যেহেতু এখন প্রশ্ন করার সময় নয় সেহেতু লেখাটা কিছু ছোট ছোট প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যাক। কাজের মাসি ছলছল চোখে এসে ডাক্তারবাবুকে জানাচ্ছে যে ওই ডাক্তারের বাড়িতে কাজ করে বলে তার অন্যবাড়ির কাজটা চলে গেছে। কি করবে সে এখন? এক ইন্টার্ন তার সিনিয়ারকে জানাচ্ছে যে যদিও সে গাইনি ওয়ার্ড এ কাজ করে তার ভয় করছে। সে কি পিপিই পেতে পারে? এক ডাক্তারের বাবা তার থেকে পাঁচশ কিমি দূরে থাকে। তার বিশেষ ব্লাড থিনার ওষুধ পাড়ার দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। কি ভাবে পাবে ? আরেক ডাক্তারের স্ত্রী যিনি স্বামীর কাছ থেকে দুশ কিমি দূরে থাকেন তিনি সাম্প্রতিক নিদান মেনে মাস্ক কিনতে চান। তিনি স্বামীকে অনুযোগ করছেন, আগে কেন বললে না, এখন মাস্ক পাই কোথায়? আরেক ডাক্তার করোনা ওয়ার্ড-এ ডিউটি করার “অপরাধে” তার হাউজিং সোসাইটি তার স্ত্রীকে গৃহহীন করেছে। তার জিজ্ঞাসা, কি অপরাধ করে ফেলেছি ?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরতো জানা। “সুস্থ থাকুন ঘরে থাকুন” এই স্লোগানে বিশ্বাসীদের কাছে এর কোনো উত্তর নেই তাই ঘরে থাকার উপদেশ সহ করোনা মোকাবিলায় নানান ডু এন্ড ডোন্ট যাঁরা তোতাপাখির মতো আউড়ে যাচ্ছেন তাঁরা বলবেন ফেলুদার কথা।
সেই সোনার কেল্লার ফেলুদা যিনি তাঁর মতো করে লালমোহন বাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে সমস্ত বুদ্ধি, মেধা আর মননশীলতার চর্চা করার একচেটিয়া অধিকার কেবল কিছু অনুমোদিত বুদ্ধিজীবীদের। এবং তাঁরা যাতে আম আদমির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে কোণঠাসা হয়ে না পরেন, সেজন্য লালমোহন বাবুর মতো আম আদমিরা প্রশ্ন করার আগে পারমিশন বা অনুমতি নেবেন, “উট সম্বন্ধে প্রশ্ন করা চলবে?”
বড় প্রশ্ন এই অনুমোদন দেবেন কে। চিরকাল এই বড় প্রশ্নটা যাঁরা তুলেছেন তাঁরা এই উত্তরই পেয়েছেন যে এই অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে কেবল মাত্র রাষ্ট্রের। কারণ রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বজ্ঞ, সর্ববর্তমান, সর্বকল্যাণমুখী। এটা স্বতঃসিদ্ধ।
এক টাকমাথা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা পেশাদার বিপ্লবী ১৯১৭ সালে সুইজারল্যান্ডে বসে লেখা একটা বইতে আমাদের মনে প্রথম এই স্বতঃসিদ্ধ সম্পর্কে খটকা ধরিয়ে দেন।। যেখানে রাষ্ট্র নামের বস্তুটার স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রয়াসে তিনি ঘোষণা করেন যে ওটা নাকি দুটো কিছুর বিরোধের অমীমাংসিত লড়াইয়ের ফসল। এটা পড়ে আমাদের কারুর কারুর মনে সংশয় জাগে তাহলে রাষ্ট্রকে যে আমরা চিরকাল একটা সর্বজ্ঞ, সর্ববর্তমান, সর্বকল্যাণমুখী একটা কিছু ভেবে এসেছি, রাষ্ট্র কি তাহলে তেমন কিছু নয়, অন্য কিছু ?
যাঁরা এটা জানলেন তাঁদের মনে একটা প্রবল অস্বস্তি তৈরি হয়। এতদিন যা জেনে এসেছি তাহলে সে সব ভুল বিলকুল বেবাক ? এই অস্বস্তিকর একটা মানসিক অবস্থা তৈরি হওয়া বা স্বস্তিকর, আরামপ্রদ একটা মানসিক অঞ্চলে বসবাস করার আরাম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলেই প্রথম যে প্রশ্নটা মনে জাগে তা’হল, রাষ্ট্রের স্বরূপ চিনতে এদ্দিন দেরি হল কেন ?
দেরিটা এই কারণেই হল যে এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া ইস্তক, মনে রাখতে হবে যে এক সময়ে বিশ্বে রাষ্ট্র ফ্যাস্ট্র বলে কিচ্ছু ছিল না কো, রাষ্ট্র বরাবর তার জন্ম ও টিঁকে থাকার জাস্টিফিকেশন বা ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গেছে। এই চেষ্টায় প্রচুরবার ধ্যারানোর পরে সে কিছু ফুলপ্রুফ মেথড বা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে।
চাবুক পেটা বা গুলি করার চেয়ে যে পদ্ধতি খুব কাজে দেয় তার একটা হ’ল কনসেনসাস বা সহমত নির্মাণ। ওই নির্মাণের কাজে তার মস্ত সহায় হ’ল বিক্রয়যোগ্য গণমাধ্যম। ওটা যে নিরপেক্ষ নয়, চাঁদির জুতোর বাড়ি মেরে তাকে বশে আনা যায় এ নিয়ে অবিশ্বাসী শিশসুলভ সারল্যে ভরপুর সুধী পাঠক কয়েক বছর আগের সেই স্মরণীয় ফতোয়ার কথা ভাবুন যেখানে রাষ্ট্রের অন্যতম একটা যন্ত্র “সরকার”-এর গুণগান না গাইলে আরেকটা যন্ত্র “সংবাদপত্র”-তে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধের হুমকি মারা সার্কুলার বা নির্দেশনা ছেপে বেরিয়েছিল।
রাষ্ট্রের এই নির্লজ্জ বেপরোয়া পদক্ষেপের উদ্দেশ্য একটাই ছিল, বিরোধিতায় কন্ঠস্বরকে দাবিয়ে দাও, দাবিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের গুণগানে ভরপুর একদল স্তাবকের জন্ম দাও যারা সোচ্চারে ও নিরুচ্চারে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমর্থনে জনমত গঠন করবে আর বিরোধিতার প্রতিটি কন্ঠস্বরকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেবে, কোনো সমালোচনা করা যাবে না, এমনকি সেটা গঠনমূলক হলেও না। কিং ক্যান ডু নো রং এই মন্ত্রে সমবেত হতে হবে আপামর জন সাধারণকে। মোটকথা ওই মিডিয়া বা সংবাদপত্রকে একপিস কেনা যন্ত্রে পরিণত করো। এই কেনা যন্ত্রই ঠিক করবে কে সঠিক বুদ্ধিজীবী। এদের সাহায্য নিয়েই তো রাষ্ট্রের সর্বজ্ঞ রূপ আর ভাবমূর্তি নির্মাণের কাজ চলবে। এঁরা দুটি কাজ করবেন, প্রথমটি হল যে সব প্ৰশ্ন রাষ্ট্রের পক্ষে অস্বস্তিকর বা বিপদজনক তাকে “বোকাবোকা” বলে দাগিয়ে দেওয়া।
উটের প্রধান খাদ্য কাঁটাঝোপ এটা জানার পরেও লালমোহন বাবুর মুখে চিত্রনাট্য রচয়িতা সেই সংলাপ বসান, উট কি কাঁটা বেছে খায়। এই সংলাপ রচনা করার পেছনে কেবল হলভর্তি দর্শকের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তোলাই লক্ষ নয়, লালমোহনবাবুকে একটি গামবাট প্রমাণ করতে না পারলে ফেলু মিত্তিরের বুদ্ধির ঝলকটা ফুটে উঠবে কি করে।
লালমোহনবাবুর মতো কেউ যদি বোকাবোকা প্রশ্ন করে ফেলে যে করোনা রোগের মোকাবিলায় তৈরি হওয়া বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কেবলই ডাক্তার কেন, প্যানডেমিক বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মেনে তাতে আইনজ্ঞ, সমাজবিদ্যা বিশারদ বা মনস্তত্ববিদরা নেই কেন। কেন স্বাস্থ্যবিভাগের প্রধান চিকিৎসকের বদলে একজন আমলা সাংবাদিক সম্মেলনে চিকিৎসার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করার দুঃসাহস দেখবেন, বা একজন রাষ্ট্রপ্রধান কোনো এক দৈব ওষুধ আবিষ্কারের কাহিনী শোনাবেন এবং তার পরে সেটা তাঁর দেশে যথেষ্ট নেই বলে অন্য একটি সার্বভৌম দেশের ভান্ডার খালি করার জন্য হুমকি দেবেন?
লালমোহনবাবুকে রাষ্ট্রের করুণায় বাঁচতে হবে প্রতিটি মুহুর্ত। রাষ্ট্রের তৈরি প্রতিটি ভাষ্যকে, প্ৰতিটি তথ্যকে ভরসা করে চলতে হয় তাঁকে। রাষ্ট্র যদি বলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোনো কাজে দেয় না, সেটাই মেনে নিতে হয়, যদি বলে ওটা কাজের ওষুধ, ওটা খেলে বাঁচা যায় অমনি সেটা মেনে নিয়ে ছুটবেন পাড়ার ওষুধের দোকানদারকে তেল দিতে যদি পাওয়া যায় দু পিস সেই বিশল্যকরণী। যদি রাষ্ট্র বলে দেশে ওর ভান্ডার যথেষ্ট নয় বলে খুল্লমখুল্লা বিক্রি, রফতানি নিষিদ্ধ সেই তথ্য অম্লান বদনে মেনে নেবেন, আবার যদি বলে এতো আছে যে বিদেশে রপ্তানি করেও আমার আপনার জন্য যথেষ্ট আছে তাহলে সেটাই মেনে নেবেন কারন রাষ্ট্রের চেয়ে সর্বজ্ঞ আর কেউ হতে পারে না। ঠিক ফেলুদার মতো।
এসব প্রশ্নগুলোকে বোকাবোকা বলে চিহ্নিত করার কারণ একটাই। কারণ লালমোহনবাবু অজান্তে একটি মারাত্মক কাজ করে ফেলেছেন, রাষ্ট্রের কালেকটিভ উইজডমকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, সে যে সর্বজ্ঞ, সর্ববিদ্য বিশারদ নয় এমন একটা সংশয় তৈরি করার চেষ্টা করছেন। হাততালি দিলে বা কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে করোনা ভাইরাস মরে যায় কিনা বা মোমবাতি জ্বালালে কার্বনমনোঅক্সাইড-এ করোনার বংশ ধ্বংস হয় কিনা হয় এর বিপক্ষে কথা বলার অবকাশই দেবে না রাষ্ট্র। জনহিতকর এসব কাজের বিপক্ষে বলা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহী বলে লালমোহনবাবুকে দাগিয়ে দেওয়া হবে।
লালমোহনবাবু বোকার হদ্দ, কিস্যু জানেন না এটা প্রমাণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে খুব জরুরি নইলে তার নেওয়া প্রতিটা পদক্ষেপ যে কতটা সুচিন্তিত ও বুদ্ধিদীপ্ত এটা প্রমাণ হবে কি করে। লকডাউনের ফলে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের ফুসফুস বেয়ে করোনা রোগ ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা যে লকডাউনের প্রবক্তাদের মাথায় আসেনি এটা ফেলুদা সাজা রাষ্ট্র কোনোদিন স্বীকার করবে না। বদলে সেই পরিযায়ীদের ঘরে ফেরার আগে তাদের গায়ে শুদ্ধ গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র করে নেওয়ার ভঙ্গিতে ওদের গায়ে জীবাণুনাশক স্প্রে করে দিলেই ল্যাটা চুকে গেল। নির্বোধ রাষ্ট্রের এই অবোধ রাজভৃত্যদের যদি জিজ্ঞেস করেন যে এর ফলে ফুসফুসে জমে থাকা করোনা জীবাণু মরলো কিনা লালমোহনবাবু রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা পাবেন।
রায়বাড়ির পৌত্র জানতেন যে দু”পয়সা সমেত সুনাম কামিয়ে নিতে গেলে ফেলুদাকে কেবলমাত্র বুদ্ধিমান বানালে চলবে না, তাকে হিরো বানাতে গেলে ভিলেন লাগবে একজন। তাই বাঙালির রেনেসাঁর শেষ যুগপুরুষ হিসেবে তাঁর দায়িত্ত্ব কর্তব্য ভুলে হিপনটিজম জাতিস্বরবাদ এসব ছদ্মবিজ্ঞানকে অনায়াসে বিজ্ঞানের মোড়কে বিক্রি করতে তাঁর দ্বিধাবোধ হল’না আর একই পথের পথিক ভবানন্দকে ভিলেন আর প্যারাসাইকোলজিস্ট হাজরাকে সাধু বানিয়ে দিলেন। রাষ্ট্র শুধু জ্ঞানী নয়, সে বিজ্ঞানীও বটে।
তাই করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য তগলিব জমায়েতকে দায়ী করে, তাদের সুপার স্প্রেডার তকমা দিয়ে ভিলেন বানানোর কাজটা বেশ বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই করতে পারে রাষ্ট্র। নইলে সে নিজে হিরো হবে কি করে।
রাষ্ট্রকে কেবল ফেলুদা সাজলেই হয় না তাকে আরো অনেক কিছুই সাজতে হয়। তাকে দুষ্টের দমন করতে হয়, শিষ্টের পালন করতে হয়। লি ফক-এর কথা অনুযায়ী এমনটাই প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ। অরণ্যদেবের আধুনিক সংস্করণরা লক ডাউন ভেঙে রাস্তায় বেরোলে তাকে ডান্ডাপেটা করে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের জানার ফুরসৎ নেই কে কেন রাস্তায় বেড়িয়েছেন। “চা খাবো না আমরা বা খাবো না চা” অথবা ষাট পেরোনো স্ত্রীর প্রেসারের ওষুধ কিনবো না, – কোনো পাল্টা প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। খুলিগুহা থেকে বৃদ্ধ মজ কেবল মাথা নেড়ে বলবে কাজটা ঠিক করেন নি, প্রেসারের অসুখে মরে গেলে ক্ষতি নেই, করোনাতে না মরলেই হ’ল। এমনটা হলে চিরকালই মানে এই বেতালের বাবা, তারা বাবা, তার বাবার বাবা লাথি ঘুষির ওষুধ প্রয়োগ করে এসেছে। কারণ বেতাল হল জনকল্যাণকামিতার প্রতিমূর্তি।
এর পরে জনগণকে তৈরি থাকতে হবে সর্বদা মুখে মাস্ক পরে থাকার জন্য। দেখেন নি, বেতাল সব সময়ে মুখোশ পরে থাকে। যদি লালমোহনবাবু প্ৰশ্ন তোলেন যে রাষ্ট্রের দেওয়া মুখোশ পড়ার এই উপদেশ মাথা পেতে নিলাম, কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব কি কেবল উপদেশ বিতরণেই শেষ হয়ে যায়, ওই মুখোশ সব নাগরিককে বিনামূল্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করার কোনো দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের নেই, তাহলে প্রস্তুত থাকুন চোয়ালে করোটি আঁকা আংটির ছাপ নিতে।
সাধারণ মানুষের কথা ছেড়েই দিন। লালমোহনবাবু দেখেন নি পিপিই-এর অপ্রতুলতা নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জব্দ করতে এক অরণ্যদেব কেমন সুন্দর ভাবে এসমা জারি করে দিয়েছেন তাঁর রাজ্যে ?
রাষ্ট্রকে কেবল ফেলুদা বা অরণ্যদেব হলেই চলে না, তাকে আরো কতকিছু হতে হয়। এই যেমন ধরুন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের আলাদিন। সেই আলাদিন তার ময়দানব সুলভ শক্তি নিয়ে মিলিটারিকে দিয়ে নিমেষের মধ্যে তৈরি করে ফেলতে পারে শত শত কোয়ারেন্টাইন সেন্টার, কিনে ফেলতে পারে হাজার হাজার ভেন্টিলেটর। লালমোহনবাবু ভুলেও প্রশ্ন করতে যাবেন না যে এদ্দিন কোথায় ছিলেন বাবা ময়দানব, কেন এই মরণকালে হরির নাম। আগে তো কেবল পাইলটের হেলমেট মাথায় ককপিটে বসে ছবি তুলে আর পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েই বেশ দিন কাটছিলো। অস্ত্র ভান্ডারে ক’পিস নিউক মিসাইল জমা আছে সেই হিসেবের আত্মপ্রসাদে ডগমগ হয়ে পিপিই সুট, মাস্ক স্যানিটাইজার-এর ভান্ডারের হিসেব কেউ নিল না। রাষ্ট্র সর্বজ্ঞ নয়, রাষ্ট্র ভুল করে, ভুল জায়গায় তার অর্থ খরচ করে রাষ্ট্র গুলিয়ে ফেলে তার প্রায়রিটি – এসব বলা মানেই রাজনীতি করা। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর কেন হয় না এসব প্ৰশ্ন তুললেই আলাদিন-কাম-বেতাল-কাম ফেলুদা বুঝিয়ে দেবে যে লালমোহনবাবু উটের পাকস্থলীর মতো সব গুলিয়ে ফেলেছেন।
ফেলুদা, অরণ্যদেব আর আলাদিনের মিশেলে তৈরি এই রাষ্ট্ৰের সেই সহমত নির্মাণের খেলাটা তখনই সফল সম্পূর্ণ হয় যখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে সপ্তাহের বাজার তার সেই প্রিয় সবুজ রঙের গাড়ি বোঝাই করে এনে লালমোহনবাবু ফ্রিজে ঢোকাতে ঢোকাতে অস্ফুটে বা সোচ্চারে বলে ওঠেন যে লকডাউন পিরিয়ড আরো বাড়ালেই ভালো। দারুণ দারুণ কাজ করছেন রাষ্ট্র।
ডাকাবুকো ডানপিটে হরিপদবাবু, ফেলুদা-জটায়ুর বহু এডভেঞ্চার এর সাক্ষী ড্রাইভার হরিপদ, মালিকের গাড়ি গ্যারেজ করে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পরে তার ছোট্ট টিভিতে দেখতে পান বহু বহু দূরে বন্ধ চা-বাগানের ত্রাণ নেয়ার লাইনে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সকে গুলি মেরে কাছা কাছি ঘেঁষাঘেঁষি লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ ভাবছে রাষ্ট্রের কি অপার করুণা। ওয়ার্ক ফ্রম হোম বলে ল্যাপটপের পর্দায় হুমড়ি খেয়ে পরা লালমোহনবাবু “করোনার কড়াকড়ি” নামের এবারের শারদীয় উপন্যাস টাইপ করতে করতে ভেবে আকুল হয়ে যান যে একজন টোটোচালকের কাছে ঘরে বসে খাওয়ার মত কত টাকা জমা আছে, কতদিন সে দাঁতে দাঁত চিপে দেশের ও দশের স্বার্থে এই লকডাউনের উপদেশ মেনে চলবে অক্ষরে অক্ষরে।
সুপারহিরো হওয়ার সুবাদে অরণ্যদেব, ফেলুদা বা আলাদিনদের খাওয়া-পরার টাকা জোগাড় করা নিয়ে চিন্তায় ভুগতে হয় নি, চিন্তায় ভুগতে হয়নি কিসে আগে মারা যাবো, করোনা না না-খেতে পেয়ে। সব সময় স্ক্রাব সুট, মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ আর গলায় মাস্কটা আলতো করে ঝুলিয়ে যে হার্ট সার্জেন সংবাদ মাধ্যমকে বাইট দেন, তিনিও জানেন কিন্তু বলতে দ্বিধাবোধ করেন যে “ইনেট ইমিউনিটি” বলে একটা বিষয় আছে যেটা যেকোনো জীবাণু ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের “ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স” আর সুষম খাদ্য না পেলে সেটা ভেঙে পরতে বাধ্য।
উটের খাদ্য কি এই প্রশ্নের উত্তর ফেলুদার জানা ছিল, “প্রধানত কাঁটা ঝোপ”। অসীম সাহসী প্রদোষ মিত্রও একথা সাহস করে বলতে পারেন নি যে মানুষের প্রধান খাদ্যও ওই কাঁটা ঝোপ। যে রাষ্ট্র অনায়াসে নির্বিকার মুখে লকডাউন ঘোষণা করে, লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করে, সেই রাষ্ট্র কেন দায়িত্ব নেবে না তার সব নাগরিকদের দু’বেলা সুষম খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার, কেন লকডাউনের সমর্থক প্রতিটি মানুষ ওষুধ সহ অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র পাবে না নিশ্চিন্তে, এই প্রশ্ন তুললেই রাজনীতি করার অভিযোগ শুনতে হবে। করুণা তোমার কোন পথ বেয়ে আসবে হে মহান রাষ্ট্র? প্রতিটা লালমোহন তো তোমার সব উপদেশ মান্য করে চলার চেষ্টা করছে করোনা মহামারী প্রতিরোধের জন্য। তোমার কি মন নাই ?
সেই দাড়িওয়ালা ফ্রেঞ্চকাট বিপ্লবীর কাছেই ফেরা যাক। তিনি দেখিয়েছিলেন যে যতদিন ওই বিরোধের, শ্রেণী বিরোধের মীমাংসা হচ্ছে না, ততদিন রাষ্ট্র থাকবে, থাকবে তার মতো করেই। ওই বিরোধের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে হবে, ওর মৃত্যু ঘটাতে হবে নইলে পরিত্রাণ নেই। সে কাজ একদিনে হবে না। লাগাতার, ধারাবাহিক ভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে, অপেক্ষায় থাকতে হবে। সেই মৃতুদিনটার জন্য লালমোহনবাবুরা অপেক্ষায় থাকব হাতে প্রদীপ নিয়ে নতুন দীপাবলির উৎসব পালনের জন্য।
“কাঁটা কি ওরা (উট) বেছে খায়?” লালমোহন বাবুর এই নিরীহ প্রশ্নতে ফেলুদা বোল্ড আউট হয়ে গেছিলেন। এতটাই বোকাবোকা ছিল ওই প্রশ্ন। চালাক সাজা রাষ্ট্রকে বোল্ড আউট করতে মাঝে মধ্যে কিছু বোকা বোকা প্ৰশ্ন করতে হয়। প্রশ্ন করে যেতে হয়।
অসামান্য একটি লেখা, সমুদ্র! এ সময়ের মধ্যে পড়া অন্যতম সেরা লেখা। সাহস করে সহজভাবে রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র, আভ্যন্তরীণ বিরোধ, শাসন এবং নিপীড়নকে কিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবহার করতে হয় – সবকিছুই এসেছে। এসেছে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন। আহা!
কাকতালীয়ভাবে আমিও ভিন্ন প্রেক্ষিতে এ অনুষঙ্গে লেখার দিকে এগোচ্ছি।
আরেকবার ভালোবাসা!
Jayanta Bhattacharya
৭.০৪.২০২০-র গণশক্তিতে প্রকাশিত আমার এই উত্তর সম্পাদকীয় নিশ্চয়ই পড়েছ। না পড়া থাকলে লিংক দিলাম।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3452420768117899&id=100000500294216
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
Thank you ever so for you article post.
Hi there, after reading this amazing paragraph i am as well delighted to share my knowledge here with friends.
Very good article! We are linking to this particularly great content on our site. Keep up the great writing.