সামাজিক ন্যায়/সুরক্ষা প্রকল্পগুলি নিয়ে কিছু বামপন্থীদের বোঝাপড়ায় ঘাটতি আছে দেখে এই লেখাটা লেখার ইচ্ছে হল। প্রথম কথা এই ধরনের প্রকল্প হঠাৎ করে আকাশ থেকে আমাদের মাঝে নেমে আসে নি। সংগঠিত ভাবে এর আত্মপ্রকাশ শিল্পোন্নত দেশগুলিতে। টু বি প্রিসাইজ, বিসমার্কের জার্মানিতে। সময়টা বুঝতে হবে। সামন্তবাদকে বুর্জোয়া বিপ্লব গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, শিল্প স্থাপন হচ্ছে, প্রচুর কল কারখানা তৈরি হচ্ছে আর তাতে কাজ করতে দলে দলে নিজের পিতৃপুরুষের ভিটা মাটি ছেড়ে মানুষ চলে আসছে। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন শ্রেনীর, মজুরি শ্রমিক। তারা এসে শহরের বস্তিতে বাসা নিচ্ছে। পরিবার পরিজন, আত্নীয় স্বজন, পড়শী এককথায় এতো দিনের পরিচিত সমাজ ছেড়ে তার কাছে এ এক নতুন সমাজ। পুরোনো সমাজে সেই মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই গ্রামীণ সমাজই তার চিকিৎসার সেবা যত্নের ব্যবস্থা করে দিত, গতর দিয়ে, পয়সা দিয়ে (ধার অথবা চাঁদা তুলে)। মানুষটা মরে গেলে তারাই শেষ কৃত্যের ব্যবস্থা করতো। শহরের বস্তিতে সে সব কোথায়?
সামন্ততন্ত্রের শেষ দিকে ছোট ছোট কারিগরদের যে গিল্ডগুলো গড়ে উঠেছিল তারা অবশ্য কিছুটা চেষ্টা করেছিল সংগঠিত করার, যেমন তাদের একটা করে চাঁদার বাক্স থাকতো। সেই অর্থ ব্যয় হয় কোনো কারিগরের ওই ধরনের দুঃসময়ে। খনি মজুররাও তেমন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। এর পরেই রাষ্ট্রের উদ্যোগে আইন বানিয়ে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্গুরলি একের পর এক চালু হয়। রাষ্ট্র, বুর্জোয়া রাষ্ট্র ততদিনে সমাজের জায়গা অনেকটা নিয়ে ফেললেও ওই প্রকল্প গুলির নামের আগে সামাজিক শব্দটা লেগে থাকলো। একে একে পশ্চিমী দুনিয়ার সবকটি দেশেই নানাবিধ প্রকল্প চালু হয়, সিকনেস স্কিমের পাশাপাশি পেনসন স্কিম, প্রতিবন্ধীদের স্কিম, বেকারদের স্কিম ইত্যাদি ইত্যাদি। ইন ফ্যাক্ট বর্তমান জার্মানিতে এমন এক ডজন স্কিম চালু আছে।
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে বুর্জোয়া শ্রেণী হঠাৎ দয়ালু হয়ে এসব স্কিম চালু করে। তারা এইটা বুঝেছিল যে অবিরাম শোষণ বঞ্চনার প্রতিকার হিসেবে, সেফটি ভালভ হিসেবে এ ধরনের কিছু প্রকল্প চালু রাখা দরকার নইলে সামাজিক বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। তাই নিজেদের পরিচালিত রাষ্ট্রকে “জনকল্যাণ মূলক” রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার তাগিদেই শাসক শ্রেণীর এসব আয়োজন।
ত্বিতীয় কথা এই যে মার্কস এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক যখন আসরে নামে তখন তাঁরা যে গুণগত পরিবর্তন আবার চেষ্টা করেন এই সামাজিক প্রকল্পগুলিতে তার প্রধান হল রাইট বেসড এপ্রচ। প্রকল্পগুলি রাষ্ট্র তথা “মহানুভব” শাসক শ্রেণীর কোনো মহৎ চ্যারিটি নয়, দান খয়রাত নয়, এগুলি মেহনতি মানুষজনের অধিকার এইটা তাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে অর্থনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি মার্ক্স একজন বড় মাপের সমাজতত্ত্ববিদ ও ছিলেন। গ্রামীণ সভ্যতা ও সমাজ থেকে “বিযুক্ত”, “বিচ্ছিন্ন” মানুষের আর্তি তিনি সঠিক ভাবে চিহ্নিত করে গেছিলেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন তৈরি হল তখন কমরেড কলনতাই রাতের পর রাত জেগে সহকর্মীদের নিয়ে রচনা করে গেছেন নারী ও শিশুদের জন্য সব সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প যাদের ব্যাপ্তি ও গভীরতা কোনো বুর্জোয়া সমাজতত্ববিদের স্বপ্নেও ধরা পড়বে না।
দেখা গেছে যে নিয়োগ কর্তার ঘাড়ে আইন করে যতই দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করা হোক না কেন সেই আইন বলবৎ করা খুব কঠিন। আচ্ছা আচ্ছা নামকরা পুঁজিবাদী সংস্থা আইন টাইন ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত। এর সাথে যুক্ত করতে হবে অসংগঠিত শিল্পে কাজ করা শ্রমিক ও তার পরিবার এবং কৃষি শ্রমিক। কাজে কাজেই রাষ্ট্রের ওপরেই সিংহভাগ দায়িত্ত্ব এসে পরে ওই প্রকল্পগুলি চালিয়ে যাওয়ার।
তৃতীয় কথা এই যে ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠীর একটা সুবিধে হল তারা অন্যদের তুলনায় কিঞ্চিৎ নবীন বলে পশ্চিমা বুর্জোয়াজির ঠিক ভুল পদক্ষেপ থেকে অনেক কিছু শিখে নিতে পেরেছে। তাই দেশটার জন্ম কাল থেকেই এই ধরনের প্রকল্প কম বেশি চালু ছিল। কেন্দ্র এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন নানান রাজনৈতিক দল তাদের মতো করে এই ধরনের প্রকল্প বানিয়েছে, চালু করেছে, বন্ধ করেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে বিশেষ করে ইউ পি এ-এর আমল থেকে গুনগত একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে মূলত বামপন্থীদের চাপে। রাইট বেসড এপ্রচ্। ভিক্ষা নয়, সামাজিক সুরক্ষা পাওয়াটা দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বামপন্থীরা কিছুটা সফল, কিছুটা অসফল। আইন সভায় কাগুজে আইন বানালেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। শেষ মানুষটা অবধি সেই সুরক্ষা জালের ঘেরাটোপে যাতে আসতে পারে সেটা দেখতে হয়।
স্বাধীনতার পরে এত কাল অবধি বামপন্থীদের এমন কোনো ম্যানিফেস্টো দেখবেন না যাতে ওই সামাজিক সুরক্ষার দাবি দাওয়াগুলো নেই। এই সামাজিক সুরক্ষা স্কিমগুলিতে রাষ্ট্রের তহবিল থেকে অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে অর্থনীতিবিদদের নানান শিবির থেকে। ভর্তুকি ডোল এই সব বন্ধ করে দেয়ার দাবিও উঠেছে নানান দক্ষিণপন্থী শিবির থেকে।
চতুর্থ এবং শেষ কথা, আজকে এটা খুব পরিতাপের বিষয় যে বামপন্থীদের কেউ কেউ এই সব সামাজিক সুরক্ষা স্কিম চালানো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, ওই স্কিমের উপভোক্তা সহ নাগরিককে ভিখারী ইত্যাদি বলে অপমান করছেন। নিজেদের দীর্ঘদিনের দাবিকে নিজেরাই নস্যাৎ করার একমাত্র কারণ হল সাম্প্রতিক নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না পাওয়া জনিত হতাশা ও ক্রোধ। এই হতাশ ও ক্রুদ্ধদের কাছে করজোড়ে নিবেদন, হতাশা ঝেড়ে ফেলুন আর ক্রোধের অভিমুখ পাল্টান। যাঁরা অনুদান পেয়েছেন তাঁরা কেউ শ্রেণী হিসেবে আপনার শ্রেণী শত্রু নয়। শত্রু মিত্র চিনতে গিয়ে গুলিয়ে একাকার হলে বছরের পর বছর হতাশায় ভুগতে হবে।
অনুদানের রাজনীতির ছোট্ট ছোট্ট ন্যারেটিভগুলোকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাওয়াটাকে কোনো সামান্য ঘরের গৃহবধূ যদি নিজের ক্ষমতায়ন বলে চিহ্নিত করেন তাকে গালি দেওয়ার আগে আরেকবার ভাবুন। ওই ক্ষমতায়নের কৃতজ্ঞতাবোধ যদি ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হয়ে আপনার আশানুরূপ ফল থেকে আপনাকে বঞ্চিত করে থাকে তাহলেও বধূটিকে গালি দেওয়ার আগে আরেকবার ভাবুন। অনুদানের মেটা ন্যারেটিভের সূত্রপাত হয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিকের বামপন্থীদের হাত ধরে। আজকের বামপন্থীদের দায়িত্ব সেই মেটান্যারেটিভ নতুন করে রচনা করার, জনগণকে অপমান করা নয়। কমরেড কোলনতা-এর দোহাই।