এখন পৃথিবীর নানা দেশের নানা রকম খবরাখবর আমরা প্রতিনিয়ত পাই। তাঁদের নানা রকম আচার আচরণ খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে শিক্ষা সংস্কৃতি চিকিৎসা বিজ্ঞান ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ক চিন্তা ভাবনাকে আমরা আস্তে আস্তে করে নিজেদের করে নিয়েছি, নিতে পেরেছি।
কিন্তু একমাত্র দেশ বোধহয় চীন, যার থেকে অল্প কিছু সুস্বাদু ডিশের রেসিপি ছাড়া আর কিছুই নিতে পারিনি! ইদানীং কিছু মেডিকেল গ্রাজুয়েট।
আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ইত্যাদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ব্যাপার, সস্তা বা দামীর ব্যাপার, তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কোন কিছুকে নিজেদের করে নেওয়াকে এক করে দেখবো না।
(এক সময় নাকি বলা হতো- হিন্দি চিনি ভাই ভাই! কি জানি কেন! তারপরও নাকি কেউ কেউ বলতো – চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান! জানি না কেন! আমার এসব বিষয়ে ইন্টারেস্ট নেই।)
মোদ্দাকথা হলো, উদার অর্থনীতির যুগে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশই ক্রমশঃ সবদিক দিয়ে বারোভাতারী হয়ে উঠতে পারলেও, তেরো নম্বর ভাতার হিসেবে সোজাসুজি চীনের জায়গা হচ্ছে না!! ঘুরপথে হচ্ছে কিন্তু।
আবারো বলছি, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমরা তো চীনের সামগ্রী ছাড়া চলতেই পারি না, কিন্তু সেই বিষয়ে আমার মতামত দেব না। খারাপ অর্থে নয়, চীনের বহু জিনিসকেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ এখনো হজম করতে পারে না। চীনও জানে।হয়তো বহু দেশই সেটা পারে না। কারণ, সিম্পলি বদহজম হয়!
সেই জিনিসের মধ্যে একটা হলো- চাইনিজ ট্রাডিশনাল মেডিসিন।
আরো স্পেসিফিক করে যেটা বলবো এই পর্বে সেটা হলো – অধুনা প্রায় ইতিহাস হয়ে যাওয়া সেইসব চাইনিজ ট্রাডিশনাল মেডিসিন, যেগুলো তৈরি হতো মানুষের বর্জ্য পদার্থ থেকে! (আমার জানা মতে- এখন ও এগুলোর বেশ কয়েকটির ব্যবহার চলছে। যদিও চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ঠিক কতটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পায়, সেটা বলা কঠিন!)
দাঁড়ান দাঁড়ান, এখুনি বমি করে ফেলবেন না। আস্তে আস্তে পড়তে থাকুন …. বাকিটা …হে হে হে
বিজ্ঞানের বিবর্তন বলতে এলাম যেহেতু, একটু চৈনিক সভ্যতার তথা Traditional Chinese Medicine সংক্ষেপে TCM এর অতীত খুলে দেখি। যদ্দুর মনে হয়, এই যুগে এসে TCM তার ধ্বজভঙ্গ অবস্থায়ও ঝোপেঝাড়ে বসে ঠিক … চেষ্টা করে যাচ্ছে!
আমাদের দেশেও অনেকেই সেম কাজ করে কিন্তু!
কারা?
আছে আছে।পৃথিবীর বহুদেশেই অমন ট্রাডিশন চলতে থাকে! তবে কি জানেন, প্রায় ২২০০ বছর হয়ে গেল! ক্রমশঃ খারাপ হওয়া অবস্থা থেকে ফিনিক্স পাখির মতো হঠাৎ করে উঠে আসা আর হলো না TCM-এর! কার কতটা দৌড়, সেটা বিজ্ঞান ফিতে ধরে মেপে নিয়েছে!
ভাবুন, খ্রীষ্টপূর্ব ১৬৮ সালে Wushier bingfang নামক চীনের একটি প্রাচীন মেডিকেল টেক্সট বলছে – তখন ঔষধের উপাদান হিসেবে মানুষের নখ, চুল এবং মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রেসক্রাইব করার কথা!! রোখকে …. আভি তক্ শুরু নেহি হুয়া!
একটি বইয়ের নাম Bencao Gangmu বা Compendium of meteria medica. না এটি হোমিওপ্যাথির মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য নয়। একে চৈনিক আয়ুর্বেদ বলা যায়। লেখক- Li Shizhen. বেশিদিন নয়, চারশো বছরের একটু বেশি সময় ধরে এটি চীনের ট্রাডিশনাল মেডিসিনের স্ট্যান্ডার্ড গাইডলাইন বই!! সেখানে মানুষকে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ এবং ফোর্থ ক্যাটেগরির প্রাণী বলা হয়েছে। আর মোটামুটি পঁয়ত্রিশ রকমের ওষুধের বর্ণনা দেয়া আছে- যেগুলো তৈরি করা হতো মানুষের বর্জ্য পদার্থ থেকে!!
যাঁরা খুব আগ্রহী তাঁদের জন্য মহৌষধির উপকরণের লিস্টি দিলুম, পড়ে নিন। চুল, চুলের খুসকি, কানের খৈল, নখ, দাঁত, সদ্যোজাতের মল বা meconium, বড়দের মল, মূত্র, মূত্র ত্যাগ করার জায়গায় জমা সেডিমেন্ট (সুলভ শৌচালয়ে গেলেই দেখা যায়!), কিডনির পাথর, পিত্তথলির পাথর, মানুষের বুকের দুধ (এটা কিন্তু এমনিতেই সদ্যোজাতের জন্য সবচেয়ে দামী ঔষধি!), হাড়, রক্ত, লালা, বীর্য, রজঃস্রাবের রক্ত, চোখের জল, ঘাম (এটা কিন্তু আমাদের দেশেও একজন ব্যবহার করেন গ্ল্যামারাস থাকার জন্য!!), মাথার খুলি, গর্ভের ফুল, গর্ভফুলের নাড়ি, মাংস, পুং জননাঙ্গ এবং আরো অনেক কিছুর সঙ্গে মমিও!!
দাঁড়াও পাঠকবর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল …
মহামান্য Li Shizhen আরো দুটি ঘাপলা মারার জায়গা রেখে গেছেন! এবং সেটা শুধুমাত্র অনুগামী ডাক্তারদের জন্য!
হ্যাঁ, Bencao Gangmu র লাস্ট চ্যাপ্টারে ছত্রিশ নম্বর আর সাঁইত্রিশ নম্বরে!
Human beings from different locations – মানে জ্যোতিষসেদ্ধ করে পাওয়া, ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু ভেদে আলাদা মানুষের থেকে পাওয়া বর্জ্য পদার্থ!!
আর শেষটি? এতে কি মহাজ্ঞান আছে?
Human beings in extraordinary condition and of odd forms!!
বুঝলেন না?? এর মধ্যে থাকবে কসমোলজি, ইনফার্টিলিটি, গর্ভাবস্থা, উভলিঙ্গ, মেটামরফোসিস, বিবর্তন এবং দৈত্য! অতএব, বোঝাই যাচ্ছে- ডাক্তারের নামে এক একজন সর্বরোগ বিশেষজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান জ্যোতিষী তান্ত্রিক আচার্য তৈরির চেষ্টায় কোন খামতি রাখেননি মহামান্য Li Shizhen! অসামান্য গাইডলাইন!!
কি, কিছু মিল টিল পাচ্ছেন নাকি কারো সঙ্গে??
********
এবার আরেকটু বিশদে যাবো দু’একটি মহৌষধির।
ধরুন বাল! আরে মশাই, ধরবেন না। হিন্দিতে বলেছি। বাংলায় যাকে চুল বলা হয়, (গল্পের সেই দুষ্টু ছেলেটির মতো চুলের স্থানভেদে আলাদা নাম আমি ব্যবহার করবো না), অথচ দেখুন সেটি নিয়ে লি মহাশয় কি চুলোচুলিই না করেছেন! ওনার মতে –
চুল চার প্রকার। মাথা থেকে কাটা, চিরুনীতে আটকানো, দাড়ি এবং অন্তর্বাসে ঢাকা পিউবিক হেয়ার!!
আরো পড়বেন? লি মহাশয় আকুপাংচার নামক পদ্ধতিতে চিকিৎসার জন্য টানাটানি করতে বাল মানে চুলকে কত নাম দিয়েছেন দেখুন –
মাথার চুল- ফা
জুলফির চুল- বিন
ভুরুর চুল- মিই
গোঁফের চুল- জি
ছাগলদাড়ির মতো দাড়ি- শু
গালের দাড়ি- রান!!
**********
রেনজিং জিঙ্গিয়ে ইং মিংমেন জিং কি কিয়াংগং …হুঁ হুঁ … চাইনিজ শিখতে হয় না হলে জানবো কি করে? উপরের শব্দগুলোর অর্থ জানেন কেউ??
প্রথম দুটোর অর্থ পুরুষ ও নারীর সিমেন!! ইং মানে রক্ত, মিংমেন নামে জীবনের দরজা সম্ভবতঃ যৌনাঙ্গের ছিদ্র বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, জিং মানে ভাইটাল এসেন্স, কি/qi মানে ভাইটাল এনার্জি (Re-qi বললে সালমান খানের রিভাইটাল হয়ে যেত!)!!
লি বলেছেন- একজন ষোল বছরের ছেলের দেড় লিটার অব্দি বীর্য থাকে যা রক্ত থেকেই তৈরি হয়, এবং পুরোটা সংরক্ষণ করলে সেটা সেং বা পাঁচ লিটার মতো হয়!!
এবার বলবেন এইরকম গল্প দিয়ে কি করবেন? বলছি বলছি! আপনিও লাফিয়ে উঠতে পারেন!!
তৎকালীন কিছু বিজ্ঞ অ্যালকেমিস্ট, নিজেদের যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য, নিজের পরিচারিকাদের ওষুধ বানানোর নাম করে বোকা বানিয়ে তাদের সঙ্গে যৌনমিলন করতো!! তারপর, ভাইটাল এনার্জিতে পরিপূর্ণ সেই পরিচারিকার যৌনরস তাঁরা পান করতেন!
আরো আছে! নিজের বীর্য অথবা বীর্যের সঙ্গে পরিচারিকার রজঃস্রাবের রক্ত মিশিয়ে কিয়াংগং নাম পানীয় বানিয়ে পান করতেন!! এবং ফলাফল? অবিশ্বাস্য! জাপানি তেল কোন কাজে লাগে মশাই? এই মহামূল্যবান পানীয় পুরুষের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অব্যর্থ ওষুধ!!
শরৎকালের বরফ
**************
আহা রে … কি ভালো জিনিস! খাবেন নাকি কিউশি কিউবিং??ওহ্ দাঁড়ান, কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট আছে। আগে বর্ণনা দিই।
ধরুন, একটি সুলভ শৌচাগার আছে। আপনি গিয়ে আপনার মূত্র বিসর্জন করে এলেন! আরো হাজার হাজার মানুষ করে গেলেন সেম কাজ! এবার শৌচাগারকে ক’দিন পরিষ্কার না করে রেখে দেয়া হলে, সেখানে জমবে ইউরিনের সেডিমেন্ট। সাদা সাদা।
না, আমার মনে কাঁদা নেই কিন্তু! এবার সেই সাদা সাদা শরৎকালীন বরফ ? মানে কিউশি থেকে তৈরি হবে কিউবিং!
কিভাবে? Bencao Gangmu তে বলা আছে – dilution, precipitation, filtration, evaporation, calcination এবং sublimation.
কোথাও মিল পাচ্ছেন কিছুর সঙ্গে?? এই পদ্ধতি কিন্তু একদমই হোমিওপ্যাথির মতো নয়! এটা চাইলেই ট্রাই করতে পারেন এবং আপনি হয়ে যেতে পারেন এ যুগের Li Shizhen!!
Aphrodisiac মানে যৌনশক্তিবর্ধক ক্যাপসুল কিনে ফতুর হয়ে গেলেন?? চৈনিক বিশ্বাস বলছে – ইউরিনে থাকে স্টেরয়েড, সেটাই আসবে কিউবিং এ, যেটা ছোট্ট কিউবিকলে আপনার পৌরুষকে করে তুলবে আসারাম বাপু, রাম রহিম বা স্বামীজীদের সমকক্ষ!!
থ্যান্কুউ বলতে ভুলবেন না যেন!
*********
গর্ভফুলের সদ্বব্যবহার
Placenta বা অমরা বলে যেটিকে আমরা জানি, সেই মহামূল্যবান সম্পদকে চাইনিজরা প্রথমে মাটির নিচে পুঁতে রাখতো সাত আট বছর! সেটি থেকে বেরোতো স্বচ্ছ তরল।
তারপর সেটিকে কিছু গাছ গাছড়ার সঙ্গে মিশিয়ে আবার মাটির নিচে পুঁতে রাখা হতো তিন থেকে পাঁচ বছর!তা রপর সেটি যে পুরানো মদের মতোই অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠতো, চিকিৎসায় মহৌষধি হিসেবে ব্যবহার হতো- সেটা বলাই বাহুল্য!
অবশ্য এই একই কাজ placentophagy নামে অন্যান্য দেশেও চলেছে বহুকাল!!
*********
আয় ভুত তোকে খাই
মহাশয় লি বিশ্বাস করতেন আমাদের মতোই। কিরকম? আমরা হলাম হুন পো! (পো মানে পোলা নয়!) হুন মানে আত্মা মৃত্যুর পর যে খাঁচা ছেড়ে উড়াল দেয়, আর পো মানে মৃতদেহ!!
এবার কোন অল্পবয়সী, যে আত্মহত্যা করেছে, তার পো-কে মাটি চাপা দিলে সেখান থেকে পাওয়া যাবে রেনপো! মানে পো-এর ভূত রেনপো! বলা যায় – চুপচাপ পঁদে ছাপের মতোই পো-এর ভূত রেনপো!! এবার সেই কয়লার মতো রেনপো থাকবে কবরের মাটিতে! সেটিই হলো মহৌষধি রেনপো! জলে মিশিয়ে খেলেই হার্টের দপদপানি বন্ধ, হালকা ঘুম পাবে, ম্যানিয়া ডিপ্রেশন হাওয়া হয়ে যাবে, আত্মার শান্তি হবে!!
দাঁড়ান মশাই, শিলাজিৎ বলে একখান চিজ কিন্তু আমাগো আয়ুর্বেদে ও আছে!! হিমালয়ের গুহায় বা পাথরের মধ্যে পশুদের জমা মূত্র অথবা বিটুমেন নামের পদার্থ থেকে শিলাজিৎ আমাদের পূজনীয় পূর্বপুরুষরাও কিন্তু বানিয়েছেন!
***********
অল্প একটু বলি। মগজে যেহেতু wisdom থাকে, তাই মাথার হাড়কে খাওয়া হতো ওষুধ হিসেবেই! কিসের জন্য জানেন?
অমরত্ব লাভের জন্য!!
*********
হোলি স্যাক্রিফাইস এবং মধুর দেহ
একটি বিখ্যাত বই Chuogeng Lu, লেখক Tao Jiucheng।কি বলা আছে সেখানে ?
সত্তর বা আশি বছর বয়স হয়ে গেলে কিছু মানুষকে খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিয়ে মরতে দেওয়া হতো। শুধু মাত্র মধু খাওয়ানো হতো! ভাবুন, ওই অবস্থায় লোকটির মল মূত্র সব মধু পূর্ণ হয়ে যেত!
লোকটি মরতো! লোকটিকে সযত্নে পাথরের কফিনে ঢুকিয়ে মাটির নিচে রাখা হতো- একশো বছর!!! তারপর সেই মধু দ্বারা সংরক্ষিত মৃতদেহ পাথরের মতোই হয়ে যেত! সেই মধু দেহের সামান্য অংশ ও খেলে হাড় ভাঙা থেকে শুরু করে গাড় ভাঙা দ্বারভাঙা সব কিছুর নিরাময় হতো!!
এখনো পাওয়া যেতেই পারে বার্মা বা চীন বা তাইওয়ানে!!
টেরাডিশন বলে কথা! কি বলেন মশাই? স্যাক্রিফাইস করবেন না?? পিলিজ!
বাকি বিবরণ দিতে গেলে বাংলা ৯ হয়ে যাবার চান্স আছে।অতবড় জ্ঞানী হবো না। আপনাদের ও অত দামী দামী ওষুধ সাপ্লাই দেব না। আপাতত আমাদের দেশীয় মল মূত্রাদির টেরাডিশন ফলো করুন।
ছবি:
প্রথমটি: ফুটিয়ে দেয়া থুরি আকুপাংচার এর ম্যাপ
দ্বিতীয়: ফিকাল ম্যাটেরিয়াল মানে বাংলায় পায়খানা
তৃতীয়: বিক্রির জন্য হলদেটে গর্ভফুল এর প্যাকেট