আমাদের দেশের অত্যন্ত সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হলো কৃমি সংক্রমণ।
কৃমি একপ্রকার পরজীবী, যা আমাদের দেহে বাস করে শরীরের থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে এবং আমাদের শরীরের ক্ষতি সাধন করে।
যে কোনো বয়সের মানুষ কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে, তবে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়। সারা পৃথিবীতেই শিশুদের পেটে বিভিন্ন ধরনের কৃমির প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে শিশুদের বেশি হলেও একেবারে ছোট শিশু যেমন পাঁচ-ছয় মাস বয়স পর্যন্ত, যখন সে শুধু মায়ের বুকের দুধই পান করে, তখন সাধারণত কৃমি হয় না।
মানুষের শরীরে সংক্রমণকারী বিভিন্ন ধরনের কৃমির মধ্যে লম্বা কৃমি (এসকারিস লুম্ব্রিকয়েডস), বক্র কৃমি বা হুক ওয়ার্ম (Hookworm), সুতা কৃমি, ট্রাইচুরিস ট্রাইচুরা, স্ট্রংগাইলয়েড স্টারকোরালিস ও ফিতা কৃমি অন্যতম।
আজ এখানে বক্র কৃমি বা হুক ওয়ার্ম নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা তুলে ধরলাম।
HookWorm বা বক্রকৃমি
আমাদের দেশে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার মূল কারণ হচ্ছে হুক ওয়ার্ম সংক্রমণ।
এই পরজীবী গুলির বিজ্ঞানসম্মত নাম Ancylostoma duodenale বা Necator americanus। পূর্ণবয়স্ক একটি কৃমির দৈর্ঘ্য প্রায় ১ সেমি হয়। এগুলি মূলতঃ আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডিনামে এবং জেজুনামের উপরের অংশে থাকে। এরা ক্ষুদ্রান্ত্রে তার হুকের সাহায্যে রক্ত চোষে এবং রক্তের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে বেঁচে থাকে।
আমাদের শরীরে এই কৃমির প্রবেশ পদ্ধতি অন্যান্য সব কৃমির থেকে আলাদা । যখন কোন রোগী জলা জায়গায় এই কৃমির ডিমসহ মল ত্যাগ করে তখন সেই জায়গায় ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে কৃমির বাচ্চা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই জায়গা দিয়ে যখন কোন মানুষ খালি পায়ে হেঁটে চলে বা হাত দিয়ে নাড়া চাড়া করে তখন বাচ্চা গুলি শরীরের চামড়া ভেদ করে তার শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশ করার পর রক্তবাহী নালী (শিরা/উপশিরা) দিয়ে হৃদপিন্ডে পৌঁছায়। সেখান থেকে রক্তের সঙ্গে মিশে ফুসফুসে চলে যায়। ফুসফসের দেওয়াল ভেদ করে শ্বাসনালীর মধ্যে প্রবেশ করে। সেখান থেকে শ্বাসনালীর মধ্যে দিয়ে উপরে উঠে গলায় পৌঁছে খাদ্যনালী তে ঢুকে পড়ে। পাকস্থলী অতিক্রম করে ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডিনামে এবং জেজুনামের উপরের অংশে পৌঁছায় এবং পূর্ণতা লাভ করে। একবার সংক্রমণের পর পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে ৪-৭ সপ্তাহ সময় লাগে। সেখানে অন্ত্রের দেওয়াল থেকে হুকের মাধ্যমে রক্ত চোষে এবং ডিম পাড়ে।
রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্তের শরীরে কোন উপসর্গ বা লক্ষণ থাকে না।
হুক ওয়ার্ম পায়ের তলা দিয়ে শরীরে প্রবেশের সময়কালে পায়ের নীচে অ্যালার্জি জনিত ডার্মাটাইটিস (Ground itch) হতে পারে, ফলে সেখানে তীব্র চুলকানি সৃষ্টি হয়।
ফুসফুসে প্রবেশ করার সময়ে ফুসফুসে প্রদাহের দরুন কাশি এবং সঙ্গে রক্ত মিশ্রিত কফও হতে পারে।
ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশের পর বমি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে।
তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি তৈরি হয় তা হলো আয়রন বা লোহার ঘাটতি জনিত রক্তাল্পতা (Iron Deficiency Anaemia)। ফলে শরীরে দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
রোগনির্ণয়
রক্ত পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম এবং ইওসিনোফিল কোষের সংখ্যা বেশি (eosinophilia) পাওয়া যায়। এছাড়া মল পরীক্ষায় কৃমির ডিম পাওয়া যেতে পারে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য ট্যাবলেট অ্যালবেন্ডাজোল 400 mg সিঙ্গেল ডোজ দেওয়া হয়। আর ২ বছরের বেশি বয়সী শিশুদেরকে জলের সাথে ট্যাবলেট গুলে বা সিরাপ হিসাবে অ্যালবেন্ডাজোল 400 mg সিঙ্গেল ডোজ দেওয়া হয়। তবে ডাক্তার প্রয়োজন মতো এই ওষুধ পুনরায় দিতে পারেন। আর রক্তাল্পতার জন্য আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
প্রতিরোধের জন্য স্যানিটারি ল্যাট্রিন এর ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে এবং খাবার গ্রহণের আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে। মল ত্যাগের পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
চাষের জমিতে কাজ করার সময় পায়ে জুতো ব্যবহার করা উচিত।