★
বারাসত থেকে নিউটাউন ফিরছিলাম।
এখন গোটা চারেক রুটের বাস আসে, ওদিক থেকে এপাশে। সবচেয়ে খুশি হই সরকারি বাসটা মানে সি-এইট পেলে। সেই বাসের ভাড়া সব চেয়ে কম। চলেও তাড়াতাড়ি।
ভাড়ার প্রসঙ্গে বলি। আমি বাসেই যাতায়াত করি বলে এই ব্যাপারে আমার কিছু বলার হক আছে। আপনারা যারা বাসেটাসে চাপেন, সবাই জানেন ব্যাপারটা। আজকাল বেসরকারি কোনও বাসেই রেট-চার্ট বলে কোনও বস্তু নেই। সরকারি পরিবহন মন্ত্রী বলে যে লোকটা আছে, সে নাকি কয়েকমাস আগেই বলেছে, বাসভাড়া ঠিক করবে বাসের মালিক আর কন্ডাকটর। অবশ্যি সরকার বলে কিছু আছে কিনা সেটাও এক বড় জিজ্ঞাস্য। এই নির্ভীক ঘোষণার পর থেকে বাসের কন্ডাকটার আর ড্রাইভারেরা বস্তুত অকুতোভয় ইদানীং। কিন্তু যাতায়াত তো করতেই হয়।
যা বলছিলাম সি-এইট বাস পাওয়া আর ডিয়ার লটারির প্রাইজ পাওয়া প্রায় সমার্থক। কিন্তু কী করে যেন আজ পেয়ে গেলাম। চাঁপাডালি থেকে উঠলাম। অল্পবয়সী এক কন্ডাকটার। গেটের পরেই যে সিট সেটা নাকি তার সিট। সেখানে বসে আছে সে।
যাত্রীরা অনেকেই অল্প দূরত্বের। উঠছেন, নেমেও যাচ্ছেন। যাত্রীরা নামার সময়ে তার হাতে দশটাকার নোট(যেটি নাকি এখন বাসের নিম্নতম ভাড়া, বেসরকারি মতে) দিচ্ছেন, দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নেমে যাচ্ছেন। কন্ডাকটারের টাকা নেবার ব্যাপারে খুব আগ্রহ। এক স্কুলছাত্রের সামান্য মলিন নোট কিছুতেই নিল না। পালটে দিতে হল। টাকা নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার টিকিট কাটার ব্যাপারে বড়ই অনীহা।
আমার পাশে বসা ভদ্রলোককে নীচু গলায় বললাম, ‘দেখেছেন, কাউকেই যে টিকিট দিচ্ছে না, সেই ব্যাপারটা?’
ভদ্রলোক আগে খেয়াল করেননি। ব্যাপার দেখে খুব দুঃখ করে বললেন, ‘ঠিকই তো! বলুন তো এমনি করে চললে এই রুটের বাস আদৌ চালাবে সরকার? অথচ এই বাসের ভাড়া সবচেয়ে কম। আমি যেখানে নামব সেখানের ভাড়া প্রাইভেট বাসে নেয় বাইশ টাকা। এই বাসে মাত্র তেরো টাকা। এই টাকাটাও মেরে দিচ্ছে। কোনও মানে হয়?’
কথায় কথা গড়াল। আমি তো আবার অতি বিপ্লবী। কাজেই তালে তাল মিলিয়ে বললাম, ‘যা বলেছেন, মন্ত্রী থেকে ইয়ে অবধি সবাই চোর। রাজ্যে কেন্দ্রে সর্বত্র।’
ভদ্রলোক কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
‘আমরা সবাই, লক্ষ করেছেন কি মাত্র দুতিনটাকা বাঁচাবার জন্য নিজেদের বিক্রি করছি?’, আমি আবারও বললাম।
‘সেটাই কথা, আমাদের প্রত্যেকেরই বিক্রয়মূল্য রয়েছে। কেউ বিক্রি কোটিতে, কেউ লাখে। কেউ বা ওই দু তিন টাকাতেই।’
আমাদের কথাবার্তা মধ্যবিত্ত দার্শনিকতার দিকে গড়িয়ে গেল।
এর আগে ব্যারাকপুর থেকে বারাসত আসার সরকারি বাসে এক ছোকরা কন্ডাকটার আমাকে বলেছিল, ‘সবাইকে টিকিট দিলে চলবে কাকু? এই চাকরি পেতে সাড়ে তিনলাখ দিতে হয়েছে আমায়। সেটা তুলতে হবে না?’
সেই অভিজ্ঞতার কথা বললাম ভদ্রলোককে। এতে নিশ্চয়ই উনি বুঝতে পারলেন, আমি এই সব দুর্নীতির মধ্যেও মানবিক টাচ খুঁজি। আসলে আমি মানুষের কথা ভাবা এক বিপ্লবী।
যাই হোক, এই সমস্ত কথা বলতে বলতে এয়ারপোর্ট চলে এল। কন্ডাকটার গাত্রোত্থান করল। এতক্ষণ সে বাসে ওঠার গেটের লাগোয়া সিটে বসে ‘তোলা’ তুলছিল। এবার সে বিভিন্ন আসনের কাছে গিয়ে, ‘টিকিটটা কাটুন’ বলছিল। টিকিট দিচ্ছিলও। এই বাসে টিকিট ভেন্ডিং মেশিন থেকে টিকিট দেওয়া হয়। যা বুঝলাম, এয়ারপোর্ট এসে গেলেই এই বাসে সম্ভবত টিকিট কাটা শুরু হয়, টিকিট না দিয়ে টাকা নেওয়ার বদলে। সে কি কোনও ইন্সপেকশন জাতীয় বিপদের ভয়ে?
সহযাত্রীকে সন্দেহের কথাটা বলতে বললেন, ‘হবেও বা!’
আলাপ এগোল। রাজ্য থেকে বিশ্ব। রাজনীতি থেকে সুড়ঙ্গ কাণ্ড, মায় পরম-পিয়া অবধি আমার সঞ্চিত নীতিবান জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হল। সহযাত্রী তত কিছু বলছিলেন না। ‘হুঁ হাঁ’ করে যাচ্ছিলেন।
‘কোথায় নামবেন?’ জিজ্ঞাসা করতে বললেন নারকেলবাগানে নামবেন।
আমিও ওই একই স্টপে নামব।
জিজ্ঞেস করে জানলাম আমি যে ডিবি ব্লকে থাকি, উনিও সে দিকেই যাবেন। নিউটাউনের রাস্তা তেমন চেনেন না। আমিও ডিবি ব্লকে থাকি শুনে নিশ্চিন্ত হলেন।
কন্ডাকটার আমাদের সিটের কাছে এসেও টিকিট চাইল। ভদ্রলোক কোথায় উঠেছেন বলে তার কাছ থেকে নারকেলবাগানের নির্ধারিত ভাড়া তেরো টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নিলেন। আমি জানালার পাশে মানে ভেতরের দিকে বসেছি। কন্ডাকটরকে একটু বিব্রত মুখে বললাম, ‘প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো মুশকিল গো। একটু পরে নামবার সময় দিচ্ছি।’
ইকোপার্ক যাত্রাগাছি পেরিয়ে আমাদের গন্তব্য এসে গেল। কণ্ডাকটারের ঘোষণা শুনে পাশের ভদ্রলোক আমার আগেই উঠে গেটের দিকে এগোলেন। এখানে আরও প্রচুর লোকজন নামবে। সবাই লাইনে এগোচ্ছে। মাঝে তিনচারজন ঢুকে যাবার পরে আমিও উঠে নামবার লাইনে ঢুকলাম।
হুড়োহুড়ি করে নামছিল সবাই। ওই ভদ্রলোক এগিয়ে ছিলেন। কাজেই নেমে গেছেন আগেই। আমি নামবার সময় তেরোটাকার বদলে কন্ডাকটারের হাতে দশটাকার নোটটা দিয়ে, টিকিট না নিয়ে নেমে পড়লাম নির্দ্বিধায়।
আমার নিজেরই ভাষায় এইমাত্র নিজেকে মাত্র তিনটাকায় বিক্রি করল এক মহা নীতিবাগীশ বিপ্লবী!
নেমেই ব্যাগ থেকে ছাতা বার করে দ্রুত খুলে নিয়ে নিজেকে আড়াল করলাম।
কে জানে, বাস থেকে নেমে যদি সহযাত্রীটি খোঁজেন আমাকে!
★