্য ডিসকাশন অন কলেরা” শিরোনামে। এই প্রতিবেদনে কানিংহামের পেশ করা পেপার নিয়ে বলা ভালো যথেষ্ট বিদ্রূপ করা হয়েছে। এই পেপারটি পড়ার পরে বিভিন্ন তথ্যাভিজ্ঞ চিকিৎসক মহল থেকে তীব্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয় ডঃ কানিংহামকে। ল্যান্সেট-এর ভাষা উদ্ধৃত করে বলতে হয় – “in the end Dr. Cuningham stood alone among the ruins he had created, and loomed before the mental vision of audience like GAVARNI’s cynical philosopher”। (Lancet, Vol. 1, 1874, পৃঃ ৪৮২)
ল্যান্সেট-এর প্রতিবেদন অনুয়ায়ী কানিংহামের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো হল – (১) ভারতে তিনি এমন কোন রোগী দেখেন নি যার ওপরে ভিত্তি করে বলা যায় যে কলেরার “contagiousness” রয়েছে, এবং (২) জল দিয়ে কলেরার (জীবাণুর তো কোন প্রসঙ্গই ওঠেনা) পরিবহণ ঘটে। মিটিংয়ে ডঃ র্যাডক্লিফ তাঁর মন্তব্যে বলেন যে কানিংহামের ব্যবহৃত “contagioin” এবং “water theory” একেবারেই কানিংহামের নিজস্ব ও স্ব-উদ্ভাবিত। ল্যান্সেট-এর ধারণানুযায়ী, ভারত হচ্ছে কলেরার বাসভূমি। ফলে সেখানেই সবচেয়ে ভালোভাবে কলেরা রোগ ও রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু যেহেতু কানিংহাম এ কাজটি মনোযোগ দিয়ে করেন নি, এজন্য এরকম আজগুবি তত্ত্ব জন্ম নিচ্ছে। এবং এগুলোকে ভারতের “special characteristic of the disease in India” বলে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৮২-৪৮৩)
কানিংহামের এ প্রতিবেদনের পরে প্র্যাক্টিশনার পত্রিকায় একটি দীর্ঘ এবং তীক্ষ্ণ ও তিক্ত সমালোচনা প্রকাশিত হয় “Quixotic Etiology: Dr. Cuningham on Cholera in Northern India, 1872” শিরোনামে (The Practitioner: A Journal of Therapeutics and Public Health, Vol. XI, July to December, 1873, পৃঃ ৪৬৩-৪৭০)
পত্রিকাটিতে বলা হয়, ডঃ কানিংহাম যে মতামত দিয়েছেন সেগুলো “diverging widely from those commonly entertained in this country on the same subjects.” (পৃঃ ৪৬৩) তিনি এক ধরণের “worship of authority” করেছেন। এবং কানিংহামের নিজের ভাষ্যে এ সিদ্ধান্তগুলো “আমাদেরকে একশ বছর আগে আমরা যে অজ্ঞতার রাজ্যে বাস করতাম সেখানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৬৪) “কানিংহাম সঠিকভাবেই বলেছেন যে তিনি যে প্রধান জায়গাটিকে আক্রমণ করেছেন তা হল কলেরার contagiousness … treats it from the beginning to end as a question of personal contagion” – সরাসরি একজনের থেকে আরেকজনের সংক্রামিত হওয়া।” (পৃঃ ৪৬৫) “Quixotic-like, his whole argument as to the contagiousness of cholera is addressed to his own conceptions.” তিনি কলেরার “জলবাহিত চরিত্র”কে তিনি নিজে যা মনে করেছেন সেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। (পৃঃ ৪৬৬)
কানিংহামের অভিমত অনুযায়ী, কলেরার স্থানিক চরিত্রের (“localisation in particular quarters of a place, and even in particular buildings”) চেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। (পৃঃ ৪৬৮) ডঃ কানিংহাম অথরিটির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন এই কারণে তাঁরা স্যানিটারি বিষয়ে ব্যক্তির পর্যবেক্ষণকে প্রভাবিত করছেন। লেখাটির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত – “Dr. Cuningham’s report is simply Quixotic.” (পৃঃ ৪৭০)
এই ছিল “jewel in the Crown”-এর স্যানিটারি কমিশনারের কলেরা রিপোর্ট নিয়ে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের অভিমত। প্রবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এর মার্চ ২, ১৮৭৪, সংখ্যায় রিপোর্টটি একই শিরোনামে পুনর্মুদ্রিত হয়।
যে ডঃ কানিংহামকে নিয়ে এতক্ষণ কথা হল, তিনি ১৮৮৪ সালে লিখলেন Cholera: What can the State do to Prevent it? পুস্তক (কলকাতা থেকে প্রকাশিত)। তাঁর পুস্তকে প্রশ্ন করলেন – (১) যদি আধুনিক মতবাদ ঠিক হয় তাহলে যে সমস্ত জাহাজ কলকাতা থেকে যাত্রা করছে সেগুলো কি কলেরায় আক্রান্ত? (২) এরা কি ভারত থেকে কলেরা অন্য দেশে নিয়ে যায়? তিনি সুনির্দিষ্টভাবে উত্তর দিলেন “must be decidedly negative”। (পৃঃ ৩৯) অর্থাৎ, আধুনিক মতবাদ যাই বলুক এদুটোর কোনটাই ঘটেনা।
পরে কানিংহাম বললেন, বিজ্ঞানের নামে সমস্ত ধরণের স্বৈরশাসন (tyranny) এবং নিপীড়ন চলছে। এবং কোয়ারেন্টাইনের অশুভ দিক হচ্ছে – “loss of personal liberty, worry and annoyamce, social misery and and anxiety, with grievous injury to trade.” এজন্য International Sanitary Boards-এর কোন প্রয়োজনই নেই। প্রতিটি দেশের নিজের নিজের স্যানিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থাকবে। (পৃঃ ১৪৩) রবার্ট কখের কলেরার জীবাণুতত্ত্বকে নস্যাৎ করে অবলীলায় বলে দিলেন – “Dr. Koch has been entirely misinformed.” (পৃঃ ১২২)
নিজের অজান্তে কানিংহাম স্বীকার করে নিলেন, যেসব অভিযোগ জোর গলায় বলা হচ্ছে যে ভারতে মেডিক্যাল অফিসাররা ঘটনার সঠিক রিপোর্টিং করা থেকে, যেগুলো “favour the contagion theory of cholera” (এর মধ্যে স্বাধীন গবেষণার কথাও ধরে নিতে হবে), “discouraged and indeed prohibited” হচ্ছে এগুলো সবই ভিত্তিহীন। অর্থাৎ এ ঘটনাগুলো বাস্তবে ঘটেছে। তাঁর মতে অভিজ্ঞতা এবং “common-sense” বিজ্ঞানের পাথেয় এবং ভারত সকারের নীতি হিসেবে একেই গ্রহণ করা হয়েছে – “theortical principles have proved not only useless but positively mischievous.” (পৃঃ ১২৯)
এই যদি সরকার এবং সর্বোচ্চ স্যানিটারি কর্তার কথা হয়, তাহলে সেসময়ের ভারতে মৌলিক মেডিক্যাল গবেষণার রসদ আসবে কোথা থেকে? স্তব্ধ হল বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা অন্তত ৩০ বছরের জন্য।
কানিংহামের পুস্তকের ২ বছর পরে ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হল ভারতের প্রাক্তন সার্জেন-জেনারেল এবং Professor of Military and Clinical Medicine in the Army Medical School, Netley-র উইলিয়াম ক্যাম্পবেল ম্যাকলিনের পুস্তক Diseases of Tropical Climates, Lectures Delivered at the Army Medical School (London)। এ পুস্তকে তিনি জানালেন ভারতের কর্তাব্যক্তিরা বারংবার বলছেন যে “cholera is not carried by persons from one locality to another”। (পৃঃ ২৩০) এ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ক্ষেত্রে কোন সংশয় নেই যে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত “political considerations weighed with the able officer when he changed his opinions in this remarkable manner.” (পৃঃ ২৩১) অর্থাৎ রাজনৈতিক চাপে কলেরা সংক্রান্ত নীতির পরিবর্তন হয়েছে। এবং আমরা আগে ক্রমাগত দেখে আসছি যে এই চাপের কারণ সুয়েজ খাল দিয়ে কোয়ারেন্টাইন ছাড়া অবাধ বাণিজ্যের প্রবল তাগিদ।
ম্যাকলিনের পরবর্তী মন্তব্য – “আমি বরঞ্চ এই অপ্রীতিকর আলোচনা পরিহার করব, কিন্তু এটা ভারতে কলেরার ইতিহাসের একটি অংশ, এবং আমি নীরবে একে ছাড়পত্র দিতে পারিনা।” (পৃঃ ২৩১)
এই পুস্তকের শেষে “Farewell Address”-এ তিনি বললেন – “From that time to the present (১৮৬৮ সালের মধ্যভাগ থেকে ভারতে কলেরা সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনের সময় থেকে) no lectures delivered in the Army Medical School by any of the professors have been published, with the exception of merely formal addresses delivered at the opening of the sessions, and then only for private circulation … I cannot publish under a censorship however mild, judicious, or even generous.” (পৃঃ ৩৩৪-৩৩৫)
এরপরে আর নতুন করে কি বলার থাকতে পারে? যেখানে গবেষণাপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ থাকে এবং অধ্যাপকেরাও গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেন না সেখানে কিভাবে কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজে গবেষণা এগোবে? এ এক সোনার পাথরবাটির মতো অবস্থা।
মিশরকে জোর করে দখল করার পরে ল্যান্সেট-এ মিশর নিয়ে একটি রিপোর্ট বেরিয়েছিল “Egypt (From our correspondent)” শিরোনামে (ডিসেম্বর ৭, ১৮৯৫, পৃঃ ১৪৬৫-১৪৬৬)। সে রিপোর্টে কয়েকটি অনুচ্ছেদে সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয় – Cholera Nesws, Examination of Suspicious Cases, Vaccination Statistics, British Troops in Cairo, British Troops in Alexandria, Sanitary Officers এবং The Tourist Season। রিপোর্টে আক্ষেপ করে জানানো হয় যে জলকে পরিশুদ্ধ করার জন্য উন্নত ইউরোপীয় দেশে গৃহীত Pasteur-Chamberland filter কায়রোতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য ব্যবস্থা করা হয়নি। ল্যান্সেট-এ বলা হয় – “In this respect the army occupation is several years behind the German Hospital, the Egyptian Government Hospital, the schools, hotels, and other large buildings in Cairo.” (পৃঃ ১৪৬৬) সহজ কথা হল, জল পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা জার্মানদের থেকে, এমনকি মিশরের সাধারণ ব্যবস্থা থেকে কয়েক বছর পেছিয়ে রয়েছে। মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশরা দখল করার আগে মিশর ফরাসীদের উপনিবেশ ছিল। ফরাসীরাই জল পরিশোধনের কাজে Pasteur-Chamberland filter-এর ব্যবহার শুরু করে। এর থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অন্যায় হবেনা যে ভারতে পরিশ্রুত জল ব্যবহার করে কলেরাকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি।
ল্যান্সেট-এ এপিডেমিওলজিকাল সোসাইটির অধিবেশনে আলোচিত “Experineces of Cholera in India” শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল (Lancet, February 1, 1896, পৃঃ ২৯৬-২৯৭)। এই অধিবেশনে মেডিক্যাল কলেজের সার্জারিরর প্রাক্তন অধ্যাপক কেনেথ ম্যাকলিওড (যাঁর বিখ্যাত পুস্তক হল ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত Operative Surgery in the Calcutta Medical College Hospital: Statistics, Cases And Comments) তাঁর অভিমতে জানান যে ভারতে এপিডেমিওলজিকাল অনুসন্ধানের পদ্ধতি সম্পূর্ণত ব্যর্থ হয়েছে “to elucidate the causation and propagation of the disease, for which the pathological and bacteriological investigation of individual cases was necessary.” অর্থাৎ, আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত নতুন পথ ও পদ্ধতিতে কলেরার প্যাথলজিকাল এবং ব্যাকটেরিওলজিকাল অনুসন্ধানের যে প্রয়োজন ছিল তা ব্যর্থ হয়েছে, এবং অবহেলিত।
ভারতে মেডিসিনের এবং নতুন পথে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। এর ফল ভোগ করতে হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজকে। সমস্ত মেধা এবং উপাদান থাকা সত্বেও বিজ্ঞানের চর্চা অন্তত ৩০ বছর পেছিয়ে গেল সুয়েজ খাল দিয়ে অবাধ বাণিজ্য এবং মুনাফার জন্য কলেরার গবেষণা চেপে দেবার এবং গবেষকদের নিশ্চুপ করিয়ে দেবার জন্য।
Very informative.
Past is the present status, lack of courage to say what a physician has observed in clinical practice
অনেক সমৃদ্ধ হলাম জেনে 🙏
অসাধারন তথ্যপূর্ণ ও মনোজ্ঞ লেখা । পড়ে অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারলাম । লেখক কে ধন্যবাদ
Thanks Jayanta. I think this problem still exits in modern India – the way I see it from a distance.
অসাধারণ
Very informative Sir
অনবদ্য আলোচনা। সমস্যাটি অনুভব করেছিলেন তৎকালীন বিজ্ঞানমনস্ক চিকিৎসক যদুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
আর কলেরার চিকিৎসা বিধান তৈরী করা নিয়ে যে সমস্যা হয়েছিল বণিক সরকারের স্বার্থে, সে সমস্যা আজকের যুগেও আছে। ব্যবসায়িক স্বার্থ এখনও বিজ্ঞান চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করে অনুগত রাষ্ট্রযন্ত্রগুলির মাধ্যমে।
ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। আপনার তথ্যগুলি সদাই সমৃদ্ধ করে পাঠকদের।
ধন্যবাদ!