(এই লেখায় মূল্যবান তথ্য ও মতামত দিয়ে সাহায্য করেছেন ডা চিন্ময় নাথের বন্ধু ও হাসপাতালের ডাক্তার Dr John N M Ruiz)
সবাই জানে এই মহামারীর শুরু হয়েছিল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। ভয়ঙ্কর সংক্রামক এই ভাইরাস তারপর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এই লেখা শুরু করা পর্যন্ত পৃথিবীর ১,৩২,৫৬২ জন মানুষ নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এর কালো ছায়া পড়েছে ১২৩ টি দেশে। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মৃত। বর্ডার বন্ধ, ভিসা বাতিল। একের পর এক উড়ান বাতিল। ইতালি, ইরান, স্পেন আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে।
চীনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি কয়েকটি ছোট দেশ কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রকোপকে আয়ত্বে রাখতে পেরেছে। এই দেশগুলো হল হংকং, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর। অসংখ্য চীনা নাগরিক আসা-যাওয়া করেন এই সব দেশে। এই দেশগুলো থেকে চীনের বড় ও মাঝারি শহরগুলোতে প্রচুর ফ্লাইট আছে প্রতিদিন। তবুও করোনা-র থাবায় এখনো পর্যন্ত বিশেষ রক্তাক্ত হয়নি এরা। এর কারণ কি?
বাকি দেশগুলোর কথা আমি জানি না। সিঙ্গাপুর সম্বন্ধে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা থাকায় ওদেশের সাফল্যের কারণগুলো বিশ্লেষণ করছি। যদিও এটা ঠিক যে ভারতের মত বড়, জনবহুল ও গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে সিঙ্গাপুরের মত দেশকে অনুসরণ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, চীনের বাইরে সিঙ্গাপুরেই আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী, ৫৮। আর আজ ১৩ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত ২০০। কোনো মৃত্যু ঘটেনি। ইরান, ইতালি, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে ব্যাপারটা সাফল্য বৈকি। কি করেছে ওরা? দেখা যাক-
১. সিঙ্গাপুর প্রথম মহামারী আক্রান্ত হয় ২০০২-০৩ সালে। সার্স হয়েছিল তখন গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে। তাতে ৩৩ জন মারা যায়। তারপর সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে বাস্তবায়িত হওয়া। ২০০৯ নাগাদ হয় সোয়াইন ফ্লু। তাতে সিঙ্গাপুর তার সার্স-লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে এবং অসফল হয়। কিন্তু দু দু-বার মহামারীর সাথে লড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার কিন্তু তারা বেশ সফল।
২. যেকোনো মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইটা একটা যুদ্ধ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, তথ্য, রাজনীতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিকাঠামো ভিত্তিক নানান যুদ্ধক্ষেত্রে এই লড়াই লড়তে হয়।
৩. সরকারের সাথে জনগনের সম্পর্ক। খুব গনতান্ত্রিক না হলেও জনসাধারণ সরকারের ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত মেনে চলে। ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক জনসাধারণ সরকারকে বিশ্বাস করে।
৪. সিঙ্গাপুরের সুবিধা হল তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুব উন্নত।
বিশেষতঃ জনস্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গবেষণায় ওই দেশের স্থান বিশ্বের প্রথম সারিতে।
৫. সেনাবাহিনীতে একটা কথা আছে, ‘তুমি শান্তির সময় মত বেশী ঘাম ঝরাবে, যুদ্ধের সময় মত কম রক্ত ঝরবে’। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর-র কাছে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে ওরা প্রতি বছর দু’বার করে বাধ্যতামূলক ভাবে মহামারী, জীবাণু যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মহড়া দেয়, অনেকটা সেনাবাহিনীর মত।
৬. স্বাস্থ্যবিভাগ,জনস্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, পর্যটন, বিদেশ, অর্থনীতি, শ্রম- সরকারের প্রত্যেকটা বিভাগকে একসাথে দ্রুত যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে কাজে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবারে।
৭. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দ্রুত করোনা ভাইরাস আক্রান্তকে সনাক্ত করা ও আলাদা করা। মৃদু সংক্রমণ হলে ঘরে বন্দী করে চিকিৎসা অথবা বেশী হলে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রাখা। শুধু তাই নয়, যারা এক-একজন রোগীর কোনরকম সংস্পর্শে এসেছে তাদের প্রত্যেককে সনাক্ত করে জাতীয় ডেটাবেসের আওতায় আনা হয়েছে।
৮. সংক্রমিত মানুষদের গ্রুপগুলো সনাক্ত করা হয়েছে এবং সংক্রমণের পথগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
৯ . সনাক্তকরণের জন্য ওরা নিজস্ব COVID-19 টেষ্ট সিস্টেম তৈরি করে পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘টেষ্ট-কিট’ দ্রুত হাসপাতালে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, বর্ডারে, বন্দরে, বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
১০. আগে থেকেই প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। Personal protective equipment অর্থ্যাৎ ভাইরাস রোধী পোষাক দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের মধ্যে সংক্রমন বন্ধ করতে তাদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবর্ত দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে কেউ একজন সংক্রমিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্ত পাওয়া যায়।
১১. জনগণের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করা হয়েছে। সমস্ত স্কুল, বার,রেস্তোরাঁ, সিনেমা, থিয়েটার, অনুষ্ঠান, বড় মিটিং,সন্মেলন, কম গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমন বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ কে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে।
১২. বারে বারে হাত ধোওয়া, পরিচ্ছন্নতা, হাঁচি কাশির সময় কনুইতে মুখ ঢাকা, জ্বর-সর্দি-কাশি হলে ঘরের বাইরে না বেরোনো, উপসর্গ বাড়লে টেলিফোনে স্বাস্থ্য বিভাগেকে জানাতে বলা হয়েছে।
১৩. প্রচুর সংখ্যক সার্জিক্যাল মাস্ক, এন-৯৫ মাস্ক, পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট, নেগেটিভ প্রেসার আইসোলেশন স্যুট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালের বেডের সংখ্যা, আই সি ইউ বেড ও আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরী করা বা বাড়ানো হয়েছে।
১৪. নাগরিকদের সরকারি ওয়েবসাইট, টিভি, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্বন্ধে বারংবার অবহিত করা হয়েছে।
১৫. জাতীয় সতর্কীকরণ (সবুজ- হলুদ- কমলা – লাল) ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশের জনগণকে COVID- 19 মহামারী সম্বন্ধে সতর্ক করা হয়েছে। এই মুহূর্তে সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হলুদ হয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে তা বাড়িয়ে কমলা করা হতে পারে।
১৬. প্রতিটা বড় বিল্ডিং,অফিস, শপিং মল, জিম ও পাবলিক প্লেসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরের তাপমাত্রা মাপার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী প্রত্যেককে ষ্টিকার দেওয়া হয়েছে, যাতে তাকে সহজেই সনাক্ত করা যায়।
১৭. ছোট্ট দেশ। সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং মানুষের করণীয় সম্পর্কে সর্বক্ষণ ঘোষণা করা হচ্ছে। যাতে মানুষ বিভ্রান্ত না হয় ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
১৮. অ্যাপ, ওয়েবসাইট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি ব্যবহার করে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে খুঁজে বার করে তাদেরকে আলাদা করে
পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
১৯. সমস্ত অর্থ, জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি একসাথে ব্যবহার না করে প্রয়োজনভিত্তিক ব্যবহার করা হয়েছে তাতে অপচয় কমানো যায়।
২০. যেসব মানুষ আর্থিক ভাবে দূর্বল, ঘববন্দী হয়ে থাকার কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২১. যারা কর্ততৃপক্ষের নির্দেশ মানছে না, তাদের কড়া শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নোভেল করোনা ভাইরাস অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সংক্রমিত হচ্ছে। এর কোনো প্রতিষেধক (vaccine) বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এর মারণক্ষমতা খুব বেশী না হলেও, আগুনের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ফলে এত দ্রুত ও এত বেশী মানুষ শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে যে, ভেন্টিলেটর ও আই সি ইউ বেডের যোগান দিতে না পেরে পৃথিবীর উন্নততম স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে। এই মহামারী থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় হল আগাম প্রস্তুতি, দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক। এব্যপারে আশা করি সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও আমাদের দিশা দেখাবে।
আমাদের কী হবে ?