দখিনা হাওয়া জবুথবু শীতের শরীরকে দেয় দোলা। শুকনো পাতা ঘূর্ণি বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যায়। দিন বাড়ে। বয়সও। ধরে রাখা যায় কি তাকে? যায় না। তবু স্মৃতি জাগে।
হলুদ হয়ে ঝরে পড়া বাঁশপাতা চার দশক আগেও সবুজ বনে হারিয়ে যেত। আজও যায়। শুধু চালসে হয়ে যাওয়া চোখ তাকে খুঁজে পায় না। তবে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে কখনো কখনো অতীতের ধূসর ছেঁড়া পাতা গুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পালপাকুড়িয়া। আলপথ। মাচাবাঁধা সব্জিক্ষেত। ভাঁট ফুলের গন্ধ মাখা বাতাস ডাক দেয় তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে যেতে। ফাল্গুনের উষ্ণ বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ মাখামাখি। আলপথের পাশে যত্নে বড় হয়ে ওঠা শশা, বেগুন, টম্যাটো। ভাগচাষী আকবর আলি বলে, ‘নেবে?’
লাজুক বালকের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে কোঁচড়ে তুলে দেয় সবুজ ফসল।
আলপথ ধরে দৌড়।
ওই যে সবুজ সাদা চেক-চেক লুঙ্গি হাঁটুর উপরে ভাঁজ করে পরা ছোটখাটো লোকটা- ওর নাম সামাদ। দু-হাতে দুটো প্যাঁক প্যাঁক করা সাদা-কালো ছোপছোপ পাতিহাঁস নিয়ে ছেড়ে দিল আমাদের বড় পুকুরে। কোঁচড় থেকে চারটে দেশী মুরগীর ডিম বের করে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে শান বাঁধানো লাল বারান্দার কোনায় বসল জুত করে। হাঁস আর ডিমের দাম নিয়ে টাকাটা লুঙ্গির খুঁটে বেঁধে নিল কষে। মুড়ির মোয়া দুটো মুখে ফেলে গেলাসের জলটা আলগোছে ঢেলে দিল গলায়। তারপর হাঁসের মতই ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল,’অ বৌদি, কচি দুটোরে নে যাই? আজ তো ন্যাড়াপোড়া!’
আমরা দুই কচি সামাদের পিছু পিছু চললাম আলপথে ধানকাটা মাঠ পেরিয়ে। রোদ জ্বলা ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝে ডালপালা মেলে একলা দাঁড়িয়ে থাকা ভুতুড়ে কুলগাছটা একটেরে চোখে তাকিয়ে দেখল আমাদের।
চষা জমির শেষে বাঁশবন। অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত বনপথ। শুকনো বাঁশপাতায় মড়মড় শব্দ। ক্ষুদ্র হৃদয়ে কম্পন তুলে কাছেই ডেকে উঠল ডাহুক পাখি। কাঠবেড়ালীর দৌড়। গাছের জালে জুলজুলে তাকিয়ে থাকা মাকড়সা। পাতা সরিয়ে সরিয়ে কয়েকটা কচি বাঁশের কোঁড় ভেঙে এনে দিল সামাদ। এপাশে-ওপাশে সড়সড় আওয়াজ। গিরগিটি। টি-টি-ই-ই-ই শব্দে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া পাখি। নালা পেরিয়ে আরো এগোতেই আবার আলোর রাজত্ব। আদ্যিকালের পিচরাস্তার বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া ইঁটের খোয়ার কঙ্কাল।
রাস্তায় উঠে কালভার্ট পেরোলাম আমরা। ততক্ষণে সঙ্গে জুটেছে আরো তিনজন। কালভার্টের নীচ দিয়ে তখনো বয়ে চলা নালা- সুঁটের খালের দিকে। সুঁটের খাল- সুবর্ণবতী। এককালে নদী ছিল। ঢেউয়ে ভাসা পালতোলা নৌকো। এখন মজা খাল। নিকাশির জল, ইঁটভাঁটা, কচুরিপানা। কালভার্ট পেরিয়ে ঘাসজমি। আবার বাদাড়। বাঁশঝাড়ের আড়ালে সামাদ-দের বাড়ি। মাটির দাওয়া। লোনা ধরা দেওয়াল। টালির চাল। মুড়ি-নারকোল, পেয়ারা। বাগান থেকে খুঁড়ে আনা মেটে আলু। হাঁসের ডিম, চাচী-র দেওয়া। কাঠ-কুটুলি, কঞ্চি-বাঁশপাতার বোঝা নিয়ে এবার ফিরে যাওয়া।
ফাল্গুনের ঝলমলে বিকেল। তেপান্তরের মাঠের পার ঘেঁষে সূর্য বসেছে পাটে। ছায়া লম্বা হয়। ফুটিফাটা মাটিতে কঞ্চি পুঁতে ন্যাড়াপোড়া। কাঠ, বাঁশ, বাঁশপাতা, খেজুরপাতা, শুকনো জঞ্জাল। আস্তে আস্তে লেলিহান আগুন। আগুনের গর্ভে আহুতি দেওয়া মেটে আলু, বেগুন, টম্যাটো, কাদা মাখানো ডিম, বাঁশের কোঁড়। সন্ধ্যায় নিভন্ত আগুন থেকে সেসব বের করে মাঠেই মহাভোজ। মুখে-হাতে কালি আর ছাই। আকাশে রুপোর থালার মত চতুর্দশীর চাঁদ। পিছনের বাঁশবনে শেয়ালের সমাবেত হুক্কাহুয়া। এবার বাড়ি ফেরার পালা। পরদিন দোল।
ফুলেল আবির। সেলফি। ফেসবুক। মোবাইল ফোন। চার দশক পার হয়ে মন আবার বর্তমানে।